
বেকার যুবকের কত কষ্ট আর কত প্রাপ্তি! কষ্টের কথা বুঝলেও প্রাপ্তি শব্দটা সকলের কাছে রহস্যময় শোনাবে। তবুও বলি, ছকবাঁধা জীবন, অফিস, সংসার, যানজট আর অফুরান সময় যারা অতিক্রম করে যায়, তারা বুঝবে না বেকার জীবনের প্রাপ্তি কত। এই আমি যখন নিরিবিলি জোছনায় ঘুরে বেড়াই অথবা সারাদিন চাকুরির আশায় স্বপ্ন বুনি... হাজার মানুষের উৎকণ্ঠা আর মাঝে মাঝে গাছের ছায়াকে ছোট-বড় হতে দেখি, তখন বুঝে যাই মানুষের জীবনে ছোট-বড় ব্যাপারগুলো এই গাছের ছায়ার মতোই। ছোটবেলায় মা বলতেন–
আমার ছেলে একদিন অনেক বড় মানুষ হবে।
অথচ সুয্যি মামা আমার অবস্থানে তার আলো পৌঁছাতে পারল না। অনেক ছায়ার নিচে ছায়াঘেরা সুশীতলতায় আমার ছায়ারা কোনোদিন ছোট-বড় হলো না। সবাই অফিস শেষ করে বিকেলটায় যখন ঘরে ফেরার উৎসবে মেতে ওঠে, ঠিক তখন আমার মনটাও আনচান করে ওঠে। আমাকেও কোথায় যেন ফিরে যেতে হবে! কিন্তু কোথায়? সংসার নেই, পৃথিবীর একমাত্র আশ্রয় ‘মা’, তাও নেই। এলোমেলো ভাবনারা আমাকে গ্রাস করে। এত ইংরেজি জেনেও ইংরেজিতে কথাগুলো গুছিয়ে বলতে না পারার অপরাধে স্পোকেন ইংলিশের কোচিং সেন্টারের উদ্দেশ্যে আমার অচল পা দুটো সচল করার চেষ্টা করি। সবাই যখন ক্লাসে একটা চাকুরি জোগাড়ের প্রত্যাশায় নিজভূমে পরবাসী হয়ে ‘ট’ কে ‘ঠ’ উচ্চারণে মগ্ন, বিকেলের ম্লান নিষ্প্রভ আলোরা তখন আমাকে মার হাতের বানানো চায়ের স্বাদের স্মৃতির ভেতরে বুঁদ করে রাখে।
ইংরেজি শব্দগুলো আমার কানে আর পৌঁছায় না। মার হাতের সেই চা! আহা, কতদিন মা’র হাতের চা খাই না! আমার বাংলা অনুভূতিতে আচ্ছন্ন অন্তর্লোকে মা’র মুখ আর এক নিরিবিলি আকাশের একখণ্ড মেঘ ভাসতেই থাকে। ক্লাসের পেছন দরজা দিয়ে চুপটি করে পালিয়ে বটতলায় এসে বসি। সন্তর্পণে পকেটে হাত রাখি। বুকে হাত রাখার ভঙ্গিতে। মৃন্ময় আমাকে দেখে হাসে। ওর বাংলা হাসিটা যেন বলে, টাকা না থাকলে সমস্যা নেই। তখন আমার জীবনের প্রাপ্তিগুলো স্পষ্ট হয়, ইচ্ছেমতো চা খেতে পারি না বলেই তো মা’র বানানো চায়ের স্বাদ মুখে লেগেই আছে। আরেকটা প্রাপ্তি আমার আছে। বেকার বলে, এই সমাজের ভয়াবহতার সঙ্গে আমার আত্মা এখনও মিশে যায়নি।
একদিন দুপুরের পর– কী জানি শেষমেশ হয়তো স্পোকেন ইংলিশের ক্লাসের দিকেই যাচ্ছিলাম। মোবাইলে আমার বন্ধুটি ওর অফিসের ঠিকানা বলছিল,
