একজন লেখককে নানা বিষয়ে পাঠ নিতে হয় বলে কোনো ধরাবাঁধা নিয়মের মধ্যে তাঁর পাঠপরিক্রমা আবর্তিত হয় না। এই ক্ষেত্রে তিনি হয়ে ওঠেন এক পরিযায়ী পাখির মতো- বাঁচার জন্য অনুকূল পরিবেশ খুঁজতে এক আকাশ থেকে আরেক আকাশে তাঁর উড়ে চলা নিরন্তর। সেই উড়ালের বিভিন্ন পর্যায়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে করতে লেখক-জীবনের প্রয়োজন এবং ক্ষুধার অন্নের সংস্থান তিনি করে থাকেন, অন্তত আমার অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। এমনই উড়ালের এক সন্ধ্যায় আমি সন্ধান পাই লতিফুল কবিরের 'হাজার বছরের বাংলাদেশ ইতিহাসের পাঠবৈচিত্র্য' শিরোনামের গবেষণামূলক গ্রন্থটি। 
বইটি একটি পরিপূর্ণ ঐতিহাসিক প্যাকেজ। অভিপ্রয়াণ প্রবণতা যে মানবজাতির প্রকৃতিগত আর এই বহমানতায় কীভাবে একটি জাতি আরেকটি জাতির ওপর আধিপত্য সৃষ্টি করেছে, একটি জাতির ওপর আরেকটি জাতির গল্পগুলো কেমন করে পাল্টে গিয়ে বসে গেছে- এসব গল্পের মধ্য দিয়ে তিনি মানবজাতির দখলদারিত্বসুলভ মনস্তত্ত্বসহ বিজয়ী ও পরাজিতের অন্তর্গত নিগূঢ় চিত্র এঁকেছেন।
বইটিতে বিস্তৃত ভূমিকায় বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্রটির বীজ কোথায় লুকিয়ে ছিল তার সন্ধান মেলে। একজন বঙ্গবন্ধুর জন্ম যে আকস্মিক নয়, এর পেছনে রয়েছে হাজার বছরের চেতনাপ্রবাহ, লেখক এ অনুধাবন পাঠকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। মানব প্রজাতির সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের ইতিহাসের বিবর্তনমূলক বিতর্ক ও বৈচিত্র্যের মধ্যে সেতু জুড়েছেন। এই সকল বিতর্ক বা বৈচিত্র্যের পেছনের কারণগুলো সন্ধানসূত্রে তিনি ছোট ছোট গল্পের অবতারণা করেছেন। ক্লান্তিকর ইতিহাস পাঠ থেকে দিয়েছেন মুক্তি।
প্রথম অধ্যায়ে 'ইতিহাসের পাঠবৈচিত্র্যের নেপথ্য কথা' পর্বে  ইউরোপিয়ান রেনেসাঁসের প্রসঙ্গ টেনে নিয়ে এসে ব্যক্তির অনুভূতির দ্বারা কীভাবে সত্য প্রকাশের ধারণা দেওয়া হয়েছিল সেই গল্পটি বলতে গিয়ে তিনি নতুন গল্প হাজির করে দেখিয়েছেন, ভোট দেওয়ার মাধ্যমে সেরা ব্যক্তি যাচাইয়ের যে প্রক্রিয়া তা কীভাবে অপরাপর মানুষের অনুভূতিগুলোতে কাজ করতে থাকে এবং এর দ্বারা বিশেষ কোনো একজনের অনুভূতির প্রাধান্য থেকে বেরিয়ে এসে সমষ্টির প্রাধান্য জয়লাভ করে। এর মাধ্যমে প্রজাতন্ত্রের কাঠামোতে নির্বাচনের দ্বারা কেমন করে জনগণের অনুভূতি-জগতের সার্বভৌমত্বের প্রয়োগ ঘটে। 
ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সময়কালে বণিকের তরী বেয়ে করপোরেট অর্থনীতি কীভাবে বিস্তার লাভ করল আর মানুষের ভেতরে করপোরেটের সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ কৌশলী পন্থাগুলো কেমন করে কাজ করতে শুরু করল, নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পেছনে ফেলে মীরজাফরকে ব্যবহার করে বাংলার শাসনদণ্ড কেমন করে ইংরেজদের হাতে চলে গেল তা তুলে ধরেছেন। প্রতিটি অধ্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের প্রসঙ্গ এনে আবার এক সূক্ষ্ণ জালে তা একীভূত করে বুনে দেওয়া হয়েছে।
মানব প্রজাতির গতিপথ কতভাবে বদলে গিয়ে কত রূপ ধারণ করতে পারে আর সেখানে মানুষের ডিএনএর গঠন থেকে শুরু করে বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের ধারাবাহিকতা, জীবন, সমাজ, ধর্মগ্রন্থ কিংবা রাষ্ট্রকাঠামো, আইন, বর্ণবাদ, ভারতবর্ষে বিভিন্ন জাতির শাসনপর্যায়, বিপ্লব, ইতিহাস ও ইতিহাসবিকৃতি, নগরসভ্যতা, অর্থনীতির গতিপথ ধরে সমসাময়িক সমাজের জীবনচিত্র নিয়ে এর পেছনের নানারকমের কারণ বিশ্নেষণের মাধ্যমে বিস্তারিত বিষয়সহ গুরুত্বপূর্ণ এবং রূঢ় বিষয়গুলো নিয়ে মানব প্রজাতির কল্পনা করার ক্ষমতা কীভাবে তারা ব্যবহার করে অন্যান্য প্রজাতির ওপর কীভাবে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে তা এমনভাবে আলোচনা করেছেন যে মনে হবে এক কল্পনার জগতে তিনি পাঠককে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন, সেখানে বিভিন্ন সময়ে মনুষ্য-কল্পনাসৃষ্ট দেবদেবতারা কীভাবে এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে পরিযায়ী হয়ে ধর্মগ্রন্থে স্থায়ী আসন গেড়ে বসেছেন তার খুব চমৎকার আলোচনা আছে। এখানে এর একটি উদ্ৃব্দতি দিতে চাই-
'বেদের উৎপত্তি কৃষিসভ্যতা পরবর্তী নগরসভ্যতার সময়। ইরান এবং মধ্য এশিয়ার স্তেপ অঞ্চল থেকে দলে দলে মানুষ সিন্ধু উপত্যকায় পৌঁছে এবং হরপ্পার গোড়াপত্তন ও বিকাশের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে। তারা তাদের সঙ্গে সেই ভূমির দেবতাকেও নিয়ে আসে, তেমন একজন দেবতা হচ্ছেন অগ্নিদেব, যাকে পরিযায়ীরা ইরান থেকে হরপ্পায় নিয়ে আসে এবং বেদে তা টিকে থাকে।' [পৃষ্ঠা নম্বর-৪৬] 
দেবদেবতা ও কল্পজগৎকে পেছনে রেখে এবার আসা যাক বাস্তব জীবনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয় টাকার সামনে, যেখানে মুদ্রা নামক শব্দটি একই সঙ্গে কেমন ভয়ংকর এবং মনোরম আর সেটার সাথে অন্তরালে যুক্ত হয়ে আছে মানুষের বিশ্বাসকে ব্যবহার করার সর্বগ্রাসী রূপটির  উন্মোচনের মাধ্যমে লেখক আজকের পৃথিবীতে 'অর্থ' নামক সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এক ঈশ্বরকে হাজির করে দিয়েছেন। এখানেও আরেকবার উদ্ৃব্দতি দেবার তাগিদ অনুভব করছি। 
'মুদ্রার প্রচলন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পথকে সুগম করেছিল এবং সাম্রাজ্যের হাত দিয়ে মুদ্রার একটি বৈশ্বিক পথ উন্মুক্ত হয়েছিল। কথায় বলে টাকার কোনো জাতপাত নাই। আসলে টাকার কোনো ধর্মও নাই। জঙ্গি অথবা সাধু সকলের কাছে টাকার গ্রহণযোগ্যতা সমান; টাকার এই সর্বজনীন বিশ্বাসযোগ্যতা  মানব প্রজাতির হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বিস্ময়কর গঠনা, য মানবসমাজকে একত্রিত করার  সবচেয়ে বড় অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে বললে ভুল হবে না।  ইতিহাসবিদ এবং দার্শনিক ইউভাল নোয়া হারারির মতে, টাকা হচ্ছে জগতের  সকল মানুষের সর্বজনীন ও সর্ববৃহৎ সমন্বিত বিশ্বাসের আধার। আজকের দিনে বেশিরভাগ লেনদেন করা হচ্ছে ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতি বা চেকের মাধ্যমে। ব্যাংকের খাতায় একজনের হিসাবের বিপরীতে যে টাকা দেখায়, সেই  সম্পদে বিশ্বাস নাই- এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। চাইলেই বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে একে নিয়ে যাওয়া যায়। অস্থাবর সম্পদের গল্পটি তৈরি হয়েছে যাকে কেন্দ্র করে, তার নাম ব্যাংক। [পৃষ্ঠা : ৬৮-৬৯] 
পৃথিবীর ইতিহাসের নানা পথ পেরিয়ে 'বাংলাদেশ : গঙ্গাঋদ্ধির পুনরুদ্ধার' পর্বে, একেবারে বাঙালির মনস্তত্ত্বের অন্দরমহলে প্রবেশ করেন লেখক। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের কাহিনি বলতে গিয়ে বাঙালির পরিচয়ের মূলে যেতে গিয়ে ফিরে গেছেন আজ থেকে ৭০০ বছর আগের ইতিহাসভূমিতে। আর সেই পথ ধরে একেবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে বাংলাদেশ নামের এই জাতিরাষ্ট্রের জন্মের ইতিহাস কীভাবে সৃষ্টি হলো তা যুক্ত করেছেন এবং দেখিয়েছেন এর আকর কোথায় লুকিয়ে ছিল। কিংবা বাংলাদেশ যে রাতারাতি সৃষ্টি হয়ে যায়নি, তার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন অত্যন্ত নিপুণভাবে। এখানে আবার একটু উদ্ৃব্দতি দেওয়া হলো-
'মহাপরাক্রমশালী সুলতান ফিরোজ শাহের ভয়ে ভারতবর্ষের সকল রাজ-রাজন্য তটস্থ, তাকেই কিনা ঠেকিয়ে দিয়েছে তিন খণ্ডে খণ্ডিত বাংলাদেশের এক খণ্ডের নৃপতি ইলিয়াস শাহ। আর কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি বাংলাদেশের অপর দুই খণ্ড যথাক্রমে সোনারগাঁও এবং লখনৌতিকে [বর্তমানে, পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া ও মুর্শিদাবাদ অঞ্চল] দিল্লির কবজা থেকে মুক্ত করে খণ্ডিত বাংলাদেশকে একত্রিত করেন। এ হচ্ছে মধ্যযুগে প্রথম বঙ্গভঙ্গ রদ। কিন্তু ইলিয়াসের সংকট অন্যখানে। একেই তুর্কি উত্তরাধিকার, আর সেনাদলে আছে একই আফগানি রক্তের সিপাই। তাহলে আলাদা সাম্রাজ্যকে কীভাবে দাঁড় করানো যাবে? সেজন্য ইলিয়াসকে বেছে নিতে হয়েছিল এমন এক পথ, তা তৎকালীন এশিয়া তো নয়ই, এমনকি ইউরোপেরও অজানা। সেটি হচ্ছে জনগণের আত্মপরিচয় ঠিক করা। প্রথমেই তার নজর গিয়েছিল সাধারণের মুখের ভাষার দিকে। ইলিয়াস শাহের বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, বাংলাদেশের মানুষ যে ভাষায় কথা বলে তা ভারতবর্ষের অন্যান্য জায়গা থেকে একেবারেই আলাদা। তাঁকে বলা হলো এই ভাষার নাম বাংলা। ইলিয়াস শাহ বললেন, তাহলে এই মুলুকের নাম বাংলা এবং এখন থেকে এই বাংলা মুলুকের মানুষের রাজনৈতিক পরিচয় বাঙালি। আর নিজের জন্য বেছে নিলেন শাহ-ই-বাঙালি উপাধি।'  [পৃষ্ঠা :২১৩-২১৪]
পৃথিবীজুড়ে পুরাণের জয়জয়কারের কারণে বেদে ঠাঁই পাওয়া দেবতাদের গল্প; অনুরূপভাবে কোরআন, বাইবেলসহ আরও অনেক ধর্মগ্রন্থের শৈল্পিক ঐতিহাসিক ব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে গল্পের পেছনের গল্প ইতিহাস ও রাজনীতির আড়ালের ব্যাখ্যা ও পুনর্ব্যাখ্যার পরত খুলতে খুলতে চলেছে বইটির পরিযাণ। বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ, সাংস্কৃতিক বুদ্ধিমত্তা ও শেষ কথা নামের তিনটি অধ্যায়ে তিনি বইটির শেষে স্থাপন করেছেন এবং সেই অধ্যায়গুলোতে একেবারে নিজের চৈতন্যগত মতামত প্রকাশ করেছে।
গ্রন্থটির প্রতিটি অধ্যায়কে গল্পরসে সিক্ত করে, গোটা পৃথিবীকে একত্রিত করে যেন একটি বইয়ে স্থান দেওয়া হয়েছে। অনুসন্ধিৎসু পাঠকের জন্য গ্রন্থটি উল্লেখযোগ্য।