এই প্রবন্ধের শিরোনাম 'মুক্তচিন্তার সীমা-পরিসীমা', যাহা একটি প্রহেলিকা বলিয়া প্রতীয়মান হইতে পারে। প্রথমেই পরিস্কার হওয়া দরকার যে চকখড়ি দিয়া মুক্তচিন্তার চৌহদ্দি নির্ধারণ করিয়া দেওয়া আদপেই এই রচনার উদ্দেশ্য নহে। বিংশ শতাব্দীতেই মানবসভ্যতা এমন এক স্তরে উপনীত হইয়াছে যখন আর মুক্তচিন্তার প্রয়োজন সম্ব্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ অবশিষ্ট নাই। তবে ব্যক্তিমানুষ এবং সমাজের কল্যাণ সম্পর্কে মুক্তচিন্তকের পক্ষে যে সচেতনতা আবশ্যক, তাহার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করিবার একটি প্রচেষ্টা এই প্রবন্ধে রহিয়াছে।

১৭০০ শতাব্দীর পূর্বে মুক্তচিন্তার প্রশ্ন মানুষকে বিচলিত করে নাই। তবে চিরকালই মানুষ কখনও শাসক কখনও ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হইয়া উঠিয়াছে। আমরা সক্রেটিসের বিষপানের কথা জানি। ইসলামের চার ইমামের প্রথম ইমাম আবু হানিফার জীবননাশের জন্য তৎকালীন খলিফার আদেশে তাহাকে বিষপান করিতে বাধ্য করা হইয়াছিল। বিবেকী মানবসত্তা মুক্তচিন্তার অন্যতম শর্ত। মানুষের কল্যাণ ও অকল্যাণ সম্পর্কে মুক্তচিন্তকের স্পষ্ট ধারণা থাকিতে হইবে এবং অকল্যাণ পরিহার করিতে হইবে।

মানুষ তাহার বিশ্বাসকে ধনভান্ডারের ন্যায় সুরক্ষিত রাখিতে চাহে। যুগে যুগে নতুন ধর্ম প্রচারকালে মানুষ বংশপরম্পরাক্রমে প্রাপ্ত ধর্মকে আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকিবার চেষ্টা করিয়াছে। এই চাহিদা একখানা মানবিক চাহিদা, ইহাকে অস্বীকার করিবার সুযোগ নাই। ইতিহাসের পাতায় যে সকল ধর্মীয় সংগ্রামের স্বাক্ষর রহিয়াছে সেইগুলি প্রধানত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও নেতৃত্বের বিরুদ্ধে।

মুক্তচিন্তার অন্তরায়সমূহের মধ্যে ধর্মীয় বিশ্বাস প্রধান। অন্য অন্তরায়গুলি হইল- ঐতিহ্যের প্রতি আনুগত্য, নেতৃত্বের দাসত্ব এবং আপ্ত আদর্শের প্রভাব। তবে জঁ জাক রুশোকে বিস্মৃত হইলে চলিবে না। মসিউ রুশো বাতলাইয়া ছিলেন, ব্যক্তিকে জাতীয় স্বার্থের কাছে স্বীয় চিন্তা, বিচার-বুদ্ধি ও বিষয়-বাসনা বিসর্জন দিতে হইবে। কোনো মতবাদ জাতীয় মন্ত্রে পরিণত হইলে তাহাও মুক্তচিন্তার অন্তরায় হইয়া দাঁড়ায়।

ধর্ম লইয়া অনতিক্রম্য সমস্যা এই যে ধর্মের সংস্কার চলে না। ধর্মের সংস্কার করা হইলে নতুন ধর্মের উদ্ভব ঘটে। কেবল কালক্রমে ধর্মে নতুন যোগ-বিয়োগ ঘটিলে তাহার সংস্কার সম্ভব এই অর্থে যে, উক্ত রূপ সংস্কারের মাধ্যমে ধর্মকে মূলরূপে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। ধর্মে যুক্তি, প্রমাণ ও বৈজ্ঞানিকতা থাকিতে পারে কিন্তু ধর্ম মূলত বিশ্বাসের বিষয়। মুক্তচিন্তা আর ধর্মের এই মৌলিক ফারাকটি হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিলে অনেক অবাঞ্ছিত বিতর্ক ও সংঘর্ষ এড়াইয়া যাওয়া সম্ভব।

