- কালের খেয়া
- অবস্থাদৃষ্টে, ইন দ্য হিন্ডসাইট... পরিস্থিতি পর্যালোচনা প্রায়শই বুদ্ধিভ্রষ্টতার দলিল
প্রচ্ছদ
অবস্থাদৃষ্টে, ইন দ্য হিন্ডসাইট... পরিস্থিতি পর্যালোচনা প্রায়শই বুদ্ধিভ্রষ্টতার দলিল

এক। হরলালের চোরের জন্য মায়া
চোর সেখানে পালায়নি। ঠিক মনে পড়ে না কোন ক্লাসে থাকতে, তবে উচ্চতর কোনো একটা ক্লাসের ব্যাকরণ বইয়ের প্রতি আমার গাঢ় মনোযোগ ছিল। হয়তো উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের এই বই, যে বইটা বাড়িতেই ছিল। আর আমার মনোযোগ ছিল একদম এর মধ্যকার রচনাগুলোর কারণে। এই রহস্যের কোনোদিনই সুবিধাজনক কিনারা করতে পারিনি যে কেন ব্যাকরণ বইয়ে রচনাও দেওয়া থাকত। হতে পারে এগুলো ফাইনাল পরীক্ষার পত্র হিসাব করে বানানো হতো। যেহেতু দ্বিতীয় পত্র বলে একটা পরীক্ষা দেওয়া লাগত, আর সেই পরীক্ষায় রচনাধর্মী জিনিসপাতি থাকত ব্যাকরণের সমাধানের সাথে একত্র করে দেওয়া হতো, তাই ব্যাকরণ বইয়েও ভাব-সম্প্রসারণ, রচনা, সারাংশ এসব জুড়ে দেওয়া থাকত। বইটা ছিল হরলাল রায়ের রচিত, আর সেখানে একটা রচনা ছিল 'একটা/একজন চোরের আত্মকাহিনি'। একটা ছিল, নাকি একজন তাও এতদিন পর আর মনে পড়ে না।
চোরের আত্মকাহিনি যে কোনো চোর লেখেন নাই সেটা বড় হয়ে খুব সহজেই বুঝেছি। এমনকি এই চোর যে আসলে ছিঁচকে চোর সেসবও বুঝে নিতে অত সমস্যা হয়নি। তবে এত বছর ধরে যে কারণে রচনাটি মনের মধ্যে গেঁথে আছে, কোনো না কোনোভাবে, তার কারণ এই চোরের ব্যক্তিত্ব। এই চোর ধরা পড়ে যান এবং বেদম পিটুনি খান। পিটুনির পর তিনি তাঁর দারিদ্র্যের বয়ান দেন। সেই দারিদ্র্যের তীব্রতা কীভাবে তাঁকে এই নিরুপায় অথচ বিপজ্জনক পথে বেঁচে থাকার চেষ্টাতে টেনে আনে সেসব ব্যাখ্যা দেন। তাঁর পরিস্থিতির তীব্রতার পর চুরি-বিষয়ক ইথিক্সের গুরুতর সংকট আমার মনের মধ্যে দেখা দেয়। উত্তরকালে যে কোনো পিটুনিতেই আমার ভালো বোধ না করার যে অনুভূতি তৈরি হয়েছে তার সাথেও এই রচনার কোনো জটিল সম্ব্বন্ধ থাকতে পারে। আরও পরে যখন ছায়াছবিতে এবং থ্রিলার উপন্যাসে চৌকশ ও বড় মাপের চোরদের সাথে পরিচয় ঘটেছে, তখন কিছুতেই হরলাল রায়ের ক্রন্দনরত চোরকে আর মনে করতে পারিনি। 'ওশান' সিরিজের ওসব মণিমুক্তা, হীরা মুকুট চুরি-করা জর্জ কুলুনির চোর দল, কিংবা 'দ্য স্কোর' ছবির রবার্ট ডি নিরো বা এডওয়ার্ড নর্টনকে দেখলে হরলালের চোর নিজেও মনে রাখতে পারতেন না তাঁর পেশাচরিত্র কিংবা করুণ বিবরণীর কথা। তাছাড়া হরলালের চোর গোড়া থেকেই পালাতে অপারগ চোর। ছিঁচকে তো বটেই! কুলুনি বা ডি নিরোরা পর্দায় কেবল বড় বড় বস্তুতে হাত দেন বলেই নন, তাঁরা পালাতে পারেন বলেই মস্ত চোর। পালানোর সকল সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে পারা, এবং সেই সম্ভাবনার পথে পালাতে পারা চোরের সাফল্যের জন্য সাধারণ বিধিমালা। কিন্তু তার থেকেও এর বিশেষ গুরুত্ব আছে। এই পলায়ন চৌর্যকে মনুষ্য কল্পনায় একটা দুর্দান্ত শিল্পমর্যাদা এনে দেয়। সাহিত্য-চলচ্চিত্রের বৈশ্বিক কলাবিদ্যাতে এই মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত আছে। ফলে আর্ট বনাম ইথিক্সের একটা মজাদার খেলায় চুরির ক্রিয়াকর্ম ঘুরপাক খায়। ছোটখাটো চুরি একভাবে খায়, বড় চুরি আরেক মাত্রায় খায়।
দুই। লোভের গুড় পিঁপড়ায় খায় না
