অধ্যায়:: ১৬ [চলমান] [পূর্বে প্রকাশিতের পর]

একচেটিয়া পুঁজির বিরুদ্ধতা করার তৃতীয় কারণটি রাজনৈতিক। ব্যক্তি-উদ্যোগের স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশকে উৎসাহিত করতে হবে জনকল্যাণের স্বার্থে। কিন্তু দেখতে হবে এটি করতে গিয়ে ব্যক্তি-পুঁজি যেন ‘রাষ্ট্রের পলিসি’ নিয়ন্ত্রণ করার মতো রাজনৈতিক অবস্থানে যেতে না পারে। রাজনীতি ও পলিসির রথের ঘোড়ার লাগাম থাকতে হবে রাজনীতিবিদ ও রাজ-কর্মচারীদেরই হাতে–সেখানে ব্যবসায়ী শ্রেণির প্রবেশাধিকার সীমিত হওয়া চাই। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নিকটবৃত্তের সহকর্মীরা এক্ষেত্রে যেমন সজাগ ছিলেন, তেমনি চিন্তিতও ছিলেন এনিয়ে। সেজন্যেই ইতোমধ্যে উদ্ধৃত অংশে তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘ব্যক্তিগত মালিকানায় উৎসাহ আমরা ততটুকুই দেব, যতটুকু উৎসাহ দিলে ব্যক্তিগত রাজনৈতিক প্রভাব ঘটাবার সুবিধা ব্যক্তি মালিকানায় থাকে না।’ স্বাভাবিকভাবেই একচেটিয়া পুঁজি বা বৃহৎ শিল্প-মালিকদের পক্ষে এই রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর সুযোগ আরও বেশি। একথা শুধু বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দীন আহমদই বলেননি, বলেছেন অন্য সাংসদরাও। মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ গণপরিষদ বিতর্কে অংশ নিয়ে (১৯৭২ সালের ৩০ অক্টোবর) বলেছিলেন, ‘সাবেক পাকিস্তানে যে সমস্যা ছিল, তা দূর করার জন্য যদি মহানবীর বাণীর শত ভাগের এক ভাগও মেনে নিত, তাহলে কুখ্যাত আদমজী, দাউদ, ইস্পাহানীর মতো লোক এদেশে জন্মলাভ করতে পারত না।’ দেখা যাচ্ছে যে, নানা দৃষ্টিকোণ থেকেই সেদিনের গণপরিষদে ‘একচেটিয়া পুঁজির’ বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানের পক্ষে সমর্থন জানানো হচ্ছিল। এজন্যেই সংবিধানের ১৩নং ধারায় বলা হয়েছিল যে, কেবল ‘আইনের দ্বারা নির্ধারিত সীমার মধ্যেই’ ব্যক্তি মালিকানাকে অপারেট করতে দেওয়া হবে। ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বরের সংবিধান চূড়ান্তভাবে গৃহীত হওয়ার সমাপনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু যা বলেছিলেন তার অর্থ দাঁড়ায়, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে শুধু সমাজতন্ত্রই (প্রচলিত মডেলের তুলনায়) অন্যভাবে সংজ্ঞায়িত হবে তা-ই নয়, এই ব্যবস্থায় গণতন্ত্রকেও ভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত হতে হবে। সেদিনই পুঁজির অন্যায় রাজনৈতিক প্রভাবের বিরোধিতা করে তিনি প্রথম উচ্চারণ করলেন ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ শব্দবন্ধটি। অনেকের মধ্যে এই ভুল ধারণা আছে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে বাকশাল প্রবর্তনের সময় বুঝি বঙ্গবন্ধু প্রথম ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেন। বস্তুত এর ব্যবহার শুরু হয় ১৯৭২ সালেই। সেদিন তিনি বলেছিলেন:
‘মানুষের একটা ধারণা এবং আগেও আমরা দেখেছি যে, গণতন্ত্র যেসব দেশে চলছে দেখা যায় সে সব দেশে গণতন্ত্র পুঁজিপতিদের protection দেওয়ার জন্য কাজ করে এবং সেখানে শোষকদের রক্ষা করার জন্যই গণতন্ত্র ব্যবহার করা হয়। সে গণতন্ত্রে আমরা বিশ্বাস করি না।
