জীবনানন্দ দাশের পাণ্ডুলিপির খাতা থেকে কবিতা পাঠোদ্ধার বিষয়ে কিছু বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। প্রথমেই বলা দরকার যে ‘সময়ান্তর’ কবি জীবনানন্দ দাশের সম্পূর্ণ অপ্রকাশিত একটি কবিতা। ভারতের জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের রেয়ার বুক কালেকশনে জীবনানন্দের ৪৮টি কবিতার খাতা সংরক্ষিত রয়েছে। এগুলির  ৪৩ সংখ্যক খাতাটির পঞ্চম পৃষ্ঠায় এই কবিতাটির খসড়া করেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। এটি এই খাতার তিন সংখ্যক কবিতা। কালিতে লেখা আদি খসড়ার পর জীবনানন্দ দাশ পেন্সিলে কিছু সংশোধন তথা পরিমার্জনা করেছিলেন। আদি খসড়া এবং এর পরিমার্জিত সংস্করণ− দুটিই মুদ্রণ করা হলো। বলা দরকার যে, পরিমার্জিত সংস্করণটিকে কোনোক্রমেই এ কবিতাটির চূড়ান্ত রূপ হিসাবে গণ্য করা সমীচীন হবে না। জীবনানন্দ দাশ একটি কবিতা প্রকাশের আগে ব্যাপক পরিমার্জনা করতেন। আমরা লক্ষ্য করেছি, পরিমার্জনাকালে তাঁর চিন্তা বদলে যেত, কবিতা লাভ করত নতুন আদল ও ভাষ্য। পরিব্যাপ্ত কাটাকুটির মধ্য থেকে প্রকাশযোগ্য ভাষ্যটি তুলে নেওয়া কেবল তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল। এ বিষয়ে প্রমাণস্বরূপ ‘দুদিকে ছড়িয়ে আছে দুই কালো সাগরের ঢেউ’ কবিতাটির পাণ্ডুলিপি দেখা যেতে পারে।
উল্লেখ্য, পাণ্ডুলিপিতে কবিতার শিরোনাম দিতেন না জীবনানন্দ। ব্যতিক্রম ছিল অবশ্য। সাধারণত কবিতা শুরু করতেন সংখ্যা লিখে এবং শিরোনাম ধার্য করতেন কবিতা প্রকাশের জন্য পত্রিকায় পাঠানোর সময়। এ রকম অনামাঙ্কিত কবিতার ক্ষেত্রে আমরা প্রথম পঙ্‌ক্তি থেকে শিরোনাম নির্ধারণের পক্ষে। তবে বর্তমান কবিতার ক্ষেত্রে শেষ পঙ্‌ক্তির ‘সময়ান্তর’ শব্দটি সমোপযুক্ত বলে প্রতীয়মান। উল্লেখ্য, কবিতা যেমন সংখ্যা দিয়ে শুরু করতেন জীবনানন্দ; শেষ করতেন শেষ পঙ্‌ক্তির নিচে মোটা চওড়া দাগ টেনে।

উপর্যুক্ত ৪৩ সংখ্যক খাতাটির শুরুতে লেখা আছে– ‘কবিতা, জীবনানন্দ দাশ, বরিশাল, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, ১৯৪৬’। তবে চতুর্দশ পৃষ্ঠার পর থেকে ১৯৪৭ সালে রচিত অনেক কবিতা আছে। এগুলি ১৯৪৭-এর মে-জুন মাসে লেখা। এ সময় জীবনানন্দ বসবাস করছিলেন কলকাতায়। কলকাতা দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে লেখা ‘১৯৪৬-৪৭’ কবিতাটি খাতার এ অংশে আছে। পাঠকের মনে থাকবে, এ কবিতাটির প্রথম প্রকাশ সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘পূর্ব্বাশা’ পত্রিকায়, ১৯৪৮ সালে (১৩৫৫)। পরে, জীবনানন্দের জীবদ্দশায়, ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ সংকলনে গৃহীত হয়েছিল। ‘এই সব দিনরাত্রি’ (‘মনে হয় এর চেয়ে অন্ধকারে ডুবে যাওয়া ভালো’) শিরোনামীয় কবিতাটিও ১৯৪৭-এ লেখা। এইখানে সূর্য্যের ততদূর উজ্জ্বলতা নেই আরেকটি কবিতা, যা ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ গ্রন্থে গৃহীত। আরও কিছু বিখ্যাত কবিতা এ খাতায় রয়েছে; যেমন ‘সময়ের পথে’ (আজকের জীবনের এই হিংসা- রক্তাক্ততা-মিথ্যা বর্বরতা দেখে), ‘দিনরাত্রি’ (সারাদিন, সমস্ত পৃথিবীই যেন আকাশ), ‘আমাকে একটি কথা দাও’ (সূর্যের আকাশের মত সকল আকাশে লীন) ইত্যাদি।
১৯৫৪ সালে কবি জীবনানন্দ দাশের প্রয়াণের পর তাঁর রেখে যাওয়া পাণ্ডুলিপি থেকে অধিকাংশ কবিতার পাঠোদ্ধার করেছেন কবি ভূমেন্দ্র গুহ। কবির অনুজ অশোকানন্দের নির্দেশেই তিনি কালো ট্রাঙ্কে রাখা সযত্নে পাণ্ডুলিপির খাতা বের করে কবিতা কপি ক’রে দিতেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশের জন্য; সঙ্গে থেকেছেন কবির অনুজা সুচরিতা দাশ। এভাবেই প্রস্তুত হয়েছিল ‘বাংলার ত্রস্ত নীলিমা’ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি, যা সিগনেট প্রেস কিছুটা পরিবর্তিত আকারে প্রকাশ করেছিল ‘রূপসী বাংলা’ নামে। একই ধারায় জীবনানন্দের সপ্তম কাব্য সংকলন ‘বেলা অবেলা কালবেলা’র পাণ্ডুলিপিও তৈরি করা হয়েছিল, যা প্রকাশে সিগনেট প্রেস অস্বীকৃত হয়েছিল। পরবর্তীকালে কবিতার কিছু খাতা হারিয়ে যায়; কয়েকটি পুনরুদ্ধৃত হয় এবং ৪৮টি কবিতার খাতা কলকাতায় অবস্থিত ভারতের জাতীয় গ্রন্থাগারে জমা দেওয়া হয়।
পেশায় শল্যচিকিৎসক কবি ভূমেন্দ্র গুহ ১৯৯৪-এ সরকারি চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণের পর জীবনানন্দের পাণ্ডুলিপি থেকে কবিতা ধারাবাহিকভাবে উদ্ধার এবং প্রকাশে প্রবৃত্ত হন। তিনি জাতীয় গ্রন্থাগারে সুরক্ষিত পাণ্ডুলিপির খাতা ফটোকপি করে একের পর এক কবিতা উদ্ধার ও প্রকাশ করতে শুরু করেন। জাতীয় গ্রন্থাগারে সুসংরক্ষিত ৪৮টি কবিতার খাতার মধ্যে ভূমেন্দ্র গুহ স্বয়ং ৩৪টি খাতা থেকে ১৫৭০টি কবিতার মূলানুগ পাঠ ১৪টি খণ্ডে প্রকাশ ক’রে গেছেন। তবে বাকি খাতাগুলির অধিকাংশ কবিতা বিভিন্ন হাতে পাঠোদ্ধারক্রমে ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। ৩৫ সংখ্যক থেকে শুরু করে পরবর্তী অন্যান্য কবিতার খাতায় যে কবিতাগুলি রয়েছে, তার মধ্যে কোনগুলি প্রকাশিত ও কোনগুলি অপ্রকাশিত, তা নিরূপণ একটি দুরূহ কাজ। তবে প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত সব কবিতার একটি তালিকা আমরা ইতিমধ্যে প্রণয়ন করেছি, যা অচিরেই গ্রন্থাকারে প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
