
'আমি বলে এতদিন তোমার সঙ্গে সংসার করলাম! অন্য কেউ হলে ...'
'আমার সঙ্গে বিয়ে না হলে তোমার অন্তত পাঁচটা বিয়ে হতো, কিন্তু একটাও টিকত না।'
'তোমার বিবাহিত জীবনটাই বৃথা। তুমি তো দাম্পত্য শব্দটার মানেই জানো না।'
এ জাতীয় নানান কথা বারংবার ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে হতে কখনও মসৃণ আবার কখনও নানান চড়াই উতরাই আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে দাম্পত্য যেতে থাকে আর যেতেই থাকে। এই তো দাম্পত্যের সত্যিকারের চেহারা। ঘর ঝাড়া দিয়ে কার্পেটের নিচে ময়লা ঢুকিয়ে টিপটপ করে রাখার মতো করে দাম্পত্য দিনের পর দিন পার করে; কখনও পরিচ্ছন্ন মহানন্দে, কখনও গুমোট হাওয়া মনের ওপরে চেপে বসা দমবন্ধ আবহাওয়ায়।
দাম্পত্য যে এমন টক-মিষ্টি-ঝাল তা কি তার মধ্যে প্রবেশের আগে লোকে জানে না? জানে নিশ্চয়। তবে দাম্পত্যে প্রবেশের ব্যাপারে সামাজিক আর পারিবারিক কিছু চাপ থাকে। আত্মীয়-পরিজন আর সবচেয়ে কাছের লোকজনই থাকে মানুষকে ধাক্কা দিয়ে দাম্পত্যের গর্তে ফেলে দেবার জন্য। তারপর দূর থেকে মজা দেখেন তারা। কেউ ভুগবে কেউ ভুগবে না, তা কী করে হয়! কিন্তু দাম্পত্যে প্রবেশ না করলেও কি আরেক রকমের ভোগান্তি নেই? আহা রে কী যেন পেলাম না, কী যেন জানা হলো না, ভয়ানক একাকিত্ব, পরিচিত অনেকে বিয়েশাদি করে প্রচুর সুখে আছে, আর আমি শেষ বয়সে সঙ্গী কোথায় পাব ... এই সমস্ত হাহাকারে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে মনে মনে মানুষ দাম্পত্যেরই জয়জয়কার ঘোষণা করেন। এ কারণেই হয়তো দাম্পত্য 'দিল্লি কা লাড্ডু'- খেয়ে-না খেয়ে পস্তানো যার যার নিয়তি। মজার ব্যাপার হলো, অনেক মানুষ একবার এর স্বাদ গ্রহণ করেও ক্ষান্ত হন না, দাম্পত্যের বন্ধন তাদের বারবার চাই। অর্থাৎ ন্যাড়া কভু বেল তলায় যায় না বলে যে প্রপাগান্ডা আছে, তা মিথ্যে করে দিয়ে ন্যাড়া বেল তলায় যায়, বারবার যায়।
দাম্পত্যকে বন্ধন বলি আর যাই বলি, বেশিরভাগ দাম্পত্যের শুরু হয় প্রেম থেকে। আবার পরিসংখ্যান বলে যে পৃথিবীব্যাপী দাম্পত্যের যত সম্পর্ক আদালতের কাঠগড়া অবধি গড়িয়ে বেশ ব্যারাভাবে সমাপ্ত হয়, তার পঁচাত্তর ভাগ শুরু হয় প্রেম থেকে। শুরু করে নিয়ে তারপর প্রেম ধীরে মুছে যায়। আবার অনেকটা মুছে গেলেও শেষে কখনও উচ্ছিষ্টের মতো কিছুটা পড়ে থাকে; যা মানুষকে পৌঁছে দেয় দাম্পত্যের সীমান্তে। সেই পড়ে থাকা মধু চাটতে চাটতে বেশিরভাগ মানুষের বাকি জীবন যন্ত্রের ছন্দে কাটাতে থাকে। মধু আহরণ কখনও হয়ে দাঁড়ায় কেবলই অভ্যাস। দাম্পত্যের আরেক অর্থ তখন অভ্যাসই। অভ্যাসের দাস হয়ে মানুষ দাম্পত্য বলয়ের বাইরে যেতে পারে না। আইনত বা সামাজিকভাবে সাধারণত পারেই না। সমাজ বা আইনের ঊর্ধ্বে দাম্পত্য সম্পর্কের সবচেয়ে নাজুক বাঁধন থাকে কিছু সম্পর্ক যাতে আঘাত লাগার ভয়ে মানুষ এর সমাপ্তি এড়িয়ে চলে, পারতপক্ষে বিচ্ছেদের ভাবনা মনে আনে না। সেই সম্পর্কগুলোর মধ্যে প্রধান হলো দাম্পত্যজাত সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের সম্পর্ক। আরও থাকে পিতা-মাতা, বর্ধিত পরিবার। নিজের আনন্দখুশি নয়, সন্তানসন্ততি ও পরিবারের আনন্দ কিংবা স্বস্তি, সামাজিক মানসম্মান তখন হয়ে ওঠে প্রধান। কিন্তু দাম্পত্যের সীমান্তের নড়বড়ে সরু দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রতিনিয়ত মনে হয় এই বুঝি টালমাটাল হয়ে স্থানচ্যুত হতে হয়! সন্তান, পরিবার আর সমাজের অদৃশ্য বন্ধন না থাকলে মানুষ সীমান্ত থেকে অনেক আগেই বাইরের কোনো দিকে ঝাঁপ দিত হয়তো।