আমরা চাই শোষিতের গণতন্ত্র এবং সেই শোষিতের গণতন্ত্রের অর্থ হলো, আমার দেশে যে গণতন্ত্রের বিধিলিপি আছে, তাতে যেসব provision করা হয়েছে, যাতে এ দেশের দুঃখী মানুষ protection পায়, তার জন্য বন্দোবস্ত আছে– ঐ শোষকরা যাতে protection পায়, তার ব্যবস্থা নাই। সেজন্য আমাদের গণতন্ত্রের সঙ্গে অন্যের পার্থক্য আছে। সেটা আইনের অনেক schedule-এ রাখা হয়েছে, অনেক বিলে রাখা হয়েছে, সে সম্বন্ধে আপনিও জানেন। অনেক আলোচনা হয়েছে যে, কারও সম্পত্তি কেউ নিতে পারবে না। সুতরাং নিশ্চয়ই আমরা কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে হাত দিচ্ছি না। কিন্তু যে চক্র দিয়ে মানুষকে শোষণ করা হয়, সেই চক্রকে আমরা জনগণের জন্য ব্যবহার করতে চাই। তার জন্য আমরা প্রথমেই ব্যাংক, ইনসিওরেন্স-কোম্পানি, কাপড়ের কল, জুট-মিল, সুগার ইন্ডাস্ট্রি– সব কিছু জাতীয়করণ করে ফেলেছি। তার মানে হলো, শোষক-গোষ্ঠী যাতে এই গণতন্ত্র ব্যবহার করতে না পারে। শোষিতকে রক্ষা করার জন্য এই গণতন্ত্র ব্যবহার করা হবে। সেজন্য এখানের গণতন্ত্রের, আমাদের সংজ্ঞার সঙ্গে অন্য অনেকের সংজ্ঞার পার্থক্য হতে পারে।’
১৬.৪। ‘সুযোগের সমতা’ ও ‘ইকুয়ালিটি অব আউটকাম’
বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব এসে পড়েছিল। অন্তত সেগুলোকে বিবেচনায় নিতে হয়েছিল। তারপরও এই গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ‘স্বকীয়তা’ সম্পর্কে ১৯৭২ সালের গণপরিষদে একটি সার্বিক সচেতনতা বিরাজ করছিল। এই স্বকীয়তাকে ঢাকা থেকে নির্বাচিত আবু মো. সুবেদ আলী প্রকাশ করেছিলেন এভাবে: ‘‘আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘পিপলস ক্যাপিটালিজম’ গ্রহণ করি নি। আমরা যুক্তরাজ্যের ‘ওয়েলফেয়ার স্টেটে’ও বিশ্বাস রাখিনি। একটি মাত্র দলের কর্তৃত্বে চীন ও রাশিয়ার যে সমাজতন্ত্র, তাও আমরা পূর্ণভাবে গ্রহণ করি নি।’’ কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিভিন্ন উৎস থেকে প্রেরণা এসেছে। এরকম একটি প্রেরণা হচ্ছে ‘সুযোগের সমতা’। বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সমাজের সকল নাগরিকের জন্য ‘সুযোগের সমতা’ সৃষ্টি করার পাশাপাশি বাস্তবে জীবনযাত্রার মানেও যতটুকু সম্ভব সমতা আনা (যাকে বলা হয়ে থাকে– ‘ইকুয়ালিটি অব আউটকাম’)। জাতিসংঘের এমডিজি ও এসডিজি-এর কল্যাণে ‘equality of opportunity’ কথাটি এখন বহুল প্রচলিত একটি ধারণা। কিন্তু এদেশে এটির প্রথম সচেতন ব্যবহার হয় ১৯৭২ সালেই। বাহাত্তরের সংবিধানের ১৯(১) ধারায় প্রথম উচ্চারিত হয় ইকুয়ালিটি অব অপরচ্যুনিটি বা সুযোগের সমতার কথা। সেখানে বলা হয়েছিল: ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন’। এবং এর আগে ১৫নং ধারায় এই ‘সুযোগের সমতাকে’ সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল:
‘(ক) অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা;
(খ) কর্মের অধিকার, অর্থাৎ কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করিয়া যুক্তিসঙ্গত মজুরীর বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার;
(গ) যুক্তিসংগত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার; এবং
(ঘ) সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতাপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারী সাহায্য লাভের অধিকার।’
১৮(১) ধারায় আলাদা করে পাবলিক হেলথ্ এবং নিউট্রিশন (পুষ্টির) কথাও বলা হয়েছিল: ‘জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন।’ বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের সংবিধান পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে ‘পুষ্টির’ এই সংযোজন ছিল একটি বিরল দৃষ্টান্ত।
দেখা যাচ্ছে, আজকের ‘সোশ্যাল প্রটেকশনের’ অনেক আগেই বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র ‘সামাজিক নিরাপত্তার অধিকারের’ কথা বলেছিল। লক্ষণীয় যে, উন্নয়নের ক্ষেত্রে এখানে ‘অধিকারের ভাষায়’ কথা বলা হচ্ছে‒ এই রাইটস্ বেইজড্ অ্যাপ্রোচের জন্ম হবে আরও বহু পরে।
একটি কথা এখানে যোগ করা দরকার। এই যে মৌলিক প্রয়োজনের জন্য ‘অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয়-শিক্ষা-চিকিৎসার’ ধারা বা নির্দিষ্ট করে ‘সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার’ ১৫ ধারায় বলা হলো এগুলো এলো কোন উৎস থেকে? মার্কসের লেখাটিতে বলা ছিল যে সাম্যবাদী বিকাশের প্রথম বা নিচু পর্যায়ে বণ্টননীতি হবে নিম্নরূপ: ‘From each according to his abilities, to each according to his work’। এখানে প্রত্যেকে যেন তার সামর্থ্যের বিকাশ ঘটানোর সুযোগ পায়, সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করতে পারে, এবং কাজের পরিমাণ/গুণ অনুযায়ী পারিশ্রমিক পেতে পারে–এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জড়িত।
মনে হতে পারে, এগুলো বুঝি ইউরোপীয় ‘সোশ্যাল স্টেট’ বা ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’-এর ধারণা থেকে উঠে এসেছে। হয়তো পশ্চিম ইউরোপের বা উত্তর ইউরোপের ‘সামাজিক গণতন্ত্রীরা’ এর পেছনে বুদ্ধিবৃত্তিক রসদ জুগিয়েছেন। আসলে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার সংগ্রামের শুরু থেকে এসব দাবি ‘প্রাণের দাবি, বাঁচার দাবি’ হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আসছিল। বিশ্বজোড়া সমাজবদলের ডাকও এতে ইন্ধন জুগিয়েছিল। এই প্রশ্নের একটি মীমাংসা পাই ড. কামাল হোসেনের ব্যাখ্যায়। ১৯৭২ সালের ৩০ অক্টোবর মৌলিক প্রয়োজন ও অধিকারের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন:
‘১৯, ২০, ২১ [ধারা]–এগুলোর ব্যাপারে কারও কোন আপত্তি নেই। কারণ, এগুলো বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশের সংবিধান থেকে সন্নিবেশিত হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক দেশে কর্মের মর্যাদা দেওয়া হয়। সে সম্পর্কে ২০ নম্বর অনুচ্ছেদে পাওয়া যায়। এটা সোভিয়েত সংবিধানে রয়েছে।’
এই ৩টি অনুচ্ছেদ (১৫, ১৯ ও ২০) সংবিধানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘সমাজতান্ত্রিক ধারা’। বলে রাখি, ১৯(১) ধারায় ‘সুযোগের সমতা’ এবং ১৯(২) ধারায় ‘মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ’ এবং ‘নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন’ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছিল। যদি ১৯(১) ধারায় বলা হয়ে থাকে সুযোগের সমতা (Equality of Opportunity)-এর কথা, ১৯(২) এবং ২০(১) ধারায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল ‘Equality of Outcome’-এর প্রতি। ২০(১) ধারায় প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল মার্কসের ‘গোথা কর্মসূচির সমালোচনা’ লেখাটির সূত্র ধরে ‘প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্য অনুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী’ বণ্টনের নীতি। মোদ্দা কথা, ‘সুযোগের সমতা’ যার উল্লেখ আমরা পাশ্চাত্যের উদারনৈতিক দর্শনে সুপ্রচুরভাবে পাই (যেমন, জন রাউলস-এর