সাম্যবাদী রাজনীতির বাস্তবতা নিয়ে নানা আলোচনা আছে। অতীতের সাম্যবাদে সর্বস্তরের সাধারণ শান্তিপ্রিয়, সাম্যপ্রিয় মানুষের সহানুভূতি বরাবরই লক্ষ্যযোগ্য। সেখানে মুসলমান কি সনাতন– উভয় ধর্মীয় বলয় থেকে ধর্মদীক্ষা পাওয়া মানুষদের অনেকেই এমনকি লাল পতাকার নিচে এসেছিলেন এবং অবিকল ঐতিহাসিক ধর্মপ্রচারকসুলভ ন্যায়নিষ্ঠা, বাৎসল্য ও আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছিলেন; সাধারণ মানুষকে এসবের কেন্দ্রে রেখে, মানুষের কল্যাণমন্ত্রকে মূলমন্ত্র জেনে। সেখানে কোনো একচোখ ধর্মীয় পুণ্যভূমি সৃষ্টির আফিম-ঘোর ছিল না বলেই তাঁদের হাতে ধর্ম সম্মানিত হয়েছে। ইতিহাস আমাদের এমন একজন রেড মৌলানাকে উপহার দিয়েছিল। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। এমন উদার, সাম্যবাদী, সেইসঙ্গে আচারনিষ্ঠ, আচারদীক্ষিত মুসলমান আরও অনেকে ছিলেন। যাঁদের আজীবনের আত্মোৎসর্গের তেমনই একজন মৌলানা আব্দুল হান্নান।
এই আব্দুল হান্নানের পরিচয়  ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ সাম্যবাদী নেতাদের একজন কমরেড মুজফ্ফর আহমদের স্বতঃস্ফূর্ত কথোপকথনেই যথার্থ বেরিয়ে আসবে। বইয়ের ৫৩ নম্বর পৃষ্ঠা থেকে ঈষৎ পরিমার্জিত কিছু অংশ : ‘১৯৪৪ সালের প্রথম দিকে কলকাতার কৃষক সমিতির কাজে পার্টি আমাকে কলকাতা পাঠায়। বহুবাজার স্ট্রিটে কৃষক সমিতির অফিসে গিয়েছি। কমরেড বগলা গুহ আমাকে গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন অফিস সম্পাদক। দেখেই তিনি সরবে বলে উঠলেন, ‘মৌলবী সাহেব এসেছেন। বসুন, বিশ্রাম করুন।’ খেয়ে মেঝের ওপর চাটাই বিছিয়ে বিশ্রাম করছিলাম। বিকেলের দিকে পাশের কক্ষ থেকে কিছু কথা কানে এলো। একজন বলছেন, ‘খুব ভালো সময়ে তোমরা এসেছ। আমরা যাঁদের কথা শুনে নীতিনির্ধারণ করি তেমন একজন নেতা আজ এখানে রয়েছেন। জনতার সঙ্গে এদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। তোমরা আজ তাঁর সঙ্গে কথা বলো।’ গলার স্বর চিনলাম। কমরেড মুজফ্ফর আহমদ। উঠে এসে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে হাত উঁচালাম। তিনি উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলে উঠলেন, এই যে ইনি!’
আত্মজীবনীমূলক এ গ্রন্থের লেখক মৌলবী আব্দুল হান্নান যখন লিখবেন বলে মনস্থ করলেন, ততদিনে তাঁর শরীর বার্ধক্যে দুর্বল হয়ে এসেছে। সম্ভব হয়নি যেটুকু বলার তার সবটা স্বহস্তে লেখা। এগিয়ে আসেন তাঁর অভিন্নহৃদয় বন্ধু হরিশংকর চৌধুরী। তিনি শ্রুতিলিখন, অনুলিখনের মাধ্যমে গ্রন্থটি সমাপ্ত করেন। এর পাণ্ডুলিপি যত্নের সঙ্গে পড়ে দেন কমিউনিস্ট পার্টির নেত্রকোনা জেলা কমিটির সম্পাদক কুন্তল বিশ্বাস। তিনি কিছু তথ্যও সংযোজন করেন। মৌলবী আব্দুল হান্নান ছিলেন কমরেড মণি সিংহের প্রিয়ভাজনদের একজন। এ গ্রন্থে লিখতে গিয়ে মণি সিংহের ‘আমার জীবন সংগ্রাম’সহ সহসংগ্রামী আরও যাঁদের গ্রন্থের সহায়তা লেখক নিয়েছেন: কমরেড প্রমথ গুপ্তের ‘মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী’, কমরেড আবদুল্লাহ রসুলের ‘কৃষক সভার ইতিহাস’, ১৯৪৮ সালে ‘জনযুদ্ধ’ পত্রিকার ৪৮ ও ৪৯ নম্বর সংখ্যায় কমরেড সোমনাথ লাহিড়ীর লেখা প্রতিবেদন প্রভৃতি।
আত্মঅনুসন্ধানের সূত্রে পূর্ণ এ গ্রন্থ। অনেক বিস্মৃত স্থান ও মানুষের কথা এ বইয়ে ওঠে এসেছে। ময়মনসিংহ জেলার একসময়ের মহকুমা নেত্রকোনার বালি অঞ্চল ছিল সাম্যবাদী রাজনীতির অন্যতম শক্তিকেন্দ্র। এ কেন্দ্র এতটা শক্তি ধরত যে, গোটা ব্রিটিশ ভারতজুড়ে বালির পরিচয় ছিল রেড বালি নামে। এই রেড বালিই মৌলানা আব্দুল হান্নানের জন্মস্থান। মুসলিমপ্রধান এ অঞ্চলে ক্রমশ সাম্যবাদী রাজনীতি যে সর্বভারতীয় কিংবদন্তি নেতাদের পদচারণায় বিপুল গণসমর্থন লাভ করেছিল। সেই নেতৃবৃন্দ হলেন– কমরেড আব্দুল্লাহ রসুল, কমরেড মুজফ্ফর আহমদ, পি সুন্দারাইয়া, ঠাকুরচন্দ্র সিং, সোমনাথ লাহিড়ী, নামবুদিরিপাদ প্রমুখ। মৌলবী আব্দুল হান্নান ছিলেন ‍তৃণমূলের নেতাদের একজন কমরেড খুশু দত্তের হাত ধরে যাঁর বামপন্থায় আসা। তাঁদের মিলিত উদ্যমে বালি, কাইলাটি, মদনপুর, কাশতলা, ন-ধার, চাপান, কান্দি, ষোলপাইসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষ সাম্যবাদে আকৃষ্ট হয়। এই নেতাদের মুখের ভাষা ছিল, মনের ভাষা উভয়ই ছিল আমজনতার সঙ্গে সমসুর। কমরেড সোমনাথ লাহিড়ী জনযুদ্ধের প্রতিবেদনে পাওয়া যায়, শুধুমাত্র বালি গ্রামেই কৃষক সমিতির সদস্য সংখ্যা ছিল ৭০০।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষকালে, ১৯৪৫ সালে নেত্রকোনার মগড়া নদীর পাড়ে নাগড়া অঞ্চলে ঐতিহাসিক নিখিল ভারত কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল দক্ষিণ ভারতের মালাবারে। সরকারি নিষেধাজ্ঞায় সিদ্ধান্ত বদলে যায়। এই সম্মেলনের বিবরণ এ গ্রন্থের অন্যতম আকর্ষণীয় অংশ। গণকবি কমরেড নিবারণ পণ্ডিতের একটি গানের উল্লেখ পাওয়া যায়।
চলরে কিষাণ বাজিয়ে বিষাণ নিয়ে লাল নিশান
সম্মেলনে চলরে ও ভাই হিন্দু-মুসলমান
শুনতে পেলাম এই শহরে কারা নাকি প্রচার করে
এই সভাতে গেলে পরে থাকবে না আর জান
এই সভাতে বোমা ফেলতে আসতেছে জাপান
সম্মেলনে চলরে ও ভাই হিন্দু-মুসলমান
নিখিল ভারত কৃষক সম্মেলন, নৌ বিদ্রোহ, তেভাগা, হাজংদের টংক আন্দোলন, ছেচল্লিশের দাঙ্গা নিয়ে এ গ্রন্থ যে অকপট বিবরণ ও তথ্য উপস্থাপন করে, তা বিশ্বস্ত ও দুর্লভ বলেই মনে হয়।