ধৈর্য, সমঝোতা- এসব হলো দাম্পত্যের প্রতিশব্দ। ধৈর্য খোয়ালে আর সমঝোতার আগ্রহী না হলে একলাফে গিয়ে দাঁড়াতে হয় সীমান্তে। সম্পর্কে একবার ভুল বোঝাবুঝি থেকে তিক্ততা এলে উল্টোদিকে ফিরে আবার নির্দোষ ভাবনাময় দিনে ফেরা কঠিন। উল্টোদিকের ওই যাত্রাপথটি শুধু কঠিনই নয়, কখনও কখনও অসম্ভবও। কারণ মানুষের মন পৃথিবীর সবচেয়ে জমাট পটভূমি, যার ওপরে একবার আঁকিবুঁকি টানলে তা আর মোছে না। যতই ঘষা হোক মাজা হোক, ওপরে রঙের প্রলেপ হোক লাগানো, ভিতর থেকে তিক্ততার রেশ ফুটে বেরোয়, কথায় কথায় ভেসে ভেসে তা স্পষ্ট হয়। বারবার স্মৃতিচারণে তিক্ত ছবিটা তিক্ততর হয়। তার সঙ্গে যোগ হয় ঘটমান বর্তমানের ক্ষোভ, অভিমান-রাগের স্তূপ বাড়তেই থাকে।
এতকিছুর পরেও কেন দাম্পত্য টিকিয়ে রাখা? তলানিতে ঠেকা প্রেম, সামাজিক রীতিনীতি, সন্তানসন্ততির বেড়ে ওঠায় দু'জনে একসঙ্গে অংশগ্রহণ ছাড়াও আছে বহুবিধ কারণ। বিচ্ছেদে অর্থনৈতিক ধাক্কা থাকতে পারে, যা দেশের আইন ঠিক করে দেবে। তবে বিচ্ছেদে সবচেয়ে বেশি থাকে মানসিক ধাক্কা যা লম্বা সময় ধরে মানুষকে বিষণ্ণ করে রাখতে পারে। অল্পস্বল্প প্রেম যা বেঁচে থাকে, সেটুকু হারানোতেও ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া হয় কারও কারও। বরং সেটুকু টিকিয়ে রাখতেই মানুষ মরিয়া হয়ে ওঠে। তাই কেবল মেনে নেওয়ার খেলা চলতে থাকে। অনেকে হারানোর ধাক্কা মেনে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে বছরের পর বছর সময় নেন। তাই ভাঙাচোরা দাম্পত্য সম্পর্ককে ঠেলেঠুলে চালিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রায়ই থাকে একমাত্র রাস্তা।
দাম্পত্য সম্পর্ক এহেন পর্যায়ে এসে মানুষকে এমন এক পরিস্থিতিতে দাঁড় করায় যেন চারপাশে তার নিজের জীবনেই যা ঘটছে তিনি হয়ে যান তার একমাত্র দর্শক। তখন শুধু মানিয়ে চলার চ্যালেঞ্জ সামনে। দিনরাত একই চ্যালেঞ্জ- সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না। এ রকমটা গভীরভাবে ভাবলে মনে হতে পারে দাম্পত্যের দু'জন সদস্যের মধ্যে হয়তো বরাবর সাপে নেউলে সম্পর্ক থাকে। না, তা সব ক্ষেত্রে থাকে না। তবে এক রকমের রাজনৈতিক সম্পর্ক থাকেই। যাকে বলে হারজিতের সম্পর্ক। সংসার এক রকমের রাষ্ট্রই বটে। সেখানে আইনকানুন থাকে, সংবিধান থাকে, লিখিত নয়, সচেতনতার মাত্রায় গোনা মৌখিক কিংবা অব্যক্ত। রাষ্ট্রে দুইজনে দুই প্রধান দল। সংসারটা একজনের ওপরে আরেকজনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা আর ক্ষমতা প্রদর্শনের সম্পর্ক। আধিপত্যের লড়াই। বিষয়টা চর দখলের মতো, ভূমিদস্যুর মতো প্রথম খুঁটিটি একজনকে গাড়তে হবে। সাধারণভাবে যেমন মানুষের ধারণা থাকে বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার ব্যাপারে। দু'জনের মধ্যে একজনকে আগে বাঁধতে হবে। কার কথায়, কার মতামতে চলবে সংসার? অন্যজনকে মানিয়ে চলতে হবে। না চলতে পারলেই অকৃতকার্য। রাজনীতিতে ভরাডুবি।
সীমানায় দাঁড়িয়ে ভূমির দিকে তাকালে খুঁতগুলো ভালো করে নজরে আসে। যেন যা ঘটছে তার অংশ নন তিনি। শুধু বাইরে থেকে দেখছেন, মজা নিচ্ছেন। আবার মুষড়েও পড়ছেন। হ্যাঁ, রাষ্ট্রটিতে, মানে সংসারে কার কর্তৃত্ব চলবে? তিনিই ঠিক করবেন ক্ষমতার ব্যবহারে কে পারদর্শী, তর্কে কে জেতেন, যুক্তি সময়মতো কার মাথায় খেলে বেশি- এই সমস্ত নানান মিটারের ওঠানামা গুরুত্বপূর্ণ। সীমানায় দাঁড়িয়ে এই সমস্ত ভালোমতো লক্ষ্য করা যায়। কখনও দোষী, কখনও আবার অপরাধ না করেই দোষী। কিন্তু বিচার হবে কোথায়? যে যার কথা বলে চলেছে, সংসারে কে শুনছে কার কথা?
