নাসির আলী মামুন (১ জুলাই ১৯৫৩) বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ আলোকচিত্রীদের একজন। তাঁর বিশেষত্বের জায়গা পোর্ট্রেট। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, এস এম সুলতান, গুন্টার গ্রাসসহ দেশ ও বিদেশের বহু ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব তাঁর ছবিতে মূর্ত। তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা ছয়। আলোকচিত্রে অবদানের জন্য শিল্পকলা পদকসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
শৈশবের যে স্মৃতি সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে–
: সিপাহি বিদ্রোহের দুই সৈনিক মেহের খান আর লাল খান ১৮৫৮ সালে ইংরেজদের চোখ কলকাতা থেকে বরিশাল হয়ে বর্তমান মাদারীপুর বাহাদুরপুরে আসেন। তারপর এখানেই স্থায়ী হন। আমার বাবা সেই বিপ্লবী মেহের খানের বংশধর। আর লাল খানের বংশধর আমাদের মোবারক চাচা। আমার বাবা আর মোবারক চাচা আমাদের দুই ভাইকে পূর্বপুরুষের সমাধি দেখাতে বাহাদুরাবাদ নিয়ে গিয়েছিলেন। জায়গাটা তখন নদী-নালা, খাল-বিল আর গাছপালায় দুর্গম ছিল। পথে পদ্মা নদীর অগণিত খাল। দুঃসাহসী মোবারক চাচা তাঁর দুই বাহুতে আমাদের দুই ভাইকে তুলে ধরে খাল পার হয়েছেন, সেখানে তাঁর গলা পর্যন্ত পানি। বহু পথ আমাদের দু’জনকে কোলে বহন করেছিলেন।
যে ব্যক্তিগত ঘটনার প্রভাব আমাকে আলোকচিত্রী করেছে–
: প্রথমে ১৮৩৮, পরে ১৮৭২ সালে আমার দাদার দাদার বাবা তাইয়্যেব খান লন্ডনে গিয়েছিলেন। সেখানে ব্রিটিশ মিউজিয়াম, ট্রাফলগার স্কয়ার মিউজিয়ামে গিয়ে বিপুল সংখ্যক শিল্পকর্মের সান্নিধ্য পান। ইংল্যান্ডে যে সমস্ত চিত্রকর্ম ও আলোকচিত্র তিনি দেখেছিলেন সেগুলোর কথা তিনি দেশে ফিরে তাঁর ছেলেদের বলেছেন, দিনলিপিতে লিখেছেন। ভয়ার্ত চোখ দেখেছিলেন কোনো এক চিত্রে। দেখেছেন শেক্সপিয়রের ছবি। প্রজন্মক্রমে সেসব কথা যখন আমি শুনেছি, আমার ভেতর প্রথম ছবির প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়েছে। মনে হয়েছে আমি ইমেজ মেকার।
প্রথম ছবির স্মৃতি–
: প্রথম বক্স ক্যামেরার সান্নিধ্যে আসি ১৯৬৩ সালে দশ বছর বয়সে। তখন এলাকায় কুলি রোড– বর্তমানে গ্রিন রোডের ওপারে একটা স্টুডিও ছিল– স্টুডিও নেহার। দোকানের ভেতর আরেকটা চৌকো ঘর, অন্ধকার। সেই ঘরে প্রথম বাকশো ক্যামেরা দেখি। ডার্করুমে, এনলার্জার মেশিনে সাদা কাগজের ওপর ওরা যখন এক্সপোজার দিল, কাগজে প্রাণ সঞ্চারিত হলো, আমি লাল আলোতে দেখলাম! আমি ছবি বলি না, বলি প্রাণ। ৬৭ সাল নাগাদ স্টুডিওর সবার সঙ্গে আমার সম্পর্ক হয়ে যায়। এক রবিবার নেহারের ফটোগ্রাফার, আমার বড় ভাই সাইফ আর আমি– এই তিনজন সাইকেলে চড়ে ধানমন্ডি লেকের ধারে গিয়েছিলাম। গোসল করে পরিষ্কার জামা পরে (আমি স্কুলে ড্রেসে) ছবি তুলেছিলাম। রিলের খরচ ছিল আমাদের। আর ফটোগ্রাফারকে কিছু বকশিশ। আমি তাঁর ক্যামেরা ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম। বললাম, শুধু একটা ছবি তুলতে দিন! অনেক অনুরোধের পর তিনি রাজি হলেন। আমি তুললাম জীবনের প্রথম ছবি, আমার বড় ভাই সাইফ আলী খানের পোর্ট্রেট।
ছবি তোলার সময় কোনো ভাবনা ভর করে?
