লেখক আপন স্বভাবদোষে যতই অসামাজিক হোক, কিংবা প্রচলিত সমাজ-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী বা বিপ্লবী যোদ্ধা, সমাজের নূ্যনতম ইউনিট পরিবার তার জন্যও অপরিহার্য। শৈশবে তো বটেই, যৌবনে স্বাধীন-স্বাবলম্বী ও বৃদ্ধ বয়সে কিছুটা পরনির্ভর হওয়ার পরও। এ সত্য আমি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি বালক বয়সেই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হলে।
যৌবনে ঢাকায় এসে বছর পাঁচেক বিদ্রোহী ও উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের পর আমি পরিবারের প্রয়োজনীয়তা আবার হাড়েমজ্জায় অনুভব করতে লাগলাম। যে বন্ধুর সঙ্গে মেসে থাকি, তার এবং মেসের বাইরেও ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা ও আড্ডায় সাময়িক আনন্দ মেলে। তাদের সঙ্গ পেতে অনেক সময় খালি পেটেও মৃতসঞ্জীবনী সুরা কি তাঁতীবাজারে দেশি জিনিস পানেও আপত্তি করি না। কিন্তু এসব অনিয়মের ফলে ক্ষতির দিকটা বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ততদিনে। যখন-তখন পেটব্যথায় কুঁকড়ে যাই।
সব সমস্যার সমাধান হিসেবে নিজের সংগ্রামী জীবনের উপযুক্ত মেয়েসঙ্গী ও নিজের মনের মতো পরিবার সংগঠনের বিষয়টি প্রধান হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ বাইশ বছর বয়সেই বিয়ে করেছিলেন। গাঁয়ের ছেলেরা আরও কম বয়সে করে। আমি বাইশ পেরিয়ে তখন তেইশে, যত দোষ থাক, নিয়মিত বেতন পাওয়ার চাকরিটা তো আছে। অতএব আর দেরি করছি কেন?
আমার বিপ্লবী রাজনৈতিক বন্ধুরা বিয়ের প্রয়োজনটাকে তেমন পাত্তা দেয় না। বিয়ে ও পরিবার নিয়ে মার্কস-অ্যাঙ্গেলসের ব্যাখ্যা শোনায়। আমার হবু স্ত্রীকেও 'লিগ্যাল প্রস্টিটিউট' বলে গাল দেয়। বিয়ে না করে কত বড় ঘরের ছেলেরা, যেমন মণি সিংহ ও রণেশ দাশ গুপ্ত, সিরাজুল আলম খান সাম্যবাদী সমাজ গড়ার স্বপ্ন-সংগ্রামে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, সে রকম হতে প্রেরণা দেয়। আবার বিয়ে না করেও দলের মেয়ে কমরেডের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে স্ত্রীর প্রয়োজন মেটানো যায়, এমন উদাহরণও দেয় ঘনিষ্ঠ এক রাজনীতিক বন্ধু।
স্বাধীনতা লাভের পর, মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে জাতীয় ঐক্যে ভাঙনের সুর নিজের পরিবারেই টের পাই প্রথম। পিতা যেহেতু মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা, ফলে ইউনিয়ন পরিষদের রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান হলেন তিনি। রিলিফ বিতরণে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ক্ষতিগ্রস্ত ও হতদরিদ্র মানুষের জন্য তার যে ধরনের দরদ ও দায়িত্ববোধ থাকা প্রয়োজন, তার অভাব ব্যর্থ-মুক্তিযোদ্ধা পুত্রের দৃষ্টিতেও দৃষ্টিকটু হয়ে ওঠে। কিন্তু গ্রামে থেকে পিতার বিরুদ্ধে কিংবা সাধারণ মানুষের পক্ষে রাজনীতি-সংগঠন করা আমার কাজ ছিল না।
রংপুর শহরে আমার অন্য মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুরা, বিশেষ করে মুজিববাহিনীতে ছিল যারা, তারা অনেকেই অস্ত্র লুকিয়ে রেখে স্বাধীন দেশে নিজেদের ক্ষমতা ও শক্তিমত্তা বাড়ানোর নানা রকম পাঁয়তারা করছিল। শহরের অবাঙালি মালিকদের খুঁজে না পেয়ে তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, দোকান ও বাড়িঘর দখল করেছে অনেকে। স্টেশন রোডে আলমনগরে এ রকম একটি দখলকৃত বাড়িতে যেন রাতারাতি গড়ে উঠেছে 'চক্রবাক' নামে একটি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠন।
নতুন গজিয়ে ওঠা সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করার জন্য লজিংবাড়ি ছেড়ে দিয়ে আমি 'চক্রবাক' অফিসের একটি কক্ষে উঠে বসবাস শুরু করি। অতঃপর গান শেখার ক্লাস, সাহিত্যের আড্ডা-অনুষ্ঠান, নতুন কর্মসূচি প্রণয়ন, একুশে উদযাপনের প্রস্তুতি ও একুশে সংকলন প্রকাশ, চাঁদা তোলা, সেমিনার কি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন- সব কাজেই শরিক হতে বেশ উৎসাহ বোধ করি। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক কাজের সঙ্গে একাত্মতার বোধ ভেঙে একা হতে থাকি। সংগঠনের নেতাদের সঙ্গেও বিরোধের সম্পর্কটা বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ক্লাস সিক্স থেকেই বাড়িছাড়া ও শহরে ছিলাম বলে মা-বাবা তেমন আদব-কায়দা শেখানোর সুযোগ পাননি। মনোভাব যে গোপন করে চলতে হয় এ সমাজে, মুখে এক ও মনে আরেক রকম থাকা কৌশলও বটে- সেটা শিখিনি। ভেতরের আবেগ-চিন্তা অকপটে প্রকাশ করতে পারলেই আনন্দ হতো। বাক-স্বাধীনতা প্রচলিত বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণার বিরুদ্ধে গেলেও ভয় পেতাম না। তা ছাড়া বিখ্যাত কবি-লেখক হওয়ার স্বপ্নটা এমনভাবে বলতাম, যেন হয়েই গেছি। বয়সে প্রায় দ্বিগুণ বড় 'চক্রবাক' সংগঠনের সর্বজন শ্রদ্ধেয় সভাপতি দাদার সামনেও সিগারেট টানতাম। বন্ধুদের সঙ্গে মদ্যপানের বিষয়টিও গোপন করার প্রয়োজন বোধ করতাম না। আরেক বয়োজ্যেষ্ঠ নেতাকে বলেছিলাম, 'আপনাকে তো মনে হয় ভুসি মালের বস্তা।'
আরেকটা উদাহরণ দিলে নিজের দোষটা আরও স্পষ্ট হবে। 'চক্রবাক' অফিসের কাছে শহরের নিষিদ্ধ পল্লি ছিল। বেশ্যালয়ের পরিবেশ ও কা কীর্তি দেখার কৌতূহল নিয়ে এক সন্ধ্যায় জনৈক বন্ধুকে নিয়ে ভেতরে গিয়ে ঘোরাঘুরি করেছিলাম অনেকক্ষণ। সভাপতি জিজ্ঞেস করলেন, 'সন্ধ্যায় তোমাকে দেখলাম না, কোথায় ছিলে?' হাসিমুখে সত্যি জবাব দিলাম। সভাপতি মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। দেখার কৌতূহল মেটানো ছাড়া খারাপ কিছু করিনি, পকেটে অতো টাকাও ছিল না- নিশ্চয়তা দেওয়ার পরও তিনি বিশ্বাস করলেন বলে মনে হলো না।
রবীন্দ্রনাথের ২২ বছর বয়সে বিয়ে করার ঘটনা নিজেকে প্রেরণা দিয়েছিল, কিন্তু তিনিও তো পছন্দমতো নিজের প্রেমিকাকে নয়, পারিবারিকভাবে অভিভাবকদের পছন্দমতো বিয়ে করেছিলেন। আমার পরিবার-প্রধান পিতার সঙ্গে যে সম্পর্ক, তাতে তেমন আশা করতে পারি না। তারপরও পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কটা সহজ করতে ছোট ভাই সঞ্জুকে ঢাকায় এনে জগন্নাথ কলেজে ভর্তি করিয়ে দিলাম। দু'ভাই মিলে শাজাহানপুর এলাকায় একটা ঘর ভাড়া করে থাকি।
রংপুরে 'চক্রবাক'-এর এক কর্মী গোলাম কিবরিয়া খোকন ঢাকায় এসে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছিল। আর একজন অচেনা কর্মী ঢাকায় কী এক চাকরির ইন্টারভিউ দিতে এলে অফিসে পরিচয় হলো। সে উপযুক্ত এক পাত্রীর সন্ধান দিল। মেয়েটি 'চক্রবাক'-এর সঙ্গে জড়িত, গান শেখে, কবিতা-গল্পও লেখে। নাম বেলা। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছে। দেখতেও ফর্সা-লম্বা, মোটামুটি সুন্দরী বলা যায়। চক্রবাকের কাছে আলমনগরেই নিজেদের বাড়ি। শহরে নিজেদের বাড়ি আছে শুনে ভয় পেয়ে বলি, এই মেয়ে তো আমার মতো গরিবের ঘরে আসতে চাইবে না। ঘটক মামা আশ্বাস দিয়ে বলে, স্টেশনমাস্টার পিতা হঠাৎ মারা যাওয়ায় পরিবারটি এখন অভিভাবক শূন্য ও গরিবি দশায় আছে। বড় ভাই কোনোমতে একটা মুদি দোকান চালায়। আর বড় বোন মাস্টার্স করে সবে শহরের বাইরে একটা বেসরকারি কলেজে অধ্যাপনায় ঢুকেছে। আমার যেমন ঢাকায় এসে স্বনির্ভর ও লেখক হওয়ার স্বপ্ন ছিল, স্বনির্ভর হয়েই ছোট ভাইটিকেও মানুষ করার চেষ্টা করছি, আমার সম্ভাব্য জীবনসঙ্গী বেলাও একই স্বপ্ন দেখছে- ঢাকায় এসে চাকরি করবে, কবিতা-গানও করবে, তারপর অভাবী পরিবারে অন্তত ছোট বোনকে সাহায্য করবে।