না, সংসার এতটা যুদ্ধক্ষেত্র না-ও হতে পারে। গভীর প্রেম শেষের পরেও রেশ থেকে যায় একজীবন। তাকে উঠতে বসতে অপছন্দ করা চলে, তবে উপেক্ষা করা দুস্কর। অ্যানাতোল ফ্রাঁস বলেছিলেন- 'প্রেম এক তীব্র ভালো লাগার অনুভূতি, একই সঙ্গে এমন এক অসহনীয় যন্ত্রণার অনুভূতিও- এতটাই ভয়াবহভাবে অসহনীয় যে তা তিন মাসের বেশি টেকে না।' তাই বলতে গেলে তিন মাস পর থেকে প্রেমের স্মৃতিই জীবন পরিচালিত করে। জাবর কাটার মতো সুখস্মৃতি উগরে আসে আর জীবনটা সুখে ভরিয়ে দিয়ে যায়। তার সঙ্গে যুক্ত হয় চলমান বর্তমানের প্রাপ্তি, ত্যাগ আর উদারতা। সেটাই হয়ে ওঠে জীবনের চালিকাশক্তি। দাম্পত্যের সীমান্তেও বহুকাল আগের স্মৃতির পর্যালোচনা হয়- কত সুখ ছিল আমাদের! সেই তুমি কেমন ছিলে, আর আজ? এত বদলে গেলে কীভাবে?
রাষ্ট্রের নিয়মকানুন বদলায়, নদীর গতিপথ বদলায়, স্থলে পানি জমে আর নদীতে পলি, সমাজ বদলে যায় প্রযুক্তির চাপে, শুধু মানুষ কেন একই থাকবে? মানুষ তো আসবাব নয়! এই সমস্ত পরিবর্তনের নিরিখে তারও রুচি বদলায়, চাওয়া-পাওয়া অন্য রকমের হয়। সমাজ নিজে বদলে যাবে কিন্তু মানুষের মানসিক পরিবর্তনকে সাদরে গ্রহণ করবে না। এই দ্বন্দ্বে মানুষ নিজের পছন্দ-অপছন্দের পরিবর্তনের খবর অনেকটা লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়। মানুষ নিজের কাজে আর কথায় মধ্যে ক্রমাগত সেলফ সেন্সরশিপ প্রয়োগ করতে থাকে। করতে করতে যা দাঁড়ায় তাই হয়ে ওঠে তার ব্যক্তিত্ব। বাইরে সে ব্যক্তিত্বকে যতটাই নিয়ন্ত্রণ করা হোক না কেন, ঘরের মানুষটির কাছে হয়তো অনেকটাই খোলাসা হয়ে পড়ে। তখনই সংঘাত ... এত বদলে গেলে কী করে! বেশিরভাগ সম্পর্কের শুরু থেকে সঙ্গী বাতলে দেন কী খাওয়া হবে, পোশাক কী পরতে হবে, ঘুম কখন আর কখন জেগে থাকা, অবসরে সময় কী করে কাটবে, কোন আত্মীয়-বন্ধুর সঙ্গে মেলামেশা করা যাবে আর কে হবেন নিষিদ্ধ, কখন বাড়ি ফিরতে হবে। ভালোবাসা, প্রেম কিংবা শুধু দাম্পত্যের সম্পর্কের খাতিরে এই সমস্ত মানতে মানতে একদিন মানুষগুলো সম্পর্কে প্রবেশের আগের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলে এক যৌগিক মানুষে পরিণত হয়। তখন কিন্তু বলা সহজই ... এত বদলে গেলে কী করে!
