'উৎস থেকে নিরন্তর'। আমার প্রথম গল্পের বই। প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে। কেবল একটি চাকরি পাবার প্রত্যাশায়ই বইটি প্রকাশ করা হয়েছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষা দিয়েছি ১৯৬৮ সালে। ছাত্রজীবনে বেশ কিছু গল্প লিখেছি, রাজশাহী এবং ঢাকার পত্রপত্রিকায় সেগুলো ছাপাও হয়েছে। একদিন আমার শিক্ষক অধ্যাপক আবদুল হাফিজ বললেন, 'তোমার গল্পগুলো নিয়ে একটি সংকলন করে ফেলো। প্রকাশনা থাকলে চাকরি পেতে সুবিধা হয়।'
স্যারকে বললাম, কে ছাপাবে আমার বই?
স্যার হাসতে হাসতে বললেন, 'প্রকাশকরা কেউ ছাপবে- এমন আশা করে লাভ নেই, তোমার নিজেকেই ছাপতে হবে। বাবার কাছে টাকা চাও।'
সেই শুরু। টাকা জোগাড় হলো। ছাপার কাজও শুরু হলো। মো. আবদুর রশিদ খানের আইডিয়াল প্রিন্টিং ওয়ার্কস ছিল তখনকার রাজশাহী শহরের আধুনিক প্রেস। সেটি ছিল কাজিরগঞ্জে। একদিন প্রুফ এলো। প্রুফ তো দেখতে জানি না, তখন রশিদ সাহেবই সাহায্য করেছিলেন। দারুণ উত্তেজনা। তখন চাকরির কথা ভুলতে বসেছি। বই হচ্ছে- এটাই বড় কথা। হাফিজ স্যার ঢাকায় এসে আমার বইয়ের প্রচ্ছদ ও ব্লক করিয়ে আনলেন। প্রচ্ছদশিল্পী এম. মনসুর আহমদ। প্রকাশক হিসেবে নাম ছাপা হলো মো. আবদুর রশিদ খানের আর পরিবেশক করা হলো নওরোজ কিতাবিস্তানকে। বইয়ের মূল্য চার টাকা। বই প্রকাশের ধকল আমাকে কিছুই সইতে হয়নি। শুধু প্রকাশের আনন্দটুকু ছিল আমার। এখানে আমি কৃতজ্ঞ আমার শিক্ষক অধ্যাপক আবদুল হাফিজের কাছে।
তো যে উদ্দেশ্যে বই প্রকাশ করা হলো, সেই উদ্দেশ্য বা স্বপ্ন বুকে নিয়ে ঢাকায় এলাম। ততদিনে এমএ পরীক্ষারও ফল বেরিয়েছে। চাকরির জন্য দরখাস্ত করি। জীবনবৃত্তান্তে ছাপা প্রকাশিত বই- 'উৎস থেকে নিরন্তর'। কিন্তু যত দরখাস্তই করি না কেন, তেমন সাড়া পাই না। চাকরি খুঁজতে খুঁজতে উনসত্তর সাল শেষ হয়ে যায়। মফস্বলের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে আসা একটি মেয়ের চাকরি হওয়া খুব সহজ কথা নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছেলেমেয়েদের সঙ্গে পারব কেন, এমন একটা ধারণা প্রায় জন্মে গিয়েছিল। তবু সাহসে বুক বাঁধলাম। দরখাস্ত করি বিভিন্ন জায়গায়।
তখন টেলিভিশনে 'নতুন বই' নামে একটি সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল। অনুষ্ঠানটি করতেন মুনীর চৌধুরী। একদিন আকস্মিকভাবে দেখলাম তিনি আমার বইটির আলোচনা করছেন। প্রচুর প্রশংসা করলেন। উত্তেজনা ধরে রাখা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ক'দিন ঠিকমতো খেতে পারিনি, ঘুমুতে পারিনি। ঢাকা শহরে তখন কোনো বন্ধু নেই যে এই আনন্দ ভাগ করে নেব। পরে শুনেছিলাম, মুনীর চৌধুরী তরুণ লেখকদের উৎসাহিত করার জন্য প্রশংসাই করতেন বেশি।
যা হোক সত্তরের শুরুতে কাগজে বিজ্ঞাপন বেরোল দুটো। একটি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের, সরকারি কলেজে লেকচারারের, অন্যটি বাংলা একাডেমির গবেষণা সহকারীর। দুই জায়গায় দরখাস্ত করলাম। যেহেতু এই অচেনা শহরে তদবিরের কোনো সুযোগ নেই, একমাত্র ভরসা আমার প্রকাশিত বই। যখন প্রবল হতাশায় আক্রান্ত হই, তখন নিজেই বই নেড়েচেড়ে দেখি এবং কখনও গল্পগুলো আবার পড়তে থাকি।
একদিন পাবলিক সার্ভিস কমিশন থেকে ইন্টারভিউ কার্ড পাই। চাকরির জন্য জীবনের প্রথম ইন্টারভিউ। আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে। নির্ধারিত তারিখে ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে দেখি বোর্ডে রয়েছেন মুনীর চৌধুরী। এই প্রথম তাঁকে আমি সামনাসামনি দেখি। আমার দরখাস্তের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'তুমি উৎস থেকে নিরন্তর বইটি লিখেছ?'
