
চিত্রকর্ম :রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
যার শরীরে কৌটিল্যের চেয়ে বেশি জ্ঞান তিনি একজন নারী। হয়তো এ কথার বিশিষ্ট উল্লেখ আবশ্যক ছিল না। এই বিবৃতিটি যার, তিনি একজন পুরুষ, তিনি কবি, তিনি জীবনানন্দ। নারীর শরীরে তিনি আবিস্কার করেছেন কৌটিল্যের চেয়ে বেশি জ্ঞান। কোনো নারী কৌটিল্যের চেয়ে ঢের বেশি জ্ঞান পুরুষশরীরে আবিস্কার করেছে কিনা তার বিবৃতি কোনো কবিতা বা গল্পে অদ্যাবধি পরিদৃষ্ট হয় না।
বিংশ শতাব্দীর শুরু অবধি কৌটিল্যের গ্রন্থ 'কৌটিলীয়ম অর্থশাস্ত্রম' সাধারণ মানুষের নিকটলভ্য ছিল না। ১৯০৯ সালে শ্যামশাস্ত্রী মহোদয় আবিস্কারপূর্ব এই বিখ্যাত গ্রন্থও প্রকাশ করেন। এরপর নানা পণ্ডিত কর্তৃক সংস্কৃত থেকে এটি নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে। কোনো কোনো বাঙ্গালী সংস্কৃত না জেনেও এ গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন। কৌটিল্য তথা চাণক্য তথা বাৎসায়ন কবে কোন্ কালে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং গ্রন্থ রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন তা আমাদের বিচার্য বিষয় নয়। তার জন্ম মৌর্য যুগে হয়ে থাকুক কি যিশুখ্রিষ্টের জন্মের পরবর্তীকালে হয়ে থাকুক, তাতে এ গ্রন্থের বনেদি কৌলিন্য বিন্দুমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। বাংলায় লিখিত রাধাগোবিন্দ বসাক মহাশয়ের 'কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্র' গ্রন্থটি আপনারা কেউ কেউ ইতোমধ্যে পাঠ করে থাকবেন। যারা করেননি, বলা অন্যায্য হবে না, তারা এ গ্রন্থে নিহিত রসমঞ্জরী থেকে আপনাদের বঞ্চিত করে রেখেছেন।
এই গ্রন্থ সম্বন্ধে সাধারণ ধারণা এই যে এটি প্রাচীন ভারতীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান মাত্র। অনেকের ধারণা, এটি ম্যাকিয়াভেলির 'দ্য প্রিন্স' জাতীয় একখানা কিতাব। কিন্তু কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র একটি রসময় গ্রন্থ যার বিষয়পরিধি বিস্তৃত। অন্যান্য চিত্তাকর্ষক বিষয়ের মধ্যে এতে রয়েছে, উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বিধবা রমণীর দ্বিতীয়বার পতি গ্রহণের অধিকার সংক্রান্ত বিধান, স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে শাসন ও শাস্তি প্রদান, প্রবাসী স্বামীর জন্য স্ত্রী কতকাল অপেক্ষা করবেন তার বিধান, স্ত্রী-সংগমের নিয়মকানুন, বৈবাহিক সম্বন্ধে আবদ্ধ হওয়ার উপযুক্ত বয়স, স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহের অধিকার, গণিকাদের বিষয়ে বিধিনিষেধ ইত্যাদি।
যারা ভেবেছেন কূট কিংবা কুটিল শব্দের সঙ্গে কৌটিল্য নামের সম্বন্ধ রয়েছে, তাদের সম্যক অনুধাবনের স্বার্থে একটি প্রশ্ন উত্থাপন করছি। ভেবে দেখুন, কোনো একজন ব্রাহ্মণ পুরুষের বহু সংখ্যক বালিকা স্ত্রী রয়েছে। ধরুন, প্রকৃতির ক্রীড়ায় সেসব বালিকা স্ত্রী একই সঙ্গে ঋতুমতী হয়েছে। এখন বলুন, সর্বপ্রথম কোন্ স্ত্রীর সঙ্গে যৌনসংগম করা উক্ত ব্রাহ্মণের জন্য ন্যায্য হবে?
প্রশ্নটি সহজ কিছু নয়। কারণ, এতে ন্যায়পরায়ণতা জড়িত। মহামতি কৌটিল্য এই প্রশ্নের সদুত্তর প্রদান করে বলেছেন, এবম্বিধ ক্ষেত্রে উক্ত ব্রাহ্মণ প্রথম যৌনসংগমের ক্ষেত্রে স্ত্রীগণের শ্রেণিগত অবস্থান মান্য করিবেন। তদুপরি, দুইজন বালিকা স্ত্রী যদি সমশ্রেণির হইয়া থাকে, তবে অগ্রে যাহাকে বিবাহ করা হইয়াছে, ব্রাহ্মণ স্বামী প্রথমত তাহাতে উপগত হইবেন।
যদি কোনো গ্রিক কবি এ কথাটিই তার কবিতায় লিখতেন তবে কি তাতে আরিস্তোতলের কথা উল্লিখিত হতো? কোনো গ্রিক কবি কি আরাধ্য, কি অনারাধ্য কোনো গ্রিক নারীর শরীরে আবিস্কার করতে পেরেছিলেন আরিস্তোতলের চেয়ে বেশি জ্ঞান?
কৌটিল্য তার অর্থশাস্ত্রে নানারকম চিন্তার জন্ম দিয়েছেন। কৌটিল্য ছাড়াও আরও নানাজনের পাণ্ডিত্যের কথা ভারতবর্ষের ইতিহাসে পুনঃপুন উচ্চারিত হয়ে থাকে। তবে জীবনানন্দ দাশ বেছে নিয়েছেন কৌটিল্যকেই। যে রকম ছান্দসিকতা জীবনানন্দের বৈশিষ্ট্য ছিল তার কাঠামোতে নামটি মসৃণভাবে খাপ খেয়ে গেছে।
নারীর শরীরে কৌটিল্যের চেয়ে বেশি জ্ঞান- এ কথা লিখে জীবনানন্দ তাঁর নারীবিষয়ক ধারণার নতুন পরিচয় দিয়েছেন। এটি একটি অসাধারণ বাকপ্রতিমা। এর মধ্যে যে কূটাভাষ নিহিত তা মনোজ্ঞ। মস্তিস্ক নয় বরং জীবনানন্দ জ্ঞানের সন্ধান পেয়েছেন নারীর দেহবল্লরীতে।
আজকের পৃথিবীতে কিছু মানুষ নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলে। তারা সমাজে পুরুষের আধিপত্য লক্ষ্য করে দুশ্চিন্তিত হয়ে থাকে। তারা নারীর সামাজিক অবস্থান নিয়ে চিন্তিত থাকতে ভালোবাসে। তারা মনে করে নারী ঘরের বাইরে এলে তবেই সমাজের উন্নতি। তারা পরিবারের কথা উহ্য রাখে। তাদের কাছে মনে হয় নারী পুরুষের শত্রু। তাদের কাছে মনে, পুরুষ নারীকে ভয় পায় পাছে নারী বলশালী হয়ে পুরুষকে ক্ষমতাচ্যুত করে ফেলে।
জীবনানন্দ কখনও নারীকে নিজের প্রতিপক্ষ ভাবেননি। বরং নারীর প্রতি নিজের মুখাপেক্ষিতার ব্যাপারে তিনি সচেতন ছিলেন। স্বাভাবিক যে, যে-কোনো সকাম পুরুষ নারীসঙ্গ আকাঙ্ক্ষা করবে এবং সংগমের মধ্য দিয়ে শারীরিক সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা করবে। পুরুষ ভালোবাসে নারীর দেহসৌষ্ঠব, নারীর রমণীয় অঙ্গভঙ্গি, নারীর চিকন কণ্ঠস্বর ও মোহনীয় বাকভঙ্গি, কিন্তু সে কখনও নিজে নারী হয়ে উঠতে চায় না।
স্বকামের মধ্য দিয়ে যে যৌনতৃপ্তি ঘটে তা নারীসংগমের বিকল্প হতে পারে না। সক্ষম পুরুষ নারীসঙ্গ কামনা করে। জীবনানন্দ দাশের শরীরবৃত্তি এর ব্যতিক্রম ছিল না। অথচ তার দাম্পত্য জীবনের গোড়ার দিকেই জীবনানন্দ একা হয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালের দিনলিপিতে জীবনানন্দ আক্ষেপ ক'রে লিখেছেন, (জেওয়াই এর কথা স্মরণ করে) অবিরল স্বকাম তাকে দ্রুত বার্ধক্যের পথে নিয়ে গেছে।