দাম্পত্যের আরেক মজা হলো, সম্পর্ক মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। যে কোনো সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে মনে রাখতে হয় কাছের মানুষটি কীভাবে বা কতটা প্রভাবিত হবে। সেভাবে সিদ্ধান্ত নতুন করে সাজাতে হয়। আরও মজার ব্যাপার হলো, যখন মানুষ সিদ্ধান্ত বদলায়, যাকে বলে সমঝোতা বা অ্যাডজাস্টমেন্ট কিংবা কম্প্রোমাইজ তখন সে তা অনেক ক্ষেত্রে ভালোবেসেও করে। করে শান্তি পায়। নিজের ভালোবাসার মানুষের জন্য এ যেন প্রতিদিনের ত্যাগ। এমনকি জীবনে একবার-দু'বার আসার মতো বড় বিষয়েও ত্যাগ- সঙ্গীর ইচ্ছেমতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ। পরে যখন সীমান্তে উপনীত, তখন অতীতের পথে হেঁটে সেই ভালোবাসার ক্ষণের জন্য নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে। তখন মানুষ সঙ্গীকে দোষারোপ করেন, তুমি বলেছিলে বলেই না আমি ওটা করেছিলাম! আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছ তুমি। আজ তোমার জন্যই আমার এই সর্বনাশ হলো। বিচারে ঝটপট এ রকম মৌখিক রায় দেওয়া খুব সহজ। কিন্তু খতিয়ে দেখলে দেখা যায় সঙ্গীকে খুশি করার জন্য হয়তো সামান্য উস্কানিতে নিজের ইচ্ছেতেই মানুষ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন। যে সময়ের প্রেম সে সময়ের জন্য সত্য হয়ে ঐতিহাসিক স্তম্ভের মতো টিকে থাকে। তার ওপরে হাজার কালিমা লেপনে তা অস্পষ্ট হবে না, মিথ্যে হবে না। পরের ঘটনার ধারাকে বিবেচনায় নিয়ে আগের ঘটনাকে মিথ্যা ঘোষণা করা যায় না। তাই প্রতিটি প্রেম পরেও সত্য।
দাম্পত্যে শুধু প্রেম নয়, বোঝাপড়া দরকার- যার নাম বন্ধুত্ব। প্রথমদিকে সম্পর্ক অনেকটাই মানসিক ও শারীরিক প্রেমনির্ভর হলেও সামান্য বয়স বাড়তেই তাতে বন্ধুত্বের রসদ প্রয়োজন। বন্ধুত্বের শুরুতেই আসে বিশ্বাসের প্রসঙ্গ। কোনো কারণে এই দুটো জায়গায় চিড় ধরলে মানুষ হোঁচট খেয়ে সীমান্তে গিয়ে উপস্থিত হয়। তারপর বাইরে দাঁড়িয়ে দেখে বিশ্বাস কী করে ভঙ্গুর কাচের মতো চুরচুর হয়ে যায়, তখন নিতান্ত নিয়মের দাম্পত্য, মনমরা কিংবা অন্য কোথাও মন খোয়ানো। কিছুদিন আগে গল্পের চরিত্রের মুখে সংলাপ বসিয়ে কয়েক মুহূর্ত সেদিকে তাকিয়ে থাকতে হয়েছিল। এ রকম ভাবনা হয়তো কখনও নিজের অজান্তেই বেরিয়ে আসে, কারও দাম্পত্যের সীমান্তের ভাবনায় ...
মা আর কন্যা চরিত্র। মা কন্যার বিয়ে ঠিক করেছেন, কন্যার পছন্দ হয়নি পাত্র। কন্যা বলে-
'ওরকম একটা লোকের সঙ্গে আমি প্রেম করব কীভাবে?'
মা অবাক, ঠোঁট উল্টে বলেন-
'সংসার করতে আবার প্রেমের দরকার পড়ল কেন?'
বহু বছরের সাংসারিক অভিজ্ঞতায় দাম্পত্যের সীমান্তে পৌঁছে মায়ের কাছে যে প্রেম অপ্রয়োজনীয়, কন্যার কাছে দাম্পত্যের শুরুতে সেই প্রেমই অবশ্য প্রয়োজনীয়। দাম্পত্যের প্রারম্ভে প্রেম মানুষকে পরিচালিত করে, পরে হয় অভ্যাস। হয়তো সময়ের সঙ্গে সংজ্ঞা পাল্টে ওই অভ্যাসটাই প্রেম। কারণ বারবার বিস্মিত, মুগ্ধ হতে হতে একসময় মানুষ একই বিষয়ে আর মুগ্ধ-বিস্মিত হতে পারে না। সঙ্গী সঙ্গেই আছেন, এই ঘিরে থাকার বোধটাই তখন প্রধান হয়ে ওঠে। ঘিরে না থাকলে অস্বস্তি হয়। পৃথিবীর অন্য সুখও চাই, আবার সঙ্গীর উপস্থিতিও চাই। সে আমার জন্যই তৈরি আছে- অন্তত এই সান্ত্ব্বনা চাই। অন্যদিকে, সীমান্তে দাঁড়িয়ে সঙ্গী কাছে থাকাকে কম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ভাবার প্রবণতাও আসে, যাকে বলে টেকেন ফর গ্র্যান্টেড। বাতাসের সমুদ্রে ডুবে থাকতে থাকতে যেমন তার বাতাসের উপস্থিতি নিয়ে কেউ ভাবে না। বাতাস হুট করে নাই হয়ে যেতে পারে, শুধু এই বাস্তবতা সামনে এলে বাতাসের সহজলভ্যতা নিয়ে যেমন ভাবনা আসে, পুরোনো প্রেম ঠিক তেমন। তাতে বুক ভরে প্রতিদিন শ্বাস নেওয়া চলে, তবে নিজের অলক্ষে, অন্তত যতক্ষণ পরিবেশ গুমোট হয়ে না ওঠে!
'আমার সঙ্গে বিয়ে না হলে তোমার অন্তত পাঁচটা বিয়ে হতো, কিন্তু একটাও টিকত না।'
'তোমার বিবাহিত জীবনটাই বৃথা। তুমি তো দাম্পত্য শব্দটার মানেই জানো না।'
এ জাতীয় নানান কথা বারংবার ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে হতে কখনও মসৃণ আবার কখনও নানান চড়াই উতরাই আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে দাম্পত্য যেতে থাকে আর যেতেই থাকে। এই তো দাম্পত্যের সত্যিকারের চেহারা। ঘর ঝাড়া দিয়ে কার্পেটের নিচে ময়লা ঢুকিয়ে টিপটপ করে রাখার মতো করে দাম্পত্য দিনের পর দিন পার করে; কখনও পরিচ্ছন্ন মহানন্দে, কখনও গুমোট হাওয়া মনের ওপরে চেপে বসা দমবন্ধ আবহাওয়ায়।
দাম্পত্য যে এমন টক-মিষ্টি-ঝাল তা কি তার মধ্যে প্রবেশের আগে লোকে জানে না? জানে নিশ্চয়। তবে দাম্পত্যে প্রবেশের ব্যাপারে সামাজিক আর পারিবারিক কিছু চাপ থাকে। আত্মীয়-পরিজন আর সবচেয়ে কাছের লোকজনই থাকে মানুষকে ধাক্কা দিয়ে দাম্পত্যের গর্তে ফেলে দেবার জন্য। তারপর দূর থেকে মজা দেখেন তারা। কেউ ভুগবে কেউ ভুগবে না, তা কী করে হয়! কিন্তু দাম্পত্যে প্রবেশ না করলেও কি আরেক রকমের ভোগান্তি নেই? আহা রে কী যেন পেলাম না, কী যেন জানা হলো না, ভয়ানক একাকিত্ব, পরিচিত অনেকে বিয়েশাদি করে প্রচুর সুখে আছে, আর আমি শেষ বয়সে সঙ্গী কোথায় পাব ... এই সমস্ত হাহাকারে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে মনে মনে মানুষ দাম্পত্যেরই জয়জয়কার ঘোষণা করেন। এ কারণেই হয়তো দাম্পত্য 'দিল্লি কা লাড্ডু'- খেয়ে-না খেয়ে পস্তানো যার যার নিয়তি। মজার ব্যাপার হলো, অনেক মানুষ একবার এর স্বাদ গ্রহণ করেও ক্ষান্ত হন না, দাম্পত্যের বন্ধন তাদের বারবার চাই। অর্থাৎ ন্যাড়া কভু বেল তলায় যায় না বলে যে প্রপাগান্ডা আছে, তা মিথ্যে করে দিয়ে ন্যাড়া বেল তলায় যায়, বারবার যায়।
দাম্পত্যকে বন্ধন বলি আর যাই বলি, বেশিরভাগ দাম্পত্যের শুরু হয় প্রেম থেকে। আবার পরিসংখ্যান বলে যে পৃথিবীব্যাপী দাম্পত্যের যত সম্পর্ক আদালতের কাঠগড়া অবধি গড়িয়ে বেশ ব্যারাভাবে সমাপ্ত হয়, তার পঁচাত্তর ভাগ শুরু হয় প্রেম থেকে। শুরু করে নিয়ে তারপর প্রেম ধীরে মুছে যায়। আবার অনেকটা মুছে গেলেও শেষে কখনও উচ্ছিষ্টের মতো কিছুটা পড়ে থাকে; যা মানুষকে পৌঁছে দেয় দাম্পত্যের সীমান্তে। সেই পড়ে থাকা মধু চাটতে চাটতে বেশিরভাগ মানুষের বাকি জীবন যন্ত্রের ছন্দে কাটাতে থাকে। মধু আহরণ কখনও হয়ে দাঁড়ায় কেবলই অভ্যাস। দাম্পত্যের আরেক অর্থ তখন অভ্যাসই। অভ্যাসের দাস হয়ে মানুষ দাম্পত্য বলয়ের বাইরে যেতে পারে না। আইনত বা সামাজিকভাবে সাধারণত পারেই না। সমাজ বা আইনের ঊর্ধ্বে দাম্পত্য সম্পর্কের সবচেয়ে নাজুক বাঁধন থাকে কিছু সম্পর্ক যাতে আঘাত লাগার ভয়ে মানুষ এর সমাপ্তি এড়িয়ে চলে, পারতপক্ষে বিচ্ছেদের ভাবনা মনে আনে না। সেই সম্পর্কগুলোর মধ্যে প্রধান হলো দাম্পত্যজাত সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের সম্পর্ক। আরও থাকে পিতা-মাতা, বর্ধিত পরিবার। নিজের আনন্দখুশি নয়, সন্তানসন্ততি ও পরিবারের আনন্দ কিংবা স্বস্তি, সামাজিক মানসম্মান তখন হয়ে ওঠে প্রধান। কিন্তু দাম্পত্যের সীমান্তের নড়বড়ে সরু দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রতিনিয়ত মনে হয় এই বুঝি টালমাটাল হয়ে স্থানচ্যুত হতে হয়! সন্তান, পরিবার আর সমাজের অদৃশ্য বন্ধন না থাকলে মানুষ সীমান্ত থেকে অনেক আগেই বাইরের কোনো দিকে ঝাঁপ দিত হয়তো।