বাংলাদেশ এদিক থেকে একটা দুর্ভাগা দেশ। এখানে, অন্তত এখন, সফল চোরদের নিয়ে কোনোরকম আলাপ-আলোচনা অত্যন্ত কঠিন হয়ে গেছে। মানুষজন যে এসব সফল চোরের বীরত্ব নিয়ে দু'কথা বলবেন কিংবা সেসব বীরকে শিল্পমর্যাদা দিয়ে গ্রহণ করবেন, সে সুযোগ নেই বললেই চলে। বরং মানুষজনের সেসব সম্ভাব্য আলাপ-আলোচনাকে দেখা হয় অমর্যাদা হিসেবে। ব্যাংকিং বা বীমা খাতের টাকাপয়সা কিংবা স্টকমার্কেটের টাকাপয়সা কিংবা বিরাট বিরাট প্রকল্পের ফান্ড বেহাত হয়ে যাওয়া নিয়ে মানুষে কম কথা বলতে প্রণোদনা পান। একটা কারণ তো অবশ্যই অনেকেরই টাকা হারিয়েছে। তাঁদের পক্ষে বীরগাথার বিবরণী লেখার জন্য যথেষ্ট সংযত ও সাহিত্যরসাপ্লুত মন তৈরি করা কঠিন। অন্য যেসব মধ্যবিত্তের টাকাপয়সা ব্যাংকে বা লগ্নিতে রাষ্ট্রের কাছে রাখা আছে, তাঁরা সেসব টাকাপয়সা নিয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে আছেন 'কখন খোয়া যায়' এই ভয়ে। বস্তুত, যেসব সরকারি চাকুরিজীবী অবসরে যাবার পর বিধি অনুযায়ী টাকা পাবার কথা, তাঁদের মধ্যেও এই ভীতি লক্ষ্য করা যায়। যত সহজে এই কথা লিখলাম, বাস্তবে আমার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, ভীতির মাত্রা তার থেকে বহুগুণ তীব্র। এসব ভীতিসমেত সার্থক চোরের বিষয়ে গুণমুগ্ধ বিবরণী দেওয়া কঠিন। তবে এসব কারণের বাইরেও কারণ আছে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক আইনকানুন যেখানে গেছে তাতে কাউকে নিয়ে দু'কথা বলে যে মন শান্ত করবেন মানুষে, তার বন্দোবস্ত নেই। এখানে বড় মাপের সফল চোরদের নিয়ে কথা বলতে গেলেই মানহানির মামলা খেয়ে বসতে পারেন লোকজন। আর কথা যদি কোনো কারণে সাইবার স্পেসে বলেন তাহলে ডিজিটাল মামলাও খেয়ে ফেলতে পারেন। সংগঠক মুশতাকের মৃত পরিণতি থেকে কিংবা কার্টুনিস্ট কিশোরের জীবন্ত পরিণতি থেকে বা দেখে, মানুষজন আর যা-ই হোক, চোর-বিষয়ক শিল্প-সাহিত্যচর্চাকে আপন করে নিতে শেখেন নাই। সেদিক থেকে বাংলাদেশের মানুষজন এখন মা[ই]র আর মামলার মধ্যে সম্ভবত সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠতে পারেন না যে কোনটার প্রতি তাঁদের অধিক পক্ষপাত। সব মিলে বড় চোরদের নিয়ে শব্দচর্চার সাধারণ আয়োজন বাংলাদেশে বিরল মানতেই হবে। বাংলা সাহিত্যের জন্য এ একটা বিরাট ক্ষতি!
বাংলায় একটা প্রবাদ বেশ শুনতাম। হয়তো প্রথম শুনেছি বাবার মুখে- 'লাভের গুড় পিঁপড়ায় খায়'। এমনিতে প্রবাদ-প্রবচনের বিষয়ে জানাশোনার হাল খুবই খারাপ। গতকাল ক্লাসে 'ছাতু মাখাতে গিয়ে বিষ্ঠা মাখানো' এই প্রবাদটা ব্যবহার করেছিলাম। যদিও বিষ্ঠার চাইতে সংগত ও ন্যায্য শব্দ বাংলা শব্দভান্ডারে রয়েছে, তাও পত্রিকার পাঠকদের জন্য তৎসম শব্দটাই ঠিক মনে হলো। শিক্ষার্থীদের বড় অংশই ছাতু কী- তা চেনেন না। বাস্তবে তাঁদের ওপর রাগ করার অনেক কারণও খুঁজে পেলাম না। ততক্ষণে প্রবাদ ব্যবহার করার কারণে নিজের ওপরেই বিরক্ত হতে শুরু করেছি। এরপর ছাতু চেনানোর জন্য কিছু কসরত করতে হলো। কপালগুণে, ক্লাসে অন্য কিছু ছাতু-বিশেষজ্ঞ পাওয়া গেল। তাঁরা আমার কাজটাকে লাঘব করলেন। আমি সান্ত্বনা খুঁজে পেলাম- 'এখনও সব শেষ হয়ে যায় নাই!' সম্ভবত 'লাভের গুড় পিঁপড়ায় খায়' প্রবাদটাকে দেখতে হবে প্রাথমিকভাবে আক্ষেপ হিসেবে। গরিবের টানাটানির বাস্তবতা বা ডিসকোর্সের মধ্যে এর অধিষ্ঠান। একটু কোনো জায়গা থেকে কিছু পয়সাপাতি হাতে আসে, তাহলে আরেক জায়গায় এমন টানাটানি বেঁধে যায় যে সেই পয়সাটুকু তো যায়ই, আরও বেশি খরচা হয়ে যায়- এ রকম একটা দশার বিবরণী এটা। তবে আরও মনোযোগ দিয়ে ভাবলে এই প্রবাদের মধ্যে একটা অভিশাপ-ইচ্ছাও থাকতে পারে। 'তুই লাভ করলি, দ্যাখ কীভাবে তোর টাকাপয়সা নষ্ট হয়!' বলাই বাহুল্য, এই অভিশাপের বাস্তবতা যদি থেকেও থাকে, তা থাকার কথা অপেক্ষাকৃত ক্ষমতাবান ও বিপুলায়তন টাকা কামাইকারীদের বিপক্ষে। আরও সহজভাবে দেখলে, যেসব লোককে 'সাধারণ' মানুষজন জনস্বার্থের বিপক্ষীয় হিসাবে দেখে থাকেন, তাঁদের অর্জন তথা চুরির বিপক্ষে এ রকম অভিশাপ তাঁরা দিতে পারেন। তবে বাস্তবে বাংলাদেশের লোভী চোরবৃন্দ, যাঁদের কথা আলোচনা না-করাই মঙ্গলজনক, এসব অভিশাপের অনেক বাইরে থাকতে পারছেন।
তিন। হোজ্জা সাহেবের ন্যায্য প্রশ্ন