সন্ধানদাতা জোর গলায় বলল, এটা হলে দু'জনই উপযুক্ত জীবনসঙ্গী পাবেন। ঘরে-বাইরে লড়ার যোগ্য কমরেড হবেন দু'জনই এবং শুভ কাজটি ঘটিয়ে দেওয়ার ব্যাপারেও তার আত্মবিশ্বাস ষোলোআনা।
আমি হবু-জীবনসঙ্গীর জন্য বাস্তব অবস্থার পটভূমিতে নিজের স্বপ্ন-পরিকল্পনার সংবিধান তো আগেই রচনা করে রেখেছিলাম। সেই সংবিধানের কপি, ছবি ইত্যাদি ঘটক মামার হাতে দিয়ে ফলাফল জানার জন্য অস্থির অপেক্ষা করতে লাগলাম।
কিছুদিনের মধ্যে জবাব এলো। সবকিছু জেনে ও আমার ছবি দেখে এবং লেখা পড়ে মেয়ে সম্মত। বেলা তার ছবি ও হাতে লেখা কবিতাও পাঠিয়েছে। কবিতার চেয়ে হাতের লেখা সুন্দর। নাম জেনেই মন ডেকেছিল, আর ছবিটি দেখামাত্রই মন বলে উঠল- এই সেই মেয়ে, যার জন্য এতদিন তুমি অপেক্ষা করছো। চিঠি চালাচালিতেই কথাবার্তা মোটামুটি চূড়ান্ত হলো। আমি দেখতে যাব, বাস্তব দেখাদেখির পর্ব শেষে সম্মতি দিলেই বিয়ে হবে এবং বিয়ের পরদিনই বউ নিয়ে ঢাকায় আসব। বিয়ের সামাজিকতার নামে বাজে খরচ কোনো পক্ষই করব না। বিয়ে করব বলে দু'রুমের একটা বাসা ভাড়া নিয়েছিলাম। বউ দেশ থেকে শিগগির আসবে বলে ওয়াদাও করেছিলাম বাড়িওয়ালাকে। কলেজ ছুটি থাকায় আমার ছোট ভাইটি তখন বাড়ি চলে গিয়েছিল। আমি নিজের 'শুভ বিবাহ' কারণ দেখিয়ে অফিসে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে গেলাম রংপুরে।
'চক্রবাক' আমার দেখা স্টেশন রোডের সেই বিশাল বাড়িটি শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেনি। তবে স্থানীয় প্রশাসন ও ক্ষমতাসীনদের ধরপাকড় করে আলমনগরেই আরেকটা ছোট পরিত্যক্ত বাড়ি বরাদ্দ নিয়ে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল। পরিচিত নেতাকর্মীদের অনেকেই চাকরি নিয়ে বা চাকরির ধান্ধায় কেটে পড়েছে। কিন্তু কর্ণধার সভাপতির কোথাও যাওয়ার বা করার কিছু নেই বলেই হয়তো কিংবা হতে পারে সাংস্কৃতিক কাজের প্রতি তার নেশা ও নিষ্ঠার কারণেও, নতুন চক্রবাক অফিসে অবস্থান করে সংগঠনকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছিলেন।
তার সঙ্গে দেখা হলে আগমনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দেখলাম, তিনি আগেই জেনে গেছেন সব। সংগঠনের গানের ক্লাসে কিশোরী বোনকে নিয়ে এসেছিল সে। সভাপতি দাদাই পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমার চোখের ভাষা তো হাজার ওয়াট-পাওয়ার বাল্ক্বের মতো উজ্জ্বল ছিলই, তার লাজুক চোখের ভাষাতেও সম্মতি বুঝলাম। কথা বলার আগে চার চোখের মিলনেই যেন বিয়েটা হয়েই গেল। 
এরপর রাতেই মেয়ের বড় ভাইতুল্য এক অভিভাবক এলো পাত্র দেখতে। তাকে নামে ও চেহারায় চিনতাম। রংপুর বেতারে নিয়মিত গান করে, সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবেও শহরে পরিচিত, বাতেন সরকার নাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে বাড়িতে বেকার বসে আছেন। আনুষ্ঠানিক পরিচয়ের পর রেস্টুরেন্টে বসে চা-সিগারেটের সঙ্গে বাতেন ভাইকে নিজের বিয়ের প্রয়োজনীয়তা, যোগ্যতা-অযোগ্যতা, স্বপ্ন-পরিকল্পনা সবই মন খুলে বললাম। বুঝলাম, আমাকে তার পছন্দ হয়েছে এবং এ বিয়ে উভয়ের জন্য ভালো হবে বলে মত দিলেন। এরপর নিজের মতটি জানানোর জন্য সরাসরি চলে গেলেন মেয়ের বাড়িতে। রাতে ঘটক মামার ঘরে আমার থাকার আশ্রয় হলো। মেয়ের বাড়ি থেকে আসা হবু-জামাইকে আপ্যায়নের পোলাও-কোরমা ইত্যাদি সুস্বাদু খাবারের সঙ্গে বেলার হাতের রান্নাও ছিল দু'পদের, যা ঘটক মামা চিনিয়ে দিয়েছিল।