অনেকে তার কাছে এর-ওর গোপন অভিসারের কথা বলত। কিন্তু জীবনানন্দ কেবল যৌনমিলনের জন্য উদগ্রীব ছিলেন, তা নয়। তিনি ভালোবাসা চেয়েছিলেন। একটি সময় ছিল যখন প্রতি রাতে তিনি আত্মহননের কথা ভাবতেন। ছয়টি কারণ তিনি উল্লেখ করেছেন দিনলিপিতে। তার চতুর্থটি হলো- 'নারী নেই, ভালোবাসা নেই।' বাসে চড়তে এ রকম অনেক নারী তিনি দেখেছেন যাদের কামনা করা যায়; কিন্তু তাদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া ও সম্পর্ক গড়ে তোলার পথ তার জানা ছিল না। একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন- 'কোনো কোনো অঘ্রানের পথে পায়চারি করা শান্ত মানুষের/ হৃদয়ের পথে ছাড়া মৃতেরা কোথাও নেই বলে মনে হয়/ তাহলে মৃত্যুর আগে আলো অন্ন আকাশ নারীকে কিছুটা সুস্থিরভাবে পেলে ভালো হত।' (১৯৪৬-৪৭)
দিনলিপিতে তিনি চার শ্রেণির নারীর কথা উল্লেখ করেছেন : হেরোডিয়াসের কন্যারা, বনলতা সেন, কাল্পনিক নারী এবং বাসে দেখা কামিনীরা।
জীবনানন্দের কাল্পনিক নারীদের কথা আমরা জানি। নানা নামে তারা জীবনানন্দের কবিতায় এসেছে। নানাভাবে নারীকে উপস্থাপন করেছেন জীবনানন্দ তাঁর কবিতায়। 'নগ্ন নির্জন হাত' কবিতায় লিখেছেন, 'আবার আকাশে অন্ধকার ঘন হয়ে উঠছে/ আলোর রহস্যময়ী সহোদরার মতো এই অন্ধকার/ যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে/ অথচ যার মুখ আমি কোনোদিন দেখিনি/ সেই নারীর মতো/ ফাল্কগ্দুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হয়ে উঠেছে।'
'সুরঞ্জনা' কবিতায় লিখেছেন- 'সুরঞ্জনা, আজও তুমি আমাদের পৃথিবীতে আছ/ পৃথিবীর বয়সিনী তুমি এক মেয়ের মতন/ কালো চোখ মেলে ঐ নীলিমা দেখেছ/ গ্রীক-হিন্দু-ফিনিশিয় নিয়মের রূঢ় আয়োজন শুনেছ ফেনিল শব্দে তিলোত্তমা-নগরীর গায়ে/ কী চেয়েছে? কী পেয়েছে?-গিয়েছে হারায়ে।"
'মিতভাষণ' কবিতায় লিখেছেন- 'তোমার সৌন্দর্য নারী, অতীতের দানের মতন/ মধ্যসাগরের কালো তরঙ্গের থেকে/ ধর্মশোকের স্পষ্ট আহ্বানের মতো/ আমাদের নিয়ে যায় ডেকে/ শান্তির সঙ্ঘের দিকে-ধর্মে-নির্বাণে/ তোমার মুখের স্নিগ্ধ প্রতিভার পানে।'
আরেকটি কবিতায়- 'আমরা জটিল ঢের হয়ে গেছি- বহুদিন পুরাতন গ্রহে বেঁচে থেকে/ যদি কেউ বলে এসে : 'এই সেই নারী/ একে তুমি চেয়েছিলে; এই সেই বিশুদ্ধ সমাজ-'/ তবুও দর্পণে অগ্নি দেখে কবে ফুরায়ে গিয়েছে কার কাজ।'
এ রকম অসংখ্যা উদাহরণ দেওয়া সম্ভব জীবনানন্দের কাব্যসমগ্র ঘেঁটে।
হেরোডিয়াসের কন্যা ছিল একজন, সালোমে। সেইন্ট জনের হত্যায় সালোমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। জীবনানন্দের সালোমে দুইজন- একজন ওয়াই অর্থাৎ বেবী বা শোভনা। অপরজনকে জেওয়াই বলে উল্লেখ করেছেন জীবনানন্দ। এদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে গেলে জীবনটা আরও তিক্ত হয়ে ওঠে। মরে যেতে ইচ্ছে করে। একদিন রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে জীবনানন্দ তাঁর জীবনের হতাশার আটটি কারণ উল্লেখ করেছেন; যার মধ্যে একটি হলো নারী, যাদের মধ্যে হেরোডিয়াসের কন্যারা অন্যতম।
