গ্রন্থের বিকাশ ঘটাতে আলোচনা-সমালোচনার বিকল্প নেই। একজন লেখক তাঁর শ্রম, মেধা আর মনন দিয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন ভালো কিছু করার। আলোচনা-সমালোচনায় গ্রন্থ যখন ঋদ্ধ পাঠকের গ্রহণযোগ্যতা পায়, বইটি পড়তে বিস্তর পাঠক আগ্রহী হন।‌ ‘শেরে বাংলা ও যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন : কিছু দুষ্প্রাপ্য দলিল’ গ্রন্থের‌‌‍ লেখক তরুন ইউসুফের জন্ম সিরাজগঞ্জ জেলায়, তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক হিসেবে কর্মরত। বইটি হাতে নিয়ে প্রথম প্রশ্ন জাগে, লেখক  দুষ্প্রাপ্য দলিল কীভাবে পেলেন। বিবরণ দিয়েছেন লেখক নিজেই। গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।   
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন স্বাধীন বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যে অধ্যায় পাঠ করে পরবর্তীকালে রাজনীতির বিভিন্ন প্রেক্ষাপট পরিবর্তিত হয়। যে নির্বাচন ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যে নির্বাচনকে ঘিরে রাজনীতির মাঠে কারও উত্থান আবার কারও পতন হয়েছে। শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক এবং ’৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন যেন একে অপরের পরিপূরক। মূলত যুক্তফ্রন্টটি গঠিত হয় তাঁকে কেন্দ্র করেই। মাঠ পর্যায়ে চলে আলোচনা। সে সময় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের কাছে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসতে থাকে রাজনৈতিক চিঠি, টেলিগ্রাম ও নির্বাচনের সময় প্রার্থী নির্বাচনের জন্য গঠিত ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির কিছু গোপনীয় প্রতিবেদন। তা ছাড়া যুক্তফ্রন্টের অঞ্চলভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ মনোনীত প্রার্থী তালিকা ও সেই সময় নির্বাচনের কিছু লিফলেট। এগুলো ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের দালিলিক প্রমাণ। বইটিতে প্রতিটি পর্বে তা সুচারুরূপে উপস্থাপিত হয়েছে।
ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের অপশাসন থেকে মুক্তি পেতে পূর্ববাংলায় অধিকার প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হিসেবে গড়ে ওঠে যুক্তফ্রন্ট। তার বিশদ বর্ণনা রয়েছে। মুসলিম লীগকে হটাতে এক হওয়া যুক্তফ্রন্টের গুরুত্বপূর্ণ নেতার নামসহ অনেক নাম ও কথা উঠে এসেছে বইটিতে। ‘যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ অধ্যায়ে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা, যুক্তফ্রন্ট গঠন সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। উঠে এসেছে অনেক তথ্য।
জনগণের প্রবল চাপে ১৯৫৩ সালের মাঝামাঝি এসে সরকার ঘোষণা করে– ১৯৫৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন হবে। কিন্তু সেটা পরে এক মাস পিছিয়ে ৮ মার্চ নির্বাচনের ঘোষণা করা হয়। মার্চ মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত এই নির্বাচন চলে। যুক্তফ্রন্ট গঠনের ইতিহাস সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। যুক্তফ্রন্টের শরিক এবং সাহায্যকারী দলগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া আছে। আওয়ামী মুসলিম লীগ (পরে আওয়ামী লীগ), কৃষক-শ্রমিক লীগ (কেএসপি), গণতন্ত্রী দল, নেজামে-ইসলাম, খেলাফতে রব্বানী পার্টি, পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।
যুক্তফ্রন্টের ইশতেহার ইতিহাসের একটি মাইলফলক। ২১ দফা ইশতেহার তুলে ধরা হয়েছে এ গ্রন্থে। নির্বাচন পরিচালনা কমিটি ও প্রার্থী নির্বাচন আলোচিত হয়েছে। মনোনয়ন কার্যক্রম পরিচালনা, মনোনয়ন ফি-সহ অনেক বিষয় উঠে আসে। যুক্তফ্রন্টের প্রধান তিন নেতার মধ্যে শুধু শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। নির্বাচনী প্রতীক, প্রার্থী তালিকা দেওয়া আছে বইটিতে।
তবে সব প্রার্থীর প্রতীক নৌকা ছিল না। ২১৭ জন নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন আর বাকি ২০ জন বিভিন্ন প্রতীকে। নির্বাচনী প্রচার ও ফলাফল, যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা গঠন এবং যুক্তফ্রন্টের পতন সম্পর্কেও আলোচনা আছে।
পত্রাবলি অধ্যায়ে উঠে এসেছে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে চিঠি, টেলিগ্রাম এবং অন্যান্য দালিলিক প্রমাণপত্র। শুরুতেই শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক সাহেবকে মোহাম্মদ তোয়াহার চিঠি। তোয়াহা ছিলেন একজন বামপন্থি রাজনীতিক। তিনি ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে একজন মনোনীত প্রার্থী ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া আছে। তাঁর জন্ম, রাজনৈতিক পথচলাসহ বিভিন্ন প্রসঙ্গ এসেছে। লেখক তাঁর চিঠি উপস্থাপন করেছেন (চিঠি-১)। চিঠি ১০-এ গিয়ে চোখ আটকে যায় বিখ্যাত ব্যক্তির ভিড়ে একজন দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীর চিঠিতে। যেখানে সেই কিশোর তার হৃদয়ের ব্যথিত আর অভাবের কথা জানিয়েছে। তার বাবা ছোটবেলায় নিরুদ্দেশ হন। গ্রামবাসী বা অন্য মানুষজনের সহযোগিতায় সংসার চললেও এখন তার ২০০ টাকা প্রয়োজন। হাতে রয়েছে ৮ টাকা। একজন দেশের সাধারণ শিক্ষার্থী টাকা চেয়ে আবেদন করতে পারে। কত বড় অবিসংবাদিত নেতা হলে তবেই তাঁর কাছে এমন আবেদন করা সম্ভব। এমন ৪৬টি চিঠি উপস্থাপিত হয়েছে। রয়েছে ৩০টি টেলিগ্রাম।
ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির গোপনীয় প্রতিবেদন ও বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রেরিত সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা দেওয়া আছে। শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের সংক্ষিপ্ত জীবনী দেওয়া আছে বইটিতে। পরিশিষ্ট অধ্যায়ে যুক্তফ্রন্ট পার্টি কর্তৃক চূড়ান্তভাবে মনোনীত প্রার্থীদের নামের তালিকা দেওয়া আছে। বইটি একজন মানুষকে ইতিহাস ও দুষ্প্রাপ্য দালিলিক প্রমাণ দেখার সুযোগ করে দেবে।