: আমার বিশ্বাস, মানুষের যেমন একটা ফেরার জায়গা থাকে বা থাকে একটা আশ্রয় নেওয়ার স্থান, প্রতিটি চেহারারও তেমনই একটা ঠিকানা থাকে। আমি সেই ঠিকানা আবিষ্কারের চেষ্টা করি। সেই ঠিকানায় পৌঁছালে ছবিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়। আমার স্বপ্ন ছিল ব্রোমাইড পেপারে সাদা কালো দিয়ে আমি প্রাণ সঞ্চার করব। সুর তুলব ছবিতে। ভালো ছবির দিকে তাকালে অর্কেস্ট্রা শুনতে পাই’আমি সুলতানের যে ছবিগুলো তুলেছি, দেখে অনেকেই মন্তব্য করেছেন, যেন বেড়ালটা এখনই খাবার মুখে নিয়ে পালিয়ে যাবে! এর মানে তাঁরা ছবিতে একটা প্রাণ অনুভব করেছেন।
যে চলচ্চিত্র বারবার দেখেছেন–
: ১৯৬৯-এ নাজ সিনেমা হলে একটা সিনেমা আমি দু’বার দেখেছিলাম, পরে আরও দু’বার দেখি। ‘দ্য নাইট অব দ্য জেনারেলস’। ঘটনাটা এমন– দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জার্মান সেনারা ফ্রান্সের প্যারিস লুট করছেন। বিখ্যাত পিটার ওটুল অভিনয় করেছিলেন জার্মান লেফটেন্যান্ট জেনারেল তান্‌জের ভূমিকায়। তান্‌জ একটা জাদুঘরে ভিনসেন্ট ভ্যান গগের একটা ছবির সামনে বিদ্যৎস্পৃষ্টের মতো দাঁড়িয়ে পড়েন। ভিনসেন্ট তার দিকে তাকিয়ে আছেন! সেই শীতে, পুরোদস্তুর ইউনিফর্মের ভেতর তান্‌জ ঘেমে ওঠেন! সেই ছবি আর তিনি লুট করতে পারেননি।
ব্যক্তিগত যে সীমাবদ্ধতা আপনাকে কষ্ট দেয়–
: আমি সামষ্টিক সীমাবদ্ধতাকে আমার ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা মনে করি। আমাদের যত জাতিগত ব্যর্থতা– জাতির অংশ হিসেবে আমিও তা বহন করি। আমাদের ইতিহাস অসচেতনতা, শিল্পের অমর্যাদা, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অতীত ও বর্তমানের ইতিহাস ও সংরক্ষণের এই উৎকর্ষের যুগেও শিল্পকর্মের যথাযথ আর্কাইভ তৈরির সরকারি উদ্যোগের অভাব আমাকে কষ্ট দেয়। এ ছাড়া একসময় শারীরিক-মানসিক অনেক কষ্ট স্বীকার করে মুক্তিযুদ্ধ, সুলতান, জসিমউদ্দীনসহ আরও অনেক ঘটনা, ব্যক্তিকে নিয়ে কাজ করেছি। গভীরে যেতে চেষ্টা করেছি, লাগাতার পড়ে থেকেছি। এই জুলাইয়ে আমার বয়স সত্তর হবে। সেই শক্তি-সাধ্য আর নেই। আর কখনও ফিরবে না।
যারা শিল্পী হতে চায়–
: যদি যথাযথ শিল্পী হতে চায়, তাহলে নিভৃতে শিল্পের সাধনা করতে হবে। দলবদ্ধ হয়ে শিল্পের সাধনা হয় না। সত্যিকার প্রার্থনার জন্য যেমন স্রষ্টার সঙ্গে একান্তে বসতে হয়, শিল্পের সাধনাও তেমন। এ কথা যেন তারা মনে রাখেন। চাই– তাঁরা যেন আমাকে ছাড়িয়ে যান। আমি আমাদের সময়ের প্রাজ্ঞদের কাছে ঋণী। নাঈব উদ্দীন আহমদ, আনোয়ার হোসেন, মনজুর আলম বেগ, সাঈদা খানম, গোলাম কাসেম ড্যাডি– তাঁরা প্রত্যেকে আমাকে প্রতিনিয়ত উৎসাহ দিয়েছেন। পোর্ট্রেটে আমার দখলকে তাঁরা স্বীকৃতি দিয়েছেন। আজ আমিও নতুন প্রদর্শনী ঘুরে ঘুরে দেখি। মনেপ্রাণে খুঁজে বেড়াই সেই ছবিটাকে, যে ছবিতে একটা মেলোডি তৈরি হয়েছে। যে ছবি আমার ছবিগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে।