গীতাঞ্জলি শ্রী, হিন্দি ভাষার কৃতি লেখক এবার আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার অর্জন করেছেন। সম্প্রতি ঢাকা লিট ফেস্ট চলাকালে কালের খেয়ার মুখোমুখি হন। সেখানে লেখকের নিজ পরিমণ্ডলে লেখালেখি, দেশভাগ, লেখার মৌলিকত্ব, সাহিত্যে নারী চরিত্রসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে আসে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শাহেরীন আরাফাত
'রেত সমাধি' (টুম্ব অব স্যান্ড) উপন্যাসের জন্য আপনি বুকার জয় করেছেন। বুকার জয়ের আগে এবং এখনকার মধ্যে পার্থক্য কী?
গীতাঞ্জলি শ্রী: পার্থক্য তো অনেকটাই আছে। তবে এখনও খুব বেশি সময় যায়নি। এর আগে আমি নিজের একটি শান্ত গণ্ডির মধ্যে ছিলাম। সেখানেই নিজের মতো কাজ করে যেতাম। আমার পৃথিবীটা ছিল সীমিত। তবে কাজ বেশি করা হতো। বুকারের পর আমার এই পৃথিবী অনেক বড় হয়েছে। গোটা বিশ্ব আমার সামনে মুক্ত হয়েছে। নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে চেনাজানা হয়েছে, কথাবার্তার সুযোগ হয়েছে- যা অবশ্যই আনন্দের বিষয়। তবে আমার কাজের ক্ষেত্রটা সম্ভবত আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। আবার এটিও মনে করি, শিগগিরই একটি সাম্যাবস্থা তৈরি হবে, যেখানে আমার বড় হওয়া পৃথিবীটাও থাকবে, আবার আমার কাজের ক্ষেত্রটাও ঠিকঠাক থাকবে।
'রেত সমাধি' উপন্যাসেও রয়েছে দেশভাগের আখ্যান। দেশভাগ সম্পর্কে আপনার উপলব্ধি জানতে চাই।
গীতাঞ্জলি শ্রী: 'রেত সমাধি' উপন্যাসে দেশভাগ এসেছে মাঝামাঝি সময়ে। এটি ঠিক ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস নয়। এখানে ইতিহাসে দেশভাগ যেভাবে এসেছে, সেটা বলা হয়নি; বরং আজ আমরা দেশভাগকে যেভাবে দেখছি- তা উঠে এসেছে। এখন আমাদের চিন্তা, রাজনীতি বা স্মৃতিতে দেশভাগ যেভাবে আছে, যেভাবে আমরা তাকে স্মরণ করি, আশপাশের যেসব গল্প বা আমাদের পরিবারের আগের প্রজন্মের কাছ থেকে জানা ঘটনাগুলোর মধ্য দিয়ে বিভিন্নভাবে দেশভাগ আমাদের জুড়ে রাখে- এর একটি ফলিত রূপ আমাকে, আমার মতো লেখকদের বেশ বিরক্ত করে; প্রভাবিত করে। এরই ফল হিসেবে এ বইয়ে দেশভাগের কথা উঠে এসেছে।
উপন্যাসে চরিত্রায়ণের বিষয়েও ভিন্নতা দেখা গেছে...
গীতাঞ্জলি শ্রী: আমার কাছে তো সবকিছুই একেকটা চরিত্র। আমার কাছে একটা দেয়াল, সড়ক বা দরজাও চরিত্র। এটি সেই দরজা, যা শত শত বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে। না জানি এ দরজার নিচ দিয়ে কত শত মানুষ গিয়েছে! এত ঘটনা, দুর্ঘটনা, অঘটনের সাক্ষী যে দরজা, সে নিশ্চিতভাবেই নিজে একটি চরিত্র। একই বিষয় সড়কের ক্ষেত্রেও আমি অনুভব করেছি। 'রেত সমাধি' উপন্যাসে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের কথা উল্লেখ করা হয়, যখন গল্পের প্রধান চরিত্র 'আম্মা' ও রাহাত সীমান্তে পৌঁছান। সেখানে তাঁদের যে পুরোনো স্মৃতি ছিল, তা রোমন্থন করেন। কিন্তু এই সড়ক তো আরও কত শত বছর ধরেই ছিল। এখানে কী না হয়েছে? আনন্দ-উল্লাস-উৎসব হয়েছে, লঙ্গরখানা খুলেছে, লুটপাট হয়েছে, খুন হয়েছে। এ সবকিছুরই সাক্ষী গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড। তাহলে এ সড়ক কী করে শুধু একটি নির্জীব সড়ক থাকে। এসবের পর তো সেটি এক জীবিত চরিত্রে পরিণত হয়েছে। উপন্যাসে আমি এ বিষয়টিই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি যে যখন কোনো কিছু ঘটছে তখন আপনি বা আমি না থাকলেও কেউ না কেউ তো দেখছে। কোনো না কোনোভাবে সেটি একদিন উঠে আসবে। সবকিছুই সমাধিতে যায়। আর এ সমাধি তো রেত সমাধি (বালুর সমাধি)। একটু বাতাসেই বালু সরে গিয়ে সেই সমাধি উন্মুক্ত হয়ে পড়ে।
আপনার লেখায় সবসময় শক্তিশালী নারী চরিত্রের দেখা পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে আপনি কোন বিষয়গুলো মাথায় রাখেন?
গীতাঞ্জলি শ্রী: আমি মনে করি, ভালো লেখকের মধ্যে এমন সহমর্মিতা থাকে, যিনি অন্যকে অনুভব করতে পারেন। যখন কোনো নারী চরিত্রকে আমি তুলে ধরছি, তখন ওই চরিত্রটিও অন্য একজন। আর আমাকে ওই চরিত্রের অনুভূতি অনুভব করেই তাঁর কথাগুলো সামনে আনতে হবে। সাহিত্যে এমন নয় যে নারী শুধু নারীর কথা বলছেন বা ট্রান্সজেন্ডার শুধু ট্রান্সজেন্ডারের কথা বলছেন। বরং এখানে অপরদিকে গিয়েও কথা বলা যায়। তবে সে চরিত্রটাকে মন থেকে অনুভব করতে হয়। আমার মধ্যে এই সহমর্মিতা আছে, আমি ওই নারী চরিত্রকে শক্তিশালীভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছি।
দক্ষিণ এশিয়ায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য অনুবাদ না হওয়ায় অথবা ভালো অনুবাদকের অভাবে বিশ্বস্তরে পৌঁছতে পারেনি। এ বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
গীতাঞ্জলি শ্রী: হিন্দি, বাংলা, তেলেগুসহ দক্ষিণ এশিয়ার বহু ভাষায় বহু রত্ন লুকিয়ে আছে। তবে তা কেবল অনুবাদ বা ভালো অনুবাদকের অভাবে বিশ্বস্তরে আসেনি, এমন নয়। এখানে আরও বিষয় জড়িত। তবে 'রেত সমাধি'র মধ্য দিয়ে এখন অন্যরা দক্ষিণ এশিয়ার সাহিত্যের দিকে তাকাবে এটুকু নিশ্চিত। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ নোবেল পাওয়ার আগে লাতিন সাহিত্য নিয়ে বিশ্বস্তরে তেমন আগ্রহ ছিল না। পরে অনেকে দাবি করেছেন- লাতিন তো মার্কেজে ভরা। মার্কেজের চেয়েও বড় লেখক লাতিনে জন্ম নিয়েছেন বলে দাবি করেছেন অনেকে।
আপনি ইতিহাসে পিএইচডি করেছেন, আবার বুকার জিতেছেন সাহিত্যের জন্য। সাহিত্য ও ইতিহাসের মিশ্রণটা কীভাবে করলেন?
গীতাঞ্জলি শ্রী: আমি চাকরি করতে চেয়েছি। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছি। সাহিত্য এমন বিষয় না, যেখানে অনেক বেশি চাকরির সুযোগ রয়েছে। সেই তুলনায় ইতিহাস অনেক কার্যকর বিষয় বলে মনে করা হয়। ইতিহাসে পড়ার পর অনেক চাকরির প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকে। অন্যান্য দিকে যাওয়ার সুযোগও থাকে। আর শিক্ষকতার সুযোগ তো থাকছেই। এ কারণে ইতিহাসের দিকে আমি গেলাম ঠিকই কিন্তু আমি কখনোই মন থেকে এটি চাইনি। আমি মনে করি না, যা হয়েছে খারাপ হয়েছে। দেখা যাবে সব বিষয়ই কোনো না কোনোভাবে আমাদের ওপর প্রভাব ফেলে। জীবন সবকিছু নিয়েই, কোনো নির্দিষ্ট একটি বিষয়ে নয়। আমরা তো আমাদের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন নই। বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে না পড়লেও আমরা ইতিহাসেরই শিক্ষার্থী। ইতিহাসে পড়ার কারণে আমি অনেক কিছু শিখেছি। আমাকে গড়ার ক্ষেত্রেও তার একটি ভূমিকা রয়েছে।
ইতিহাসে পড়তে আমার কোনো সমস্যা হয়নি। তবে এটি যে আমার পথ ছিল না, তা বেশ ভালোই জানা ছিল। সাহিত্যে কীভাবে আসব- এটি কিছুটা কষ্টকরই ছিল। কারণ আমি শুরু থেকে সাহিত্যে পড়িনি। ব্যক্তিগতভাবে ঘরে পড়েছি। কীভাবে আমি এটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেব, সে ভাবনা থেকেই পিএইচডি করেছি প্রেমচন্দের ওপর (সোশ্যাল অ্যান্ড ইন্টেলেকচুয়াল ট্রেন্ডস ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া :আ স্টাডি অব প্রেমচন্দ)। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময়ে লেখক কেমন স্বাধীন ভারতের দাবি করছিলেন, এ বিষয়ে কী লিখছিলেন- এভাবে প্রেমচন্দকে আমি গবেষণার ভিত্তি করেছি। আমি মনে করি, এটি ছিল ইতিহাস থেকে সাহিত্যে যাওয়ার সেতু। এরপর আমি ইতিহাস ছেড়ে শতভাগ সাহিত্যে মনোনিবেশ করি।