২০০৯-এর প্রথমদিকে ভূমেন্দ্র গুহ’র সম্পাদনা এবং প্রিয়ব্রত দে-এর সার্বিক পরিকল্পনায় কলকাতা থেকে প্রতিক্ষণ প্রকাশনা সংস্থা জীবনানন্দ দাশের কয়েকটি লেখার খাতার ফটো গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত ৭ বছরের আটটি লেখার খাতার প্রতিলিপি দুই খণ্ডে প্রকাশ করা হয়। ১৯৪৯-এর কোনো খাতা উদ্ধার সম্ভব হয়নি। এ গ্রন্থের নাম রাখা হয়েছিল ‘শেষ ছ’বছর’। এগুলো কবিতার পরিচ্ছন্ন লিপি তৈরির খাতা নয়; দিনলিপি লেখার খাতাও নয়। এ খাতাগুলিতে লেখা কবিতার সংখ্যা খুবই কম। ১৯৪৭ সালে দৈনিক স্বরাজ পত্রিকার সহকারী সম্পাদকের চাকুরিটি চলে যাওয়ার পর জীবনানন্দ খুব কম কবিতাই লিখেছেন। ১৯৫৪ সাল চিহ্নিত ৪৮ সংখ্যক খাতায় লিখিত কবিতার সংখ্যা মাত্র চারটি।
আমরা সম্যক অবহিত যে, পাণ্ডুলিপি থেকে কবিতার নির্ভরযোগ্য পাঠ উদ্ধার করা চ্যালেঞ্জিং কাজ। ২০১৫-তে তুলনা করে দেখা যায়, ১৯৫৭ সালে সিগনেট প্রেস কর্তৃক প্রকাশিত ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যে অনেক কবিতার ‘মুদ্রিত-রূপ’ এবং ‘পাণ্ডুলিপি-রূপ’-এর মধ্যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যাপক ও সর্বার্থে আপত্তিকর পার্থক্য রয়েছে। সিগনেট প্রেসের সম্পাদক কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী কোন বিবেচনায় নতুন শব্দ সংযোজন করেছিলেন এবং জীবনানন্দ কর্তৃক ব্যবহৃত শব্দ বা শব্দগুচ্ছ বর্জন করেছিলেন, তা আমাদের বুদ্ধিতে কুলায় না। কবিতা ধ’রে ধ’রে পাণ্ডুলিপির সঙ্গে মিলিয়ে এই পার্থক্য নিরূপণ করা হয়েছে ও ‘রূপসী বাংলা’র একটি মূলানুগ সংস্করণ প্রকাশক আলমগীর রহমান প্রতীক প্রকাশন থেকে ২০১৯ সালে প্রকাশ করেছেন। এ প্রসঙ্গে জানানো যায়, জীবনানন্দ দাশের ‘একত্রিশ নম্বর কবিতার খাতা’র ফ্যাকসিমিলি সংস্করণ সম্প্রতি ঢাকা থেকে প্রকাশ করা হয়েছে, যাতে ৩৬টি কবিতার মূলানুগ পাঠ সংযোজন করা হয়েছে।
