- কালের খেয়া
- রোজার কাজা, কাফফারা ও ফিদইয়ার বিধান
রোজার কাজা, কাফফারা ও ফিদইয়ার বিধান

প্রতীকী ছবি
রোজা শারীরিক ইবাদত। শারীরিক ইবাদত সম্পাদন করতে প্রয়োজন হয় বল ও শক্তি। যা শরীরকে সতেজ রাখে। কিন্তু রোজায় পানাহার পরিহার করতে হয়। তাই রোজায় বল ও শক্তি ম্রিয়মাণ। কেননা ক্ষুধা এ ইবাদতের মুখ্য উপকরণ। ক্ষুধার তীব্রতায় সম্পাদিত হয় এ ইবাদত। আর ক্ষুধার তীব্রতা কারও কারও জন্য সহ্যাতীত। বিশেষ করে যারা ব্যাধিগ্রস্ত, শক্তিহীন বয়োবৃদ্ধ কিংবা নিজ বাসগৃহ থেকে বহুদূরে অবস্থিত ক্লান্ত মুসাফির।
মহান আল্লাহ সহজতা পছন্দ করেন। তিনি বান্দার প্রতি কখনও কঠোর হন না। মহান আল্লাহ আবশ্যিকভাবে রোজাকে বিধিত করেছেন। আবার অপারগদের জন্য আবশ্যিক এই বিধিতে এনেছেন সহজতা। তাই যারা বিভিন্ন কারণে রোজা পালনে অক্ষম, মহান আল্লাহ তাদের জন্য কাজা, কাফফারা ও ফিদইয়ার বদলা ব্যবস্থা নির্ধারণ করেছে।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ থাকবে অথবা সফরে থাকবে (রোজার সময়), তার পক্ষে অন্য সময়ে সে রোজা আদায় করে নিতে হবে। আর এটি যাদের জন্য কষ্টদায়ক হয়, তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকিনকে খাবার দান করবে। ...কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে রোজা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে, সে অন্য দিনে রোজা পালন করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান। তিনি জটিলতা কামনা করেন না।’ (সূরা বাকারা: ১৮৪-১৮৫)
ইসলামি শরিয়ত মুসাফির অবস্থায়, রোগ বৃদ্ধির বেশি আশঙ্কা থাকলে, গর্ভের সন্তানের ক্ষতির শঙ্কা থাকলে, ক্ষুধা-তৃষ্ণায় এমন বেশি কাতর হলে যাতে মৃত্যুর আশঙ্কা হয় এবং শক্তিহীন বৃদ্ধ হলে রোজা না রাখার অনুমতি দিয়েছে। আর মেয়েদের ঋতুস্রাবের দিনগুলোতে রোজা নেই। এসব ক্ষেত্রে রোজা ভঙ্গ করার কারণে পরে সমান সংখ্যক রোজা কাজা করতে হবে। এ ছাড়াও যে ব্যক্তি রোজাই রাখেনি তার জন্যও শুধু কাজা আদায় করলেই হবে, কাফফারা দিতে হবে না। (ফতোয়া দারুল উলুম দেওবন্দ- ১৭১৪৩৩)
বছরের যেকোনো দিন রমজানের রোজার কাজা আদায় করা যায়। তবে ঈদের দিনের মতো নিষিদ্ধ দিন, পরবর্তী কোনো রমজান ও মান্নতের রোজার জন্য নির্ধারিত দিনে তা আদায় করা যাবে না। পরবর্তী রমজান মাস আসার আগে যত দ্রুত সম্ভব রমজানের রোজার কাজা আদায় করা উত্তম। বিনা কারণে কাজা আদায়ে বিলম্ব করা মাকরুহ। (আল ফিকহুল ইসলামি ওয়া আদিল্লাতুহু: ৩/১০৭-১১৩)
শরিয়তসম্মত কোনো কারণ ছাড়া ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার বা সহবাসের মাধ্যমে রমজানের রোজা ভঙ্গ করলে তার কাজা ও কাফফারা আদায় করতে হবে। পানাহার ও সহবাস ছাড়া অন্য পদ্ধতিতে ইচ্ছাকৃতভাবে রোজা ভঙ্গ করলে কাফফারা দিতে হবে না, তবে কাজা করতে হবে। (মাবসুতে সারাখসি: ৩/৭২)
রোজার কাজা আদায় করার জন্য একটির বদলা হিসেবে একটি আদায় করতে হবে। আর রোজার কাফফারা আদায়ের ক্ষেত্রে তিনটি বিধান রয়েছে।
(১) একাধারে ৬০ দিন রোজা রাখতে হবে। একাধারে ৬০টি রোজা রাখার মাঝখানে যদি এক দিনও বাদ যায়, তাহলে পুনরায় শুরু থেকে রোজা আরম্ভ করতে হবে এবং আগের রোজাগুলো বাদ হয়ে যাবে। (মাবসুতে সারাখসি: ৩/৮২)
