সবিশেষ
কাফকাকে ঘিরে

ফ্রানৎস কাফকা [৩ জুলাই, ১৮৮৩–৩ জুন, ১৯২৪]
মুর্শিদা জামান
প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০৮:৩১
অনেক দিন থেকেই ভেবেছি আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে মানুষ যেমন করে ভ্রমণ করতেন, অনেকটা সে রকম ভ্রমণ করব। জরুরি তথ্যগুলো জানতে আমার সঙ্গী রিয়াসাত হাসান জ্যোতি সারাক্ষণ গুগল করছিল। তবে মানা থাকায় ও আমাকে কিছুই জানায়নি, এমনকি হোটেলের নামও শুনিনি। প্রাগ বিমানবন্দর থেকে পুরোনো শহরের প্রান্তে আসতে আসতে দেখলাম এ তো শিল্পের খাজানা, চারদিকে জাদুঘরের ছড়াছড়ি! হোটেলের গলির প্রবেশমুখেই আশ্চর্য চোখের ছেলেটির মুখ দেয়ালে সাঁটানো। শীতের চাইতে উত্তেজনার কাঁপুনি আমাকে ধাক্কা দিল। আরেহ, এ যে মহান লেখক ফ্রানৎস কাফকার জাদুঘর!
পুরোনো শহরটির পরতে পরতে বিস্ময় অপেক্ষা করছিল যেন আমাদের জন্য। আমরা এক সপ্তাহের জন্য প্রাগে থাকব যখন তাড়াহুড়ো করিনি। ভ্লতাভা নদীর কোল ঘেঁষে এত রূপবতী একটি শহর গড়ে তুলছে যারা, সেইসব শিল্পপ্রেমী মানুষের প্রতি মন কেমন হয়ে গেল। রাস্তাময় পর্যটকের ভিড়। সকলের মুগ্ধ চোখের ঝিলিকে প্রাগ যেন আরও রূপসী হয়ে উঠল। প্রথম দিন সকলের দেখাদেখি যা দেখছি সবকিছুর ছবি তুলছিলাম। হঠাৎ হুঁশ ফিরলে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম একদম ফোন আর ক্যামেরায় হাত দেব না। চার্লস ব্রিজে দেখলাম কিছু মানুষ আসলেই ফোন ব্যবহার করছেন না। ভীষণ মন দিয়ে দেখছেন তুখোড় কাজগুলো।
আসা-যাওয়ার পথেঘাটে, ট্রামে, ট্রেনে সবখানে চেকবাসীরা বই মেলে বসে আছেন। তাদের নিমগ্ন পড়ুয়া স্বভাব দেখে ভেবে পাচ্ছিলাম না আসলে টাইমমেশিনে করে আমাদের কেউ নিয়ে এলো না তো অন্য কোনো শতকে। স্থানীয় মানুষদের সাথে কথা বলে যদিও বুঝতে পারছিলাম অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। আইনকানুন খাতা-কলমে কেবল। আরও আছে নাগরিক অভিমান কিন্তু এসবের কোনো কিছুই তাদের শিল্পবিমুখ করেনি। রোববার সেজেগুজে থিয়েটারে যাচ্ছেন ফুল এবং ওয়াইন হাতে। নয়তো গ্লাসের পর গ্লাস বিয়ার খাচ্ছেন আয়েশি ভঙ্গিতে ‘নাজদ্রাবি’ বলে।
এক রোদেলা সকালে কাফকার জাদুঘরে পা রাখলাম আমরা। আমাদের সামনে কয়েকজন এসেছেন বার্লিন থেকে। তাদের হাতে খাতা-কলম দেখে বুঝলাম কত গুছিয়ে যত্ন করে নোট টুকে নিচ্ছে। লেখকের জাদুঘরে তার বই, চিঠি– কাচের বাক্সে সাজানো পরপর। নানা সময়ের ছবিও যুক্ত করা আছে। একটি ঘরে কাফকার ছেলেবেলার শহর তাঁর সময়কার প্রাগের প্রামাণ্যচিত্র চলছিল। অন্য আরেকটি ঘরে কাফকার আঁকা স্কেচ। কত কত চিঠি, ডায়েরির পাতা। প্রথম পাণ্ডুলিপি! প্রেমিকার ছবি, তাকে লেখা চিঠি।