২০২১ সালের কভিড-রুদ্ধ পরিবেশে আমরা প্রথম একটি অপ্রকাশিত কবিতা প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলাম। ৪০ সংখ্যক কবিতার খাতায় একটি কবিতা পাওয়া গেল, যা সম্পূর্ণ অপরিচিত। এর প্রথম পঙ্‌ক্তি ছিল: ‘যাদের ক্ষমা অক্ষমা সাধ অন্ধকারে ফুরিয়ে গেছে আজ’ এবং শেষাংশ ‘তোমার জলকণিকা ভেঙে জল করেছ আমায় তোমার মত অনন্ত নদীর’। হাতের লেখা স্পষ্ট থাকায় কবিতাটির নির্ভুল প্রতিলিপি তৈরিতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। কাটাকুটি বা বিকল্প শব্দের ইঙ্গিত ছিল না বললেই চলে। বর্তমান কবিতার আদি খসড়া কালিতে লেখা ও স্পষ্ট। কিন্তু বেশ কাটাছেঁড়া আছে, যা পেন্সিলে করা। ফলে পরিমার্জিত সংস্করণ তৈরিতে কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে। স্বীকার্য, প্রথম পঙ্‌ক্তিটি সবচেয়ে সমস্যাবহুল। যেহেতু পাণ্ডুলিপির পাতাটি মুদ্রিত হচ্ছে, তাই আমাদের পাঠোদ্ধারে ভুল হয়ে থাকলে পাঠক তা নিরূপণ করতে সক্ষম হবেন।
খসড়ার কোনো শব্দ বা বাক্যাংশ পরিবর্তন করতে চাইলে জীবনানন্দ তা নিম্নরেখাঙ্কিত ক’রে ওপরে বিকল্প শব্দ বা বাক্যাংশ লিখে রাখতেন। অনেক ক্ষেত্রে বিকল্প লেখেননি। কোনো শব্দ বা বাক্যাংশ বর্জনীয় স্থির করলে জীবনানন্দ তা বৃত্তাবদ্ধ করে রাখতেন। পত্রিকা বা বইয়ে নেওয়ার সময় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতেন। দুই স্তবকে বিভক্ত সতের পঙ্‌ক্তির এ কবিতাটির আদি খসড়ায় প্রথম পঙ্‌ক্তি ছিল: ‘সুন্দর ঐ আকাশের সময়ের নিঃসীম অগ্নিসৃষ্টি’। কবির নির্দেশিত সংস্কার অনুসরণক্রমে প্রথম পঙ্‌ক্তি দাঁড়িয়েছে: ‘সুন্দর ঐ মকরসংক্রান্তির রাত্রির আকাশের শুকতারা, মুস্তারি, পারভিন, শতভিষা, আলদেবরণ নক্ষত্র নির্ঝর’। পাঠক জানবেন, ‘মুস্তারি’ ও ‘আলদেবরণ’ নিয়ে আমরা সন্দেহমুক্ত নই। u

সময়ান্তর (আদি খসড়া)
জীবনানন্দ দাশ

সুন্দর ঐ আকাশের সময়ের নিঃসীম অগ্নিসৃষ্টি
সুন্দর এই হৃদয়ের−হৃদয়ের ভাব
যে আজকের এই পৃথিবীর
জাতীয়তা লোভ অপ্রেম অন্ধ-অর্থনীতিকূপের থেকে উদ্বেল
বিনাশ দুর্গন্ধ ভয় অধঃপতন
যুদ্ধ ও শান্তিবৈঠকের কালিমায় আকাশ কালো ক’রে দিলেও
নিম্ন নিঃস্ব শ্রেণীর অন্নের ক্ষুধায় সমস্ত পৃথিবী
গভীর শববিগলিত হয়ে গেলেও
সময়ের সচলতা এসে অবলেহন ক’রে ফেলে সব
চারিদিকে শুশ্রূষার শব্দ শোনা যায় অন্তবিহীন জলের ঝর্ণার

কে মেরেছিল–কেন মরেছিলাম–কেন মেরেছিলাম প্রভৃতি দুঃশব্দের
অপরিমেয় দুর্গন্ধের ক্লেদ ধুয়ে ফেলে
জলের মতন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে পৃথিবীর নদী
আলোর মতন উৎকণ্ঠিত হয়ে ওঠে নীলিমার সূর্য্য
মানুষের মন অবলম্বন ক’রে অগ্রসর হয়
সেই জল আলো–অগ্নির–সাগ্নির
সুস্থির সময়ান্তর।