জানামতে নাসিরুদ্দিন হোজ্জাও চুরির শিকার হয়েছিলেন। তাঁর মতো চৌকশ বুদ্ধির লোকও, জানামতে, চুরির পর ভ্যাবলা মেরে গেছিলেন। সেটাই সংগত অবশ্য। তাঁর স্ট্রিটস্মার্ট ব্যক্তিত্ব বজায় থাকেনি। সেই সুযোগে বন্ধু-প্রতিবেশী নানান রকমের সওয়াল-জবাব, ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণ করতে শুরু করেছিলেন। অবশ্য চুরির পর সেইসব আচরণকে বৈশ্বিক বলেই মানতে হবে। হোজ্জা সাহেব যখন আবিস্কার করলেন তাঁর ঘরে চুরি গেছে, তখন তিনি বিলাপ বা চেঁচামেচি করতে শুরু করেন। তাতে লোকজন এসে জড়ো হয়। সকলেই তাঁকে চেনেন। সকলেরই তাঁর জন্য দুর্ভাবনা আছে হয়তো। হয়তো সেসব দুর্ভাবনা থেকেই তাঁরা পরিস্থিতি পর্যালোচনা শুরু করেন। আর হোজ্জাকে নানান কথা বলতে থাকেন : 'তোমার কিন্তু আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।' 'আহা! ঠিকমতো দরজা-জানালা দেখে যাবা না বাইরে?!', 'ঘরে পাহারা রাখো না কেন?', 'এই যে সারাদিন ঘুরে বেড়াও, চোর তো চুরি করবেই!' 'ঠিকমতো নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারো না?' ইত্যাদি। লোকজনের কথায় হোজ্জা চুরির বেদনা গেলেন ভুলে। তিনি তাঁর অন্যান্য সময়ের ব্যক্তিত্ব ফিরে পেলেন। তখন তিনি বললেন, 'ও! তোমাদের আলাপে যা বোঝা যাচ্ছে তাতে সব দোষই এখন আমার; আর যে লোকটা আমার বাসার সব জিনিসপত্তর নিয়ে পালাল, তার কোনোই দোষ তাহলে নেই?' এসব গল্পে সাধারণত পরের অংশ আর পাওয়া যায় না। জানা যায় না, হোজ্জার এই প্রশ্নের উত্তরে তাঁর প্রতিবেশী বন্ধুরা কী বলেছিলেন। তবে এটাও অসম্ভব না যে এই কথা বলে হোজ্জা আর সেখানে থাকেননি। বলে হাঁটা শুরু করে নিজ ঘর থেকেই চলে গেছিলেন। আমার হোজ্জার ওপর যে আস্থা, তাতে আমি নিশ্চিন্তে ভাবতে পারি যে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, 'যেহেতু আমার ঘরে চুরিযোগ্য আর জিনিসপত্র নাই, আর যেহেতু আমি ঠিকমতো নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারি নাই, আমি নতুন জিনিস কিনে আনতে গেলাম। আর তোমরাই এখন থেকে আমার ঘরের পাহারাদার।'
বাস্তবতা হলো, হোজ্জা বা অন্য কেউ, যিনিই চুরিকার্যে ক্ষতিগ্রস্ত তিনিই মারাত্মক তদন্তের মধ্যে পড়েন। সবচেয়ে স্কদ্ধুটিনাইজড লোকটাই বোধহয় তখন তিনি। তিনি যথাযথভাবে তাঁর গেরস্ত-কর্তব্য পালন করেছেন কিনা এই বিষয়ে এতসব ব্যাখ্যা এই বেচারার দিতে হয় যে তখন যদি তিনি ভেবে বসেন যে চুরির খবরটা লোককে জানিয়ে তিনি ঠিক করেননি, তাহলে তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না। আবার পর্যালোচকদেরও তেমন দোষ দেওয়া যায় না। আচ্ছামতো কথা শোনানোর জন্য তাঁরা চোরকে হাতের কাছে পাচ্ছেন না। আবার চোর যদি সেধে সেধে সামনে আসতেনও, মনে হয় না তিনি গেরস্তের বন্ধুদের বিলাপ বা পর্যালোচনা শুনবার মতো যথেষ্ট ধৈর্য বা কারণ খুঁজে পেতেন। তাছাড়া, চুরিকার্যের নৈতিকতার বিষয়ে বক্তৃতা তিনি তখন শুনতে যাবেন কেন? পর্যালোচকরা যদি নৈতিকতা বাদ দিয়ে তাঁর চৌর্য-দক্ষতা বিষয়ে বক্তৃতা শুনতে আশা করেন, সেটাই-বা তিনি শেয়ার করতে যাবেন কেন? আর এ বাদে থাকে গেরস্তের নিরাপত্তা কৌশলবৃদ্ধির লাগাতার পরামর্শ। এই পরামর্শগুলো মুফতে শুনতে পেলে চোরের মনভারের কারণ নেই। তবে ধারণা করা যায়, এসব পরামর্শ পারঙ্গম চোরের কাছে শিশুতোষ এবং হাস্যকর লাগে। ফলে যদি কোনো চুরি-উত্তর পর্যালোচনা-সভায় কোনো [ছোটখাটো/ছিঁচকে] চোর লুকিয়ে থেকে যান, তিনি বন্ধুসুলভ এসব পরামর্শ এবং গেরস্তকে বকাঝকা হাসি চেপে রেখে শুনতে থাকেন। আমার ধারণা, সুযোগ থাকলে, অনেক চোরই এ রকম একটা পরিস্থিতিতে ফিরে আসেন এবং মানুষজনের কাজকর্ম কথাবার্তা দেখতে ও শুনতে থাকেন। অন্তত আমি হলে তাই করতাম। আমার ধারণা, হোজ্জা সাহেবও তা জানেন, এবং তিনি নিজে হলেও তাই করতেন।
চার। বৌদ্ধিক বিপর্যয় ঠেকানোর মরিয়া চেষ্টা