বলা বাহুল্য, বেলার হাতের রান্নার স্বাদটাই বেশি ভালো লেগেছিল। বেলা আমার জন্য ধোপদুরস্ত বিছানা-বালিশও পাঠিয়েছিল। এসব তৃপ্তিদায়ক আচরণের পর, মেয়ের অভিভাবকদের পক্ষ থেকে আমার জন্য অস্বস্তিকর একটা প্রস্তাব এলো। বিবাহ যেহেতু একটি সামাজিক ব্যাপার এবং আমার যেহেতু মা-বাবা জীবিত আর বাড়ি খুব দূরেও নয়, মুরব্বি-অভিভাবকের কেউ উপস্থিত না থাক, নিদেনপক্ষে তাদের মতটা নেওয়া জরুরি। তাদের কথাটা যুক্তিযুক্ত। কিন্তু আমি পড়লাম মহা ফ্যাসাদে। ছোট ভাইটিকে ঢাকায় নেওয়ার পরও পিতার সঙ্গে আমার সম্পর্কের উন্নতি ঘটেনি। কথাবার্তাও হয় না। বিয়ে করব বলে তার মতামতের ধার ধারিনি। কিন্তু আমার মা-বাবার প্রতি মেয়ে পক্ষের ভক্তিশ্রদ্ধা দেখে সম্মত না হয়ে উপায় রইল না। সিদ্ধান্ত হলো, আমি আগামীকাল বাড়িতে যাব। তার পরদিন মেয়ে পক্ষের বড়জোর জনাদশেক লোক আমাদের বাড়ি দেখতে যাবে। আমার পিতার মত নিয়েই চলে আসার পরদিনই শুভ বিবাহ সম্পন্ন হবে এবং পরদিন নববধূ বেলাকে নিয়ে আমি ঢাকায় যাব। বেলাও এ রকম মত দিয়েছে জেনে বহুদিন পর গেলাম বাড়িতে।
বাড়িতে গেলেও পিতা আমাকে এড়িয়ে চলেন। মুখোমুখি কথাবার্তা হয় না। নিজেই স্বজনদের সামনে বিয়ের প্রয়োজনীয়তা ও পাত্রী ঠিক করার কথা বলে পিতার সম্মতি চাইলাম। তিনি মুখ ঘুরিয়ে রাখলেন। ঘনিষ্ঠদের মাধ্যমে পাত্রীর বংশপরিচয়, আসল বাড়ি, ভাইয়ের কী ব্যবসা, বাড়িঘরের চেহারা কেমন- ইত্যাদি জানতে চাইলেন। আমি এসব খোঁজ নেওয়া জরুরি মনে করিনি। পিতা নিকট আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত দিলেন, বিয়ে করাটা যখন এতই জরুরি, উপযুক্ত মেয়ে খুঁজে আমি বিয়ে দেব ওর। আবার বিদ্রোহী হতে হলো। সামনে গিয়ে বললাম, 'বিয়ে করব আমি, আর মেয়ে পছন্দ করে দেবেন আপনি? এটা কেমন কথা! এসব গ্রাম্য নিয়ম আমার জন্য খাটবে না। আমি তো কচি খোকা নই, সব দেখেশুনে মেয়ে পছন্দ করেছি। আমার বিয়েতে আপনার একটা টাকাও খরচ হবে না। কোনো মুরব্বিকেও থাকতে হবে না, কারণ বিয়ে করেই বউকে নিয়ে ঢাকা চলে যাব আমি। শুধু কালকে মেয়ে পক্ষের লোকদের আপ্যায়ন করে মতটা দিলেই আপনার দায়িত্ব শেষ হবে।'
মা ও ছোট ভাই এবং আরও কিছু স্বজন পক্ষে থাকায় পিতা মনে হয় নত হলেন।
পরদিন মেয়ে পক্ষের লোকজনদের আপ্যায়নে কোনো কার্পণ্য করেননি। মত দেননি শুধু, বেয়াই যেহেতু জীবিত নেই, বিয়ের পর তার বক্তব্য বেয়ানকে বলার জন্য একটি চিঠি লিখেও মেয়ের ভাইয়ের হাতে দিয়েছিলেন। আমার সম্পর্কে কী ক্ষোভ-দুঃখের কথা লেখা ছিল সে চিঠিতে জানি না। পরদিন গাঁয়ের ভাবিরা ঘটা করে বাড়িতে আমার গায়ে হলুদ দিল। গীত ও নাচে বাড়ি মাতালো প্রতিবেশী বুড়ি দাদি। তারপর বিকেলে ছোট ভাইসহ চারজন বরযাত্রী নিয়ে ট্রেনে চেপে শহরে গেলাম বিয়ে করতে।
কথা ছিল মেয়ে পক্ষ স্টেশন থেকে বরকে রিসিভ করে নিয়ে যাবে বাড়িতে। কিন্তু কাউকে না দেখে, হেঁটেই কাছাকাছি দূরত্বে গেলাম 'চক্রবাক' অফিসে। সেখানে ঘটক মামা ও সভাপতি দাদাকেও পেয়ে গেলাম। তাদের মুখ ভার। ঘটক মামা নিজেও গতকাল আমাদের বাড়িতে গিয়ে বিয়ের ভোজ খেয়ে সাফল্যের আনন্দ নিয়ে এসেছে। এখন কান্নাচাপা নতমুখ কেন? সংগঠনের সভাপতি দাদা জানালেন, 'সবই ঠিক ছিল রে মঞ্জু, কিন্তু মেয়ের বড় বোন বাড়িতে এসে গোল বাধিয়েছে। ছেলের ছোট চাকরি, বেতন কম, লিনথিন দেখতে- এসব শুনে আপত্তি করছে সে।' সভাপতি দাদা নিজেও তাদের বাড়িতে গিয়ে অনেক বুঝিয়েছেন, কিন্তু ওরা এখন রাজি না।