শোন, ইন্টারভিউ ২৮ তারিখে।
হাফিজ নেবে আমার ইন্টারভিউ? আমার স্কুলজীবনের বন্ধু হাফিজ। পড়াশোনায় একটু দুর্বল ছিল বলে রেজাউল স্যার ওকে বিকৃত নামে ডাকত। ফোনের অপর প্রান্ত প্রায় ধমকের স্বরে হাফিজ বলল,
কাগজ-কলম হাতে নিয়েছিস? তাড়াতাড়ি কর; তোর মতো অফুরান সময় আমার হাতে নেই।
ঠিকানাটুকু লিখে নেওয়ার জন্য পথের আশপাশে পড়ে থাকা কাগজ খুঁজছিল আমার চোখ। বেকার দু’চোখে চশমাও কেমন বেমানান। ভাগ্যিস মা বেঁচে নেই। বেকারদের চোখে চশমা অন্যের কাছে হাস্যকর হলেও মায়েদের আত্মায় তা ক্ষত হয়ে বাজতে থাকে। বন্ধুকে অস্থির বিনয়ের সঙ্গে ঠিকানাটা পুনরায় বলতে অনুরোধ করলাম। খ্যাক খ্যাক করে উঠল বন্ধুজন। অথচ ছাত্রজীবনে কতদিন তাকে পড়িয়েছি! ক্যালকুলাস, স্থিতিবিদ্যা-গতিবিদ্যা ওর মাথায় ঢুকত না বলে ওর জন্য আমার আরও মায়া হতো। ছাত্রজীবন নামের এক ভয়াল প্যারাময় জীবনকে মানুষের কেন বয়ে বেড়াতে হয়? এত বড় আর জটিল অঙ্কগুলো এ দেশে আমাদের আসলে কোন কাজে লাগে? আমার স্মৃতিচারণ আর ভাবনা থামিয়ে সে বলল,
বেকার মানুষ ব্যাটা! সারাক্ষণ তোর হাতে ফাইল থাকবে; ফাইলে থাকবে সাদা কাগজ। এত ক্যালাস হলে– জীবনে কি কিছু হবে?
জীবনে আমার কিছু হলোও না। বাবার কোনো ভাই-বোন নেই। মা-ও ছিল নানার একমাত্র মেয়ে। খুঁটিশূন্য আমার জীবন! কুড়িয়ে পাওয়া একটা পোস্টকার্ডে ফাঁকা জায়গা খুঁজছিলাম। আমার মান্যবর বন্ধুটি তার প্রতিষ্ঠানের নাম বলছে– ‘হাইটেক... ১৬, এলিফ্যান্ট রোড...’
২.
বাকি শব্দগুলো আমি আর শুনিনি। পোস্টকার্ড পড়ছিলাম,
‘মা এই স্কুলের সিলেবাস বাংলাদেশের অন্যান্য ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের মতোই। আমি আরশোলা কত ভয় পাই। বাংলায় কথা বললে ওরা যখন হাসাহাসি করে– অভদ্রভাবে; তখনই একটা আরশোলা আমার হার্টের ভেতরে ঢুকে যায়। তুমি যে বাংলায় কথা বলো! তোমাকে দেখতে পাই না। এজন্য আরশোলাটা আমার ছোট্ট হৃদপিণ্ডটা খেয়ে ফেলে। শুধু ভয় লাগে। ভেতরে কী যেন ছটফট করে ঘুরে বেড়ায়। শুধু মনে হয়, তোমাকে না দেখতে পেলে আমি তাড়াতাড়ি মরে যাব। বাংলাদেশের মতো এখানেও ক্লাস ফোরের একই সিলেবাস... তবু আমি চেন্নাইয়ে...। কেন? কেন মা!’
ডাক বিভাগের রানারের থলে থেকে কি এখানে পোস্টকার্ডটি পড়ে গেছে? তার মা কি পড়ার পর ফেলে দিয়েছেন পোস্টকার্ডটি? তাই কি হয়?
