“আত্মবিস্মৃত এবং আত্মবিস্মৃতিপ্রবণ এক জনসম্প্রদায়ের নাম ‘বাঙালি’। বাঙালি বারবারই তার আত্মপরিচয় ভুলে গিয়েছে, ভুলে থেকেছে, ভুলতে চেয়েছে এবং ভুলে যেতে চায়। আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে বাঙালি কখনও উচ্চাভিলাষী, কখনও হীনমন আবার কখনওবা বিভ্রান্ত। এই জনসম্প্রদায় আত্ম ভুলে বারবারই অপরের রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নিয়েছে, অপরের পরিচয় গায়ে মেখে গৌরববোধ করেছে ও করছে। এমনকি তাকে কোথাও বাঙালি বলে চিহ্নিত করা হলে কিংবা বাঙালি বলে চিহ্নিত হয়ে পড়লে সে হীনমনবোধ করেছে এবং করে থাকে। তথাপি ‘বাঙালি’ শব্দটির প্রতি এই জনসম্প্রদায়ের রয়েছে এক অদ্ভুত মোহ।” কবি, গল্পকার, প্রবন্ধকার শামীম সাঈদের ‘বাঙালির দ্বিধার চলক’ প্রবন্ধগ্রন্থে এভাবেই বাঙালির আত্মপরিচয় ভুলে যাওয়ার কথা তুলে ধরা হয়েছে।

‘বাঙালির আত্মপরিচয়ের সংকট : সংস্কৃতি, ভাষা ও ধর্ম’ প্রবন্ধে লেখক তুলে ধরেছেন– বাঙালিত্ব হলো অস্তিত্বের ভিত্তি, সত্তার আধার। ইচ্ছে হলেই একে তো মুছে ফেলা যায় না, ভুলে যাওয়া যায় না। তবে কেন মিছে চেষ্টা। এসব বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। ইতিহাসের মাঝেই বাঙালি সংস্কৃতি ও জাতিসত্তার ভিত্তি নিহিত। ইতিহাস হাতড়ে দেখা যায়, আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকের দিকে ঐতরেয় আরণ্যকে ‘বঙ্গা’ শব্দটির উল্লেখ রয়েছে। সহস্রাব্দের পুরোনো চর্যাগীতিতেও বাঙালি, বঙ্গাল নামের দেশের উল্লেখ রয়েছে। তবে সে সময়ে ‘বাঙালি’ নামের কোনো জাতিত্ববোধের জনসম্প্রদায় গড়ে ওঠেনি। যদিও সেকালে জনসম্প্রদায়ের অস্তিত্ব বিরল ছিল না। এর মানে– তখন ‘বাঙালি’ শব্দটি জাতীয়তা বা জাতিসত্তার পরিচয়জ্ঞাপক কোনো পরিভাষা ছিল না। বরং এই শব্দটি একটি জনসম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক পরিচয়-পরম্পরার সাক্ষ্য বহন করে।

লেখকের মতে, উপনিবেশের প্রভাবে জাতিত্ব, জাতীয়তাবোধের মতো চেতনা, জ্ঞানপ্রবণতা ও মানসিকতা গড়ে উঠেছে। পাশ্চাত্যের প্রভাবে এ ধারণাগুলো এখানে বিকশিত হয়েছে। আবার উপনিবেশকারীদেরই উদ্যোগে সাংস্কৃতিক, ভাষাতাত্ত্বিক বা নৃতাত্ত্বিক আত্মপরিচয়ের শিকড় খোঁজা হয়। এই অনুসন্ধানের মধ্য দিয়েই ‘বাঙালি’ পরিভাষাটি পাওয়া। এটি আসলে ভারতীয় উপমহাদেশ ও বাঙালির উপনিবেশ যাপনের ফল। উপনিবেশের কারণে বাইরে থেকে আসা জ্ঞানের সংস্পর্শে বাঙালিরা জ্ঞানচেতনাও পেয়েছে এবং নিজস্বতায় চিন্তা করতে গিয়ে তার কিছু দ্বিধাও এসেছে। এ প্রসঙ্গে লেখক বলেন, ‘বাঙালির আত্মপরিচয়ের সংকটটি অন্য আর কিছুই নয়, তার সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বিভ্রান্তির পরিণাম, যা বিভিন্ন কালে ঔপনিবেশিক শক্তির প্রভাব বলয়ে থেকে বাঙালির সমাজচৈতন্যে প্রবেশ করেছে। বাহিরের শক্তি যেমন বাঙালির সাংস্কৃতিক, ভাষাভিত্তিক আত্মপরিচয়টিকে ভুলিয়ে দিতে চেয়েছে এবং চাইছে, তেমনই বাঙালি নিজেও অনেকাংশেই তার বাঙালিত্বকে আর মনে রাখতে চায় না বা অন্যভাবে চিনতে চায় নিজেকে।’