মাথা নাড়ি, গলা শুকিয়ে কাঠ।
তিনি হেসে বললেন, 'ভালো লেখা।'
তবুও ভয় কাটে না। যা হোক, সেদিন আমাকে কী প্রশ্ন করা হয়েছিল আজ আর আমার তা মনে নেই। বোর্ডে আর কারা ছিলেন, সেটাও আমার জানা ছিল না। তবু চাকরিটি আমার হয়েছিল। পোস্টিং দেওয়া হয় সিলেটের এমসি কলেজে। সেটা ১৯৭০ সালের জুন মাস। কিন্তু আমি এই চাকরিটি করিনি। এই চাকরির ইন্টারভিউর ফলাফল বেরুতে বেরুতে বাংলা একাডেমির চাকরির ইন্টারভিউ কার্ড পাই। তখন পরিচালক ছিলেন কবীর চৌধুরী। বর্ধমান ভবনের তৃতীয় তলায় তিনি বসতেন। নির্ধারিত তারিখে তাঁর ঘরে ইন্টারভিউ দিতে গেলাম। অপেক্ষায় বসে থাকি আমার ডাক আসার জন্য। বুকের মধ্যে একটাই সাহস যে প্রার্থী যাঁরা ছিলেন, তাঁদের কোনো বই ছিল না। এমএ-তে আমার রেজাল্ট ছিল দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম, কিন্তু এর চেয়ে আমার বড় কৃতিত্ব- আমি একটি বইয়ের লেখক, যে বইটি আমি বর্ম হিসেবে সঙ্গে করে এনেছি।
ইন্টারভিউ বোর্ডে ছিলেন ড. মুহম্মদ এনামুল হক, কবীর চৌধুরী, ড. নীলিমা ইব্রাহিম ও ড. আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দীন। পাবলিক সার্ভিস কমিশনে ইন্টারভিউ দিয়ে ভীতি কিছুটা কেটে গিয়েছিল। তাই বুকে যত কাঁপুনিই থাক না কেন, বাইরে বেশ স্মার্ট থাকার চেষ্টা করলাম। কাগজপত্র উল্টেপাল্টে দেখে ড. নীলিমা ইব্রাহিম বেশ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, 'ওহ রাজশাহী ইউনিভার্সিটি?'
শুনে দাঁত কিড়মিড় করে উঠল, কিন্তু উত্তর দেবার সাহস ছিল না। অপমান হজম করে বসে রইলাম। ড. এনামুল হক জিজ্ঞেস করলেন, 'পুঁথি পড়তে পারো?'
বললাম, পারি। পুঁথি আমার এমএ-তে পাঠ্য ছিল।
বললেন, 'পড়ো।'
পড়লাম। একটুও আটকাল না।
ড. আল-মুতী শরফুদ্দীন বললেন, 'আপনি তো গল্প লেখেন, গবেষণার কাজ করতে পারবেন?'
বললাম, পারব।
আরও কী কথা হয়েছিল আজ আর তা মনে নেই। সেদিন রাগ এবং হতাশা নিয়েই ফিরে এসেছিলাম। ধরেই নিয়েছিলাম যে চাকরি হবে না। তারপর জুন মাসে দুটো চাকরির নিয়োগপত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে পাই। আমার নিজের জন্য সরকারি কলেজের চেয়ে বাংলা একাডেমিকে অনেক বেশি উপযুক্ত স্থান মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল, যে বই সম্বল করে জীবনের সিঁড়ি ভাঙতে চেয়েছিলাম, বাংলা একাডেমি তো সে বইয়েরই জায়গা।
গ্রন্থনা ::আশিক মুস্তাফা