ধৈর্য, সমঝোতা- এসব হলো দাম্পত্যের প্রতিশব্দ। ধৈর্য খোয়ালে আর সমঝোতার আগ্রহী না হলে একলাফে গিয়ে দাঁড়াতে হয় সীমান্তে। সম্পর্কে একবার ভুল বোঝাবুঝি থেকে তিক্ততা এলে উল্টোদিকে ফিরে আবার নির্দোষ ভাবনাময় দিনে ফেরা কঠিন। উল্টোদিকের ওই যাত্রাপথটি শুধু কঠিনই নয়, কখনও কখনও অসম্ভবও। কারণ মানুষের মন পৃথিবীর সবচেয়ে জমাট পটভূমি, যার ওপরে একবার আঁকিবুঁকি টানলে তা আর মোছে না। যতই ঘষা হোক মাজা হোক, ওপরে রঙের প্রলেপ হোক লাগানো, ভিতর থেকে তিক্ততার রেশ ফুটে বেরোয়, কথায় কথায় ভেসে ভেসে তা স্পষ্ট হয়। বারবার স্মৃতিচারণে তিক্ত ছবিটা তিক্ততর হয়। তার সঙ্গে যোগ হয় ঘটমান বর্তমানের ক্ষোভ, অভিমান-রাগের স্তূপ বাড়তেই থাকে।
এতকিছুর পরেও কেন দাম্পত্য টিকিয়ে রাখা? তলানিতে ঠেকা প্রেম, সামাজিক রীতিনীতি, সন্তানসন্ততির বেড়ে ওঠায় দু'জনে একসঙ্গে অংশগ্রহণ ছাড়াও আছে বহুবিধ কারণ। বিচ্ছেদে অর্থনৈতিক ধাক্কা থাকতে পারে, যা দেশের আইন ঠিক করে দেবে। তবে বিচ্ছেদে সবচেয়ে বেশি থাকে মানসিক ধাক্কা যা লম্বা সময় ধরে মানুষকে বিষণ্ণ করে রাখতে পারে। অল্পস্বল্প প্রেম যা বেঁচে থাকে, সেটুকু হারানোতেও ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া হয় কারও কারও। বরং সেটুকু টিকিয়ে রাখতেই মানুষ মরিয়া হয়ে ওঠে। তাই কেবল মেনে নেওয়ার খেলা চলতে থাকে। অনেকে হারানোর ধাক্কা মেনে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে বছরের পর বছর সময় নেন। তাই ভাঙাচোরা দাম্পত্য সম্পর্ককে ঠেলেঠুলে চালিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রায়ই থাকে একমাত্র রাস্তা।
দাম্পত্য সম্পর্ক এহেন পর্যায়ে এসে মানুষকে এমন এক পরিস্থিতিতে দাঁড় করায় যেন চারপাশে তার নিজের জীবনেই যা ঘটছে তিনি হয়ে যান তার একমাত্র দর্শক। তখন শুধু মানিয়ে চলার চ্যালেঞ্জ সামনে। দিনরাত একই চ্যালেঞ্জ- সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না। এ রকমটা গভীরভাবে ভাবলে মনে হতে পারে দাম্পত্যের দু'জন সদস্যের মধ্যে হয়তো বরাবর সাপে নেউলে সম্পর্ক থাকে। না, তা সব ক্ষেত্রে থাকে না। তবে এক রকমের রাজনৈতিক সম্পর্ক থাকেই। যাকে বলে হারজিতের সম্পর্ক। সংসার এক রকমের রাষ্ট্রই বটে। সেখানে আইনকানুন থাকে, সংবিধান থাকে, লিখিত নয়, সচেতনতার মাত্রায় গোনা মৌখিক কিংবা অব্যক্ত। রাষ্ট্রে দুইজনে দুই প্রধান দল। সংসারটা একজনের ওপরে আরেকজনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা আর ক্ষমতা প্রদর্শনের সম্পর্ক। আধিপত্যের লড়াই। বিষয়টা চর দখলের মতো, ভূমিদস্যুর মতো প্রথম খুঁটিটি একজনকে গাড়তে হবে। সাধারণভাবে যেমন মানুষের ধারণা থাকে বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার ব্যাপারে। দু'জনের মধ্যে একজনকে আগে বাঁধতে হবে। কার কথায়, কার মতামতে চলবে সংসার? অন্যজনকে মানিয়ে চলতে হবে। না চলতে পারলেই অকৃতকার্য। রাজনীতিতে ভরাডুবি।
সীমানায় দাঁড়িয়ে ভূমির দিকে তাকালে খুঁতগুলো ভালো করে নজরে আসে। যেন যা ঘটছে তার অংশ নন তিনি। শুধু বাইরে থেকে দেখছেন, মজা নিচ্ছেন। আবার মুষড়েও পড়ছেন। হ্যাঁ, রাষ্ট্রটিতে, মানে সংসারে কার কর্তৃত্ব চলবে? তিনিই ঠিক করবেন ক্ষমতার ব্যবহারে কে পারদর্শী, তর্কে কে জেতেন, যুক্তি সময়মতো কার মাথায় খেলে বেশি- এই সমস্ত নানান মিটারের ওঠানামা গুরুত্বপূর্ণ। সীমানায় দাঁড়িয়ে এই সমস্ত ভালোমতো লক্ষ্য করা যায়। কখনও দোষী, কখনও আবার অপরাধ না করেই দোষী। কিন্তু বিচার হবে কোথায়? যে যার কথা বলে চলেছে, সংসারে কে শুনছে কার কথা?