দ্বিধা-প্রশ্ন পায়ের তলায় মাড়িয়ে তারপর ঠিকানা ধরে এগিয়েছি। মফস্বল শহরের একতলা বিশাল বাড়ি। গৃহকর্তা মতো একজন এলেন। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম,
মিসেস শ্রাবন্তীর একটা চিঠি! বলে পোস্টকার্ডটা ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে ধরলাম। বিরক্তি সহকারে তিনি জানালেন,
ভাইয়াকে তালাক দিয়ে তিনি এখন ঢাকায়। বড় চাকুরি করছেন। হয়তো বিয়ে করেছেন অথবা লিভ টুগেদার...
তার ছেলের চিঠিটা তাকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলাম। ভ্রু কুঁচকে পুনরায় তিনি বিরক্তি প্রকাশ করলেন,
আরে ভাই, আপনি তো মহাবিরক্তিকর লোক। ছেলে একটা ঝামেলা ছিল বলে তো তাকে বাইরে পাঠানো হয়েছে। মিসেস শ্রাবন্তী আর ভাইয়া মিলে ভাগাভাগি করে মাসে-মাসে টাকা পাঠাচ্ছে... ব্যস! দেন তো চিঠিটা; দেখি।
পোস্টকার্ডটি তাকে না দিয়ে দ্রুত নিজের পকেটে ভরলাম। তারপর বাসাটার চারদিকের ছড়ানো প্রাচুর্যের ভেতরে চোখ বোলালাম। বিস্তৃত ছড়ানো এমন সুখ, কোনো নারী কেন ছেড়ে যায়– তার মনস্তাত্ত্বিক কারণ বোঝার চেষ্টা করলাম। কোনো কিছু বোঝার আগেই শিশুটার মুখ কিছু কিছু দৃশ্যকল্পের ভেতরে স্পষ্ট হলো।
বাসার দক্ষিণ প্রান্তে ছোট্ট সুইমিংপুল। তার পাশে ফাঁকা এক দোলনা। আমার মনে হলো শান্ত; হ্যাঁ, মনে মনে আমি ধরেই নিলাম বাচ্চাটির নাম শান্ত, দোলনায় দুলছে। সুইমিংপুলে ওর মা’র হাত ধরে সাঁতার শেখার চেষ্টা করছে। মিসেস শ্রাবন্তী ছেলেকে ভালো করে সাঁতার শেখানোর জন্য মাঝে মাঝে তার হাত ছেড়ে দিচ্ছেন। শান্ত প্রায় ভয় পেয়ে বলছে,
মা তুমি আমাকে ছেড়ে দিচ্ছ? আমি ডুবে যাব তো! মিসেস শ্রাবন্তী ছেলেকে কোলে টেনে বলছেন,
সাঁতার শেখার জন্য মাঝে মাঝে আমার হাত ছেড়ে দিয়ে তোর তো প্র্যাকটিস করতে হবে।
ছবির মতো সাজানো কয়েক বিঘার বাসাটির আনাচে কানাচে আমার চোখ ঘুরছিল। দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে বড় এক আমগাছ। কয়েকটা কাঠবিড়ালী সেখানে একে অন্যকে ধরার চেষ্টায় মহাব্যস্ত। সে দৃশ্য দেখে শান্ত অশান্ত রকম আনন্দে মহাব্যস্ত। দোতলার সামনে ছড়ানো ব্যালকনি থেকে মিসেস শ্রাবন্তী শান্তকে ডাকছেন,
শান্ত! কয়েকদিন পরই তোমাকে নতুন স্কুলে যেতে হবে। হুল্লোড় করে হাত-পা ভেঙো না; ভেতরে এসো...। শান্ত অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলছে,
আমি নতুন স্কুলে যাব না মা। আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না। মিসেস শ্রাবন্তী ছেলেকে আত্মবিশ্বাসী করার জন্য বলছেন,
কাঠবিড়ালীগুলো কি ওদের মায়ের আঁচল ধরে বসে আছে?
