অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম পরিণত বয়সেই (৯৪ বছর) শান্তভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন– খবরটা মঙ্গলবার রাত ৮টায় ফোন করে আমাকে জানান ড. কাজী শাহাবুদ্দীন। ফোন পেয়ে একরাশ স্মৃতি মানসপটে ভেসে উঠল। বিশেষত শাহাবুদ্দীন ভাই যখন বললেন, খবরটা আমার আরেক শিক্ষক ড. আনিসুর রহমানকে দিতে হবে। মনে পড়ে গেল, ২০১৪ সালে নভেম্বর মাসে দৈনিক সমকালেই আমার প্রিয় দুই শিক্ষককে নিয়ে লিখেছিলাম। সেখানে তাঁদের ভিন্নধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে আমি বলেছিলাম– একজন প্রখর বাস্তববাদী, আরেকজন বিস্ময়করভাবে আদর্শবাদী।

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য দুই ধরনের গুণেরই প্রয়োজন ছিল। তাই সম্ভবত ১৯৭২-৭৫ কালপর্বে বঙ্গবন্ধু ভিন্ন ধরনের এই দু’জনকে ধারণ করেই গড়ে তুলেছিলেন তাঁর শক্তিশালী পরিকল্পনা কমিশন। দুই বিপরীতধর্মী দৃষ্টিভঙ্গির টানাপোড়েনের মধ্যেই প্রণীত হয়েছিল আমাদের স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাটি। অর্থাৎ ‘আদর্শনিষ্ঠ বস্তুবাদ’ অথবা ‘বস্তুনিষ্ঠ আদর্শবাদ’ নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনে সবসময়ই একটা টানাপোড়েন চলছিল।

প্রফেসর ইসলাম আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন না। ১৯৭৪ সালে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে প্রথম বর্ষে ভর্তি হই, তখন তিনি শিক্ষকতা ছেড়ে বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান। তিনি যাঁদের পড়িয়েছেন, তাঁদের কয়েকজন আমার শিক্ষক ছিলেন।

আমরা অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থীরা অধ্যাপক নুরুল ইসলাম সম্পর্কে সম্ভ্রম ও ভক্তি নিয়ে বেড়ে উঠেছি। এক পর্যায়ে তাঁর লেখা একটি বই আমাদের হাতে আসে, যা প্রকাশ হয়েছিল ১৯৭৯ সালে। বইটির নাম ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানিং ইন বাংলাদেশ– এ স্টাডি ইন পলিটিক্যাল ইকোনমি। বইটিতে তিনি ১৯৭২ থেকে ’৭৫ কাল-পর্ব তুলে ধরেছেন, যাকে বলতে পারি বাংলাদেশের সবচেয়ে অনিশ্চিত ও উত্তেজনাপূর্ণ, হৃদয়গ্রাহী ও হৃদয়বিদারক, মহৎ ও ট্র্যাজিক ধরনের সময়। যে ধরনের সময়কে চার্লস ডিকেন্স ‘টেল অব টু সিটিজ’ গ্রন্থে লিখেছেন– ইট ওয়াজ দ্য বেস্ট অব দ্য টাইমস, ইট ওয়াজ দ্য ওয়ার্স্ট অব দ্য টাইমস।