এ প্রসঙ্গে 'লোকেন বোসের জার্নাল' কবিতার কথা মনে পড়ে। কবিতাটি শুরু হয়েছে একটি স্বগতোক্ত প্রশ্ন দিয়ে- 'সুজাতাকে ভালোবাসতাম আমি/ এখনো কি ভালোবাসি?' কিছু পরেই সুবলের প্রেমিকা অমিতা সেনের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে জীবনানন্দ লিখেছেন- 'কিন্তু কথাটা থাক।' কিন্তু আমাদের বুঝতে সমস্যা হয় না এই অমিতা সেনের প্রতিও কবির অনুরাগ অঙ্কুরিত হয়েছিল। 'সুজাতা এখন ভুবনেশ্বরে' এই তথ্যটি পরিবেশনের সঙ্গে সঙ্গে তাই প্রশ্নবোধক স্বগতোক্তিটিও শ্রুত হয় 'অমিতা কি মিহিজামে'। একই কবিতায় দুই নারীর প্রতি অনুরাগ প্রকাশের উদাহরণ অন্য কারো কবি রাখেননি।
জীবনানন্দের অস্তিত্বে নারীশূন্যতা হতে দেয়নি যা তিনি হতে পারতেন। তার জীবনকে অপূর্ণ করে রেখেছিল নারীসঙ্গহীনতা। পরমেশ্বর আদমের নিঃসঙ্গতা ঘোচাতে হাওয়াকে সৃষ্টি করেছিলেন। জীবনানন্দের জন্য কাউকে সৃষ্টি করেননি তিনি?
তুমি যে শরীর নিয়ে রয়ে গেছ, সেই কথা সময়ের মনে
জানাবার আধার কি একজন পুরুষের নির্জন শরীরে
একটি পলক শুধু-হৃদয়বিহীন সব অপার আলোকবর্ষ ঘিরে?
অধঃপতিত এই অসময়ে কে-বা সেই উপচার পুরুষমানুষ?-
ভাবি আমি-জানি আমি, তবু
সে কথা আমাকে জানাবার
হৃদয় আমার সেই-
যে-কোনো প্রেমিক আজ এখন আমার
দেহের প্রতিভূ হয়ে নিজের নারীকে নিয়ে পৃথিবীর পথে
একটি মুহূর্তে যদি আমার অনন্ত হয় মহিলার জ্যোতিস্কজগতে।
('সূর্য্য নক্ষত্র নারী')
বিংশ শতাব্দীর শুরু অবধি কৌটিল্যের গ্রন্থ 'কৌটিলীয়ম অর্থশাস্ত্রম' সাধারণ মানুষের নিকটলভ্য ছিল না। ১৯০৯ সালে শ্যামশাস্ত্রী মহোদয় আবিস্কারপূর্ব এই বিখ্যাত গ্রন্থও প্রকাশ করেন। এরপর নানা পণ্ডিত কর্তৃক সংস্কৃত থেকে এটি নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে। কোনো কোনো বাঙ্গালী সংস্কৃত না জেনেও এ গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন। কৌটিল্য তথা চাণক্য তথা বাৎসায়ন কবে কোন্ কালে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং গ্রন্থ রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন তা আমাদের বিচার্য বিষয় নয়। তার জন্ম মৌর্য যুগে হয়ে থাকুক কি যিশুখ্রিষ্টের জন্মের পরবর্তীকালে হয়ে থাকুক, তাতে এ গ্রন্থের বনেদি কৌলিন্য বিন্দুমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। বাংলায় লিখিত রাধাগোবিন্দ বসাক মহাশয়ের 'কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্র' গ্রন্থটি আপনারা কেউ কেউ ইতোমধ্যে পাঠ করে থাকবেন। যারা করেননি, বলা অন্যায্য হবে না, তারা এ গ্রন্থে নিহিত রসমঞ্জরী থেকে আপনাদের বঞ্চিত করে রেখেছেন।