(২) একাধারে ৬০ দিন রোজা রাখতে সক্ষম না হলে ৬০ জন মিসকিনকে দুই বেলা খাবার খাওয়াতে হবে। কোনো ব্যক্তির ইচ্ছাকৃতভাবে একাধিকবার একই রমজানের রোজা ভঙ্গ করার কারণে এক কাফফারাই যথেষ্ট হবে। অর্থাৎ ভেঙে ফেলা সব রোজার জন্য ৬০ জন মিসকিনকে দুই বেলা খাবার খাওয়াবে, অথবা প্রতি মিসকিনকে এক ফিতরা পরিমাণ সম্পদ সদকার মাধ্যমেও কাফফারা আদায় করা যাবে। তবে শর্ত হলো, ওই টাকা দ্বারা মিসকিনকে খাবার খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। একজন গরিবকে প্রতিদিন এক ফিতরা পরিমাণ করে ৬০ দিন দিলেও আদায় হবে। ৬০ দিনের ফিতরা পরিমাণ একত্রে বা এক দিনে দিলে আদায় হবে না। (বাদায়েউস সানাইয়ে: ২/১০১)
(৩) একজন দাসকে মুক্ত করে দিতে হবে। বর্তমান সময়ে যেহেতু দাসপ্রথা নেই, তাই রোজার কাফফারার জন্য প্রথম দুই বিধানের যে কোনো একটি অবলম্বন করতে হবে।
যারা অতিশয় বৃদ্ধ বা গুরুতর রোগাক্রান্ত ব্যক্তি, যাদের সুস্থ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই অথবা রোজা রাখলে জীবনহানির আশঙ্কা থাকে, তারা রোজার বদলে ফিদইয়া বা মুক্তিপণ আদায় করবে। রোজার ফিদইয়ার পরিমাণ হলো, প্রতিটি রোজার জন্য একটি করে সদকাতুল ফিতরের সমপরিমাণ গম বা তার মূল্য। ফিদইয়া আদায় করার পর ওই অপারগ ব্যক্তি যদি পরবর্তী সময়ে সুস্থ হয়ে রোজা রাখার মতো শক্তি ও সাহস পায়, তাহলে তার আগের রোজার কাজা আদায় করতে হবে। তখন আগে আদায়কৃত ফিদইয়া সদকা হিসেবে গণ্য হবে।
প্রতিদিনের রোজার পরিবর্তে একজন দরিদ্রকে একটি সদকাতুল ফিতর অর্থাৎ ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম গম বা তার সমমূল্য ১২৫ টাকা দান করে অথবা একজন দরিদ্রকে দুই বেলা পেট ভরে খাওয়ানোর মাধ্যমে ফিদইয়া আদায় করা যাবে।
ফিদইয়া আদায়ের ক্ষেত্রে ধনী-গরিবের মাঝে কোনো তারতম্য নেই। সবার ওপর সমানহার প্রযোজ্য। তবে দারিদ্রতার দরুন ফিদইয়া দিতে একেবারেই অক্ষম হলে তওবা করবে। পরবর্তীতে কখনও সামর্থ্যবান হলে অবশ্যই ফিদইয়া আদায় করে দিবে। (হিন্দিয়া: ১/২০৭)
কেউ যদি রোজা না রেখে মারা যায় তাহলে অন্য কারও জন্য সেই মৃত ব্যক্তির রোজার কাজা বা কাফফারা আদায়ের কোনও বিধান নেই। তবে মৃত্যুকালে সে ব্যক্তি ফিদইয়া দেওয়ার অসিয়ত করলে তার রেখে যাওয়া সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ থেকে অসিয়ত পূর্ণ করা জরুরি। অসিয়ত না করলে ফিদিয়া দেওয়া জরুরি নয়। তবে তার প্রাপ্ত বয়স্ক ওয়ারিশগণ নিজ নিজ অংশ হতে তা আদায় করলে আদায় হবে। (দুররুল মুখতার: ২/৪২৪)
আল্লাহতায়ালা রোজা পালন করতে বলেছেন মানুষের শারীরিক ও মানসিক উৎকৃষ্ট সাধনের জন্য। মানুষ যেন ক্ষুধা ও তৃষ্ণার যন্ত্রণায় শরীর ও মনকে পরিশুদ্ধ করতে পারে। এতে জীবন হবে কলুষমুক্ত। সঞ্চিত হবে পাথেয়। যা পরকালে আলো জ্বালাবে। তাই একেবারে অপরাগ ও অক্ষম না হলে রোজা ছেড়ে দেওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। কেননা একটি ফরজ রোজার বিকল্প সারা বছর রোজা রাখলেও হবে না। একটি ফরজ রোজার কাফফারা হিসেবে ৬০টি রোজা কেবল একটি রোজার ফরজ দায়িত্ব থেকে মুক্ত করে। কাফফারার ৬০টি রোজা সওয়াবের দিক দিয়ে ফরজ একটি রোজার সমান কখনই হতে পারে না। তাই এই বিষয়ে সতর্কতা কাম্য।
লেখক: ধর্মীয় নিবন্ধকার
মন্তব্য করুন