২.
বিংশ শতাব্দীতে 'প্রগতিশীলতা' মানুষ ও সমাজের একটি আদর্শিক বৈশিষ্ট্য হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করিয়াছে। অন্যদিকে 'মুক্তচিন্তা' প্রগতিশীলতার লক্ষণ বলিয়া পরিগণিত হইতেছে। জাতীয়তাবাদী ফরাসিরা যুক্তিকে 'শয়তানের হাতিয়ার' আখ্যা দিয়া সুখ লাভ করিয়াছিল। অন্যদিকে মুক্তচিন্তার প্রথম কথা হইল মানুষের বিশ্বাস যুক্তির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হইবে; কোনো ধর্ম, ঐতিহ্য অথবা কোনোরূপ আপ্ত আদর্শ মানুষের বিশ্বাসের ভিত্তি হইবে না। এই সংজ্ঞার্থ সারবান হইলেও মুক্তচিন্তা কার্যত সমস্যামুক্ত নহে। কারণ মুক্তচিন্তাও কার্যত একশ্রেণির বিশ্বাস, যেমন ধর্ম একগুচ্ছ বিশ্বাসের আঁকড়।

দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল সাহেব মুক্তচিন্তার মূল্যমান লইয়া সম্যক চিন্তিত ছিলেন। এই প্রসঙ্গে তাঁহার বক্তব্য স্মরণ করা যাইতে পারে। তিনি মুক্তচিন্তার বিনিময়ে ধর্মকে বিসর্জন দিতে বলেন নাই। তাঁহার মতে, একজন মানুষের বিশ্বাস দিয়া মুক্তচিন্তকের পরিচয় নিশ্চিত করা যায় না, বরং তিনি সেই সব বিশ্বাসকে কীভাবে ধারণ ও লালন করেন তাহাই দেখিবার বিষয়। যেই ব্যক্তি ভাবেন জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার চিন্তা ও বিশ্বাসকে ধারণ ও লালন না-করিলে তাঁহাকে অসন্তুষ্ট করা হইবে, সেই ব্যক্তিকে মুক্তচিন্তক বলা যাইতে পারে না। অন্যদিকে তিনি যদি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার চিন্তাভাবনাকে বিশ্নেষণ করিয়া যুক্তি ও প্রমাণের ভিত্তিতে সারবত্তা নিরূপণ করেন, তবে যে সিদ্ধান্তেই তিনি উপনীত হউন না কেন, তাঁহাকে মুক্তচিন্তক বলা যাইতে পারে।

নানা কিছু মানুষের চিন্তা পদ্ধতিকে আবিষ্ট করিয়া রাখে। কোনো একটি হইতে মুক্ত হইলেই ওই ব্যক্তিকে মুক্তচিন্তার অধিকারী বলা যাইতে পারে। বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে, মুক্তচিন্তককে দুইটা জিনিস হইতে মুক্ত থাকিতে হইবে : এক. ঐতিহ্যের প্রভাব এবং দুই. স্বীয় আকাঙ্ক্ষার প্রতি আনুগত্য। কোনো মানুষই এইসব হইতে সম্পূর্ণ মুক্ত নহে। এইসব নিগড় হইতে একজন মানুষ কতখানি মুক্ত, তাহাই বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত।

যে সকল বিষয় মুক্তচিন্তাকে সমস্যাক্রান্ত করিয়া ফেলে তাহার মধ্যে রহিয়াছে মানবকল্যাণসম্পৃক্ত ভাবনার অনুপস্থিতি, পরমত-অসহিষ্ণুতা, একদেশদর্শিতা ইত্যাদি। এই বিষয়ে একজন মুক্তচিন্তক সচেতন না থাকিলে সমাজের কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণ সাধিত হইতে পারে।