লেখায়) বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র সেখান থেকে শুরু করলেও সেখানেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সেখানে দুর্ভাবনা ছিল জন্মসূত্রে সমাজের বিভিন্ন নাগরিকদের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির দুস্তর ফারাক নিয়ে। Initial conditions- এর মধ্যে বিশাল ব্যবধান থাকলে শুধু বর্তমান সময়ে ‘সুযোগের সমতার’ দাওয়াই দিয়ে নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের বৈষম্য এবং সামর্থ্যের (capability) বৈষম্য দূর করা যায় না। জন্মসূত্রে ফারাকের সাথে যুক্ত করতে হয় ‘কপালের লিখন’-এর কথাও। অনেকেই আছেন, যারা বিশুদ্ধ দুর্ভাগ্যজনিত কারণে ব্যবসায় সফল হন না, অথবা আকস্মিক ট্রমার কারণে যথাযথ উদ্যোগ নিতে পারেন না– এককথায়, ‘সুযোগের সমতার’ সদ্ব্যবহার করতে পারেন না এক্ষেত্রেও দেখতে পাচ্ছি, শুধু ‘সুযোগের সমতা’ দেওয়াই যথেষ্ট নয়। একারণেই বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীরা Equality of Opportunity-এর পাশাপাশি ‘Equality of Outcome’-এর সাংবিধানিক বিধান রেখে গেছেন। এজন্যে তারা ১৯(২) ধারায় ‘সম্পদের সুষম বণ্টন’ নীতি এবং ২০(১) ধারায় মার্কসের ‘শ্রম অনুযায়ী বণ্টন’ নীতি–এ দুই নীতিকে সাংবিধানিক মর্যাদা দিয়ে গেছেন। আবার পাশাপাশি ১৫(ঘ) ধারায় আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তা লাভের গ্যারান্টি দিয়ে গেছেন ‘অধিকারের ভাষা’ ব্যবহার করে।
১৬.৫। নানামাত্রিক শোষণের অবসান
বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজের পঞ্চম বৈশিষ্ট্যের রাজনৈতিক ও মানবিক গুরুত্বকে কোনোভাবেই খাটো করা যায় না। এই বৈশিষ্ট্যের মূল কথা নিহিত ‘শোষণহীন সমাজ’ গড়ার অঙ্গীকারের মধ্যে। ১৯৭২ সালের ৭ই জুনের ভাষণে বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রের সরলতম সংজ্ঞা দিয়েছিলেন (যেটা ইতঃপূর্বে উল্লেখ করেছি): ‘এ সমাজতন্ত্র হলো বাংলার মানুষের সমাজতন্ত্র, তার অর্থ হলো শোষণহীন সমাজ, সম্পদের সুষম বণ্টন।’ এর পূর্বলেখ (geneological trail) অনুসরণ করলে বহু পেছনে চলে যাওয়া যায়। ১৯৬৪ সালের ‘পুনরুজ্জীবিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের খসড়া ম্যানিফেস্টোতে’ আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক আদর্শ বর্ণনা করতে গিয়ে প্রথমেই বলা হয়েছিল: ‘আওয়ামী লীগের আদর্শ শোষণহীন সমাজ-ব্যবস্থা কায়েম করা। সমাজতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থার মাধ্যমেই বর্তমানের শোষণ, বৈষম্য ও দুর্দশার হাত হইতে মুক্তিলাভ করা সম্ভব বলিয়া আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে।’ ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে একটি অধ্যায়ের শিরোনাম ছিল ‘শোষণের অবসান অবশ্যই করতে হবে’ এবং তাতে বলা ছিল– ‘বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শোষণ ও অবিচারের যে অসহনীয় কাঠামো সৃষ্টি করা হয়েছে, অবশ্যই তার আমূল পরিবর্তন করতে হবে।’ ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১৪ নং ধারায় উল্লেখ আছে– এটি ড. আম্বেদকরের ভারতীয় সংবিধানেও নেই– ‘‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতী মানুষকে–কৃষক ও শ্রমিককে–এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা।’ সবশেষে উদ্ধৃতি দিতে চাই প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনার দলিল থেকে। সেখানে প্রথম পরিচ্ছেদের ১.