না, সংসার এতটা যুদ্ধক্ষেত্র না-ও হতে পারে। গভীর প্রেম শেষের পরেও রেশ থেকে যায় একজীবন। তাকে উঠতে বসতে অপছন্দ করা চলে, তবে উপেক্ষা করা দুস্কর। অ্যানাতোল ফ্রাঁস বলেছিলেন- 'প্রেম এক তীব্র ভালো লাগার অনুভূতি, একই সঙ্গে এমন এক অসহনীয় যন্ত্রণার অনুভূতিও- এতটাই ভয়াবহভাবে অসহনীয় যে তা তিন মাসের বেশি টেকে না।' তাই বলতে গেলে তিন মাস পর থেকে প্রেমের স্মৃতিই জীবন পরিচালিত করে। জাবর কাটার মতো সুখস্মৃতি উগরে আসে আর জীবনটা সুখে ভরিয়ে দিয়ে যায়। তার সঙ্গে যুক্ত হয় চলমান বর্তমানের প্রাপ্তি, ত্যাগ আর উদারতা। সেটাই হয়ে ওঠে জীবনের চালিকাশক্তি। দাম্পত্যের সীমান্তেও বহুকাল আগের স্মৃতির পর্যালোচনা হয়- কত সুখ ছিল আমাদের! সেই তুমি কেমন ছিলে, আর আজ? এত বদলে গেলে কীভাবে?
রাষ্ট্রের নিয়মকানুন বদলায়, নদীর গতিপথ বদলায়, স্থলে পানি জমে আর নদীতে পলি, সমাজ বদলে যায় প্রযুক্তির চাপে, শুধু মানুষ কেন একই থাকবে? মানুষ তো আসবাব নয়! এই সমস্ত পরিবর্তনের নিরিখে তারও রুচি বদলায়, চাওয়া-পাওয়া অন্য রকমের হয়। সমাজ নিজে বদলে যাবে কিন্তু মানুষের মানসিক পরিবর্তনকে সাদরে গ্রহণ করবে না। এই দ্বন্দ্বে মানুষ নিজের পছন্দ-অপছন্দের পরিবর্তনের খবর অনেকটা লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়। মানুষ নিজের কাজে আর কথায় মধ্যে ক্রমাগত সেলফ সেন্সরশিপ প্রয়োগ করতে থাকে। করতে করতে যা দাঁড়ায় তাই হয়ে ওঠে তার ব্যক্তিত্ব। বাইরে সে ব্যক্তিত্বকে যতটাই নিয়ন্ত্রণ করা হোক না কেন, ঘরের মানুষটির কাছে হয়তো অনেকটাই খোলাসা হয়ে পড়ে। তখনই সংঘাত ... এত বদলে গেলে কী করে! বেশিরভাগ সম্পর্কের শুরু থেকে সঙ্গী বাতলে দেন কী খাওয়া হবে, পোশাক কী পরতে হবে, ঘুম কখন আর কখন জেগে থাকা, অবসরে সময় কী করে কাটবে, কোন আত্মীয়-বন্ধুর সঙ্গে মেলামেশা করা যাবে আর কে হবেন নিষিদ্ধ, কখন বাড়ি ফিরতে হবে। ভালোবাসা, প্রেম কিংবা শুধু দাম্পত্যের সম্পর্কের খাতিরে এই সমস্ত মানতে মানতে একদিন মানুষগুলো সম্পর্কে প্রবেশের আগের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলে এক যৌগিক মানুষে পরিণত হয়। তখন কিন্তু বলা সহজই ... এত বদলে গেলে কী করে!