৩.
চিন্তকের কর্মপ্রণালি একজন বিজ্ঞানীর কর্মপ্রণালি হইতে ভিন্ন কিছু নহে। বস্তুত, চিন্তা সকলের কাজও নহে। অন্যদিকে চিন্তা করিবার প্রতিভা থাকাই যথেষ্ট নহে, মুক্তচিন্তা সাহসেরও বিষয়। এই সাহস বা নির্ভীকতার অবর্তমানে চিন্তার মুক্তি ঘটিবে না।
যে কোনো বিষয়ে প্রচলিত বয়ান বা ন্যারেটিভকে প্রশ্ন করা মুক্তচিন্তার অন্যতম লক্ষণ।

এই প্রসঙ্গে আমরা ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনাবসানের ঘটনা বিবেচনা করিতে পারি। সচরাচর ইহাকে 'ভারত বিভাগ' বলিয়া উল্লেখ করা হইয়া থাকে। জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ইতিহাসের সাক্ষ্যপ্রমাণ বিবেচনায় লইয়া প্রশ্ন তুলিলেন, যে ভারত কখনই একীভূত ছিল না, তাহাকে কী করিয়া বিভক্ত করা যাইতে পারে? লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসে অধ্যাপক হ্যারল্ড লাস্কির তত্ত্বাবধানে পিএইচডি গবেষণাকালে তিনি পর্যবেক্ষণ করিলেন যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে হিন্দু ধর্ম সংস্কারের আন্দোলন ক্রমশ হিন্দুত্ববাদের পুনর্জাগরণের সংগ্রামে পর্যবসিত হইয়াছিল। কংগ্রেসের কার্যকলাপের বিবর্তন বিশ্নেষণ করিয়া তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইলেন যে, কংগ্রেস শেষাবধি একটি হিন্দুরাষ্ট্রের জন্যই কসরৎ করিয়াছিল, যাহার ফলে পাকিস্তান ও ইন্ডিয়া দুইটি রাষ্ট্রের উদ্ভব হইয়াছিল- প্রচলিত বয়ানের বিপরীতে এইরূপ সাংঘর্ষিক একটি বয়ান উপস্থাপন করিতে কেবল যুক্তি-প্রমাণ যথেষ্ট নহে, ইহার জন্য অসীম সাহসের প্রয়োজন হয়। তাহার সদ্য প্রকাশিত পিএইচডি অভিসন্দর্ভের খসড়া পাঠ করিয়া দেখা যাইতেছে, অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের এই সাহস যথেষ্টই ছিল।

মুক্তচিন্তা প্রকাশে নির্ভীকতা একটি অন্যতম শর্ত। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম বাঙ্গালী মনীষী শিবনারায়ণ রায় এই শর্ত পূরণ করিতেন। ২০২১ সালে মৃত্যুর পূর্ববর্তী দুই যুগে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সাধারণ্যে দেবতুল্য মর্যাদায় আসীন হইয়াছিলেন। তাহার বিরুদ্ধবাদী বলিতে কাহারও অস্তিত্ব দেখা যায় নাই। তাহার সমালোচনা করিবেন বাংলাদেশে এইরূপ নির্ভীক কাহাকেও দেখা যায় নাই। অন্যদিকে শিবনারায়ণ রায়ের কাছে মনে হইয়াছে আনিসুজ্জামান দর্জির মাপে জীবন নির্দিষ্ট করিয়া লইয়াছিলেন। তিনি অকপটে লিখিয়াছেন, তাহার লেখকচরিত্র যতটা হিসাবি এবং আপসপন্থী ততটা জেদি বা নির্ভীক নহে।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের আত্মজীবনী 'কাল নিরবধি' পাঠ করিয়া শিবনারায়ণ রায়ের কাছে অবারিত হইয়াছে যে তাহার চারিত্র্য বৈশিষ্ট্য হইল হিসেবিপনার আধিক্য, ঝুঁকি এড়াইয়া চলিবার সিদ্ধান্ত, প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষণা লাভের আগ্রহ এবং অপ্রিয় প্রসঙ্গ চাপিয়া যাওয়ার নিশ্চিত প্রবণতা। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের এই সকল চরিত্রবৈশিষ্ট্য শিবনারায়ণ বাবু ছাড়া আর কারও চোখে দৃশ্যমান হয় নাই, তাহা কে বিশ্বাস করিবে? দুঃখের মধ্যে কেবল তাহার পক্ষেই উচ্চারণ করা সম্ভব হইল যে, মুক্তচিন্তার অক্ষমতা 'কাল নিরবধি' গ্রন্থটিকে মননদীপ্ত প্রাণাবেগ হইতে বঞ্চিত করিয়াছে :না তিনি কালের মৌলিক প্রশ্নসমূহ উত্থাপন করিয়াছেন, না তিনি সেই সব প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করিয়াছেন।