১২ অধ্যায়ের শিরোনামই ছিল– শোষণের হ্রাসকরণ (reducing exploitation)। ব্যাখ্যায় বলা ছিল: ‘Under the prevailing objective conditions elements of exploitation can only be reduced in phases if the productive process is not to be disrupted।’ এখানে বিভিন্ন দলিল থেকে ‘শোষণহীন সমাজ’ গড়ার যে অঙ্গীকার তুলে ধরা হলো তা শুধু কথার কথা ছিল না। এই অঙ্গীকার ছিল গণমানুষের দীর্ঘদিনের দাবি। এক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি, ‘শোষণ’ শব্দটি বিভিন্ন অর্থে (সংগত কারণেই) ব্যবহৃত হয়েছে। কখনো সেটা ব্যবহৃত হয়েছে গ্রামের কৃষক জনগোষ্ঠীর ওপরে সামন্তবাদী জমিদারি-জোতদারি-জায়গিরদারি শোষণের অবসান প্রসঙ্গে। কখনো সেটা ব্যবহৃত হয়েছে শ্রমিক-মেহনতি মানুষের ওপর অর্থনৈতিক শোষণ ছাড়াও সকল প্রকার ‘অন-অর্থনৈতিক শোষণ’ (extra-economic exploitation) শোষণের অবসান প্রসঙ্গে। অর্থাৎ শুধু উৎপাদনকেন্দ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থনৈতিক শ্রেণিসমূহ– যথা, শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষ– তাদের ক্ষেত্রেই দৃষ্টি সীমিত থাকেনি। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সকল প্রকার ‘অনগ্রসর অংশসমূহের’ ওপরে অর্থনৈতিক ও অন-অর্থনৈতিক (সামাজিক, সাংস্কৃতিক) শোষণের অবসান অর্থে কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে। কখনো সেটা ব্যবহৃত হয়েছে নারীর প্রতি শোষণমূলক আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির অবসানের কল্পে। আজকের যুগে সামাজিক-ধর্মীয়-ভাষাগত-জাতিগত-লিঙ্গগত শোষণ-বঞ্চনার–বৃহত্তর অর্থে, আইডেনটিটি-পলিটিক্সের ডিসকোর্সের–অন্তর্গত ন্যারেটিভ হিসেবে পড়তে হবে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ‘শোষণহীন সমাজ’ ধারণাটিকে। একে শুধু অর্থনৈতিক বঞ্চনার কথা ভাবা ভুল।
সংবিধানের ১৪নং ধারায় কৃষক-শ্রমিকের পাশাপাশি ‘জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহের’ কথা উল্লেখ ছিল এবং তাদের ওপরে ‘সকল প্রকার শোষণের’ অবসানের সাংবিধানিক গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছিল। এটি বাংলাদেশের সংবিধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এ নিয়ে বাংলাদেশ গণপরিষদে বেশ বিতর্কও হয়েছিল সেদিন সাংসদদের মধ্যে, যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। লারমা চেয়েছিলেন ১৪নং ধারার ‘অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান’ করার প্রতিশ্রুতিকে আরও সুনির্দিষ্ট রূপ দিতে। ১৪নং ধারার পর ১৪ক শীর্ষক একটি নতুন অনুচ্ছেদ তিনি সংযোগ করতে চেয়েছিলেন। তার প্রস্তাবে ছিল নিম্নোক্ত সংযোজনী:
‘১৪ অনুচ্ছেদের পর নিম্নরূপ নতুন অনুচ্ছেদটি সংযোজন করা হোক:
১৪ক। সংখ্যালঘু জাতিসমূহ ও অনগ্রসর জাতিসমূহের
(ক) ন্যায়সঙ্গত অধিকার সংরক্ষণ করা হইবে;
(খ) শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মান উন্নয়নের জন্য বিশেষ-অধিকার দেওয়া হইবে; এবং
(গ) অগ্রসর জাতিসমূহের সহিত সমান পর্যায়ে উন্নত হইবার পরিপূর্ণ সুযোগ রাষ্ট্র সম্পূর্ণভাবে নিশ্চয়তা বিধান করিবেন।’
