বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় ধারার সার্থক উত্তরাধিকারী সমরেশ মজুমদার। সত্তর-আশির দশক থেকে দুই বাংলায় যাঁদের লেখা পাঠক সৃষ্টিতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে, সমরেশ মজুমদার তাঁদের অন্যতম। এক সময় আমাদের দেশে সাময়িক পত্রগুলোর ভূমিকা অনেক বেশি ছিল। এখনও আছে যদিও, তবু সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, আগে সে ভূমিকা ছিল আরও বড়। সেই জায়গাগুলোয় নিয়মিতভাবে আমরা সমরেশ মজুমদারের লেখা পেয়েছি এবং সেসব লেখা আমাদের রুচি ও সমাজকে প্রভাবিত করেছে। একই সঙ্গে কালোত্তীর্ণ লেখার রচয়িতা ও বহুপ্রজ- এমন সমন্বয়ের লেখক শুধু বাংলা কেন; পৃথিবীর কোনো ভাষাতেই খুব বেশি পাওয়া যায় না। সেই জায়গা থেকে সমরেশ মজুমদার আমাদের চিরকালীন গৌরবের উপলক্ষ হয়ে থাকবেন।

সমরেশ সম্ভবত সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত হয়ে থাকবেন তাঁর উপন্যাস চতুষ্ক– উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ ও মৌষলকাল নিয়ে। এর ভেতর উত্তরাধিকার যখন প্রকাশিত হয়; সেই ১৯৭৯ সালের কথা; তখন থেকে যে আবেশ তৈরি হয়েছে পাঠকের মনে, সেই আবিষ্ট ভাব কি আজও কেটেছে? আমি মনে করি– না। আমি বিশ্বাস করি, সমরেশ মজুমদারের পাঠক হিসেবে ‘উত্তরাধিকার’-এর উত্তরাধিকার বহন করে চলবে আগামী দিনের পাঠককুল। সেই যে স্বর্গছেঁড়া টি এস্টেট, আঙরাভাসা নদী– সে তো কেবল অনিমেষ মিত্রের হয়ে থাকেনি। হয়ে গেছে প্রত্যেকের। সাধারণ মানুষের আন্দোলনভাবনা, সংগ্রামচেতনা– এই জায়গাগুলো নিয়ে একেবারেই যেন প্রাকৃতিক শক্তি দিয়ে খেলেছিলেন সমরেশ। কালবেলা, কালপুরুষে যা আরও বিকশিত, পরিণত। গর্ভধারিণীর জয়িতার কথা কি কোনোদিন ভুলতে পারবে কেউ? সমাজের প্রচল কাঠামো ভেঙে ফেলে মানুষের জন্য মানুষের তৈরি সাম্যের নতুন সমাজ গড়ার যে প্রত্যয় বন্ধুরা দেখিয়েছে; এর পর তো পাঠকের মানস বদলে গিয়েছিল অনেকখানি– বলাই যায়। সাম্যবাদের প্রতি একটা আবেগ; বিরুদ্ধ পরিবেশ নিয়ে একটা উদ্বেগ কিন্তু উস্কে দিয়েছিল ওসব বই। উপন্যাসের সক্ষমতা, গল্পের ক্ষমতার জায়গা তো এটাই। এমনকি এখনও যখন পশ্চিমবাংলার কোনো বিপ্লবী প্রেক্ষাপটের সৃজনশীল লেখা কিংবা চলচ্চিত্র সামনে আসে, আমার মনে সমরেশের সেই সৃষ্টিগুলোই আবার দোলা দিয়ে যায়।  

দুই বাংলা মিলিয়ে যে বৃহত্তর বাঙালি পরিমণ্ডল; মানুষের মানসজগৎসহ সেই পরিমণ্ডলের প্রায় সবটাই কি সমরেশের লেখায় উঠে আসেনি? আমি মনে করি, এসেছে। আমি খুঁজে পেয়েছি। আমি বাংলাদেশের পাঠক হিসেবে সেই বৃহত্তর বাঙালি পরিমণ্ডলের একজন হিসেবে তাঁর লেখায় যেন সব সময় আমার চারপাশকে খুঁজে পেয়েছি। সমরেশ মজুমদারের অনেক লেখার সঙ্গে আমি একাত্ম হতে পারিনি, তা ঠিক। তবে এটা তো সত্যি, একজন লেখকের পক্ষে তাঁর জীবনজুড়ে প্রতিটি লেখায় প্রত্যেকের হৃদয় জয় করা ঠিক স্বাভাবিক নয়। সৃষ্টির অরণ্যে যদি সবকটি বৃক্ষই মহিরুহ হয়, তবে সেই অরণ্য কি সব প্রাণীর আবাস হয়ে উঠতে পারে? একেক বৃক্ষে যে একেক প্রাণীর বাস। তাঁর যে গ্রন্থের সঙ্গে আমি দ্বিমত করেছি, সেটি হয়তো আর কারও হৃদয়ের ধনে পরিণত হয়েছে। এই তো স্বাভাবিক।

সমরেশ মজুমদারের মতো লেখকদের জগৎ একবারই পায়। তিনি আমাদের বাংলা ভাষার গৌরব; বিশ্বেরও। অনুবাদের মাধ্যমে তিনি ছড়িয়ে পড়লে বিশ্ববাসী আরও বৃহৎ পরিসরে তাঁকে ও এই উপমহাদেশকে জানতে, বুঝতে পারত। তাঁর যে সাহিত্যকীর্তি, তা তাঁকে বাংলা সাহিত্য নয় কেবল; বিশ্বসাহিত্যেও একদিন অমরতা দেবে– আমি এই শুভকামনা, বিশ্বাস ও আস্থা জানিয়ে রাখছি। তাঁর প্রতি আমার চির অমলিন শ্রদ্ধা ও অটুট ভালোবাসা ব্যক্ত করে গেলাম।

সেলিনা হোসেন: কথাসাহিত্যিক; সভাপতি, বাংলা একাডেমি