চোর পালালে চুরিতে ক্ষতিগ্রস্ত লোকটা যা করতে থাকেন বা করতে থাকেন বলে সাহিত্য ও সমাজ-গল্পে বিবৃত হয়ে আছে, তা নিয়ে আসলে পুনর্তদন্তের সুযোগ আছে। আসলে অতি জরুরি সেই পুনর্তদন্ত। চুরিতে ক্ষতিগ্রস্ত লোকটার সম্পদের ক্ষতি গুরুতর। তবে আমি প্রস্তাব করছি যে এতে অধিকন্তু আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয় লোকটার বা লোকদের চিন্তার সংগঠন, কিংবা ইংরেজিতে যাকে বলে কম্পোজার। এই লোকগুলোর উত্তরকালের অনেকগুলো আচরণ ও কর্মকাণ্ডই আসলে এই সংগঠন-বিপর্যস্ততার কারণে ঘটে থাকে। তিনি বা তাঁরা যে এই বিপর্যয়ের পরে ঠিকঠাক আছেন, সংহত চিন্তার মালিক আছেন, সেটা প্রমাণের একটা গুরুতর চাপ এঁদের ওপর বর্তায়। চাপটা কে কোথা থেকে কী পরিমাণে দেন তা একেবারেই স্বতন্ত্র জিজ্ঞাসা; এবং আপাতত এই জিজ্ঞাসা নিয়ে আমি চিন্তিত নই। কিন্তু এই চাপটা তাঁরা সামলান। ওদিকে, যদি চুরিকার্যটা ঘটে থাকে আসলেই কিছু অসতর্কতার কারণে তাহলে এই চাপের কোনো শেষ নাই। ফলে বুদ্ধি যেসব প্রমাণ আমাদের তাঁরা দিতে থাকেন তা সেই অসতর্কতা নিয়ে লাগাতার পর্যালোচনার চাপ থেকে পরিত্রাণের জন্যই। মোটামুটি দুটো অংশ নিয়ে একটা প্রস্তাব আমার তাহলে। বিপর্যস্ততার কারণে চিন্তাসংহতি বিগড়ে যায়নি তার প্রমাণের চেষ্টা; আর অসতর্কতা এবং/বা কম দক্ষ গেরস্তির প্রমাণ হাতে পেয়ে সম্ভাব্য পর্যালোচনার হাত থেকে পরিত্রাণের চেষ্টা। এই হলো মোটামুটি চোর পালাবার পর গেরস্তের বুদ্ধি প্রমাণের মরিয়া দশার সারকথা। সকলেই তো আর হোজ্জা নন যে একবাক্যে সেরে দেবেন!
আচ্ছা চুরি মেলা হয়েছে। আমরা অন্যদিকে চোখ ফেরাই। পরিস্থিতির বিবরণী আর পর্যালোচনা নিয়ে ভাবি। খুব সরল করে যদি আমরা পেশাভেদে কার্যভেদ করি, তাহলে বিবরণীটা হচ্ছে সাংবাদিকীয় কাজ। আর পর্যালোচনাটা হচ্ছে বিশেষজ্ঞীয়-পণ্ডিতীয় কাজ। পরিস্থিতির উপশম হলো পরিকল্পনাবিদ অথবা রাজনীতিবিদের কাজ। অবশ্য বড় রাজনীতিকরা সব দায়িত্বই শেষ করে দিয়ে থাকেন। তাই তাঁদেরকে বাইরে রাখা যায় এই আলাপে। সাংবাদিকতার কাজের হরেক রকম ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণ, যাচাই-বাছাই, বিচার-তদন্ত আপনারা করতে পারেন। এমনকি তাঁদের মধ্যে কার কী নিয়ত, এসব নিয়েও নিন্দামন্দ বা বন্দনা করতে পারেন। কিন্তু সাংবাদিকতার জগতের লোক আপনাকে অনায়াসে বলে দিতে পারেন 'যা ঘটছে তাই-ই আপনারে কইলাম, এখন যান গিয়া'। এই সুযোগ জগতে বিশেষজ্ঞ-পণ্ডিতদের নাই। তাঁদের ঘ্যানরঘ্যানর করে বলতে হয়ে 'কেন ঘটেছে', এর প্রপঞ্চ-উপাদান কী, এর পরিপ্রেক্ষিত-অনুবর্তী কী। ফলে, এমনকি প্রাথমিক সংজ্ঞার দিক থেকেও বিশেষজ্ঞ-পণ্ডিতদের জব ডেসক্রিপশন যারপরনাই অসুবিধাজনক, ডিমান্ডিং। তাঁদের কার্যবিধির মধ্যেই ঘ্যানঘ্যানানির একটা বীজ পুরে দেওয়া আছে। ফলে বিচিত্র নয় যে পরিস্থিতি-পর্যালোচনা নিয়ে লোকজনের বিরক্তি ধরে যায়। এসব কারণেই হয়তো, যতক্ষণ না ঝগড়া বেধে যাচ্ছে, যেটাতে ক্রীড়াঙ্গনের উত্তেজনা পাওয়া যেতে পারে, টেলিভিশনের টক শোগুলোর সামনে সাধারণত বসে থাকেন ফ্ল্যাটবাড়ির সেইসব লোক, যাঁদের আর রিমোট চালানোর শক্তি অবশিষ্ট নাই। 'কেন ঘটেছে' আর 'কী হতে পারত' সিরিজের এই আলাপগুলো শুনতে থাকা মোটের ওপর বিশেষ শক্তিনাশ ঘটায় না [যদি না ঝগড়া বেধে যায়]।
মুশকিল হচ্ছে, প্রায়শই এই পর্যালোচনা করেন ঠিক সেই-সেই লোকজন, যে-যে লোকজন সংশ্নিষ্ট কর্মকাণ্ডগুলো ঘটিয়েছিলেন। তাতে গ্রাহককুলে একটা মারাত্মক ভেজাল বেধে যায়। যত বেশি বেশি ওসব মানুষ পর্যালোচনা করতে থাকেন, তত বেশি তাঁদের পর্যুদস্ত মনে হতে থাকে। বুদ্ধির প্রমাণের এসব চেষ্টা কুস্তির অধিক কিছু থাকে না। কুস্তি লড়ে যখন তাঁরা বুদ্ধির প্রমাণ দিতে থাকেন, ততই তাঁদের বুদ্ধিভ্রষ্টতার দলিল প্রকট হতে থাকে। বর্তমানের তিনিটা যত সরব হতে থাকেন, এতক্ষণ নীরব থাকা অতীতের তিনিটা ততই গরবহীন হতে থাকে। তাঁর বর্তমানের পর্যালোচনা অতীতের তিনিকে আমাদের লোচনযুক্ত করে তোলে। তাঁর কুস্তিতে আমাদের স্বস্তি ফিরে আসে না। আসলে তাঁরও আসে না।