শেষ পর্যন্ত মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সংশোধনী-প্রস্তাব গণপরিষদে গৃহীত হলো না। অথচ ভুল শব্দের ব্যবহার (‘সংখ্যালঘু ও অনগ্রসর জাতি’) সত্ত্বেও একথা তো পরিষ্কার, তিনি শুধু চেয়েছিলেন যে শুধু ‘অনগ্রসর অংশসমূহের’ ওপরে শোষণের অবসানের প্রতিশ্রুতিই নয়, সেটাকে আরও সাংবিধানিক ভাবে দৃঢ় করা হোক কংক্রিট পদক্ষেপের মাধ্যমে। সেকারণেই তিনি বলেছিলেন, (ক) অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিসংক্রান্ত ‘বিশেষ অধিকার’ সংরক্ষণ করতে হবে; এবং (খ) রাষ্ট্রকে নিশ্চয়তা দিতে হবে, যাতে করে কালক্রমে তারা ‘অগ্রসর’ অংশসমূহের সাথে ‘সমান পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পরিপূর্ণ সুযোগ পায়’। সেদিনের আনীত সংশোধনী প্রস্তাবে ‘জাতিসমূহ’ কথাটি বাদ দিয়ে লারমার প্রস্তাবিত মূল কথাগুলো ১৪নং অনুচ্ছেদে বাড়তি অনুচ্ছেদ হিসেবে রাখলে কিছু ক্ষতি-বৃদ্ধি হতো না। সংবিধানের অন্যান্য অনুচ্ছেদে এসব কথা তো এমনিতেই ছিল (যেমন ২৮ ও ২৯ নং অনুচ্ছেদে)। বরং এটা করা হলে পরবর্তীকালে সৃষ্ট জাতিগত বা নৃগোষ্ঠীগত মনঃকষ্ট তৈরি হওয়ার কোনো যৌক্তিক অবকাশই হয়তো আর থাকত না।
বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের পঞ্চম বৈশিষ্ট্য ‘শোষণহীন’ সমাজ প্রতিষ্ঠার আরেকটি অর্থ হচ্ছে নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা বিধান। এটি নানা অনুচ্ছেদেই এসেছে গুরুত্বের সাথে। সংবিধানের ‘মৌলিক অধিকারের’ অংশে ২৮(১) ধারায় পরিষ্কার বলা হয়েছে:
(১)    ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’
(২)    ‘নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান-প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।’
নারী-পুরুষের সমানাধিকারের বিষয়টিকে শিক্ষা লাভ, বিনোদন, ‘সরকারি নিয়োগলাভে সুযোগের সমতা’ প্রভৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রেই সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। নারী ও পুরুষের মধ্যে সমানাধিকারের বিষয়টি শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেসম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর পূর্ব-উপলব্ধি ছিল। এজন্যেই স্বাধীনতা-উত্তরকালে প্রয়োজনীয় নীতি-পদক্ষেপ নিতে কালবিলম্ব করেননি বঙ্গবন্ধু। ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে তরুণ মুজিব লিখছেন:
“পুরুষ শ্রেষ্ঠ আর স্ত্রী জাতি নিকৃষ্ট” এই পুরানো প্রথা অনেক দেশে বহুকাল থেকে চলে আসছে, তাহা আর নয়াচীনে নাই। আইন করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাই আজ নয়াচীনে সমস্ত চাকরিতে মেয়েরা ঢুকে পড়ছে। পুরুষদের সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করছে। প্রমাণ করে দিতেছে পুরুষ ও মেয়েদের খোদা সমান শক্তি দিয়েই সৃষ্টি করেছে। সুযোগ পেলে তারাও বৈজ্ঞানিক, ঐতিহাসিক, ডাক্তার, যোদ্ধা সকল কিছুই হতে পারে।...নয়াচীনের মেয়েরা আজকাল জমিতে, ফ্যাক্টরিতে, কলে-কারখানাতে, সৈন্যবাহিনীতে দলে দলে যোগদান করছে।...যে সমস্ত ফ্যাক্টরি, কলকারখানা, সরকারি অফিসে আমি গিয়াছি সেখানেই দেখতে পেয়েছি মেয়েরা কাজ করছে; তাদের সংখ্যা স্থানে স্থানে শতকরা ৪০ জনের ওপরে। নয়াচীনের উন্নতির প্রধান কারণ পুরুষ ও মহিলা আজ সমানভাবে এগিয়ে এসেছে দেশের কাজে। সমানভাবে সাড়া দিয়াছে জাতিগঠনমূলক কাজে। তাই জাতি আজ এগিয়ে চলেছে উন্নতির দিকে।’
অন্যত্র তিনি বলেছেন, ‘সত্য কথা বলতে গেলে, একটা জাতির অর্ধেক জনসাধারণ যদি ঘরের কোণে বসে শুধু বংশবৃদ্ধির কাজ ছাড়া আর কোন কাজ না করে তা হলে সেই জাতি দুনিয়ায় কোনোদিন বড় হতে পারে না।’

[ক্রমশ]