৩.
বস্তুত, সমকালে মানুষের মধ্যে দুইটি নতুন প্রবণতার প্রাদুর্ভাব হইয়াছে :প্রথমত কোনো কোনো চিন্তাশীল মানুষ তাহার ভিন্নমত অন্যের উপর চাপাইয়া দিতে ব্রতী হইয়াছেন। দ্বিতীয়ত, অনেক মুক্তচিন্তক তাহার আদর্শের বিপরীত ধ্যান-ধারণাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করিতেছেন এবং বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করিতেছেন। মন্তব্য ক্রমে আক্রমণাত্মক হইয়া উঠিতেছে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় মুক্তচিন্তার উদ্দেশ্য এই রূপ গোঁড়ামিতে আচ্ছন্ন ছিল না।

মুক্তচিন্তা ও ধর্ম প্রসঙ্গে শিবনারায়ণ রায়ের অবস্থান প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, আমি ঘোষিতভাবেই নাস্তিক ও নিরীশ্বরবাদী। আমার দৃঢ় ধারণা, ধার্মিক গোঁড়ামি হইতে মানুষ মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তাহার বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ দুই-ই অন্ধকার। এই কারণে তিনি জিজ্ঞাসা, স্বাধীনতা এবং অস্মিতার বিকাশকে স্বীয় জীবনে পূর্বিতা দিয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেন, আমার জীবন দর্শন এবং আল মাহমুদের ধর্মীয় প্রত্যয়ের মধ্যে সেতু রচনা করা অসম্ভব। - স্পষ্টত কবি আল মাহমুদের ধর্মের প্রতি আনুগত্য শিবনারায়ণ রায়কে পীড়া দিয়াছে কিন্তু তিনি কখনও আল মাহমুদের কবিতা হইতে মুখ ফিরাইয়া লন নাই। প্রগতিশীলরা প্রায়শ যে ধরনের গোঁড়ামির সংকটে ভোগেন, শিবনারায়ণ রায়কে সেই গোঁড়ামি আচ্ছন্ন করতে পারে নাই।

শিবনারায়ণ রায় তাহার 'জিজ্ঞাসা' পত্রিকায় বাংলাদেশের কবি আল মাহমুদের একগুচ্ছ কবিতা প্রকাশ করেন। এতে মনঃক্ষুণ্ণ হইয়া অনেক বাংলাদেশী পাঠক চিঠি লিখিয়া জানান যে, আল মাহমুদ বর্তমানে ইসলাম-প্রচারক হইয়া উঠিয়াছেন, তিনি সরকারের সমর্থক ও প্রগতিবিরোধী, সেই কারণে তাহার প্রতি শিবনারায়ণ রায়ের মতো র‌্যাডিক্যাল মানবতন্ত্রীর অনুরাগ অযৌক্তিক ও অসংগত।

প্রত্যুত্তরে শিবনারায়ণ রায় 'জিজ্ঞাসা' পত্রিকায় কবি আল মাহমুদের আরেকগুচ্ছ কবিতা প্রকাশ করেন এবং সম্পাদকীয় বক্তব্যে এমতরূপ অভিমত ব্যক্ত করেন যে, কবির ব্যক্তিগত বিশ্বাসের অংশভাক্‌/////// অথবা তাহার বিবিধ ক্রিয়াকলাপের সমর্থক না হইয়াও তাহার কবিতা উপভোগ করা সম্ভব। অনুভবের সত্যতা, কল্পনার মৌলিকতা, শব্দ ব্যবহারে দক্ষতা, উপমা ও ব্যঞ্জিত বাকপ্রতিমার/////// উদ্ভাবনা শক্তি যাঁহার কবিতায় প্রত্যক্ষ, তাহার বিশ্বাস ও ব্যবহার যাহাই হউক না কেন তাহার কবিতায় সাড়া দেওয়া কাব্যানুরাগীর পক্ষে স্বাভাবিক।