এমন ঘটতে পারে, ভুলেও ভাবিনি একবারও। জীবনের সেরা হোঁচটটি খেয়েও মনে হলো, কোথায় যেন একটা চক্রান্ত আছে। বললাম, 'আমাকে মেয়ের বাড়িতে নিয়ে চলেন, আমি বেলার সঙ্গে কথা বলব।' সভাপতি বললেন, 'আমি বেলাকে ডেকেও কথা বলেছি, সে আগে মত দিয়েছিল, কিন্তু এখন রাজি না।' তারপরও আমি সে বাড়িতে যাওয়ার কথা বললে সভাপতি জানালেন, মেয়েকে নিয়ে তার বড় বোন আজ সন্ধ্যার ট্রেনেই তার কর্মস্থলের বাসায় চলে যাওয়ার কথা, এতক্ষণে চলে গেছে নিশ্চয়।
ঘটক মামাও উপস্থিত, আরও দু'একজন বিষণ্ণ বদনে চুপচাপ। বরযাত্রীদের মধ্যে আমার ছোট ভাইটি সশব্দে কেঁদে উঠল প্রথম। তার কান্না সংক্রমিত হলো অন্যদের মাঝেও। কিন্তু বর যেন পাথর হয়ে গেছে। ঘটক মামা আমাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য তার ঘরে নিয়ে গেল। যে ঘরে দু'দিন আগেও জামাই-আদর ভোগ করে গেছি, বিয়ের আগেই যে মেয়ে তার সম্মতি বোঝাতে আমাকেই শুধু নিজের হাতের রান্না খাওয়ায়নি, বিয়ের পরদিনই আমার সঙ্গে ঢাকা যাবে বলে চক্রবাকের এক বন্ধুকে ঢাকার নতুন সংসারে আমন্ত্রণ জানিয়েও বিয়েতে তার সম্মতি নিশ্চিত করেছিল। এখন রাত জেগে, হয়তোবা সারা জীবনব্যাপী বিশ্বাসঘাতক ও প্রতারক মেয়ের কাছে পাওয়া আঘাতের পরিমাণ আমাকে মাপতে হবে।
বিয়েবাড়ির খাওয়ার বদলে কান্না নিয়ে ছোট ভাইয়েরা একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু আমি ঘুমাতে পারি না। জীবনের সমস্ত সুখস্বপ্ন-প্রেরণা-বিশ্বাস এক দমকায় উড়িয়ে দিয়ে কলিজা ছিন্নভিন্ন করা এমন ঝড়ের মুখে পড়িনি কখনও। এমন ঝড়ের মধ্যেও মনে হলো, বাড়িতে ফিরে পিতাকে মুখ দেখাতে পারব না এ জীবনে। যে কোনো প্রকারেই হোক- বিশ্বাসঘাতক প্রতারক বেলাকে খুন করতে হবে, তা হলে ফাঁসিকাঠে ঝোলার আগেও হয়তোবা আত্মা কিছুটা শান্তি পাবে আমার। সারারাত ঝড়ের দোলায় আকাশ-পাতাল দুলেও কোনো সিদ্ধান্তে স্থির হতে পারলাম না।
বাতেন ভাই আমার হাত চেপে ধরে বললেন, 'আপনি আজকের দিনটা আমাকে সময় দিন, ভাইদের নিয়ে এখানেই অপেক্ষা করুন। দেখি আমি কী করতে পারি।'
বাতেন ভাইয়ের সহানুভূতি উপেক্ষা করতে পারলাম না। ঘণ্টা তিনেক পর তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন আমার পুরোনো হাইস্কুলের পাশের এক হোমিও দোকানে। স্কুলে পড়ার সময় এই দোকানের সমুখ দিয়ে স্কুলে যেতাম ও ভেতরে ডাক্তারি চেয়ারে বসা বুড়ো ডাক্তারটিকেও অনেক দেখেছি। একবার আমাশয় রোগে তার ওষুধ খাব কিনা, দ্বিধা-দ্বন্দ্বে বাইরে দাঁড়িয়ে থেকেও হোমিও ওষুধের ওপর আস্থা জাগাতে পারিনি। বাতেন ভাই আজ ভেতরে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন, বৃদ্ধ ডাক্তার তার পিতা। আমাকে দোকানে কিছুক্ষণ বসতে বলে কোথাও চলে গেলেন তিনি। বুড়ো ডাক্তার এবং পরে আরও এক অচেনা মুরব্বি আমার ইন্টারভিউ নিতে লাগল। ঘণ্টা খানেক সেখানে অবস্থানের পর আমি বরযাত্রী ছোট ভাইদের কাছে ফিরে গেলাম। হোটেলে নিয়ে খাওয়ালাম তাদের। বিকেলের মধ্যে শিল্পী বন্ধু বাতেন ফিরে এলেন আবার। সকাল থেকে ছোটাছুটি করে, মোটামুটি সব আয়োজন সম্পন্ন করে একান্তে খবরটি জানালেন আমাকে। আমার সঙ্গে কথাবার্তা বলে সত্যই আমাকে তার পছন্দ হয়েছে। এই সংকট থেকে আমাকে উদ্ধারের জন্য বিকল্প পাত্রী ঠিক করে ফেলেছেন। পাত্রী আসলে তার আপন ভাগনি, নিজের মেয়েও বলা যায়। শহরের উপকণ্ঠে নিজেদের বাড়ি, পিতা প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। বোন-দুলাভাইকে বলে বাতেন ভাগনিকে নিজেদের বাড়িতে এনে শহরের স্কুলে পড়িয়েছেন। এখন বেগম রোকেয়া কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ছে। আমি যে রকম জীবনসঙ্গী খুঁজছি এবং বন্ধুটি আমার প্রয়োজন সে রকম বুঝেছেন, তাতে তার ভাগনি সাহেদা কোনো দিক দিয়েই আমার অযোগ্য হবে না। এখন সন্ধ্যায় দেখার পর আমি দেখেশুনে মত দিলে রাতেই বিয়ে হবে।