একজন মানুষ কী বিমর্ষ, কত প্রান্তিক কত দুরবস্থায় লিখে গেছেন আর সেসব আবার কিনা পুড়িয়ে দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে। ভাগ্যিস, কথা না রেখে বিরল বন্ধুত্বের নিদর্শন রেখে গিয়েছিলেন ম্যাক্স ব্রড।
দুপুরের পরপর আমরা পাশের আরেকটি শহরে গেলাম কাফকার কবর দেখতে। রোদ তখন যাই যাই করছে। কিন্তু এত নির্জন আর শান্ত জায়গাটি দেখে অবাক হচ্ছিলাম। আসলে আমরা প্রাগের সবচে বড় কবরখানায় এসেছি, সেটা এমন প্রাচীরঘেরা তালাবদ্ধ, বুঝতে পারছিলাম না কেন। বেশ কিছুটা পরে প্রধান ফটকের পাশে নোটিশবোর্ড দেখে বুঝলাম আমরা দেরি করেছি আসতে। সাড়ে ৪টার আগে এলে ঢুকতে পারতাম। কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখে মনে মনে চটে যাচ্ছিলাম যদিও। প্রাচীর উঁচু করে রেখেছে এতটা যে বাইরে থেকেও দেখার উপায় নেই। দুজন ইয়া বড় লেন্স-সমেত ক্যামেরা হাতে নিয়ে এসেও নোটিশ পড়ে চলে গেলেন বিরস মুখে। কিন্তু আমি আর জ্যোতি নাছোড়বান্দা, এসেছি যখন না দেখে ফিরব না। এদিকে তাপমাত্রা কমতে শুরু করেছে হঠাৎ করেই। জ্যোতি গুগল করে ওয়েবসাইট ঘেঁটে কল করল কাকে যেন, ফোনের স্ক্রিনে যে লেখাটি ভেসে উঠল আমরা একটু হতচকিত হয়ে পড়লাম।
“কলিং টু ফানৎস কাফকা গ্রেভ!”
যা-ই হোক, উঁকি দিতে দিতেই একটা সাইনবোর্ডে দেখতে পেলাম কাফকা ডান দিকে প্রায় দুইশ মিটার পরেই শুয়ে আছেন। আশ্চর্য ঠিক আরও একটি লোহার উঁচু ফটক। আর সেখানেই কিনা একটি গাছের নিচে আবছা কালো অক্ষরে লেখা ড. ফানৎস কাফকা। একটি ষড়ভুজ সমাধি পাথরে হিব্রু ভাষায় ছিল বাকি লেখা।
আমরা দুজনে একজন প্রাজ্ঞ মানুষের কবরের সামনে শ্রদ্ধানত তখন। ভুলে গেছি ক্যামেরা বের করতে। কত কী মনের ভেতর। মাত্র চল্লিশ বছরের জীবনে তাঁকে মেনে নিতে হয়েছে, যন্ত্রণার বিদঘুটে দানবকে। সহ্য করতে হয়েছে সংখ্যালঘু হওয়ার চাপ। তবুও দূরদর্শী বন্ধুর সুবাদে আজও মানুষ তাঁকে পড়ছে, শ্রদ্ধা জানাতে ছুটে আসছে কবরে। আশেপাশের কবরে তুষারের স্তূপ। তাঁর কবরে একটি হলুদ ডেইজি তখনও তাজা, আর কমলা রঙের মোম জ্বলছিল। ফিরে আসার আগে কবরের ছবি বাইরে থেকেই নিলাম দু’চারটে।
এই জরাগ্রস্ত শীতের পরে আবার আসার তীব্র ইচ্ছে বুকে নিয়ে ট্রামের দিকে চললাম।
কবরের গাছগুলোর আড়ালে দিনের আলোর শেষ রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছিল সেদিন। এই তো সেদিন ইহুদিরা মরছিল, আর আজ যুদ্ধের তামাম কিছু ভুলে গিয়ে নতুন যুদ্ধে শামিল তারা। কাফকার সাহিত্যকর্ম ইসরায়েলে নিয়ে যাওয়ার আইনি লড়াই করেই-বা কী হলো আসলে। সেই যদি মানুষের জীবন কেড়ে নেয়ার নেশা না কাটে। অথচ হিব্রু ভাষায় পাথুরে শিলালিপির শব্দ ভাষান্তর করে দেখা গেল লেখা–
“তাঁর আত্মা মিলনে আবদ্ধ হোক। জীবন!”