অপ্রিয় হইলেও সত্য যে, মুক্তচিন্তার অনেক মানুষ তাহার চিন্তাচেতনাকে অন্যের ওপর চাপাইয়া দিতে চেষ্টা করেন। ইহা nosey preference
ব্যতিরেকে আর কিছু নহে। ১৯৬৮ সালে অধ্যাপক অমর্ত্য সেন তাহার 'দি ইম্পসিবিলিটি অব প্যারেশিয়ান লিবের‌্যাল' শীর্ষক প্রবন্ধে গাণিতিক প্রমাণ দ্বারা দেখাইয়াছেন, মানুষের nosey preference সমাজের সার্বিক কল্যাণের বিপরীতে ক্রিয়া করিতে পারে। উদারনৈতিক সমাজে সকলের মতামত ধারণের স্থান থাকিবে বটে, কিন্তু একের উপর অন্যের অভিরুচি চাপাইয়া দিলে সমাজের কল্যাণসাধনের পরিবর্তে অকল্যাণ সাধিত হইবে। - অতএব মুক্তাচিন্তার প্রবক্তাদের সতর্ক থাকিতে হইবে যেন তাহাদের মতবাদ অন্যের জন্য বোঝা হইয়া না দাঁড়ায়। সমাজের সার্বিক কল্যাণ অগ্রাহ্য করিয়া নিছক আদর্শিক কারণে মুক্তিচিন্তার তাৎপর্য থাকিতে পারে না।

৪.
মুক্তচিন্তকের সমাজকল্যাণবোধের আবশ্যকতা বিষয়ে একটি উদাহরণ দিতেছি। ইসলামের ঊষালগ্নে খলিফা ও ধর্মীয় পণ্ডিতদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়াছিল। চতুর্থ ইমাম আহমদ বিন হাম্বলীর আমলে খলিফা মামুন ফতোয়া দেন যে, অন্যান্য সৃষ্টির ন্যায় কোরআনও আল্লাহর একটি 'সৃষ্টি'। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলীর পক্ষে এই ব্যাখ্যা মানিয়া লওয়া সম্ভব ছিল না, কারণ খলিফা মামুনের ফতোয়া অর্থাৎ অভিমত কোরআন ও হাদিস দ্বারা সমর্থিত ছিল না। ইমাম হাম্বলীকে নতজানু করিবার জন্য তাহার উপর দীর্ঘকাল অবর্ণনীয় নির্যাতন চালানো হইয়াছিল। খলিফা মামুন ও তাহার অনুচর দল শেষাবধি সফল হয় নাই। - ইসলামে মুক্তচিন্তার অবকাশ নাই, কারণ যে কোনো ধারণা বা ক্রিয়াকলাপ কোরআন ও হাদিসের চৌহদ্দিতে সীমাবদ্ধ থাকিতে হইবে। - খলিফা মামুনের ফতোয়াটি মুক্তচিন্তার উদাহরণ হইতে পারে বটে, কিন্তু ইহার সহিত মুসলিম সমাজের কল্যাণ বা অগ্রগতির কোনোরূপ সম্বন্ধ ছিল না। ইহা মুসলমান শাসকদের ইতিহাসের পাতায় একটি অনপনেয় কলঙ্ক হইয়া রহিয়াছে।

অন্যদিকে ঊনবিংশ শতাব্দীতে রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সমাজের কল্যাণে বিপ্লবী অভিমত প্রকাশ করিয়া এবং তাহার বাস্তবায়ন করিয়া চিরস্মরণীয় হইয়া রহিয়াছেন। মুক্তচিন্তা মানেই ধর্মের বিসর্জন তাহা নহে। রাজা রামমোহন রায় ধর্মকে উৎপাটন করেন নাই। হিন্দু ধর্ম হইতে তিনি পৌত্তলিকতা বিসর্জন দিয়া ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। তাহার মূল লক্ষ্য ছিল মানুষের কল্যাণ।