চোর সেখানে পালায়নি। ঠিক মনে পড়ে না কোন ক্লাসে থাকতে, তবে উচ্চতর কোনো একটা ক্লাসের ব্যাকরণ বইয়ের প্রতি আমার গাঢ় মনোযোগ ছিল। হয়তো উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের এই বই, যে বইটা বাড়িতেই ছিল। আর আমার মনোযোগ ছিল একদম এর মধ্যকার রচনাগুলোর কারণে। এই রহস্যের কোনোদিনই সুবিধাজনক কিনারা করতে পারিনি যে কেন ব্যাকরণ বইয়ে রচনাও দেওয়া থাকত। হতে পারে এগুলো ফাইনাল পরীক্ষার পত্র হিসাব করে বানানো হতো। যেহেতু দ্বিতীয় পত্র বলে একটা পরীক্ষা দেওয়া লাগত, আর সেই পরীক্ষায় রচনাধর্মী জিনিসপাতি থাকত ব্যাকরণের সমাধানের সাথে একত্র করে দেওয়া হতো, তাই ব্যাকরণ বইয়েও ভাব-সম্প্রসারণ, রচনা, সারাংশ এসব জুড়ে দেওয়া থাকত। বইটা ছিল হরলাল রায়ের রচিত, আর সেখানে একটা রচনা ছিল 'একটা/একজন চোরের আত্মকাহিনি'। একটা ছিল, নাকি একজন তাও এতদিন পর আর মনে পড়ে না।
চোরের আত্মকাহিনি যে কোনো চোর লেখেন নাই সেটা বড় হয়ে খুব সহজেই বুঝেছি। এমনকি এই চোর যে আসলে ছিঁচকে চোর সেসবও বুঝে নিতে অত সমস্যা হয়নি। তবে এত বছর ধরে যে কারণে রচনাটি মনের মধ্যে গেঁথে আছে, কোনো না কোনোভাবে, তার কারণ এই চোরের ব্যক্তিত্ব। এই চোর ধরা পড়ে যান এবং বেদম পিটুনি খান। পিটুনির পর তিনি তাঁর দারিদ্র্যের বয়ান দেন। সেই দারিদ্র্যের তীব্রতা কীভাবে তাঁকে এই নিরুপায় অথচ বিপজ্জনক পথে বেঁচে থাকার চেষ্টাতে টেনে আনে সেসব ব্যাখ্যা দেন। তাঁর পরিস্থিতির তীব্রতার পর চুরি-বিষয়ক ইথিক্সের গুরুতর সংকট আমার মনের মধ্যে দেখা দেয়। উত্তরকালে যে কোনো পিটুনিতেই আমার ভালো বোধ না করার যে অনুভূতি তৈরি হয়েছে তার সাথেও এই রচনার কোনো জটিল সম্ব্বন্ধ থাকতে পারে। আরও পরে যখন ছায়াছবিতে এবং থ্রিলার উপন্যাসে চৌকশ ও বড় মাপের চোরদের সাথে পরিচয় ঘটেছে, তখন কিছুতেই হরলাল রায়ের ক্রন্দনরত চোরকে আর মনে করতে পারিনি। 'ওশান' সিরিজের ওসব মণিমুক্তা, হীরা মুকুট চুরি-করা জর্জ কুলুনির চোর দল, কিংবা 'দ্য স্কোর' ছবির রবার্ট ডি নিরো বা এডওয়ার্ড নর্টনকে দেখলে হরলালের চোর নিজেও মনে রাখতে পারতেন না তাঁর পেশাচরিত্র কিংবা করুণ বিবরণীর কথা। তাছাড়া হরলালের চোর গোড়া থেকেই পালাতে অপারগ চোর। ছিঁচকে তো বটেই! কুলুনি বা ডি নিরোরা পর্দায় কেবল বড় বড় বস্তুতে হাত দেন বলেই নন, তাঁরা পালাতে পারেন বলেই মস্ত চোর। পালানোর সকল সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে পারা, এবং সেই সম্ভাবনার পথে পালাতে পারা চোরের সাফল্যের জন্য সাধারণ বিধিমালা। কিন্তু তার থেকেও এর বিশেষ গুরুত্ব আছে। এই পলায়ন চৌর্যকে মনুষ্য কল্পনায় একটা দুর্দান্ত শিল্পমর্যাদা এনে দেয়। সাহিত্য-চলচ্চিত্রের বৈশ্বিক কলাবিদ্যাতে এই মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত আছে। ফলে আর্ট বনাম ইথিক্সের একটা মজাদার খেলায় চুরির ক্রিয়াকর্ম ঘুরপাক খায়। ছোটখাটো চুরি একভাবে খায়, বড় চুরি আরেক মাত্রায় খায়।
দুই। লোভের গুড় পিঁপড়ায় খায় না
বাংলাদেশ এদিক থেকে একটা দুর্ভাগা দেশ। এখানে, অন্তত এখন, সফল চোরদের নিয়ে কোনোরকম আলাপ-আলোচনা অত্যন্ত কঠিন হয়ে গেছে। মানুষজন যে এসব সফল চোরের বীরত্ব নিয়ে দু'কথা বলবেন কিংবা সেসব বীরকে শিল্পমর্যাদা দিয়ে গ্রহণ করবেন, সে সুযোগ নেই বললেই চলে। বরং মানুষজনের সেসব সম্ভাব্য আলাপ-আলোচনাকে দেখা হয় অমর্যাদা হিসেবে। ব্যাংকিং বা বীমা খাতের টাকাপয়সা কিংবা স্টকমার্কেটের টাকাপয়সা কিংবা বিরাট বিরাট প্রকল্পের ফান্ড বেহাত হয়ে যাওয়া নিয়ে মানুষে কম কথা বলতে প্রণোদনা পান। একটা কারণ তো অবশ্যই অনেকেরই টাকা হারিয়েছে। তাঁদের পক্ষে বীরগাথার বিবরণী লেখার