কিন্তু মা, এই গাছটাই তো কাঠবিড়ালীদের মা!
৩.
মা আর সন্তানের ভেতরের অন্তর্লোকের দৃশ্যকল্প শিশুরা ছাড়া এমন করে আর কে দেখে? সেদিন আমিও দেখলাম। আকাশজোড়া কালো মেঘের ঘনঘটায় যখন কাঠবিড়ালীরা গাছটার ভেতরে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। শহর-প্রান্তের এই বাসা। পৃথিবী-ঢাকা মেঘের ঘন আঁধার। শান্ত নিশ্চল ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে ঊর্ধ্বমুখে। হঠাৎ বদলে যাওয়া এই আঁধারি দৃশ্যপটের সামনে বিস্ময়াভিভূত এক শিশু যেন দাঁড়িয়ে আছে অনন্তকাল। হয়তো ‘মা’রূপী গাছের কোলে ‘সন্তান’রূপী কাঠবিড়ালীরা কীভাবে আশ্রয় নিয়েছে তাই-ই খুঁজছে শান্ত। মাকে হারানোর আগে মায়ের স্নেহের উষ্ণ মমতার আবেগাপ্লুত ধরন ছোট্ট শান্তকে এই বয়সেই কবি বানিয়ে দিয়েছে। মহাকাল নামক সময়ের কাছে তার স্বল্পকাল অতিক্রম করা শিশুসত্তা ঠিক খুঁজে পাচ্ছে না শব্দের পরে শব্দ দিয়ে গঠিত অতল অনুভূতির বদলে যাওয়া ভাষাচিত্। শান্তর সত্তার ভেতরে মিশে গেল আমার নিজের অস্তিত্ব। আমিও শিশু হয়ে গেলাম। হয়ে গেলাম শান্ত। আমার নিজের মায়ের দূর থেকে ভেসে আসা শব্দগুলো ফিসফিস করে আমার কানে ধ্বনিত হতেই থাকল,
শান্ত এখনই ঝড় আর বৃষ্টি হবে। বৃষ্টিতে ভিজে যাবি বাবা। তাড়াতাড়ি ভেতরে চলে আয়। আমার নির্বাক কণ্ঠের ভেতর থেকে কে যেন প্রতিধ্বনি করে ওঠে– ‘সাঁতার শিখতে হলে মায়ের হাত ছেড়ে দিতে হয় মা।’ আর সাথে সাথে আমাদের দু’জনের আত্মা এক স্বরে গেয়ে উঠল,
মা ছেড়ে গেলে অথবা হারিয়ে গেলে বৃষ্টির ফোঁটা আর বৃষ্টি-মুখরতার আঁধার আমাদের কল্পলোকের কাছে মায়ের উষ্ণতা হয়ে যায়।
আমি স্পষ্টই দেখতে পেলাম, শান্ত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ার জন্য বিদেশের উদ্দেশে বাড়িটার মূল ফটক অতিক্রম করতে গিয়ে বারবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছে। চোখে তার বৃষ্টির ফোঁটার চেয়েও বড় বড় অশ্রুকণা। ঘন কালো মেঘলা দিনের আঁধারের রহস্যময়তার চেয়েও হৃদয় তার বর্ষাকাতর শীতে জবুথবু। ভেজা কাঠবিড়ালীর মতো তার দু’চোখের ভেতরে লুকানো ‘বিস্ময়’ ঢেকে গেছে অজানা হতাশার ভীতিতে।
আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোকের ধাক্কায় আমার কল্পনায় দেখা দৃশ্যকল্পগুলো কেঁপে গেল। কাঁপতে কাঁপতে স্থির হয়ে থেমে গেল। আমি আমার সামনে শান্তর পরিবর্তে রূঢ় চেহারার একজন মানুষকে বলতে শুনলাম,
