বাঙালির আবহমানকালের ইতিহাস সরবে উচ্চারণ করে বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, বাঙালির ভাষার সংস্কৃতির ঐতিহ্য অনেক দৃঢ় ভিতের ওপর স্থাপিত ছিল। বাঙালির জারিগান ও সারিগান, যাত্রাপালা এবং চর্যাপদ থেকে উৎসারিত ভাষার ঐতিহ্য নিয়ে এই বঙ্গভূমি সবসময় ছিল সমৃদ্ধ। এই কারণেই ওলন্দাজ, পর্তুগিজসহ মধ্য এশিয়ার দেশগুলো বাংলার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। বৃহত্তর বাংলার হয়তো নয়, আমাদের মাতৃভূমি পূর্ব বাংলা মানুষের সহজিয়া জীবনযাপন বারবার বিঘ্নিত হয়েছিল ভিন্ন দেশীয় শোষণ প্রক্রিয়ার কাছে। এই বঙ্গভূমি বর্তমানে আমাদের বাংলাদেশ বিদেশিদের হাতে নিষ্পেষিত হয়েছে বারবার। দু’জনের খাবার পাঁচজনে ভাগ করে খাবার ঐতিহ্য আর কোন সংস্কৃতিতে আছে কিনা আমার জানা নেই। বাংলার পালাগান, গ্রামীণমেলা, গ্রামীণ নিসর্গ এবং সর্বোপরি সহজিয়া জীবন দর্শন বাঙালিকে এক অনন্য গৌরব দান করেছে। বাংলার মসলিন কাপড়ের লোভে বিলেতের সাহেবরা মসলিন কাপড়ের কারিগরদের হাত কেটে দিয়েছিল ব্রিটিশ শাসনকালে এবং নিয়ে গিয়েছিল এ দেশ থেকেই এই শাড়ির বানাবার করণ কৌশল। ব্রিটিশ শাসনকালেই এই দেশের বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলের চা শ্রমিকরা ব্রিটিশ কর্তা অর্থাৎ চা বাগানের শ্বেতকায় ম্যানেজারদের হাতে অকথ্যভাবে নির্যাতিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। বঙ্গে, বিশেষ করে শস্য-শ্যামলা পূর্ববঙ্গ বারবার বিদেশি শাসকদের লোভাতুর দৃষ্টির শিকার হয়েছিল। শক-হুন, মোগল-পাঠানসহ পাশ্চাত্যের ব্রিটিশ, ওলন্দাজ, পর্তুগিজ এবং অন্যান্য বহিরাগত শোষণকারীরা বাঙালির সহজিয়া ও মধ্যবিত্ত জীবনযাপনকে করেছিল পর্যুদস্ত।
এই বঙ্গে জন্মেছিল শিল্প সংস্কৃতির ও সংগীতের পুরোধা পুরুষ মহাত্মা লালন, শাহ আব্দুল করিম, কবি জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ।  বিশ্ব মানবতা ও সাহিত্য সৃজনের অনন্য পুরুষ রবীন্দ্রনাথের মনন তৈরি হয়েছিল এই বঙ্গে যখন তরুণ রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের শিলাইদহ, পতিসর, শাহজাদপুরে পৈতৃক ভূ-সম্পত্তি দেখাশোনা করার দায়িত্ব নিয়ে জনক মহর্ষি দেবেদ্ৰনাথ ঠাকুরের নির্দেশে পূর্ববঙ্গে ৭-৮ বছর সময় অতিবাহিত করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তাঁর অনন্য গ্রন্থ ‘ছিন্নপত্র’ এবং ছুটিসহ আরও অনন্য ছোট গল্প রচনা করেছিলেন এই বঙ্গে অবস্থানের সময় (কুষ্টিয়ার শিলাইদহ বসে)। কবির ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে লেখক একটি চিঠিতে কবি লিখেছিলেন ‘বাস্তবিক আমি পদ্মাকে ভালবাসি’।  
তারপরে পূর্ববঙ্গের বাঙালিদের ওপর নেমে এলো আরও দুঃসহ অমানিশা ব্রিটিশ প্রভুরা ভারতকে দু’ভাগ করে দিয়ে চলে গেল। জন্ম হলো দুটো রাষ্ট্রের। ভারত ও পাকিস্তান। ভারত আর অখণ্ড থাকল না। ধর্মের দোহাই দিয়ে দুই হাজার কিলোমিটার চেয়ে বেশি দূরে অবস্থিত পূর্ববঙ্গ (বর্তমানে স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র বাংলাদেশ)-কে জুড়ে দেওয়া হলো পাকিস্তানের সঙ্গে। মাছ ভাজার অগ্নিপাত্র হতে বাঙালি আগুনে পড়ে গেল। শুরু হলো পূর্ববঙ্গের বাঙালিদের ক্রীতদাসের জীবনযাপন, যার ব্যাপ্তিকাল ছিল প্রায় ২৫ বছর। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাঙালিরা নিগৃহীত হতে লাগল। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর বিশ্বখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় উচ্চারণ করেছিলেন—  
‘মহা বিদ্রোহী রণ–ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না… ।’