জন্য যথেষ্ট সংযত ও সাহিত্যরসাপ্লুত মন তৈরি করা কঠিন। অন্য যেসব মধ্যবিত্তের টাকাপয়সা ব্যাংকে বা লগ্নিতে রাষ্ট্রের কাছে রাখা আছে, তাঁরা সেসব টাকাপয়সা নিয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে আছেন 'কখন খোয়া যায়' এই ভয়ে। বস্তুত, যেসব সরকারি চাকুরিজীবী অবসরে যাবার পর বিধি অনুযায়ী টাকা পাবার কথা, তাঁদের মধ্যেও এই ভীতি লক্ষ্য করা যায়। যত সহজে এই কথা লিখলাম, বাস্তবে আমার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, ভীতির মাত্রা তার থেকে বহুগুণ তীব্র। এসব ভীতিসমেত সার্থক চোরের বিষয়ে গুণমুগ্ধ বিবরণী দেওয়া কঠিন। তবে এসব কারণের বাইরেও কারণ আছে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক আইনকানুন যেখানে গেছে তাতে কাউকে নিয়ে দু'কথা বলে যে মন শান্ত করবেন মানুষে, তার বন্দোবস্ত নেই। এখানে বড় মাপের সফল চোরদের নিয়ে কথা বলতে গেলেই মানহানির মামলা খেয়ে বসতে পারেন লোকজন। আর কথা যদি কোনো কারণে সাইবার স্পেসে বলেন তাহলে ডিজিটাল মামলাও খেয়ে ফেলতে পারেন। সংগঠক মুশতাকের মৃত পরিণতি থেকে কিংবা কার্টুনিস্ট কিশোরের জীবন্ত পরিণতি থেকে বা দেখে, মানুষজন আর যা-ই হোক, চোর-বিষয়ক শিল্প-সাহিত্যচর্চাকে আপন করে নিতে শেখেন নাই। সেদিক থেকে বাংলাদেশের মানুষজন এখন মা[ই]র আর মামলার মধ্যে সম্ভবত সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠতে পারেন না যে কোনটার প্রতি তাঁদের অধিক পক্ষপাত। সব মিলে বড় চোরদের নিয়ে শব্দচর্চার সাধারণ আয়োজন বাংলাদেশে বিরল মানতেই হবে। বাংলা সাহিত্যের জন্য এ একটা বিরাট ক্ষতি!
বাংলায় একটা প্রবাদ বেশ শুনতাম। হয়তো প্রথম শুনেছি বাবার মুখে- 'লাভের গুড় পিঁপড়ায় খায়'। এমনিতে প্রবাদ-প্রবচনের বিষয়ে জানাশোনার হাল খুবই খারাপ। গতকাল ক্লাসে 'ছাতু মাখাতে গিয়ে বিষ্ঠা মাখানো' এই প্রবাদটা ব্যবহার করেছিলাম। যদিও বিষ্ঠার চাইতে সংগত ও ন্যায্য শব্দ বাংলা শব্দভান্ডারে রয়েছে, তাও পত্রিকার পাঠকদের জন্য তৎসম শব্দটাই ঠিক মনে হলো। শিক্ষার্থীদের বড় অংশই ছাতু কী- তা চেনেন না। বাস্তবে তাঁদের ওপর রাগ করার অনেক কারণও খুঁজে পেলাম না। ততক্ষণে প্রবাদ ব্যবহার করার কারণে নিজের ওপরেই বিরক্ত হতে শুরু করেছি। এরপর ছাতু চেনানোর জন্য কিছু কসরত করতে হলো। কপালগুণে, ক্লাসে অন্য কিছু ছাতু-বিশেষজ্ঞ পাওয়া গেল। তাঁরা আমার কাজটাকে লাঘব করলেন। আমি সান্ত্বনা খুঁজে পেলাম- 'এখনও সব শেষ হয়ে যায় নাই!' সম্ভবত 'লাভের গুড় পিঁপড়ায় খায়' প্রবাদটাকে দেখতে হবে প্রাথমিকভাবে আক্ষেপ হিসেবে। গরিবের টানাটানির বাস্তবতা বা ডিসকোর্সের মধ্যে এর অধিষ্ঠান। একটু কোনো জায়গা থেকে কিছু পয়সাপাতি হাতে আসে, তাহলে আরেক জায়গায় এমন টানাটানি বেঁধে যায় যে সেই পয়সাটুকু তো যায়ই, আরও বেশি খরচা হয়ে যায়- এ রকম একটা দশার বিবরণী এটা। তবে আরও মনোযোগ দিয়ে ভাবলে এই প্রবাদের মধ্যে একটা অভিশাপ-ইচ্ছাও থাকতে পারে। 'তুই লাভ করলি, দ্যাখ কীভাবে তোর টাকাপয়সা নষ্ট হয়!' বলাই বাহুল্য, এই অভিশাপের বাস্তবতা যদি থেকেও থাকে, তা থাকার কথা অপেক্ষাকৃত ক্ষমতাবান ও বিপুলায়তন টাকা কামাইকারীদের বিপক্ষে। আরও সহজভাবে দেখলে, যেসব লোককে 'সাধারণ' মানুষজন জনস্বার্থের বিপক্ষীয় হিসাবে দেখে থাকেন, তাঁদের অর্জন তথা চুরির বিপক্ষে এ রকম অভিশাপ তাঁরা দিতে পারেন। তবে বাস্তবে বাংলাদেশের লোভী চোরবৃন্দ, যাঁদের কথা আলোচনা না-করাই মঙ্গলজনক, এসব অভিশাপের অনেক বাইরে থাকতে পারছেন।
তিন। হোজ্জা সাহেবের ন্যায্য প্রশ্ন
