‘মানুষের জীবনে তিনটি জিনিসের প্রয়োজন– বই, বই এবং বই।’ এমনটাই বলেছেন বহুভাষাবিদ, বিশিষ্ট শিক্ষক ও দার্শনিক ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বলেছেন ‘বইয়ের মতো এত বিশ্বস্ত বন্ধু আর নেই।’ বই পড়া ও বই নিয়ে মনীষী ও দার্শনিকদের হাজারো উক্তি আছে। আছে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন দর্শন। প্রাবন্ধিক, কবি, কলামিস্ট হিসেবে খ্যাত আহমদ রফিকের বই পড়ার আখ্যান নিয়ে রচিত ‘বইপড়া-কাগজপড়ার একান্ত ভুবন’। বইটিতে লেখক তাঁর বই পড়া ও খবরের কাগজ পড়া নিয়ে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত বিভিন্ন তথ্য, দর্শন ও মতামত তুলে ধরেছেন। উপস্থাপন করেছেন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও বই পড়ার সমস্যা নিয়েও। বইয়ে লেখকের পেশাগত স্মৃতিচারণ ও অভিজ্ঞতার বর্ণনা নিয়ে এগারোটি রচনা আছে।
নিবন্ধ থেকে নিবন্ধে লেখক জানিয়েছেন বই পড়া ও কাগজ পড়া ভিন্ন হলেও এই দুটি পরস্পরের পরিপূরক। তবে বই পড়ার ভুবন ব্যাপক। পাঠের আনন্দ কিংবা সুখও অসাধারণ। বইয়ের পাতায় পাতায় পাঠক কখনও নিজেকে খুঁজে পান। কখনও পান ভিন্ন এক জগতের স্বাদ, ঠিকানা। সেখানে বিচরণ একদিকে উপভোগের, অন্যদিকে জ্ঞানের। তেমনি কাগজ বা সংবাদপত্র বিশ্বভুবনের সাম্প্রতিক খবর আমাদের সামনে নিয়ে আসে। খবরগুলো কখনও ভয়াবহ, কখনও অভিনব হয়। তবে পাঠের পর যে জ্ঞান কিংবা আনন্দ মেলে তা সামান্য নয়। মন-মননের বহুমুখী দরজা-জানালা খুলে দেয় পাঠের অভ্যাস। যে যার ইচ্ছেমতো মননশীলতার চর্চায় নিজেকে সমৃদ্ধ করে তুলতে পারেন। বই স্বদেশি হোক বা বিদেশি– মূল্যমানে গভীর হলেই তার নান্দনিক মর্যাদা বাড়ে। বড় কথা হলো, বই বিশ্বনান্দনিক যোগাযোগের একটি বড় মাধ্যম, তার অন্তর্নিহিত তাত্ত্বিক গুণের কথা বাদ দিয়েই; এ কথা নিশ্চিত বলা যায়।
নিভৃতে গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা কোনো নদীর খবর কিংবা কলম্বিয়ার আফিম ফুলের ক্ষেতের পাশে কোনো বিপ্লবীর জীবননাট্যের কোনো ঘটনা– সবই লেখককে আনন্দ দেয়। সমৃদ্ধ করে। বই পড়া-কাগজ পড়ার একান্ত ভুবন বইয়ের প্রথম রচনাটি ‘যে বই কৈশোরে আমাকে আলোড়িত করেছিল’। এখানে লেখক তার শৈশব-কৈশোর ও ছাত্রজীবনে পড়া বিভিন্ন বইয়ের কথা বলেছেন। সে সময়ে তাকে গোয়েন্দা কাহিনি, ভৌতিক কাহিনিনির্ভর বই, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি আনন্দ দিয়েছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শার্লক হোমস, আগাথা ক্রিস্টির গোয়েন্দা কাহিনি, শিবরাম চক্রবর্তীর উপভোগ্য সরস গল্পসহ বিশ্বসাহিত্যের কিছু বই তাঁর মনে জায়গা করে নিয়েছে।
কৈশোরের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আহমদ রফিক বলেন, ‘বই পড়ার দীর্ঘজীবনে বই নানাভাবে আমার মনের সঙ্গী হয়েছে। চিন্তায় প্রভাব ফেলেছে, কখনও রাজনৈতিক চেতনার সহায়ক হয়েছে, কখনও বিশ্বভুবনের সঙ্গে পরিচিত করে তুলেছে। তবু বলব কৈশোরে যে বইটি আমার মনোভুবনে গভীর দাগ কেটেছে, আমার ভাবনাকে দৃঢ় ভিত্তির যুক্তিসিদ্ধ পথরেখায় চিহ্নিত করেছে, সেটি ছিল ইরানি কবি ওমর খৈয়ামের চতুষ্পদী কবিতা সংকলনের বেশ কিছু রুবাই।’ লেখক আরেকটি প্রবন্ধে বলেছেন তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক অগ্রগতির এই সময়ে বই পড়ার অভ্যাস নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলছেন। এর মধ্যে অনেকেই পিডিএফ ডাউনলোড করে বই পড়ায় অতি উৎসাহী। তাই অনেকেই মনে করছেন ছাপা অর্থাৎ মুদ্রিত বইয়ের দিন বুঝি গেল। লেখক মনে করেন ঘরের এক কোণে বা বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে কিংবা একফালি বারান্দায় চেয়ারে হেলান দিয়ে টবের ফুলগাছটির পাশে বসে বই পড়ার মজা অন্যরকম। যা ডাউনলোড করা বই দিতে পারে না। সময়, পরিবেশ, পরিস্থিতি, রাজনৈতিক অবস্থার কারণে আগের তুলনায় বর্তমানে পাঠকদের পাঠরুচিরও পরিবর্তন ঘটেছে। নন্দনতত্ত্বের পরবর্তিত ধারণা পাঠকের মনে প্রভাব ফেলে। শ্রেণিচেতনা ও শ্রেণিসংগ্রাম মননশীল চেতনা, মতাদর্শ, প্রগতিবাদী ধ্যান-ধারণার স্থান এখন দখল করে নিয়েছে কথিত পশ্চিমা ‘গণতন্ত্র’ ও ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’ ধারণা। তবে যা-ই হোক না কেন, বই পাঠ ও সংবাদপত্র পাঠ করা পাঠকের সংখ্যা বেড়েছে। পাকিস্তান আমলে ইংরেজি ও বাংলা মিলিয়ে দৈনিকের সংখ্যা কম থাকলেও, পরে তা ব্যাপকহারে বেড়েছে।
বইটিতে সংবাদপত্রের পথচলা নিয়ে কিছু কথা, ঢাকাই সংবাদপত্র, তার আপন বৈশিষ্ট্য, সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার বিচিত্র ভুবন নিয়ে প্রবন্ধ আছে। এই প্রতিটি লেখা পড়ে সংবাদপত্রের অনেক অজানা তথ্য ও বিশ্লেষণ জানা যাবে। মোটকথা ‘বইপড়া-কাগজপড়ার একান্ত ভুবন’ বইটি জ্ঞানপিপাসু ও সচেতন পাঠকের পড়ার জন্য।
‘বইপড়া-কাগজপড়ার একান্ত ভুবন’ বইটি প্রকাশ করেছে অনিন্দ্য প্রকাশ। প্রচ্ছদ করেছেন চারু পিন্টু। মূল্য ১৫০ টাকা।