এই গ্রন্থ সম্বন্ধে সাধারণ ধারণা এই যে এটি প্রাচীন ভারতীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান মাত্র। অনেকের ধারণা, এটি ম্যাকিয়াভেলির 'দ্য প্রিন্স' জাতীয় একখানা কিতাব। কিন্তু কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র একটি রসময় গ্রন্থ যার বিষয়পরিধি বিস্তৃত। অন্যান্য চিত্তাকর্ষক বিষয়ের মধ্যে এতে রয়েছে, উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বিধবা রমণীর দ্বিতীয়বার পতি গ্রহণের অধিকার সংক্রান্ত বিধান, স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে শাসন ও শাস্তি প্রদান, প্রবাসী স্বামীর জন্য স্ত্রী কতকাল অপেক্ষা করবেন তার বিধান, স্ত্রী-সংগমের নিয়মকানুন, বৈবাহিক সম্বন্ধে আবদ্ধ হওয়ার উপযুক্ত বয়স, স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহের অধিকার, গণিকাদের বিষয়ে বিধিনিষেধ ইত্যাদি।
যারা ভেবেছেন কূট কিংবা কুটিল শব্দের সঙ্গে কৌটিল্য নামের সম্বন্ধ রয়েছে, তাদের সম্যক অনুধাবনের স্বার্থে একটি প্রশ্ন উত্থাপন করছি। ভেবে দেখুন, কোনো একজন ব্রাহ্মণ পুরুষের বহু সংখ্যক বালিকা স্ত্রী রয়েছে। ধরুন, প্রকৃতির ক্রীড়ায় সেসব বালিকা স্ত্রী একই সঙ্গে ঋতুমতী হয়েছে। এখন বলুন, সর্বপ্রথম কোন্ স্ত্রীর সঙ্গে যৌনসংগম করা উক্ত ব্রাহ্মণের জন্য ন্যায্য হবে?
প্রশ্নটি সহজ কিছু নয়। কারণ, এতে ন্যায়পরায়ণতা জড়িত। মহামতি কৌটিল্য এই প্রশ্নের সদুত্তর প্রদান করে বলেছেন, এবম্বিধ ক্ষেত্রে উক্ত ব্রাহ্মণ প্রথম যৌনসংগমের ক্ষেত্রে স্ত্রীগণের শ্রেণিগত অবস্থান মান্য করিবেন। তদুপরি, দুইজন বালিকা স্ত্রী যদি সমশ্রেণির হইয়া থাকে, তবে অগ্রে যাহাকে বিবাহ করা হইয়াছে, ব্রাহ্মণ স্বামী প্রথমত তাহাতে উপগত হইবেন।
যদি কোনো গ্রিক কবি এ কথাটিই তার কবিতায় লিখতেন তবে কি তাতে আরিস্তোতলের কথা উল্লিখিত হতো? কোনো গ্রিক কবি কি আরাধ্য, কি অনারাধ্য কোনো গ্রিক নারীর শরীরে আবিস্কার করতে পেরেছিলেন আরিস্তোতলের চেয়ে বেশি জ্ঞান?
কৌটিল্য তার অর্থশাস্ত্রে নানারকম চিন্তার জন্ম দিয়েছেন। কৌটিল্য ছাড়াও আরও নানাজনের পাণ্ডিত্যের কথা ভারতবর্ষের ইতিহাসে পুনঃপুন উচ্চারিত হয়ে থাকে। তবে জীবনানন্দ দাশ বেছে নিয়েছেন কৌটিল্যকেই। যে রকম ছান্দসিকতা জীবনানন্দের বৈশিষ্ট্য ছিল তার কাঠামোতে নামটি মসৃণভাবে খাপ খেয়ে গেছে।
নারীর শরীরে কৌটিল্যের চেয়ে বেশি জ্ঞান- এ কথা লিখে জীবনানন্দ তাঁর নারীবিষয়ক ধারণার নতুন পরিচয় দিয়েছেন। এটি একটি অসাধারণ বাকপ্রতিমা। এর মধ্যে যে কূটাভাষ নিহিত তা মনোজ্ঞ। মস্তিস্ক নয় বরং জীবনানন্দ জ্ঞানের সন্ধান পেয়েছেন নারীর দেহবল্লরীতে।
আজকের পৃথিবীতে কিছু মানুষ নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলে। তারা সমাজে পুরুষের আধিপত্য লক্ষ্য করে দুশ্চিন্তিত হয়ে থাকে। তারা নারীর সামাজিক অবস্থান নিয়ে চিন্তিত থাকতে ভালোবাসে। তারা মনে করে নারী ঘরের বাইরে এলে তবেই সমাজের উন্নতি। তারা পরিবারের কথা উহ্য রাখে। তাদের কাছে মনে হয় নারী পুরুষের শত্রু। তাদের কাছে মনে, পুরুষ নারীকে ভয় পায় পাছে নারী বলশালী হয়ে পুরুষকে ক্ষমতাচ্যুত করে ফেলে।