জানামতে নাসিরুদ্দিন হোজ্জাও চুরির শিকার হয়েছিলেন। তাঁর মতো চৌকশ বুদ্ধির লোকও, জানামতে, চুরির পর ভ্যাবলা মেরে গেছিলেন। সেটাই সংগত অবশ্য। তাঁর স্ট্রিটস্মার্ট ব্যক্তিত্ব বজায় থাকেনি। সেই সুযোগে বন্ধু-প্রতিবেশী নানান রকমের সওয়াল-জবাব, ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণ করতে শুরু করেছিলেন। অবশ্য চুরির পর সেইসব আচরণকে বৈশ্বিক বলেই মানতে হবে। হোজ্জা সাহেব যখন আবিস্কার করলেন তাঁর ঘরে চুরি গেছে, তখন তিনি বিলাপ বা চেঁচামেচি করতে শুরু করেন। তাতে লোকজন এসে জড়ো হয়। সকলেই তাঁকে চেনেন। সকলেরই তাঁর জন্য দুর্ভাবনা আছে হয়তো। হয়তো সেসব দুর্ভাবনা থেকেই তাঁরা পরিস্থিতি পর্যালোচনা শুরু করেন। আর হোজ্জাকে নানান কথা বলতে থাকেন : 'তোমার কিন্তু আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।' 'আহা! ঠিকমতো দরজা-জানালা দেখে যাবা না বাইরে?!', 'ঘরে পাহারা রাখো না কেন?', 'এই যে সারাদিন ঘুরে বেড়াও, চোর তো চুরি করবেই!' 'ঠিকমতো নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারো না?' ইত্যাদি। লোকজনের কথায় হোজ্জা চুরির বেদনা গেলেন ভুলে। তিনি তাঁর অন্যান্য সময়ের ব্যক্তিত্ব ফিরে পেলেন। তখন তিনি বললেন, 'ও! তোমাদের আলাপে যা বোঝা যাচ্ছে তাতে সব দোষই এখন আমার; আর যে লোকটা আমার বাসার সব জিনিসপত্তর নিয়ে পালাল, তার কোনোই দোষ তাহলে নেই?' এসব গল্পে সাধারণত পরের অংশ আর পাওয়া যায় না। জানা যায় না, হোজ্জার এই প্রশ্নের উত্তরে তাঁর প্রতিবেশী বন্ধুরা কী বলেছিলেন। তবে এটাও অসম্ভব না যে এই কথা বলে হোজ্জা আর সেখানে থাকেননি। বলে হাঁটা শুরু করে নিজ ঘর থেকেই চলে গেছিলেন। আমার হোজ্জার ওপর যে আস্থা, তাতে আমি নিশ্চিন্তে ভাবতে পারি যে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, 'যেহেতু আমার ঘরে চুরিযোগ্য আর জিনিসপত্র নাই, আর যেহেতু আমি ঠিকমতো নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারি নাই, আমি নতুন জিনিস কিনে আনতে গেলাম। আর তোমরাই এখন থেকে আমার ঘরের পাহারাদার।'
বাস্তবতা হলো, হোজ্জা বা অন্য কেউ, যিনিই চুরিকার্যে ক্ষতিগ্রস্ত তিনিই মারাত্মক তদন্তের মধ্যে পড়েন। সবচেয়ে স্কদ্ধুটিনাইজড লোকটাই বোধহয় তখন তিনি। তিনি যথাযথভাবে তাঁর গেরস্ত-কর্তব্য পালন করেছেন কিনা এই বিষয়ে এতসব ব্যাখ্যা এই বেচারার দিতে হয় যে তখন যদি তিনি ভেবে বসেন যে চুরির খবরটা লোককে জানিয়ে তিনি ঠিক করেননি, তাহলে তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না। আবার পর্যালোচকদেরও তেমন দোষ দেওয়া যায় না। আচ্ছামতো কথা শোনানোর জন্য তাঁরা চোরকে হাতের কাছে পাচ্ছেন না। আবার চোর যদি সেধে সেধে সামনে আসতেনও, মনে হয় না তিনি গেরস্তের বন্ধুদের বিলাপ বা পর্যালোচনা শুনবার মতো যথেষ্ট ধৈর্য বা কারণ খুঁজে পেতেন। তাছাড়া, চুরিকার্যের নৈতিকতার বিষয়ে বক্তৃতা তিনি তখন শুনতে যাবেন কেন? পর্যালোচকরা যদি নৈতিকতা বাদ দিয়ে তাঁর চৌর্য-দক্ষতা বিষয়ে বক্তৃতা শুনতে আশা করেন, সেটাই-বা তিনি শেয়ার করতে যাবেন কেন? আর এ বাদে থাকে গেরস্তের নিরাপত্তা কৌশলবৃদ্ধির লাগাতার পরামর্শ। এই পরামর্শগুলো মুফতে শুনতে পেলে চোরের মনভারের কারণ নেই। তবে ধারণা করা যায়, এসব পরামর্শ পারঙ্গম চোরের কাছে শিশুতোষ এবং হাস্যকর লাগে। ফলে যদি কোনো চুরি-উত্তর পর্যালোচনা-সভায় কোনো [ছোটখাটো/ছিঁচকে] চোর লুকিয়ে থেকে যান, তিনি বন্ধুসুলভ এসব পরামর্শ এবং গেরস্তকে বকাঝকা হাসি চেপে রেখে শুনতে থাকেন। আমার ধারণা, সুযোগ থাকলে, অনেক চোরই এ রকম একটা পরিস্থিতিতে ফিরে আসেন এবং মানুষজনের কাজকর্ম কথাবার্তা দেখতে ও শুনতে থাকেন। অন্তত আমি হলে তাই করতাম। আমার ধারণা, হোজ্জা সাহেবও তা জানেন, এবং তিনি নিজে হলেও তাই করতেন।
চার। বৌদ্ধিক বিপর্যয় ঠেকানোর মরিয়া চেষ্টা