দাম্পত্যের আরেক মজা হলো, সম্পর্ক মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। যে কোনো সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে মনে রাখতে হয় কাছের মানুষটি কীভাবে বা কতটা প্রভাবিত হবে। সেভাবে সিদ্ধান্ত নতুন করে সাজাতে হয়। আরও মজার ব্যাপার হলো, যখন মানুষ সিদ্ধান্ত বদলায়, যাকে বলে সমঝোতা বা অ্যাডজাস্টমেন্ট কিংবা কম্প্রোমাইজ তখন সে তা অনেক ক্ষেত্রে ভালোবেসেও করে। করে শান্তি পায়। নিজের ভালোবাসার মানুষের জন্য এ যেন প্রতিদিনের ত্যাগ। এমনকি জীবনে একবার-দু'বার আসার মতো বড় বিষয়েও ত্যাগ- সঙ্গীর ইচ্ছেমতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ। পরে যখন সীমান্তে উপনীত, তখন অতীতের পথে হেঁটে সেই ভালোবাসার ক্ষণের জন্য নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে। তখন মানুষ সঙ্গীকে দোষারোপ করেন, তুমি বলেছিলে বলেই না আমি ওটা করেছিলাম! আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছ তুমি। আজ তোমার জন্যই আমার এই সর্বনাশ হলো। বিচারে ঝটপট এ রকম মৌখিক রায় দেওয়া খুব সহজ। কিন্তু খতিয়ে দেখলে দেখা যায় সঙ্গীকে খুশি করার জন্য হয়তো সামান্য উস্কানিতে নিজের ইচ্ছেতেই মানুষ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন। যে সময়ের প্রেম সে সময়ের জন্য সত্য হয়ে ঐতিহাসিক স্তম্ভের মতো টিকে থাকে। তার ওপরে হাজার কালিমা লেপনে তা অস্পষ্ট হবে না, মিথ্যে হবে না। পরের ঘটনার ধারাকে বিবেচনায় নিয়ে আগের ঘটনাকে মিথ্যা ঘোষণা করা যায় না। তাই প্রতিটি প্রেম পরেও সত্য।
দাম্পত্যে শুধু প্রেম নয়, বোঝাপড়া দরকার- যার নাম বন্ধুত্ব। প্রথমদিকে সম্পর্ক অনেকটাই মানসিক ও শারীরিক প্রেমনির্ভর হলেও সামান্য বয়স বাড়তেই তাতে বন্ধুত্বের রসদ প্রয়োজন। বন্ধুত্বের শুরুতেই আসে বিশ্বাসের প্রসঙ্গ। কোনো কারণে এই দুটো জায়গায় চিড় ধরলে মানুষ হোঁচট খেয়ে সীমান্তে গিয়ে উপস্থিত হয়। তারপর বাইরে দাঁড়িয়ে দেখে বিশ্বাস কী করে ভঙ্গুর কাচের মতো চুরচুর হয়ে যায়, তখন নিতান্ত নিয়মের দাম্পত্য, মনমরা কিংবা অন্য কোথাও মন খোয়ানো। কিছুদিন আগে গল্পের চরিত্রের মুখে সংলাপ বসিয়ে কয়েক মুহূর্ত সেদিকে তাকিয়ে থাকতে হয়েছিল। এ রকম ভাবনা হয়তো কখনও নিজের অজান্তেই বেরিয়ে আসে, কারও দাম্পত্যের সীমান্তের ভাবনায় ...
মা আর কন্যা চরিত্র। মা কন্যার বিয়ে ঠিক করেছেন, কন্যার পছন্দ হয়নি পাত্র। কন্যা বলে-
'ওরকম একটা লোকের সঙ্গে আমি প্রেম করব কীভাবে?'
মা অবাক, ঠোঁট উল্টে বলেন-
'সংসার করতে আবার প্রেমের দরকার পড়ল কেন?'
বহু বছরের সাংসারিক অভিজ্ঞতায় দাম্পত্যের সীমান্তে পৌঁছে মায়ের কাছে যে প্রেম অপ্রয়োজনীয়, কন্যার কাছে দাম্পত্যের শুরুতে সেই প্রেমই অবশ্য প্রয়োজনীয়। দাম্পত্যের প্রারম্ভে প্রেম মানুষকে পরিচালিত করে, পরে হয় অভ্যাস। হয়তো সময়ের সঙ্গে সংজ্ঞা পাল্টে ওই অভ্যাসটাই প্রেম। কারণ বারবার বিস্মিত, মুগ্ধ হতে হতে একসময় মানুষ একই বিষয়ে আর মুগ্ধ-বিস্মিত হতে পারে না। সঙ্গী সঙ্গেই আছেন, এই ঘিরে থাকার বোধটাই তখন প্রধান হয়ে ওঠে। ঘিরে না থাকলে অস্বস্তি হয়। পৃথিবীর অন্য সুখও চাই, আবার সঙ্গীর উপস্থিতিও চাই। সে আমার জন্যই তৈরি আছে- অন্তত এই সান্ত্ব্বনা চাই। অন্যদিকে, সীমান্তে দাঁড়িয়ে সঙ্গী কাছে থাকাকে কম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ভাবার প্রবণতাও আসে, যাকে বলে টেকেন ফর গ্র্যান্টেড। বাতাসের সমুদ্রে ডুবে থাকতে থাকতে যেমন তার বাতাসের উপস্থিতি নিয়ে কেউ ভাবে না। বাতাস হুট করে নাই হয়ে যেতে পারে, শুধু এই বাস্তবতা সামনে এলে বাতাসের সহজলভ্যতা নিয়ে যেমন ভাবনা আসে, পুরোনো প্রেম ঠিক তেমন। তাতে বুক ভরে প্রতিদিন শ্বাস নেওয়া চলে, তবে নিজের অলক্ষে, অন্তত যতক্ষণ পরিবেশ গুমোট হয়ে না ওঠে!
মন্তব্য করুন