আমার দুঃসময়ে বন্ধুর আন্তরিক সহানুভূতি ও ছোটাছুটি দেখে, তাকে অবিশ্বাস করার কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না। বললাম, 'মেয়েকে দেখার প্রয়োজন নেই। দেখতে সে যেমনই হোক, সব জেনেশুনে আপনার ভাগনিও যদি মত দিয়ে থাকে, তাহলে আপনাকেও এখনই মামা ডাকতে আমার আপত্তি নেই।'
সন্ধ্যার পর চক্রবাকের বেশ কিছু বন্ধু বরযাত্রী দলে যোগ দিল। মেয়ের নানা-বাড়িটিও আমার চেনা। কারণ স্কুলে পড়ার সময় এ মহল্লাতেও বছর কয়েক ছিলাম আমি। সন্ধ্যার পর তবু আনুষ্ঠানিকভাবে পাত্রী দেখানো হলো। আমার বরযাত্রী ভাই-বন্ধুরা মহাতৃপ্তিতে বিয়ের খাওয়া খেতে লাগল।
প্রথম পছন্দ করা মেয়ের সঙ্গে অনিবার্য মিলনের মাঝখানে সহসা যে প্রচ স্বপ্ন-বিধ্বংসী ঝড় সামলে ভেতরের কান্নাকে চেপে রেখেছিলাম, তা নববধূকে একান্তে পাওয়ার আনন্দে চোখ উছলে উঠেছিল। চোখে কান্না নিয়ে বলেছিলাম, 'মামার কাছে সবই তো শুনেছো, তুমিও আমাকে ছেড়ে যাবে না তো? সুখে-দুঃখে আমার পাশে সারাজীবন থাকবে তো?' সাহেদা ওরফে আমার সাজু ঘাড় দুলিয়ে এবং আমার হাত ধরেও সম্মতি দিয়েছিল। আমিও মনে মনে শপথ নিয়েছিলাম, যে কোনো মূল্যে তাকে সুখী করার চেষ্টা করব এবং কোনো অবস্থাতেই ত্যাগ করব না তাকে।
বিবাহ-নাট্যের এ খবর ওদিকে গ্রামের বাড়িতেও আমার পিতা জেনে গেছে। কারণ মেয়ের নানাজি তার শিল্পী ছেলের ওপর নির্ভর করে মত দেয়নি। গোপনে তার পরিচিত ও বিশ্বস্ত এক বন্ধুর মাধ্যমে আমার চৌদ্দগোষ্ঠীর খবর জেনেছে এবং তার মত পাওয়ার পরই বিয়েতে সম্মতি দিয়েছিল। নানা-শ্বশুরের সেই বন্ধু ছিল আব্বারও বিশেষ পরিচিত। তার কাছেই সব জেনে বিয়ের পরদিনই আব্বা পুত্রবধূর জন্য শুভেচ্ছা-উপহারসহ আমাদের বংশের একজন মুরব্বিকে পাঠিয়েছিল শহরে।
বিয়ের পরদিন ছিল পঁচিশে বৈশাখ। রবীন্দ্রজয়ন্তীর এক অনুষ্ঠানে বাতেন মামা গান করবেন। তার আমন্ত্রণে নববধূকে নিয়ে গেলাম সেই অনুষ্ঠানে। সেখানে বেলার ছোট বোন পারুলকে দেখে চমকে ওঠেছি। বেলা ও তার গোটা পরিবারকে সাজুও চিনত। পারুল জানাল, বেলা আজ বড় আপার সঙ্গে তার কলেজের বাসায় চলে গেছে। যাওয়ার আগে বাতেন ভাইকে দেওয়ার জন্য একটা চিঠি দিয়ে গেছে, সেই চিঠি দেওয়ার জন্য এসেছে সে। তার মানে আমি বেলাকে বিয়ে করতে আসার দিন রাতে বাড়িতেই ছিল সে? প্রশ্নটা মনে জাগলেও বেলা, বেলার চিঠি ও তার বোনকে নিয়ে বিন্দুমাত্র কৌতূহল দেখাইনি আর। মনোযোগ দিয়ে অনুষ্ঠান দেখেছি।
আয়োজকদের অনুরোধে মঞ্চে উঠে রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতাও আবৃত্তি করেছি। সন্দেহ নেই, শ্রোতাদের মধ্যে আমার সাজু সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ হয়ে শুনেছিল স্বামীর আবৃত্তি। কিন্তু অন্যদের মতো জোরে তালি বাজায়নি স্বভাবজাত লজ্জায়।
এভাবে ১৯৭৬-এর ৭ মে যে দাম্পত্য যাত্রা শুরু হয়েছিল, তারপর থেকে সুখে-দুঃখে দু'জনে একাত্ম থেকে সামনে এগোনোর লড়াই- এ লেখাটি লেখার সময় পর্যন্ত অব্যাহত আছে। বিয়ের ছয় বছরের মধ্যে দু'জনের পরিবার-সংগঠনে আরও দুই সদস্য যোগ দিয়েছে। বয়সে শিশু হলে হবে কি, নিজেরা হাঁটা শেখার আগেই, সমস্ত প্রতিকূলতা ঠেকিয়ে সামনে এগিয়ে চলার জন্য সন্তানই মা-বাবার 'জীবন-ইঞ্জিনে' বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জ্বালানি হিসেবে কাজ করেছে। দু'সন্তানের মা-বাবা হওয়ার পর ওদের