১৮২৫-এর অক্টোবরে কলকাতায় একটি হত্যাকাণ্ড ঘটে। নিহত ব্যক্তির সঙ্গে তাহার স্ত্রীকে সহমরণ দেয়া হয়। এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করিলেন। এই আন্দোলন সহজ হয় নাই। তিনি গবেষণা করিয়া প্রমাণ পেশ করিলেন যে, সহমরণ কোনো শাস্ত্রীয় বিধান নহে, বরং ইহা একটি কুসংস্কার। তিনি লিখিলেন, শাস্ত্রানুসারে সহমরণ হিন্দু বিধবাদের শ্রেষ্ঠ কর্তব্য নহে। তিনি তাহার আন্দোলনকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করিতে সক্ষম হন। অন্যদিকে ব্রিটিশ সরকারকেও সহমরণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুপ্রাণিত করেন। শেষ পর্যন্ত লর্ড বেন্টিকের আমলে ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে সতীদাহ প্রথা বাতিলের আইন জারি করা হয়।

১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পরলোকগমন করিলেন। তাহার স্মৃতিচারণ করিতে গিয়া শিবনাথ শাস্ত্রী মহোদয় লিখিয়াছেন :১৮৫৪ সনে হিন্দু সমাজে মহাবিপ্লব উপস্থিত হইল। এই সময়ে বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহবিষয়ক পুস্তক প্রকাশ হইবা মাত্র মহাঝটিকা উপস্থিত হইল। সমস্ত সমাজ কাঁপিয়া উঠিল। চারিদিকে নিন্দার ঝড় বহিতে লাগিল। কিন্তু বিদ্যাসাগর ভয় পাইবার লোক ছিলেন না। বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধে যে সমস্ত পুস্তক বাহির হইয়াছিল, ১৮৫৫ সনে অকাট্য যুক্তি বলে তাহা খণ্ড-বিখণ্ড করিয়া দিয়েছিলেন। - বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আবেদন মোতাবেক ১৮৫৬ সালের ২৬শে জুলাই বিধবা বিবাহবিষয়ক আইন দ্য হিন্দু উইডো'স রিম্যারেজ অ্যাক্ট ১৮৫৬ জারি হইল।

মোটের উপর মুক্তচিন্তার লক্ষ্য হওয়া উচিত মানবকল্যাণ ও সমাজকল্যাণ। যে চিন্তাধারার সহিত মানবকল্যাণ অথবা সমাজকল্যাণের যোগ মাত্র নাই, তাহা নিরর্থক।

৫.
সন্দেহ নাই ধর্ম মানুষের জীবনযাপন রীতিকে শৃঙ্খলিত করিয়া রাখে। কিন্তু রাষ্ট্র যে নানা আইনের মধ্য দিয়া নাগরিককে শৃঙ্খলিত করিয়া রাখে তাহাও উপেক্ষণীয় নহে। সম্প্রতি পরিলক্ষিত হয়, বাংলাদেশের যাহারা মুক্তচিন্তার ধ্বজাধারী তাহারা কয়েকটি বিষয় লইয়া দুশ্চিন্তায় ভুগিয়া থাকেন। এইগুলির মধ্যে সর্বপ্রথমে রহিয়াছে নারীবিষয়ক প্রশ্নাবলি। যাহারা প্রগতিশীল বলিয়া নিজেদের সম্প্রচার করিয়া থাকেন তাহাদের প্রায় সকলেই নারীর মুক্তি, নারী স্বাধীনতা, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদির প্রশ্নে ক্ষমাহীন। এই সব বিষয়কে তাহারা প্রশ্নযোগ্য বলিয়া মনে করেন না।

শিক্ষিত মধ্যবিত্তের কাছে যে আরেকটি সমস্যা প্রকটিত হইয়াছে বলিয়া প্রতীয়মান হয়, তাহা হইল মাদ্রাসাকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা। তাহারা মাদ্রাসাকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থাকে সমাজের জন্য অকল্যাণকর বলিয়া জ্ঞান করেন। তাহারা মনে করেন, মাদ্রাসাশিক্ষা সমাজের সার্বিক পশ্চাৎপদতার অন্যতম কারণ।
অনেকের মতে, নারীর নিজ পোশাক নির্বাচনের স্বাধীনতা সর্বাগ্রে গণ্য। বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে গত পনের-কুড়ি বছরে ইসলামের প্রতি আনুগত্য বৃদ্ধি পাইয়াছে। সমানুপাতে বোরকাধারী নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি লাভ করিয়াছে। বোরকাধারী নারী বোরকাবিহীন নারীর জন্য সমূহ বিপদের কারণ নহে। তবু বোরকাকে সমাজের সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করা হইতেছে। ইহার বিপরীতে একদল মুসলমানের মাথাব্যথার কারণ হইল হাফপ্যান্ট পরিধানপূর্ব নারীর ফুটবল খেলা। দুই ক্ষেত্রেই মূল সূত্র হইল ধর্মীয় বিশ্বাস।