আমরা অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণকে পরাজিত করে আজ স্বাধীন-সার্বভৌম-জাতিরাষ্ট্র আমাদের জাতির পিতার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছি। আমি আমার জাতীয় সকল নেতাদের গভীর শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় স্মরণ করছি। লক্ষ লক্ষ প্রাণ বিসর্জন ও সম্ভ্রম হারানো মা-বোনদেরও স্মরণ করছি অপরিসীম শ্রদ্ধায় ও মমতায়। স্মরণ করছি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের রমনার রেসকোর্সের মাঠে ১৮ মিনিটের তাৎক্ষণিক বক্তৃতা, যা কেবল মুক্তি স্বাধীনতার ঘোষণাই ছিল না; যুগপৎ ছিল রাষ্ট্র পরিচালনায়ও, ব্যবস্থাপত্রও ছিল।  
১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনই  বাঙালির দ্রোহ-চেতনার তার দ্বার খুলে দিয়েছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর পূর্ববর্তী সকল বাঙালি গণ-নায়কদের তেজোদৃপ্ত সারাৎসার তাঁর হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের কালরাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একের পর এক জাতীয় জীবনের সকল জটিল গ্রন্থি ছিন্ন করে আনুষ্ঠানিকভাবে এক তার-বার্তায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে বাঙালি জাতি পাকিস্তানিদের সম্পূর্ণ পরাজিত করে বিজয় অর্জন করেছিল।   
দেশের শত্রুরা যারা বাংলাদেশের  স্বাধীনতা ও সার্বভৌম মেনে নিতে পারেনি, তারাই বিদেশি চক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে তথা স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম ও নৃশংসতম হত্যার নজির সৃষ্টি করে। বাংলাদেশকে বিপথগামী করার সকল অপচেষ্টাকে নস্যাৎ করে বাঙালিরা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জীবনের জটিল গ্রন্থিগুলো শিথিল করে ধীরে ধীরে উন্নতির সোপানে ক্রমাগত আরোহণ করছে।
বাঙালিত্বের আত্মমর্যাদা, বাংলা ভাষার গৌরব, বাঙালির হাজার বছরের ভাষা ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য এবং সর্বোপরি দ্রোহ-চেতনার অগ্নি মশাল বাঙালিকে যেমন দিগন্তে অগ্নিমশাল জ্বালাতে সাহায্য করেছিল, তেমনি তাদের সহজিয়া জীবনাচরণ, শিল্প ও সংস্কৃতি বাঙালিদের আজ একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত করেছে।  
বাঙালির সমগ্র সুকৃতি ধারণ করেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সহযাত্রীদের সঙ্গে হাতে হাতে মিলিয়ে ১৯৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্ন একে একে জীবনের সকল জটিল গ্রন্থি ছিন্ন করে সমগ্র দেশবাসীর সহযোগিতায় আমাদের উপহার দিতে পেরেছিলেন একটি স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র; যার নাম ‘বাংলাদেশ’। বঙ্গবন্ধুর জীবনের বিরাট অংশ কেটেছে কারাগারের অন্ধকারে এবং তারপরও তাঁর সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চা থেমে থাকেনি। তিনি নিজের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ এবং ‘আমার দেখা নয়াচীন’ নামে তিনটি অনন্য গ্রন্থ আমাদের এবং পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়েছেন। সর্বোপরি তিনি নব প্রজন্মকে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি অনুরাগী হতে উৎসাহ জুগিয়ে চলেছেন। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নজরুল ইসলামের ভক্ত। তিনি অনেক কবিতা মুখস্থ বলতে পারতেন। তিনিই তৎকালীন প্রাদেশিক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী থাকাকালীন চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য এফডিসি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনিই মঞ্চ নাটকের ওপর থেকে প্রমোদকর রহিত করেছিলেন এবং ব্রিটিশ আমলের কালাকানুন ‘সেন্সরশিপ সার্টিফিকেট’ সহজতর করেছিলেন; যা তাঁর কন্যা আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা গণপরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের ভোটে সম্পূর্ণ বাতিল করেছিলেন।
শেষ কথা হলো, মানুষের মুখের ভাষা যেমন কেড়ে নেওয়া যায় না, তেমনি তার আবহমানকালের সংস্কৃতি,  সভ্যতা এবং তাঁর স্বাধীন সত্তাকেও কেড়ে নেওয়া যায় না। পরিশেষে উচ্চারণ করব– মানবতা ও দেশপ্রেমেরই জয় হয়েছে।