মানুষ করার লক্ষ্যটা আমাদের দু'জনেরই প্রধান অঙ্গীকার হয়ে উঠেছিল। প্রতিশোধ-প্রতিহিংসায় বেলাকে দেখে নেওয়ার শপথ করেছিলাম সেই ঝড়ের রাতেই। বিয়ের মাসাধিক কাল পর নতুন শ্বশুরবাড়ি গেলে, বেলার সঙ্গে দেখা করার জন্যও গোপনে একদিন সরাসরি তাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। দরজার কড়া নাড়লে দরজা খুলে অবাক হয়েছিল সে। নিভৃত ঘরে বসে মুখোমুখি কথা শুরু হয়েছিল তার সঙ্গে। বিয়েটা না হওয়ার জন্য প্রধানত দায়ী করেছিল সে 'চক্রবাক'-এর সভাপতি দাদাকে এবং দ্বিতীয়ত আমাকেও। কারণ তার বড় বোন বাড়িতে এসে বর সম্পর্কে জানতে সভাপতি দাদাকে ডেকে তার মতামত জানতে চেয়েছিল।
সভাপতি সত্যি কথাই বলেছিল। যেমন ছেলেটি উচ্ছৃঙ্খল, বেপরোয়া টাইপের, ইচ্ছে করেই উচ্চশিক্ষা নেয়নি, নেশাভাং করত, ছোট চাকরি, বেতন কম, বাপে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল ইত্যাদি। সভাপতি এ রকম যদি বলে থাকে, মিথ্যে বলেনি অবশ্যই। কারণ নিজের সম্পর্কে লেখা স্বপ্ন-পরিকল্পনার সংবিধানে বেলার কাছে আমি তো অযোগ্যতা বা দুর্বলতার দিকগুলো লুকাইনি। এগুলো থেকে মুক্ত হয়েই সুশৃঙ্খল জীবনে ফেরার জন্যই পরিবার সংগঠন ও জীবনসঙ্গীর সহযোগিতা প্রয়োজন হয়েছিল।
বেলার জবাব ছিল, আমার লেখা পড়ে আমার ওপর তার বিশ্বাস জেগেছিল। কথাবার্তা পাকা হওয়ার পর তার মধ্যে বিন্দুমাত্র দ্বিধা জাগেনি। কিন্তু সভাপতির কথা শুনে তার বড় বোন ও মায়ের মধ্যে স্বভাবতই দ্বিধা-ভয় জেগেছিল কিছুটা। ভালো করে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য সময় চেয়েছিল তার বড় বোন। বেলা মা-বোন কি সভাপতি দাদার সামনে তাদের মতের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ করতে পারেনি। তবে অপেক্ষায় ছিল বর তাদের বাড়িতে আসবে। আমি যেমন বেলাকে বিয়ে করার জন্য নিজের পিতার মতের বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নিয়েছিলাম, তেমনি বরযাত্রী বাড়িতে উপস্থিত হলেই সে মা-বোনের বিরুদ্ধে গিয়ে আমার পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু সারারাত অপেক্ষার পরও বর বাড়িতে আসেনি। পরদিন আমার বিয়ের খবর শুনে প্রিয় বাতেন ভাইকে নিজের জীবন ধ্বংস হওয়ার দুঃখ জানিয়ে একটি চিঠি দিয়ে বড় বোনের সঙ্গে চলে গিয়েছিল সে।
তবে তার চোখে কান্না দেখে দুর্বল হয়েছিলাম বোধহয়। সত্যই কি তবে সে আমাকে পছন্দ করে ভালোবাসার জীবনসঙ্গী হতে চেয়েছিল? ভেতরের প্রতিশোধ-প্রতিহিংসা ছাপিয়ে এই প্রশ্ন মনে বড় হয়ে উঠেছিল। বলেছিলাম- ঠিক আছে, সামাজিক সম্পর্ক নাইবা হলো, আমরা অন্তত বন্ধু হতে পারি। সে আপত্তি করেনি, পত্র যোগাযোগের জন্য নিজ হাতে তার বাড়ির ঠিকানা লিখে দিয়েছিল।
এরপর ডাকযোগে পত্রবন্ধুত্বের সম্পর্কটা দ্রুতই নিবিড় হয়ে উঠেছিল। বাস্তবে দিতে পারেনি বলেই হয়তো চিঠিতে যেন ভালোবাসা উথলে উঠত দু'জনেরই। আমাদের প্রথম সন্তান হওয়ার খবর শুনে তাকেও নিজের সন্তান দাবি করেছিল সে। বছর দুয়েক পরে ঢাকায় এসে এক আত্মীয়বাড়িতে উঠেছিল বেলা। উদ্দেশ্য একটা চাকরি জোগাড় করে স্বনির্ভর হবে। ঢাকায় থেকে লেখালেখি করবে। চিঠি হয়ে অনেকবার এসেছিল বলেই সশরীরেও একদিন এসেছিল আমার অফিসেও। স্ত্রীর সম্মতি নিয়ে তাকে বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম একদিন। আত্মীয়বাড়িতে অবস্থানে সাময়িক কিছু সমস্যা হয়েছিল বলে আমাদের বাসাতেও কিছুদিনের জন্য মেহমান হিসেবে ছিল। ততদিনে খিলগাঁওয়ের রেললাইনের ধারে ২০০ টাকা ভাড়ার বাসায় উঠে আমাদের সংসারের শ্রী-চেহারা কিছুটা উন্নত হয়েছিল।