অধ্যাপক নুরুল ইসলামের বইটিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সম্পর্কে একটি চমকপ্রদ মূল্যায়ন রয়েছে। তাঁর মৃত্যুর পর আজ মনে হচ্ছে, সেটি এখন ইতিহাসে পরিণত হলেও তার থেকে এখনও অনেক মূল্যবান শিক্ষা নেওয়ার আছে। তিনি লিখেছিলেন, স্বাধীনতা অর্জনের পর শাসকশ্রেণি সমাজের প্রায় সব অংশের সার্বিক আনুগত্য লাভ করেছিল। কিন্তু শুরু থেকেই রক্ষণশীল শক্তি এবং বিপ্লবী শক্তি ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। দলের সর্বোচ্চ শিখরে আসীন নেতৃত্ব উভয় শক্তির প্রতিযোগিতার মাঝখানে অবস্থান গ্রহণ করেন। এই নেতৃত্ব সমতাধর্মী নীতি গ্রহণ করে সমাজতন্ত্র অভিমুখিন পদক্ষেপ গ্রহণে ইচ্ছুক ছিলেন, যদিও এর বিরুদ্ধে রক্ষণশীল শক্তি বা কায়েমি স্বার্থের তরফ থেকে তীব্র প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। বস্তুত রাজনৈতিক নেতৃত্ব অনেক সময় পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন দুই রাস্তাই খোলা রাখতে। দলের সাংগঠনিক কাঠামো এবং অর্থনীতিতে যেসব শক্তিশালী আর্থসামাজিক গোষ্ঠীর অবস্থান ছিল, তার বিরুদ্ধে নেতৃত্ব সরাসরি বিরোধে যেতে পারেননি। এ ক্ষেত্রে আশঙ্কা ছিল, এ গোষ্ঠীগুলোকে যদি আলোকিত আত্মস্বার্থের কথা বলে, বুঝিয়ে পক্ষে না এনেই তাদের ক্ষমতা ও সুবিধাগুলো কেড়ে নেওয়া হয়, তাহলে তারা রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিরোধী অবস্থান নেবে। ১৯৭২ থেকে ’৭৫ সাল পর্যন্ত যত অর্থনৈতিক নীতিমালা ও কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে, তাকে এই সুনির্দিষ্ট সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেই মূল্যায়ন ও বিচার করতে হবে (দেখুন নুরুল ইসলাম, ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানিং ইন বাংলাদেশ– এ স্টাডি ইন পলিটিক্যাল ইকোনমি– পৃষ্ঠা ৪ ও ৫)।

অধ্যাপক নুরুল ইসলামের মূল্যায়ন এখনও শিক্ষণীয় ও প্রাসঙ্গিক। তবে এ প্রশ্ন উঠতে পারে– রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়িত্ব ছিল তাঁর পুরোনো সহচরদের মধ্যে যাঁরা নতুন প্রয়োজনের সঙ্গে একমত, তাঁদেরকে নিয়ে জনগণের কাছে যাওয়া এবং জনশক্তিতে বলীয়ান হয়ে সমাজতান্ত্রিক উন্নয়নের পথে অগ্রসর হওয়া। সেটা কি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান করতে পারতেন না? সেই সক্ষমতা ও ইচ্ছা কি তাঁর ছিল? ১৯৭৫ সালে তাঁর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর সে প্রশ্নের যাচাইযোগ্য উত্তর আজ আর পাওয়া সম্ভব নয়। তবে আমরা তাঁর মৃত্যুর আগের পদক্ষেপ এবং মৃত্যুর পর কারা উপকৃত হলেন, তাঁদের চরিত্র বিশ্লেষণ করে তা অনুমানের চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু নুরুল ইসলাম কঠোর প্রত্যক্ষবাদী অর্থনীতিবিদ হিসেবে সে ধরনের কোনো বিশ্লেষণে ইচ্ছুক ছিলেন না।

অধ্যাপক নুরুল ইসলাম আমৃত্যু মিশ্র অর্থনীতির পক্ষেই থেকে গেছেন। তিনি ছিলেন কিছুটা প্রয়োগবাদী, যতটুকু বাস্তবে ঘটেছে ততটুকুর ভিত্তিতেই তিনি সিদ্ধান্ত নিতে চেয়েছেন। নীতিগত দুর্বলতা আর সবলতা উভয়কে তিনি চিহ্নিত করেছেন। আমার মনে হয়, গণতান্ত্রিক পথে, বিবর্তনের পথে সমাজতন্ত্রে পৌঁছানো সম্ভব বলে তখন তাঁর মনে এক ধরনের বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সে জন্য অন্তর্বর্তীকালে যে নিবেদিতপ্রাণ, অঙ্গীকারসম্পন্ন নেতৃত্ব এবং দল প্রয়োজন, যাঁর একই সঙ্গে জনগণের প্রতি অঙ্গীকার, নৈতিক নিষ্ঠা ও কৌশলগত নমনীয়তা থাকবে, সে রকম নেতৃত্ব তিনি সর্বাঙ্গসুন্দররূপে খুঁজে পাননি। হয়তো তিনি ঠেকে ঠেকে তা হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন এবং অবশেষে বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে বিদেশে চলে যান। যদিও বঙ্গবন্ধু তাঁকে বিদায়লগ্নে গান শুনিয়েছিলেন– ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে…’ ( দেখুন, নুরুল ইসলাম, অ্যান ওডিসি-দ্য জার্নি অব মাই লাইফ- পৃ. ৮৬)।