ইহা দৃষ্টি এড়াইবার মতো নহে যে, সাম্প্রতিকালে ধর্মই মুক্তচিন্তকদের প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হইয়াছে। কখনও কখনও তাহাদের ধর্মবিরোধিতা তীব্র বিদ্বেষের রূপ পরিগ্রহ করে। ধর্মবিরোধিতা তাহাদের সকল মনোযোগ, সময় ও শ্রম দখল করিয়া রাখার ফলে সমাজের অন্যান্য জ্বলন্ত সমস্যা তাহাদের মনোযোগ হইতে বঞ্চিত হইতেছে। যথা, যখন দ্রব্যমূল্যের কারণে কোটি কোটি মানুষের নাভিশ্বাস উঠিয়াছে তখন দরিদ্রের কথা বিস্মৃত হইয়া অনেক মানুষ নারীর পোশাক লইয়া কালক্ষেপণ করাকে দায়িত্ব মনে করিতেছে।

মুক্তচিন্তা যখন সামাজিক কল্যাণের নিরিখে কোন বিষয়টি মুখ্য আর কোনটি গৌণ তাহার বিভেদ করিতে ব্যর্থ হয়, তখন শঙ্কিত না হইয়া পারা যায় না। এই কারণেই মুক্তচিন্তার সীমানার কথা লইয়া ভাবিতে হইতেছে। তবে এই বিষয়ে রাষ্ট্রে হস্তক্ষেপ কখনই কাম্য নহে; মুক্তচিন্তককেই দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়া নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখিতে হইবে এবং সমাজে যুক্তিশীলতার প্রসার ঘটাইতে হইবে।

৬.
একুশ শতকের শুরু হইয়াছে একটি কালান্তর দিয়া। নিশ্চুপ থাকিবার পর্ব শেষ হইয়াছে এবং মানুষ কথক হইয়া উঠিয়াছে। এমন এক যুগের অভ্যুদয় হইয়াছে যখন মানুষ স্বীয় অভিমত ব্যক্ত করিতে উন্মুখ হইয়া পড়িয়াছে। প্রযুক্তি সেই মঞ্চ সরবরাহ করিয়াছে। ইহার ফলে সাধারণ মানুষও চিন্তাশীল হইয়া পড়িতেছে। প্রতিটি বিষয়ে তাহার অভিমত ফেনাইয়া উঠিতেছে।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে মুক্তচিন্তা ছিল সমাজের মুষ্টিমেয় বিদ্বৎজনের বিলাস। শিক্ষিতের হার বৃদ্ধি, নগরায়ণ এবং প্রযুক্তিগত সুবিধার কারণে এই বিলাসিতা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজকে আক্রান্ত করিয়াছে। সত্তরের দশকে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন বলিতেন, বারজন অর্থনীতিবিদ সমবেত হইলে তেরটি অভিমত পাওয়া যাইবে, যাহার দুইটি জন মেনার্ড কেইন্স সাহেবের। এখন অর্থনীতিবিদদের গলাবাজি করিতে দেখা যায় না। তবে সাধারণ মানুষ এই অভাব সহস্রাংশে পূরণ করিতেছে।

মানুষের নবলব্ধ চিন্তাশীলতা ও তাহার প্রকাশ সমাজকে দ্রুত পরিবর্তন করিতেছে। এই অবস্থায় দায়িত্বশীলতার পরিচয় না-দিলে মানুষ তাহার চিন্তা প্রক্রিয়াকে সমাজকল্যাণে ব্যবহার করিতে পারিবে কিনা, তাহা লইয়া সংশয় রহিয়াছে।
লেখক
গবেষক
প্রাবন্ধিক