সাহিত্যে মৌলিকত্বের বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
গীতাঞ্জলি শ্রী: ইনতিজার হুসেইনের বরাতে বলছি, তিনি বলতেন- মৌলিকতা বলতে কিছু নেই। আমি তো নকল করেই চলেছি। এই নকল করা মানে আক্ষরিক নয়। এটি বোধের ব্যাপার। আমরা তো আসলে সেই অর্থে নতুন কিছু করছি না। পৃথিবীতে ওই একই জিনিস আছে- প্রেম, হিংসা, বিভিন্ন রকম সম্পর্ক, বিভিন্ন রকম সুখ-দুঃখ। শত শত বছর ধরে আমরা এসবই কিন্তু লিখছি। তবে সব লেখকেরই লক্ষ্য থাকে, এটিকে ভিন্ন আঙ্গিকে লেখা। কতটা ভিন্ন আঙ্গিকে তিনি লিখতে পারলেন, তা পাঠক ও বোদ্ধাদের কাছ থেকেই জানা সম্ভব। সাহিত্যে প্রকৃত অর্থে মৌলিকতা থাকে কিনা, এটি প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। তবে অভিব্যক্তিটা যেন মৌলিক হয়, সে চেষ্টাটুকু থাকে।
দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বব্যাপী ডানপন্থার উত্থান ঘটছে। এ সময়ে লেখক-সাহিত্যিকদের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত?
গীতাঞ্জলি শ্রী: ডানপন্থার উত্থান হচ্ছে। এটি বাস্তবতা। তবে এ সময়ে লেখক-সাহিত্যিকরা কিছু লিখলেই যে রাতারাতি সব বদলে যাবে, আমাদের সব কথা মেনে নেওয়া হবে- এমন নয়। সাহিত্য এমন তাড়াহুড়োর বিষয় নয়। এখানে যা হয়, সেটি ধীরে কিন্তু শক্তভাবে হয়। এরপরও আমরা আশা করি, সাহিত্য লোকজনকে পড়তে উৎসাহিত করে। লোকজন যখন পড়েন তখন কিছু বোঝার চেষ্টা করেন; অনুভব করার চেষ্টা করেন। যখন তাঁরা বিভিন্ন বিষয়কে নতুন করে দেখার চেষ্টা করেন তখন আশা করা যায়, তাঁদের ভেতর আরও অনেক ইতিবাচকতা প্রবেশ করবে। সাহিত্য পাঠককে উগ্রতার দিকে নিয়ে যায় না। যে কোনো শিল্প সবসময় মানুষকে যুক্ত করে- তা মানবিকতারই শিক্ষা দেয়। সাহিত্য ভাঙে না। যদি ভাঙার কথা বলে, তাহলে সেটি ভেঙে ফেলার মতো বিষয়কেই ভাঙতে বলে। যেমন- জাতি-বর্ণ প্রথা; এটি ভেঙে ফেলা জরুরি। এটি ভেঙেই সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। সাহিত্যের লক্ষ্য সবসময়ই ভালোবাসা, মানবিকতা- যেখানে একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ার প্রত্যয় থাকে। সময় যেমনই হোক, প্রত্যাশা থাকে দুর্বার। রাতারাতি নয়, লেখক একা নয়- আমরা সবাই একই সমাজের অংশ; লেখক-পাঠক মিলেই এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারেন। আমরা সবাই মিলে যখন পরিবর্তনের চিন্তা করব, তখন সবাই মিলে একটি আওয়াজ ওঠাতে পারব। এর মাধ্যমে সমাজে একটি পরিবর্তনের আশা করা যেতে পারে। যেখানে শান্তি ও ভালোবাসার একটি জায়গা তৈরি হবে।
শেষ প্রশ্ন, জীবন মানে কী?
গীতাঞ্জলি শ্রী: এটি তো অনেক বড় প্রশ্ন। এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়াটা বেশ কঠিন। একটি বড় উপলব্ধি হলো, আমরা জীবনটা পেয়েছি। এ জীবন কোথা থেকে এলো, কীভাবে এলো, কে এটি নিয়ন্ত্রণ করে, কে এটি চালায়- এর সব রহস্য আমরা জানি না। তবে আমরা এ জীবনটা পেয়েছি। এখানে যত বেশি মানুষকে যুক্ত করা যায় ততই ভালো। মানুষের সঙ্গে যুক্ত করে আমরা এ জীবনকে আরও কার্যকর করতে পারি। আমাদের সে চেষ্টাটুকুই করা উচিত।