বেলার সব চিঠি না দেখালেও তাকে বন্ধু হিসেবে নেওয়ার সত্যটি সাজুর কাছে গোপন করিনি। সহজ-সরল স্বভাবের মেয়ে সে, ভালোবাসত বলে আমাকে বিশ্বাসও করত। তা ছাড়া বেলা মামার ছোট বোন, আমার আগে থেকেই তাদের চেনাজানা। সমবয়সী পরিচিত বেলাকে নিজ সংসারে কিছুদিনের জন্য আশ্রয় দিতে দ্বিধা করেনি সে। বেডরুমে আমাদের দেড় বছরের শিশুপুত্রকে মাঝখানে নিয়ে তারা দু'বান্ধবী শোয়, অন্য ঘরের মেঝেতে বিছানা পেতে আমি একা।
একজন অভিভাবক ও ভাগ্যদেবতার কাছে আত্মসমর্পণ করে আমার জীবনসঙ্গী হয়েছে, অন্যজন আমাকে পছন্দ করেও চক্রান্তজালে আটকে পড়ে আমার সঙ্গে জোট বাঁধতে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু আজ দু'জনই আমার ঘরে। দু'জনই আমাকে ভালোবাসে। নির্ঘুম রাত কাটে আমার।
অফিস থেকে ফিরে একদিন দেখি, বেলা নেই। একেবারেই চলে গেছে তার সেই আত্মীয়বাড়িতে। আমার কাছে বিদায় নেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেনি। সহসা তার চলে যাওয়ার কারণটি জানাতে সাজু তার কঠোর অবস্থানটি জানিয়েছে। চিঠি লিখে তার স্বামীকে সবটুকু ভালোবাসা দেওয়ার কী অধিকার আছে তার? এতই যদি ভালোবাসা, আমাকে নিয়ে সংসার করুক সে, সন্তানকে নিয়ে সে চলে যাবে। এ কথা শুনে বেলা বিদায় নেওয়ার সময় কথা দিয়েছে, আর কোনো সম্পর্ক রাখবে না আমার সঙ্গে। 
বিয়ের পর পরই সাজু রংপুরে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে একটা চাকরি পেয়েছিল। কিন্তু সুখে-দুঃখে আমার পাশে থাকবে বলে সেই চাকরি প্রত্যাখ্যান করেছে। সারাজীবন স্বামীসেবা কম করেনি। তবু দীর্ঘ জীবনে কখনও মনে হয়েছে, তার কাছে সত্যিকার ভালোবাসা পাইনি বলে ভেতরে আমার এত প্রেমতৃষ্ণা। তারও একইরকম অনুভূতি হয় বলেই হয়তোবা আমার প্রতি চরম ঘৃণা প্রকাশ করেছে অনেক সময়। কিন্তু অধিকতর ভালোবাসা পাওয়ার বা দেওয়ার বিকল্প মানুষ আমরা দু'জনের কেউই পাইনি জীবনে। হঠাৎ অফিসের এক সহকর্মীর কাছে বেলার খবর জেনে চমকে উঠেছিলাম। আমি যেমন টাইপ-শর্টহ্যান্ড শিখে চাকরিতে ঢুকেছিলাম, সেও সেরকম একটি চাকরি পেয়েছে বড় একটি সরকারি সংস্থায়। ঢাকাতেই আছে। অফিসের ঠিকানা পেয়ে একদিন গিয়েছিলাম দেখতে। ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছিল সে-ও। কুশলবার্তা জানিয়েছিল। বিয়ে করেছে অবশেষে। যে আত্মীয়বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল, সেই বাড়িরই কাজিন সম্পর্কিত একজন। একটি কন্যাসন্তান হয়েছে।
বেশ কিছুদিন পর এক ছুটির দিনে গিয়েছিলাম বেলার বাসায়। তার স্বামী বাসায় ছিল না। ঘরে বসিয়ে চা-নাশতা খাইয়েছে। আমার পরিবারের কুশলাদিও জেনেছে। তিন-চার বছর বয়সী মেয়েটা আমার সঙ্গে একটাও কথা বলেনি। বিদায় দেওয়ার সময় মেয়েটি তার মায়ের কোলে মুখ লুকিয়েছিল, আর তার মা বেলার চোখে ছিল ছলছলে অশ্রু।
২০০১ সালে শহরতলির বাড়ি ছেড়ে আমরা যখন কলাবাগানের ভাড়া বাসায়, বাতেন মামা একদিন এলেন সেই বাসায়। বিষণ্ণ কণ্ঠে জানালেন, বেলা আর নেই! হার্ট অ্যাটাকে হঠাৎ মারা গেছে।
ইচ্ছে ছিল, নিজের পরিবার-সংগঠনে ট্র্যাজিক-নাটকীয় ঘটনার অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করে এমন একটি গভীর প্রেমের উপন্যাস লিখব, যেখানে অনেক দার্শনিক জিজ্ঞাসারও জবাব খুঁজব। 'দাম্পত্য বিলাস' নামের একটি উপন্যাস সাজুকে উৎসর্গ করে লিখেছিলাম 'যে তুমি সঙ্গে আছো ছায়ার মতো', আর আত্মজৈবনিক ট্র্যাজিক প্রেমের উপন্যাসটি লেখা হলে বেলার নামে উৎসর্গ করে লিখব, 'যে তুমি হারিয়ে গিয়েও জেগে থাকো অপার বেদনায়'।

বিষয় : প্রচ্ছদ মঞ্জু সরকার

মন্তব্য করুন