১৯৪৭ সালে দেশভাগের মধ্য দিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম। ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া এ ভূখণ্ডের সাধারণ মানুষ দেশভাগের দাম দিয়েছে বুকের রক্ত ঝরিয়ে। দেশ স্বাধীন হওয়ার আনন্দের সঙ্গে দেশভাগের যন্ত্রণা সাধারণ মানুষের জীবন তছনছ করে দিয়েছে। দেশজুড়ে দাঙ্গা, লুটপাট আর সহিংসতার ফলে বিপর্যস্ত হয়েছে মানুষের জীবন। ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত হিংস্রতার তফাত আছে। একটি সমষ্টি-দেশ, জাতি বা ধর্ম, অন্য একটি সমষ্টির আক্রমণের মুখে নিজেদের বিভেদ বা ব্যক্তিগত সত্তা ভুলে অনেকটাই এক হয়ে যায়। নিজের সমষ্টির রক্ষণার্থে। একটি সমষ্টির আপাত শান্তিপ্রিয় মানুষ যদি মনে করে তার গোষ্ঠী বা সমষ্টি আক্রান্ত, তার ব্যবহার পাল্টে যেতে সময় লাগে না। সাধারণ সময়ে হয়তো একটা মুরগিও যে কাটতে পারেনি, দেশভাগের সময় তার হাতেই খুন হয়েছেন বহু মানুষ– এ রকম উদাহরণের অভাব নেই। নিজের সত্তাকে বিসর্জন দেওয়ার এই প্রবণতা দেখা যায় নিজের গোষ্ঠীর প্রতি।

‘দেশভাগ : সংকীর্ণ রাজনীতি, জাতীয়তা ও সংস্কৃতিচেতনার বহুচ্ছিন্ন বৈজয়ন্তী’ প্রবন্ধে লেখক বিভাজন-বিচ্ছিন্নতা যে মানুষের সংকট তৈরি করেছে– ব্যক্তি থেকে দলকে, গোষ্ঠী থেকে সম্প্রদায়কে বিচ্ছিন্ন করে তুলেছে– সে বিষয়টি দেখিয়েছেন। মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা, ভৌগোলিক ভাঙন, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক যে অবক্ষয় তা তো এক দিনের ইতিহাস নয়। এই যে নানা দলে-উপদলে, সমাজে-রাষ্ট্রে কিংবা সম্প্র্রদায়ে বিচ্ছিন্নতা– এর একটি আদি ইতিহাস রয়েছে। নানান মত-পথের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, রাজনীতি রয়েছে। যেটি কখনও নিজ দলের স্বার্থে, কখনওবা পুরো দেশের স্বার্থে। কিন্তু প্রকৃত ইতিহাস উদ্ঘাটনের প্রয়াস ক’জনইবা করেছেন? মিথ্যের ফুলঝুরি, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মুলা ঝোলানোর ইতিহাসই যুগের পর যুগ ধরে চলেছে। যে কারণে ইতিহাস আজ নির্মম ভূমিকা পালন করছে। যে বিষয়গুলো অধ্যয়ন করতে হলে, ইতিহাসের দ্বারস্থ হতে হয়।

লেখক প্রাক-আর্য কাল থেকে আজ পর্যন্ত সিন্ধু অববাহিকার হরপ্পা সভ্যতা তথা ভারতীয় সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যগত স্বরূপটা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। টিকা-টিপ্পনীসহ, তথ্য-উপাত্ত হাজির করে তিনি নিখুঁতভাবেই কাজ করতে চেয়েছেন। সিন্ধু, আর্য কিংবা হিন্দু নামের সাংস্কৃতিক পরিচয় কীভাবে ভারতীয়দের জাতীয়তার প্রতীক হতে পারে, এর ইতিহাস তুলে ধরেছেন।

‘ভাষার অশ্বমেধ যজ্ঞ ও বাঙালির বায়ান্নর একুশ’ প্রবন্ধে লেখক ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, ত্রুটি-বিচ্যুতি উপস্থাপন করেছেন। লেখকের মতে, বাঙালির ভাষা আন্দোলন কয়েক হাজার বছরের। আর্যগণ এ ভূখণ্ডের মানুষের প্রাকৃত ভাষাকে ঘৃণা জানিয়ে সংস্কৃত ভাষা চাপিয়ে দিয়েছিল।

এরপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপনিবেশও বাঙালির ভাষার ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। তাই বাঙালির ভাষা আন্দোলন শুধু ১৯৫২ সালে হয়নি। আর তা শেষও হয়ে যায়নি। এ সময়ে যখন ভাষা থেকে সবকিছুই সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ আগ্রাসনের মুখে রয়েছে, তখন ভাষা আন্দোলনও শেষ হয়ে যায়নি। লেখক বলেন, “এখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য না থাকলেও ব্রিটিশ ভাষার যে বিশ্বজোড়া সাম্রাজ্য সেখানেও আর তার সূর্য অস্ত যায় না। ইংরেজি এখন মাটির পৃথিবী ছেড়ে মহাজাগতিক পরিসরে সাম্রাজ্য বিস্তার করে চলেছে। অব্যাহত রয়েছে ‘অশ্বমেধ যজ্ঞ’। বাংলা যদি এই ইংরেজির ঘোড়া ডিঙাতে না পারে, তবে বায়ান্নর একুশকে বাঙালি স্মরণ করবে কোন মহিমায়!”

তিনটি প্রবন্ধ নিয়ে ‘বাঙালির দ্বিধার চলক’ বইটি ইতিহাসের খেরোখাতা নতুন করে পাঠকের সামনে তুলে ধরে। আত্মসত্তার অন্বেষণে তিনি যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হাজির করেছেন, তা নতুন আবিষ্কার নয়। তবে এ সময়ে যখন বাঙালিত্বের স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করতে অনেক বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন, তখন এমন একটি বই পাঠককে ভিন্ন চিন্তার খোরাক জোগাতে পারে।