আমরা বলি মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধ। আর কোনো যুদ্ধ যদি জনযুদ্ধ হয় তাহলে অধিকাংশ মানুষই যোদ্ধা। জনযুদ্ধ ও গৃহযুদ্ধ আলাদা বিষয়। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে যখন যুদ্ধ হয়েছে মুক্তির জন্য, সংগ্রামের জন্য; তখন তালিকা প্রস্তুত করা হয়নি, তালিকাভুক্তদের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা বংশধর পর্যন্ত বর্তায়নি। তালিকাভুক্তির জন্য এমন হাহাকার দেখা যায়নি। প্রবাসে কূটনৈতিক ছিলেন, স্বাধীনতার আগে আগে পক্ষ ত্যাগ করেছেন তিনি মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীন বাংলা বেতারে যিনি কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি মুক্তিযোদ্ধা। দেশের ভেতরে থেকে যেসব সাধারণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র থেকে খাবার সরবরাহ, বিভিন্ন অপারেশনে সহায়তা দিয়েছেন, এ কারণে নির্যাতিত হয়েছেন, নিহত হয়েছেন, পরিবার, সম্পদ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা নন। হ্যাঁ, তাঁদের আলবদর বা স্বাধীনতাবিরোধী বলা যাবে না, এই আর কী! এ রকম নিদারুণ অবিচার আর কোনো দেশে হয়নি। আসলে ১৯ মার্চ ঘোষণা করা উচিত জনযুদ্ধ দিবস। কারণ, সেদিন প্রথম হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে, বাঙালি সামরিক যোদ্ধা ও জনতা, বাঙালি জনতার ছিল প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ।
গেরিলা বা মুক্তিযোদ্ধা কখনোই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধ করতে পারতেন না যদি না সাধারণ মানুষ তাঁদের সহায়তা করতেন।  মাও সে তুং বলেছিলেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে যুদ্ধ করতে হয়। যেমন– মাছের মধ্যে মাছ মিশে যায়। গেরিলা বা যোদ্ধারা সীমান্ত পেরিয়ে এসেছেন তখনই গ্রাম বা শহরের মানুষ আশ্রয় দিয়েছেন, খাবার দিয়েছেন, কুরিয়ার হিসেবে কাজ করেছেন, পাহারা দিয়েছেন, চিকিৎসা করেছেন। বিনিমিয়ে গ্রামকে গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, গৃহকর্তাকে ধরে নিয়ে গুম করা হয়েছে, মেয়েদের ধর্ষণ করা হয়েছে। অনেক পরিবার লুপ্ত হয়েছে। অবরুদ্ধ দেশেই শুধু নয়, যুদ্ধে যাঁরা গিয়েছিলেন তাঁদের অধিকাংশ সাধারণ মানুষ– যাঁরা গণহত্যা ও যুদ্ধ কোনোটাই বুঝতেন না, বুঝতেন শুধু স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু– এ দুটি শব্দ। বিদেশি এক আলোকচিত্রীর এক ছবি আছে– খালি গা, লুঙ্গি পরা, মাত্র হয়ে ওঠা তরুণ, পিঠে বোঁচকা, বাবার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য। নাম না জানা এসব মানুষ তালিকাভুক্ত হননি। জানতেনও না তালিকাভুক্তির ব্যাপারটি। হয়তো শহীদ হয়েছেন কোথাও, কেউ জানে না। ভারত সীমান্তে এ রকম অনেক কবর পাওয়া গেছে নাম না জানা মুক্তিযোদ্ধাদের।
প্রথমেই বলি, সবাই সীমান্ত পেরোননি মৃত্যুভয়ে বা যুদ্ধে যোগদানের জন্য। দেশে থেকেই বিভিন্নভাবে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন প্রতিদিন মৃত্যুকে তুচ্ছজ্ঞান করে। সাধারণ মানুষ ছাড়া এ রকম যোদ্ধা গ্রুপের সংখ্যা ছিল প্রায় ২০-২৫, তাঁরা তাঁদের এলাকা মুক্ত রেখেছেন, তাঁদের পুরো ইতিহাস কখনও তেমনভাবে লেখা হয়নি।
যেমন– লেখক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছিল, যাঁরা শহীদদের পরিবারের পুনর্বাসন, মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র-ওষুধ সরবরাহ, মনোবল উজ্জীবিত রাখার জন্য পত্রিকা [প্রতিরোধ ও স্বাধীনতা] প্রকাশ করতেন। অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদ, স্থপতি রবিউল হুসাইন, রাজনৈতিক কুতুবুর রহমান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক জয়নাল আবেদিন থেকে শুরু করে অনেকে যুক্ত ছিলেন। আমি যুক্ত ছিলাম ঐ দুটি পত্রিকার সঙ্গে। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ৯ জানুয়ারি থেকে লেখা ও বক্তৃতায় শুধু বলেছিলেন– দাবি একটাই, তা হলো স্বাধীনতা।
এ রকম একজন ব্যক্তির ঢাকা শহরে তখন প্রকাশ্যে থাকাটাই ছিল দুঃসাহস। প্রয়াত অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ভাষ্যে– বোরহান ও তাঁর বন্ধুরা মিলে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলেন। অসহায় পরিবারগুলোর জন্য তাঁরা দ্বারে দ্বারে গিয়ে ঐ সময় টাকাপয়সা তুলেছেন। কাপড়চোপড়, ঔষধপত্র জোগাড় করেছেন, রীতিমতো দুঃসাহসী ছিলেন তাঁরা। তারপর তিনি তাঁর বন্ধু অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদের কথা বললেন যিনি ঐ গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ‘গিয়াস’, বললেন তিনি, ‘অনেক সময় লুঙ্গিটা খাটো করে পরে, গেঞ্জি গায়ে, মাথায় গামছা বেঁধে, হাতে ঝুড়ি নিয়ে শ্রমিকের বেশে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গেছেন।’ মাঝে মাঝে অনেক রাতে গিয়াস স্যার আসতেন আমাদের ধানমন্ডির বাসায়। আমি ছিলাম তাঁর ছাত্র। তিনি আর ড. জাহাঙ্গীর মিলে কোথায় কী সাহায্য পাওয়া যাবে, কীভাবে বিতরণ করা হবে তা আলাপ করতেন। এর কিছু কিছু পরে আমি উল্লেখ করেছি। একবার এক অনুষ্ঠান শেষে চা খেতে খেতে প্রয়াত কবি, স্থপতি রবিউল হুসাইন বললেন, “একটি ঘটনার কথা বলি। একদিন বোরহান ভাই আমার অফিসে এসে বললেন, ‘রবিউল, এই হলো এয়ারপোর্টের স্থাপনা ও ভূগর্ভস্থ পাইপের নকশা। এগুলো কপি করে আগামীকাল গুলিস্তানে এক মুদি দোকানে পৌঁছে দেবেন।’ কোত্থেকে তিনি এইসব নকশা জোগাড় করেছিলেন তিনিই জানেন। আমি আর স্থপতি শামসুল ওয়ারেস রাত জেগে সেইসব নকশা নকল করলাম। সকাল ১০টার দিকে, হাতে নকশাগুলো গোল করে রাবার ব্যান্ড দিয়ে পেঁচিয়ে বেবিট্যাক্সির খোঁজ করছি। পেয়ে গেলাম একটা। ভয়ও লাগছে, বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট পাকিস্তানি সৈন্যদের।
ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে আসতেই দু’জন সৈন্য ইশারা করে ট্যাক্সি থামাল। আমার অবস্থা বোঝেন তখন। কোনো কথা না বলে সৈন্য দু’জন আমার দু’পাশে বসল। জিজ্ঞেস করল, কাহা যাতা হ্যায়। বললাম, অফিস। হাতে তখন নকশার বান্ডিল। হাত ঘামছে। পল্টনের সামনে এসে তারা নেমে গেল। লিফট নিল আর কি! ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ল। গুলিস্তানে সেই দোকান খুঁজে নকশা দিয়ে তখন শান্তি।”
রবিউল ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় ৪৫ বছরের, কখনও এ কথা বলেননি। শামসুল ওয়ারেসের ছোট বোন আজমিরি ওয়ারেস ছিলেন আমাদের সহপাঠিনী। তাঁকে প্রেগন্যান্ট সাজিয়ে ড. জাহাঙ্গীর তাঁর ছোট ফিয়াটে করে একবার অস্ত্র দিয়ে এসেছিলেন গাবতলী পেরিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপের কাছে। এমনি ছোট ছোট কত ঘটনা! এগুলি হচ্ছে সাধারণের মুক্তিযুদ্ধ।
সুস্মিতা ইসলাম তাঁর আত্মজীবনীতে একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। ১৯৭১ সালে ওয়াপদার পাওয়ার প্ল্যানিংয়ের পরিচালক ছিলেন এ. এস. এম নুরুল্লাহ। সুস্মিতা কন্যাসহ তাঁর ফ্ল্যাটেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁর ভাষায়– “মুক্তিযোদ্ধারা যত ইলেকট্রিকের sabotage করত, তার পেছনে নুরুর হাত থাকত। নুরুই মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে সঠিক ড্রইং দিয়ে দিত, ... নুরুর ড্রাইভার মুশতাক ছিল বিহারি। তার সাহায্যে কত হিন্দু পরিবারকেই যে নুরু ওপারে যেতে সাহায্য করত তার ঠিক নেই। সন্ধ্যার পর ঘর ভরে যেত ভীতসন্ত্রস্ত্র লোকের ভিড়ে। সবাই একদম চুপ, একটি আওয়াজ নেই। সুলতানা [নুরুল্লাহর স্ত্রী] সবাইকে খাইয়ে তারপর ধীরে ধীরে কীভাবে যে বাড়ির বাইরে পার করে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করত, তা আমরা অত কাছে থেকেও জানতে পারতাম না, …। এতে মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে ষোড়শ বাহিনীর এক সদস্য নুরুকে এই বলে চার্জ করে যে, ‘নুরুল্লাহ সাহেব, আপনি তো ঢাকায় বসে অফিস করেন, পুরো ৯ মাস ধরেই পাকিস্তানি বাহিনীর মদত দিয়ে গেলেন। আপনার মুখে মুক্তিযুদ্ধের কথা মানায় না।’ এইটুকু শুনেই রাগে অপমানে নুরু স্টেজের ওপরই অজ্ঞান হয়ে যায়– তারপর ওর আর জ্ঞান ফেরেনি।”
[সুস্মিতা ইসলাম, আমার দিনগুলি, ঢাকা, ২০১৬]
কয়েক দিন আগে এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আচ্ছা, ১৯৭১ সালে শাহরিয়ার কবির সাহেব কী করতেন?’
“তিনি সীমান্ত পেরিয়ে গেছিলেন, জানালাম আমি, যাবার আগের রাতে আমাকে নিতে এসেছিলেন। আমি যেতে পারিনি। সেখানে তিনি কালচারাল স্কোয়াডের সঙ্গে ছিলেন, জহির রায়হানের সহকারী হিসেবে স্টপ জেনোসাইডে কাজ করেছেন। বই লিখেছেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা শাহরিয়ারের ‘পূর্বের সূর্য’ বোধহয় প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস, যা ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে বেরিয়েছিল কলকাতা থেকে।”
‘তিনি কোথাও কিছু সাপ্লাই করতেন নাকি?
এবার আমি বুঝি- কেন তিনি প্রশ্নটি করেছেন। একজন বলেছেন আমাকে, টেলিভিশনের টক শোতে বলা হয়েছে– ‘মুনতাসীর মামুন, শাহরিয়ার কবির মুক্তিযুদ্ধের সময় কোথায় ছিলেন? আজকাল এত বড় বড় কথা বলেন! শাহরিয়ার তো ক্যান্টনমেন্টে মুরগি সাপ্লাই করত।’ আমি দেশেই ছিলাম এবং এজন্য আমার কোনো গ্লানিবোধ নেই। যা হোক, আমি বললাম, ‘কলকাতা থেকে কি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে মুরগি সাপ্লাই দেয়া সম্ভব?’ তিনি আর কিছু বলেননি।
১৯৭১ সালের ১৫ নভেম্বর হাতিরপুল এলাকা থেকে ডা. আজহার আলী ও ডা. হুমায়ুন কবীরকে সকাল সাড়ে ৮টার সময় কয়েকজন রাজাকার ও পশ্চিম পাকিস্তানি পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। তারা সকালবেলা বাইরে যাওয়ার জন্য গলির মুখে এলে কয়েকজন মুখে কালো কাপড় পরা ব্যক্তি তাদেরকে ধরে নিয়ে যায়। এদিকে তাদের আত্মীয়স্বজন তাদেরকে ছাড়ানোর জন্য সকল থানা ও মার্শাল ল হেডকোয়ার্টারে খোঁজ করে। কিন্তু থানা এবং আর্মি হেডকোয়ার্টার থেকে বলে যে তারা ওই রকম কোনো লোককে ধরে নাই। পরদিন সকালবেলা মতিঝিল এলাকার ফকিরাপুলের নিচে ওই দুই ডাক্তারের মৃতদেহ পাওয়া যায়। কিন্তু লাশ দেখে তাদের চেহারা চেনা যাচ্ছিল না। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় তাদের দু’জনের পরনেই স্যুট ছিল। কিন্তু মৃত্যুর পরে তাদের পরনে শুধু আন্ডারওয়্যার আর ছেঁড়া শার্ট ছিল। তাদের সমস্ত শরীরে মারের চিহ্ন ছিল আর সারা মুখ বেয়নেট দিয়ে খোঁচানো। ডা. আজহার আলী (বয়স অনুমান ৩৫ বৎসর) ঢাকা মেডিকেল কলেজের রেডিওলজিস্ট ছিলেন আর হুমায়ুন কবীর এই বছরই ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে বের হয়েছেন। ওদের দু’জনের বাড়িই ফরিদপুর।
এর কিছুদিন পূর্বে একজন কুখ্যাত অবাঙালি মোটর ব্যবসায়ী খানকে মুক্তিবাহিনী হত্যা করতে অকৃতকার্য হয়। সে তারপর থেকে ওই পাড়ার সকলের ওপর অত্যাচার করতে থাকে; একে ধরিয়ে দেয়, ওকে ধরিয়ে দেয়। আরেক ঘটনায় একজন অবাঙালি কম্পাউন্ডারকে মুক্তিবাহিনী মেরে ফেলে। খান সেই ঘটনায় বলেছিল যে, ওরা আমাদের একজন কম্পাউন্ডারকে মেরেছে। আমরা ওদের দু’জন ডাক্তার মেরে এর বদলা নেব। এখন সকলের ধারণা, ওই দু’জন ডাক্তার হত্যার পেছনে ওই কুখ্যাত খানের ঘৃণ্য হাত আছে। যে পত্রিকা আমরা বের করতাম সেখানে এক সংখ্যায় বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রসঙ্গে আশুগঞ্জ থেকে পাঠানো একটি রিপোর্ট তিনি লিখেছেন– (প্রেরকের নাম নেই)।
‘আশুগঞ্জ বিশ্বগুদাম। হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প। উক্ত গুদামে ৮০-৯০ জন যুবতী মেয়েকে অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় আটকে রাখা হয়েছে। তাদের উপর পাশবিক অত্যাচার করা হয়েছে। অনেকেই গর্ভবতী। কিছু মেয়ের নাম জোগাড় হয়েছে।’ এরপর নামসহ ৫৩ জনের তালিকা। সর্বকনিষ্ঠের বয়স ১২, জ্যেষ্ঠের ২৩।’
একজন মহিলা প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলেন এ রকম–
‘যাত্রাপুরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর মেয়েকে ২৫০০ টাকা ঘুষ দিয়ে ছাড়িয়ে আনা হয়েছে। তার মুখ থেকে শোনা ঘটনা। হানাদার দু’জন সৈনিক ১০ বৎসরের একটি সুন্দরী মেয়েকে ছিনিয়ে আনে শ্লীলতাহানির জন্য। বলা বাহুল্য, মেয়েটি বেঁচে নেই। তার লাশ মেঘনায় ভাসিয়ে দেয়া হয়। অবশ্য বলাৎকার করার পর অসংখ্য মেয়েকে মেরে মেঘনায় ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে।
বিশ্বগুদামের একটি ঘরে ১০-১২ জন বন্দিকে এনে দাঁড় করানো হলো। কিছুক্ষণ পরেই তারা নাম্নী জনৈকা উলঙ্গ যুবতী মেয়েকে নিয়ে আসা হলো। শফি নামক কলেজের জনৈক বন্দি ছাত্রকে উক্ত ঘরেই সকলের সামনে উক্ত যুবতীর উপর পাশবিক অত্যাচার করতে বাধ্য করা হলো। সাথে সাথে উক্ত যুবতী নারীর উপর বলাৎকারের অপরাধে শফির বিচার হলো সকলের সামনে। অপরাধ প্রমাণ হওয়ায় শফির প্রাণদণ্ড হলো। এ রকম অসংখ্য ঘটনা রয়েছে, যা ধীরে ধীরে আপনাদের জানাব।’
আরেকটি ঘটনা–
‘আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে যশোহর জেলার নেহালপুর গ্রামের জনৈক বীর চাষী কোদালের আঘাতে একজন পাকিস্তানি সেনাকে খতম করে। পশ্চিম সেক্টরে কর্মরত জনৈক ন্যাপ কর্মীর খবরে প্রকাশ ঐ দিন একদল পাকিস্তানি সেনা উক্ত গ্রাম আক্রমণ করে। ইসলামের প্রতিনিধি জনৈক পাকিস্তানি সেনা জনৈকা যুবতীকে ধরার জন্য দৌড়াতে থাকে। যুবতী দৌড়ে মাঠে চলে যায়। ঐ সময় মাঠে কয়েকজন কৃষক কোদাল দিয়ে কাজ করছিল। তারা যুবতীটির অসহায় অবস্থা দর্শনে বিচলিত হয়ে পড়ে এবং তৎক্ষণাৎ তাদের মধ্যে একজন সাহস করে এগিয়ে এসে ঐ শয়তান সৈন্যটিকে কোদাল দ্বারা আঘাত করে আজরাইলের হেফাজতে পাঠিয়ে দেয়।’
(১) নান্দাইল, (২) রুইতপুর, (৩) শিবরামপুর, (৪) সৈয়দপুর, (৫) কামর খাঁ, (৬) গোয়ালখালী, (৭) গাটাগাঁও, (৮) আঁটি, (৯) গাছগাঁও, (১০) মোরাজীগাঁও, (১১) রুহিলা, (১২) খলমা, (১৩) কামরাঙ্গীর চর (১৪) খোলামরা– এই গ্রামগুলো প্রকারান্তরে বুড়িগঙ্গা থেকে শুরু করে ধলেশ্বরী পর্যন্ত বিস্তৃত এবং প্রতিটিই বর্ধিষ্ণু গ্রাম।
এই সমস্ত গ্রামে ১৬ নভেম্বরের রাত থেকে সামরিক সরকারের আদেশে এই পৈশাচিক হত্যালীলা শুরু হয়। ১৭, ১৮, ১৯ এই তিন দিন এবং তিন রাত উপরিউক্ত গ্রামগুলোতে নারী, শিশু, বৃদ্ধ নির্বিচারে গ্রামবাসীদের হত্যা করা হয়, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে প্রকাশ, সশস্ত্র পাকিস্তানি ফৌজ ও রাজাকাররা পরিকল্পিতভাবে এই গ্রামগুলোতে আক্রমণ চালায় এবং অবাঙালি মুসলিম লীগ ও ইসলামপন্থি দলগুলোর লোকেরা ঘরে ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেয় এবং ভীতসন্ত্রস্ত গ্রামবাসী যখন পালাতে চেষ্টা করেছে তখন তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়। যারা ঘরের ভিতরে লুকিয়ে ছিল তাদের বাইরে টেনে বের করে এনে মারা হয়। মেয়েদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালানো হয়। সবচেয়ে জঘন্য ব্যাপার এই যে, ইসলামপন্থি দলের লোকেরা, যারা কথায় কথায় ইসলাম ধর্মের শাসন-অনুশাসনের উল্লেখ করে, তারাই এই নারী নির্যাতনে বেশি অংশগ্রহণ করে।
এক হাজারেরও বেশি লোক নিহত হয়েছে এবং ছয়শ বাড়ি সম্পূর্ণভাবে ভস্মীভূত হয়। তাছাড়া আহতের সংখ্যাও হাজারখানেক হবে। এসব গ্রামের অধিবাসী প্রায় সবাই ব্যবসায়ী ও চাকরীজীবী। ঢাকা শহরের সঙ্গে এদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকায় প্রায় অধিবাসীই শিক্ষিত এবং সচ্ছল। রুইতপুর ও শিবরামপুরের বাজার দুটি এ অঞ্চলের তথা পূর্ব বাংলার দুটি বৃহৎ বাণিজ্যকেন্দ্র। এখানে প্রস্তুত লুঙ্গির চাহিদা বাবুরহাটের লুঙ্গির মতো বাংলার সর্বত্র। এই বাজার দুটির সমস্ত দোকানপাট, বিক্রয়কেন্দ্রগুলো সম্পূর্ণভাবে ভস্মীভূত হয়ে এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এই ধ্বংসলীলায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলো আঁটি এবং কামরাঙ্গীর চর গ্রাম দুটি। শুধু আঁটিতেই তিনশজন হতাহত হয়েছে এবং দুইশ গৃহ ভূমিসাৎ করা হয়েছে। এই সমস্ত গ্রামের মধ্যে আঁটি ছিল সবচেয়ে বর্ধিষ্ণু গ্রাম। সেখানে নির্বিচারে রাজাকারদের বাহিনী পাকফৌজের সহায়তায় অকথ্য অত্যাচার চালায়। গোয়ালখালী গ্রাম নিবাসী জনৈক বৃদ্ধ জানান যে, সেই গ্রামে ৫০ জন গ্রামবাসী জীবন্ত দগ্ধ হয়েও রাজাকারের গুলিতে নিহত হয়। এবং সম্পূর্ণ গ্রামটি একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। কারণ, গ্রামের মানুষরা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতেন। পাকিস্তানিদের নির্দেশ ছিল কোনো গ্রামে একজন মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় নিলেও সে গ্রাম পুড়িয়ে দিতে হবে। এদের জন্যই জনযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ। আজ উন্নত বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে, কখনও এ কথাগুলি ভাবতে পারেন–
১. এক কিশোরকে হানাদার বাহিনী ধরে এনেছে। তাঁকে বলা হলো– ‘বোল শালে পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। সে বলল– জয়বাংলা। তাঁকে গুলি করে মেরে ফেলা হলো।
২. কত জননী ছেলেদের পাঠিয়েছেন যুদ্ধে। ফেরেননি, ছেলে বা স্বামী। মেয়ে হয়তো ধর্ষিত। ড. আজাদের কথা চিন্তা করুন। যিনি জেলহাজতে মার কাছে ভাত খেতে চেয়েছিলেন। মা পরদিন ভাত নিয়ে এসেছিলেন। ছেলে তখন মৃত। মা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আর ভাত খাননি।
৩. সেই অন্তঃসত্ত্বা তরুণীর কথা ভাবুন। যিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তার দায়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তাঁকে সেনাদের জিপের পেছনে দড়ি দিয়ে শহরে ঘোরানো হয়েছিল। তাঁর লাশ তখন ছিন্নভিন্ন।
৪. বাংকার থেকে (বারবার ধর্ষিত) কিশোরী ফিরছেন ১৬ তারিখে বাসায়। আশা জাহান্নাম থেকে ফিরেছেন। বাবা-মা তাঁকে বুকে টেনে আবার স্বর্গের সাধ দেবেন। জীবন শুরু করবেন নতুনভাবে। দরজায় কড়া নাড়েন। দেখেন, মা জানালা খুলে তাকে এক ঝলক দেখে ম্লান মুখে সরে যান। দরজা খোলে না। কিশোরী আবার দরজা ধাক্কা দেয়। ভাবে, মা বাবাকে ডাকতে গেছেন। বাবা আবার তাকে বুকে নিয়ে বলবেন ‘আর কান্দে না মা’। কিন্তু, বাবাও আর দরজা খোলেননি।
না, জনযোদ্ধারা আর কাঁদেননি। বাংলাদেশের কাছে আর কিছুই চাননি। এরাই হলেন জনযুদ্ধের মুক্তিযোদ্ধা।