জীবনানন্দ কখনও নারীকে নিজের প্রতিপক্ষ ভাবেননি। বরং নারীর প্রতি নিজের মুখাপেক্ষিতার ব্যাপারে তিনি সচেতন ছিলেন। স্বাভাবিক যে, যে-কোনো সকাম পুরুষ নারীসঙ্গ আকাঙ্ক্ষা করবে এবং সংগমের মধ্য দিয়ে শারীরিক সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা করবে। পুরুষ ভালোবাসে নারীর দেহসৌষ্ঠব, নারীর রমণীয় অঙ্গভঙ্গি, নারীর চিকন কণ্ঠস্বর ও মোহনীয় বাকভঙ্গি, কিন্তু সে কখনও নিজে নারী হয়ে উঠতে চায় না।
স্বকামের মধ্য দিয়ে যে যৌনতৃপ্তি ঘটে তা নারীসংগমের বিকল্প হতে পারে না। সক্ষম পুরুষ নারীসঙ্গ কামনা করে। জীবনানন্দ দাশের শরীরবৃত্তি এর ব্যতিক্রম ছিল না। অথচ তার দাম্পত্য জীবনের গোড়ার দিকেই জীবনানন্দ একা হয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালের দিনলিপিতে জীবনানন্দ আক্ষেপ ক'রে লিখেছেন, (জেওয়াই এর কথা স্মরণ করে) অবিরল স্বকাম তাকে দ্রুত বার্ধক্যের পথে নিয়ে গেছে।
অনেকে তার কাছে এর-ওর গোপন অভিসারের কথা বলত। কিন্তু জীবনানন্দ কেবল যৌনমিলনের জন্য উদগ্রীব ছিলেন, তা নয়। তিনি ভালোবাসা চেয়েছিলেন। একটি সময় ছিল যখন প্রতি রাতে তিনি আত্মহননের কথা ভাবতেন। ছয়টি কারণ তিনি উল্লেখ করেছেন দিনলিপিতে। তার চতুর্থটি হলো- 'নারী নেই, ভালোবাসা নেই।' বাসে চড়তে এ রকম অনেক নারী তিনি দেখেছেন যাদের কামনা করা যায়; কিন্তু তাদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া ও সম্পর্ক গড়ে তোলার পথ তার জানা ছিল না। একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন- 'কোনো কোনো অঘ্রানের পথে পায়চারি করা শান্ত মানুষের/ হৃদয়ের পথে ছাড়া মৃতেরা কোথাও নেই বলে মনে হয়/ তাহলে মৃত্যুর আগে আলো অন্ন আকাশ নারীকে কিছুটা সুস্থিরভাবে পেলে ভালো হত।' (১৯৪৬-৪৭)
দিনলিপিতে তিনি চার শ্রেণির নারীর কথা উল্লেখ করেছেন : হেরোডিয়াসের কন্যারা, বনলতা সেন, কাল্পনিক নারী এবং বাসে দেখা কামিনীরা।
জীবনানন্দের কাল্পনিক নারীদের কথা আমরা জানি। নানা নামে তারা জীবনানন্দের কবিতায় এসেছে। নানাভাবে নারীকে উপস্থাপন করেছেন জীবনানন্দ তাঁর কবিতায়। 'নগ্ন নির্জন হাত' কবিতায় লিখেছেন, 'আবার আকাশে অন্ধকার ঘন হয়ে উঠছে/ আলোর রহস্যময়ী সহোদরার মতো এই অন্ধকার/ যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে/ অথচ যার মুখ আমি কোনোদিন দেখিনি/ সেই নারীর মতো/ ফাল্কগ্দুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হয়ে উঠেছে।'
'সুরঞ্জনা' কবিতায় লিখেছেন- 'সুরঞ্জনা, আজও তুমি আমাদের পৃথিবীতে আছ/ পৃথিবীর বয়সিনী তুমি এক মেয়ের মতন/ কালো চোখ মেলে ঐ নীলিমা দেখেছ/ গ্রীক-হিন্দু-ফিনিশিয় নিয়মের রূঢ় আয়োজন শুনেছ ফেনিল শব্দে তিলোত্তমা-নগরীর গায়ে/ কী চেয়েছে? কী পেয়েছে?-গিয়েছে হারায়ে।"
'মিতভাষণ' কবিতায় লিখেছেন- 'তোমার সৌন্দর্য নারী, অতীতের দানের মতন/ মধ্যসাগরের কালো তরঙ্গের থেকে/ ধর্মশোকের স্পষ্ট আহ্বানের মতো/ আমাদের নিয়ে যায় ডেকে/ শান্তির সঙ্ঘের দিকে-ধর্মে-নির্বাণে/ তোমার মুখের স্নিগ্ধ প্রতিভার পানে।'
আরেকটি কবিতায়- 'আমরা জটিল ঢের হয়ে গেছি- বহুদিন পুরাতন গ্রহে বেঁচে থেকে/ যদি কেউ বলে এসে : 'এই সেই নারী/ একে তুমি চেয়েছিলে; এই সেই বিশুদ্ধ সমাজ-'/ তবুও দর্পণে অগ্নি দেখে কবে ফুরায়ে গিয়েছে কার কাজ।'
এ রকম অসংখ্যা উদাহরণ দেওয়া সম্ভব জীবনানন্দের কাব্যসমগ্র ঘেঁটে।
হেরোডিয়াসের কন্যা ছিল একজন, সালোমে। সেইন্ট জনের হত্যায় সালোমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। জীবনানন্দের সালোমে দুইজন- একজন ওয়াই অর্থাৎ বেবী বা শোভনা। অপরজনকে জেওয়াই বলে উল্লেখ করেছেন জীবনানন্দ। এদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে গেলে জীবনটা আরও তিক্ত হয়ে ওঠে। মরে যেতে ইচ্ছে করে। একদিন রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে জীবনানন্দ তাঁর জীবনের হতাশার আটটি কারণ উল্লেখ করেছেন; যার মধ্যে একটি হলো নারী, যাদের মধ্যে হেরোডিয়াসের কন্যারা অন্যতম।
এ প্রসঙ্গে 'লোকেন বোসের জার্নাল' কবিতার কথা মনে পড়ে। কবিতাটি শুরু হয়েছে একটি স্বগতোক্ত প্রশ্ন দিয়ে- 'সুজাতাকে ভালোবাসতাম আমি/ এখনো কি ভালোবাসি?' কিছু পরেই সুবলের প্রেমিকা অমিতা সেনের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে জীবনানন্দ লিখেছেন- 'কিন্তু কথাটা থাক।' কিন্তু আমাদের বুঝতে সমস্যা হয় না এই অমিতা সেনের প্রতিও কবির অনুরাগ অঙ্কুরিত হয়েছিল। 'সুজাতা এখন ভুবনেশ্বরে' এই তথ্যটি পরিবেশনের সঙ্গে সঙ্গে তাই প্রশ্নবোধক স্বগতোক্তিটিও শ্রুত হয় 'অমিতা কি মিহিজামে'। একই কবিতায় দুই নারীর প্রতি অনুরাগ প্রকাশের উদাহরণ অন্য কারো কবি রাখেননি।
জীবনানন্দের অস্তিত্বে নারীশূন্যতা হতে দেয়নি যা তিনি হতে পারতেন। তার জীবনকে অপূর্ণ করে রেখেছিল নারীসঙ্গহীনতা। পরমেশ্বর আদমের নিঃসঙ্গতা ঘোচাতে হাওয়াকে সৃষ্টি করেছিলেন। জীবনানন্দের জন্য কাউকে সৃষ্টি করেননি তিনি?
তুমি যে শরীর নিয়ে রয়ে গেছ, সেই কথা সময়ের মনে
জানাবার আধার কি একজন পুরুষের নির্জন শরীরে
একটি পলক শুধু-হৃদয়বিহীন সব অপার আলোকবর্ষ ঘিরে?
অধঃপতিত এই অসময়ে কে-বা সেই উপচার পুরুষমানুষ?-
ভাবি আমি-জানি আমি, তবু
সে কথা আমাকে জানাবার
হৃদয় আমার সেই-
যে-কোনো প্রেমিক আজ এখন আমার
দেহের প্রতিভূ হয়ে নিজের নারীকে নিয়ে পৃথিবীর পথে
একটি মুহূর্তে যদি আমার অনন্ত হয় মহিলার জ্যোতিস্কজগতে।
('সূর্য্য নক্ষত্র নারী')
মন্তব্য করুন