বিদায় মুহূর্তে বাকশাল বা একদলীয় শাসনের পক্ষে আমাদের প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদদের কেউই ছিলেন না। তাঁরা সবাই সে সময়ে বঙ্গবন্ধুর সরকার থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন। অধ্যাপক নুরুল ইসলামও এ পদ্ধতি সমর্থন করেননি। তবে বাকশাল সফল বা ব্যর্থ হলে কী হতো– এ বিতর্কে তিনি স্বাভাবিকভাবেই নাক গলাননি। সুতরাং শোষিতের গণতন্ত্র বনাম শোষকের গণতন্ত্র বা বুর্জোয়া গণতন্ত্র, সর্বহারার একনায়কতন্ত্র, একদলীয় ব্যবস্থা বনাম অংশীদারিত্বমূলক গণতন্ত্র বা উচ্চতর গণতন্ত্র ইত্যাদি বিতর্ক তাঁর কাছে প্রাসঙ্গিক ছিল না। কারণ তিনি মতাদর্শিক কোনো জায়গা থেকে এগুলোকে দেখেননি। তাঁর বিচার পদ্ধতি হচ্ছে বাস্তব তথ্যমূলক; আদর্শগত বিশ্বাসের মূল্যায়নে তাঁর কোনো আগ্রহ নেই।

এই প্রায়োগিক পদ্ধতি যে আমৃত্যু অধ্যাপক নুরুল ইসলামের কাছে সত্য ছিল– তা আমরা টের পাই (২০ নভেম্বর, ২০১৪) একটি দৈনিকে প্রকাশিত তাঁর সাক্ষাৎকারে। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং গণতন্ত্র সম্পর্কে। তিনি জবাব দিয়েছেন, ‘উন্নয়ন ও গণতন্ত্র এই দুটোর সম্পর্ক বড় জটিল। আপনার প্রশ্ন তো এটাই যে, গণতন্ত্র না হলে উন্নয়ন হবে কিনা? ইতিহাস এটাই বলে যে, উন্নয়ন হতে পারে গণতন্ত্রে বা বিনা গণতন্ত্রে। এটা নির্ভর করে নেতৃত্ব উন্নয়নের প্রতি কতটুকু সংকল্পবদ্ধ এবং কী নীতি অনুসরণ করেন তার ওপর।’ সুতরাং দেখা যাচ্ছে, গণতন্ত্র ছাড়া উন্নয়নের সূচনা সম্ভব হতে পারে বলে অধ্যাপক নুরুল ইসলামের বিশ্বাস। ইতিহাস অবশ্য তাঁর পক্ষেই কথা বলবে।

বঙ্গবন্ধু যদি স্বাধীনতার পরপর বিপ্লবী সরকার গঠন করে রেজিমেন্টেড পদ্ধতিতে এগোতেন, তাহলে জাসদ কি তৈরি হতো? তাহলে পরাজিত দক্ষিণপন্থিরা পুনরুত্থানের সুযোগ পেত? তাহলে মাত্র চার বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুকে কি প্রাণ হারাতে হতো? ইতিহাসের এসব প্রশ্নের কোনোটারই উত্তর আমরা দিতে অক্ষম। সেটা হয়তো নিশ্চিতভাবে দেওয়া কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।

অধ্যাপক নুরুল ইসলাম আজ এসব বিতর্কের অতীত। তিনি চলে গেছেন লোকান্তরে। ওখান থেকে হয়তো হাসতে হাসতে তিনি ভাবছেন– ‘কর্তৃত্ববাদের অধীনে বাংলাদেশে এই মুহূর্তে উন্নয়ন তো হচ্ছে। কিন্তু দুর্নীতি আছে, সুশাসনের অভাব আছে– ভবিষ্যতে এই উন্নয়ন সংস্কার ছাড়া বজায়যোগ্য বা টেকসই হবে কি?’

ড. এম এম আকাশ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক