- কালের খেয়া
- অনিশ্চয়তার রথে গল্পের এক বিচিত্র যাত্রা
বইয়ের ভুবন
অনিশ্চয়তার রথে গল্পের এক বিচিত্র যাত্রা

হয়তো বলে কিছু আছে, লেখক-মাহরীন ফেরদৌস, প্রকাশক-কথাপ্রকাশ, দাম-২৫০ টাকা, পৃষ্ঠা সংখ্যা-১০৪ পৃষ্ঠা
‘হয়তো বলে কিছু আছে’ মাহরীন ফেরদৌসের গল্পগ্রন্থ। তরুণ লেখকের ১২টি গল্পে সাজানো বইটি প্রকাশিত হয়েছে এ বছরের বইমেলায় কথাপ্রকাশ থেকে।
মাহরীন ফেরদৌসের গল্পগুলোতে বিষাদের ঘ্রাণ সুস্পষ্ট, ঠিক তেমনি বিভ্রান্তিরও। তাঁর চরিত্রগুলো যেন দ্বিধার দোদুল্যমানতায় ভোগে, ঠিক তেমনি পাঠককেও দ্বিধার দ্বারপ্রান্তে দাঁড় করিয়ে দেয়– যা বুঝলাম ঠিক বুঝলাম তো, যা ভাবছি তাই-ই কি সত্যি? ভাবনার জগতে একটা বড় প্রশ্নবোধক চিহ্নের মুখোমুখি হয় পাঠক– এমনও কি হতে পারে? হয়তো … কে জানে… হয়তোর জগতে সবই সম্ভব, গল্পগুলো পাঠকের মনে একটা সংশয়ের চারা রোপণ করে দেয়– হয়তো বলে সত্যিই কিছু আছে হয়তো …।
মাহরীন তাঁর বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন– একজন গল্পকার যখন গল্প লেখেন, তখন তিনি চলে যান একটি ভ্রমণে। কখনও সেই ভ্রমণ হয় ভয়ংকর নৈরাজ্যের। কখনও-বা সেই ভ্রমণ হয় তীব্র বোধের কিংবা অবিমিশ্রিত ভালো লাগার। ঠিক একই কথা মাহরীনের গল্পের পাঠকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। একটি গল্পের সাথে এগিয়ে যাওয়া একটি ভ্রমণের মতোই। যে ভ্রমণের পথে পথে আছে অনিশ্চয়তা, পথের বাঁকে রয়েছে অজানা চমক, অচেনা মুখ। এ এমন এক ভ্রমণ, যেখানে পাঠক জানে না তার গন্তব্য। আঁচ করার উপায় নেই গল্পের ট্রেন কোন স্টেশনে থামবে। অথবা পাঠককে মাঝপথে নামিয়ে দিয়ে গল্প কোনো অচেনা গন্তব্যে চলে যায়, দূর থেকে আর ঠাওর করবার উপায় থাকে না তার পরবর্তী যাত্রাপথ কেমন হবে। ‘গন্তব্য ফিফথ অ্যাভিনিউ’ পড়ার পরে যেমন মনে হয়– আসলে কি এটুকুই গন্তব্য, না এর পরেও কিছু আছে? কখনও-বা গন্তব্যে পৌঁছানোর পর তার পাড়ি দিয়ে আসা পথটির চিহ্ন থাকে না। যেমন তাহেরের ফিরে আসার নেপথ্যের গল্পগুলো ধোঁয়াশার ঘেরা, গল্প শেষ হলেও তার পেছনের গল্পগুলো আমাদের অজানা থেকে যায়। শেষ হয়েও শেষ হয় না, ভাবনার খোরাক থেকেই যায় তাতে।
মাহরীনের গল্পগুলো মনস্তাত্ত্বিক। যতটা না ঘটনাবহুল, তার চেয়ে মনোজগতের অলিতে-গলিতে ঘোরাঘুরি তার বেশি। তরতরিয়ে কাহিনির ডালপালা বেয়ে এগোনোর চেয়ে ভাবনার মালমসলা বিছিয়ে দু’দণ্ড ভাববার আয়োজনই এখানে জোরালো। তাঁর গল্পের চরিত্রদের মনোভূমি কিছুটা জটিল, কিছুটা ধোঁয়াশা ঘেরা। অথবা একটি সরল চরিত্রের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায় জটিল কোনো একজন। যেমন ‘ইসাবেলা’ গল্পের গল্পকথকের সাথে যে মেয়েটি দেখা করতে আসত, গল্পের শেষে সে বিরাট একটি প্রশ্ন রেখে যায় পাঠকের জন্য।
কিছু গল্প চেনা মনে হতে হতেই ছুঁয়ে ফেলে জাদুবাস্তবতার সীমানা। সে আর পাঠকের সহজ বোধগম্যতার নাগালে থাকে না, তাকে বুঝতে কল্পনার ডানা একটু বেশিই মেলতে হয়। ‘চৈতালী সন্ধ্যায় সামরিন’ গল্পটিও পাঠককে ঠিক সেভাবেই বিহ্বল করবে। কোন সামরিন আসল? কোন সামরিন গল্পকথকের হ্যালুসিনেশন, অথবা প্রত্যেকেই বিদ্যমান বাস্তবেই? অথবা ‘মেরিনার মেঘমালা’ গল্পের মেঘে ঝুলে থাকা মেয়েটি, এবং তার হাতের আগ্রাসী ফাঁস দেওয়া দড়িটি, এক বিষণ্ন ভাবালুতার মুখোমুখি করবে পাঠককে।
কয়েকটি গল্প সম্পর্কে আলাদাভাবে বলার তাগিদ অনুভব করছি। ‘বিষাদের ডাকনাম’ গল্পটি ছোট হলেও চমৎকার, একটি বাড়ির অনুভূতিময় সত্তা বেশ বিশ্বাসযোগ্যভাবেই মনকে ছুঁয়ে যায়। ‘স্মৃতিচিহ্ন’ গল্পটির মা মনকে নাড়া দেয় বেশ। তাকে না পারা যায় অপছন্দ করতে, না পারা যায় মমতার চোখে দেখতে। ঠিক যেমন মা-ও পারেন না তাঁর সাতাশ বছরের কন্যাটিকে মন থেকে গ্রহণ করতে, অথবা তাঁর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে উপেক্ষা করতে।
‘বোকামানুষি’ গল্পের শান্তার জন্য বিষাদে আক্রান্ত হতেই হয়। এমন এক সমাজ আমাদের, নিজের পরিবারও নিরাপদ নয় মেয়েদের জন্য। বরং পুরুষের কামলোলুপতার শিকার মেয়েটির কপালেই জোটে তির্যক বাক্যবাণ অথবা দুশ্চরিত্রা খেতাব। আশ্রয়দানকারীর কুৎসিত স্পর্শের চেয়েও ভাইয়ের সহানুভূতিহীনতা তাই শান্তাকে কষ্ট দেয় বেশি। ক্লিষ্ট অপমানে আত্মঘাতী শান্তার প্রতিশোধপরায়ণতাকেও তাই সমর্থন না করে থাকা যায় না। যদিও-বা তা হয়তো কথকের কল্পনাতেই।
‘মেয়েটি এসেছিল শরতের শেষে’ একটি সম্ভাব্য মিলনাত্মক গল্প। ভাবতে ভালো লাগে– গল্পের যেখানে ইতি টেনেছেন লেখক, সেখান থেকেই শুরু আরেকটি নতুন গল্পের, ভালোবাসার হাত ছুঁয়ে দুটি হৃদয়ের কাছে আসার গল্প।
‘এইটা তোমার গল্প কিংবা আমার’ পড়তে পড়তে শেষাবধি ইতিবাচক পরিণতির প্রত্যাশায় থাকলেও চমকে যেতে হয়। গল্পের বাঁকে এসে অদেখা শেষটায় চোখ বুলালে দুঃখবোধ ভিড় করে মনের ভেতর। একজন মানুষ কীভাবে আরেকজনের মতো হয় হুবহু? আর এই অবিকল হয়ে ওঠার বিরক্তিকে ছাপিয়ে যখন জীবনকে অদলবদল করে নেওয়ার ইচ্ছা জাগে, ভাবতে বাধ্য হই– এর পেছনের মনস্তাত্ত্বিক কারণটি কী? জীবনে কিছুটা বৈচিত্র্যের স্বাদ আনা? নাকি ক্লান্তি, ক্লান্তির অবিরাম ভার! ‘অবিকল’ গল্পের শেষাংশ সহজে মেনে নিতে চায় না মন।
তবুও হয়তো বলে কিছু তো থাকেই, সেই হয়তোর অমিত সম্ভাবনাই মাহরীন তাঁর গল্পগুলোতে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। শেষ কথাটিও লেখকের ভাষাতেই বলি– এসব গল্প বিশ্বাস করতে নেই। তবে কোনো কিছু অবিশ্বাস করার জন্য আগে তা জানাটা অত্যন্ত জরুরি।
মন্তব্য করুন