চোর পালালে চুরিতে ক্ষতিগ্রস্ত লোকটা যা করতে থাকেন বা করতে থাকেন বলে সাহিত্য ও সমাজ-গল্পে বিবৃত হয়ে আছে, তা নিয়ে আসলে পুনর্তদন্তের সুযোগ আছে। আসলে অতি জরুরি সেই পুনর্তদন্ত। চুরিতে ক্ষতিগ্রস্ত লোকটার সম্পদের ক্ষতি গুরুতর। তবে আমি প্রস্তাব করছি যে এতে অধিকন্তু আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয় লোকটার বা লোকদের চিন্তার সংগঠন, কিংবা ইংরেজিতে যাকে বলে কম্পোজার। এই লোকগুলোর উত্তরকালের অনেকগুলো আচরণ ও কর্মকাণ্ডই আসলে এই সংগঠন-বিপর্যস্ততার কারণে ঘটে থাকে। তিনি বা তাঁরা যে এই বিপর্যয়ের পরে ঠিকঠাক আছেন, সংহত চিন্তার মালিক আছেন, সেটা প্রমাণের একটা গুরুতর চাপ এঁদের ওপর বর্তায়। চাপটা কে কোথা থেকে কী পরিমাণে দেন তা একেবারেই স্বতন্ত্র জিজ্ঞাসা; এবং আপাতত এই জিজ্ঞাসা নিয়ে আমি চিন্তিত নই। কিন্তু এই চাপটা তাঁরা সামলান। ওদিকে, যদি চুরিকার্যটা ঘটে থাকে আসলেই কিছু অসতর্কতার কারণে তাহলে এই চাপের কোনো শেষ নাই। ফলে বুদ্ধি যেসব প্রমাণ আমাদের তাঁরা দিতে থাকেন তা সেই অসতর্কতা নিয়ে লাগাতার পর্যালোচনার চাপ থেকে পরিত্রাণের জন্যই। মোটামুটি দুটো অংশ নিয়ে একটা প্রস্তাব আমার তাহলে। বিপর্যস্ততার কারণে চিন্তাসংহতি বিগড়ে যায়নি তার প্রমাণের চেষ্টা; আর অসতর্কতা এবং/বা কম দক্ষ গেরস্তির প্রমাণ হাতে পেয়ে সম্ভাব্য পর্যালোচনার হাত থেকে পরিত্রাণের চেষ্টা। এই হলো মোটামুটি চোর পালাবার পর গেরস্তের বুদ্ধি প্রমাণের মরিয়া দশার সারকথা। সকলেই তো আর হোজ্জা নন যে একবাক্যে সেরে দেবেন!
আচ্ছা চুরি মেলা হয়েছে। আমরা অন্যদিকে চোখ ফেরাই। পরিস্থিতির বিবরণী আর পর্যালোচনা নিয়ে ভাবি। খুব সরল করে যদি আমরা পেশাভেদে কার্যভেদ করি, তাহলে বিবরণীটা হচ্ছে সাংবাদিকীয় কাজ। আর পর্যালোচনাটা হচ্ছে বিশেষজ্ঞীয়-পণ্ডিতীয় কাজ। পরিস্থিতির উপশম হলো পরিকল্পনাবিদ অথবা রাজনীতিবিদের কাজ। অবশ্য বড় রাজনীতিকরা সব দায়িত্বই শেষ করে দিয়ে থাকেন। তাই তাঁদেরকে বাইরে রাখা যায় এই আলাপে। সাংবাদিকতার কাজের হরেক রকম ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণ, যাচাই-বাছাই, বিচার-তদন্ত আপনারা করতে পারেন। এমনকি তাঁদের মধ্যে কার কী নিয়ত, এসব নিয়েও নিন্দামন্দ বা বন্দনা করতে পারেন। কিন্তু সাংবাদিকতার জগতের লোক আপনাকে অনায়াসে বলে দিতে পারেন 'যা ঘটছে তাই-ই আপনারে কইলাম, এখন যান গিয়া'। এই সুযোগ জগতে বিশেষজ্ঞ-পণ্ডিতদের নাই। তাঁদের ঘ্যানরঘ্যানর করে বলতে হয়ে 'কেন ঘটেছে', এর প্রপঞ্চ-উপাদান কী, এর পরিপ্রেক্ষিত-অনুবর্তী কী। ফলে, এমনকি প্রাথমিক সংজ্ঞার দিক থেকেও বিশেষজ্ঞ-পণ্ডিতদের জব ডেসক্রিপশন যারপরনাই অসুবিধাজনক, ডিমান্ডিং। তাঁদের কার্যবিধির মধ্যেই ঘ্যানঘ্যানানির একটা বীজ পুরে দেওয়া আছে। ফলে বিচিত্র নয় যে পরিস্থিতি-পর্যালোচনা নিয়ে লোকজনের বিরক্তি ধরে যায়। এসব কারণেই হয়তো, যতক্ষণ না ঝগড়া বেধে যাচ্ছে, যেটাতে ক্রীড়াঙ্গনের উত্তেজনা পাওয়া যেতে পারে, টেলিভিশনের টক শোগুলোর সামনে সাধারণত বসে থাকেন ফ্ল্যাটবাড়ির সেইসব লোক, যাঁদের আর রিমোট চালানোর শক্তি অবশিষ্ট নাই। 'কেন ঘটেছে' আর 'কী হতে পারত' সিরিজের এই আলাপগুলো শুনতে থাকা মোটের ওপর বিশেষ শক্তিনাশ ঘটায় না [যদি না ঝগড়া বেধে যায়]।
মুশকিল হচ্ছে, প্রায়শই এই পর্যালোচনা করেন ঠিক সেই-সেই লোকজন, যে-যে লোকজন সংশ্নিষ্ট কর্মকাণ্ডগুলো ঘটিয়েছিলেন। তাতে গ্রাহককুলে একটা মারাত্মক ভেজাল বেধে যায়। যত বেশি বেশি ওসব মানুষ পর্যালোচনা করতে থাকেন, তত বেশি তাঁদের পর্যুদস্ত মনে হতে থাকে। বুদ্ধির প্রমাণের এসব চেষ্টা কুস্তির অধিক কিছু থাকে না। কুস্তি লড়ে যখন তাঁরা বুদ্ধির প্রমাণ দিতে থাকেন, ততই তাঁদের বুদ্ধিভ্রষ্টতার দলিল প্রকট হতে থাকে। বর্তমানের তিনিটা যত সরব হতে থাকেন, এতক্ষণ নীরব থাকা অতীতের তিনিটা ততই গরবহীন হতে থাকে। তাঁর বর্তমানের পর্যালোচনা অতীতের তিনিকে আমাদের লোচনযুক্ত করে তোলে। তাঁর কুস্তিতে আমাদের স্বস্তি ফিরে আসে না। আসলে তাঁরও আসে না।
মন্তব্য করুন