দরজা ছেড়ে দাঁড়িয়ে আপনি আকাশ-পাতাল ভাবতে থাকুন। ভালো কথা, আপনি কি মিসেস শ্রাবন্তীর কিশোরী বয়সের ছ্যাকা খাওয়া প্রেমিক? উনার তো আবার প্রেমিকের অভাব নেই। আর হ্যাঁ, দিন তো, সায়েমের চিঠিটা আমাকে দিন।
আমার কল্পনার শান্ত আসলে সায়েম... আমি অস্থির কণ্ঠে বললাম, না, না! ঠিক আছে– আমি দেখছি... বলে পালিয়ে এসেছি। আসার সময় সায়েমের ঠিকানাটা নিতে ভুলিনি। রক্ত-মাংস আর মানুষের লালসার লেলিহান ঘাম-গন্ধে কেমন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে এই সমাজ। আমার এলোমেলো ভাবনারা ডালপালা মেলছিল। ছক-বাঁধা জীবন, অভিনয়, মেকি হাসির আড়ালে মানুষ শুধু মানুষের মাংসের গন্ধ খুঁজে বেড়ায় এখানে। তালাকের উৎসবে শিশুরা কালীপূজার বলি।
৪.
পয়সার অভাব ভাগ্যিস প্রকট আমার। না হলে এসব ফরমালিন মাখা দেশভর্তি আপেল-আম খেয়ে কবে জীবিত লাশ হয়ে যেতাম! বিয়ে-তালাক, লিভ টুগেদার, সেপারেশন এই শব্দগুলোর কোনোটার জন্যই প্রস্তুতির সামর্থ্য অথবা যোগ্যতা নেই আমার। ঘৃণা এবং ভালোবাসা এই শব্দগুলো একে অন্যের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত বলে ভালোবাসা অথবা ঘৃণা জানানোর সাহসটুকুও নেই। থাকলে হয়তো হয়ে যেতাম আস্ত মমি। কপি করা মানুষের হুবহু লাশের মমিতে অনেক রাসায়নিক যৌগ থাকলেও আত্মা থাকে কি? প্রাপ্তি আমার এই– এই ভয়াবহ সামাজিকতায় আমার জীবন অথবা আত্মা কোনোটাই সংশ্লিষ্ট নয়।
বারবার মন বলল, আমার নিজের শিশুসত্তা আমাকে ছেড়ে কোন সুদূরে এক ছাত্রাবাসের জানালায় উদাসীন দৃষ্টি মেলে বসে আছে আমারই প্রত্যাশায়। চাকুরি পাওয়ার মতো সামান্য পথ অতিক্রম করাও আমার জন্য দুঃসাধ্য। অথচ সুদূর চেন্নাই গিয়ে হাজির হলাম। আমার ভেতরে বাস করা এক শান্তরূপী সায়েমের নাম-ঠিকানা বলতেই বিস্মিত চোখে এক শিক্ষক আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
ওহ! আপনি কি তার বাবা? তার ওমন প্রশ্নে মনে মনে আওড়ালাম, ‘কী আশ্চর্য? বোকা লোক! বেকার মানুষ বাবা হয় কীভাবে?’ আমাকে উত্তর দেবার সুযোগ না দিয়ে তিনি বললেন,
আসুন; আমার সাথে আসুন।
তিনি আমাকে স্কুলপ্রধানের অফিস পর্যন্ত নিলেন। প্রধান শিক্ষক ইংলিশ মিডিয়ামে যিনি একজন প্রিন্সিপাল আর কি; তড়িঘড়ি আমার দিকে মনোযোগ দিলেন,
এই না হলে বাবার মন! আপনার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। আমরা দুঃখিত। কিন্তু আপনারা কেমন মানুষ বলুন তো? বাচ্চাকে সেই যে হোস্টেলে রেখে গেলেন আর খবর নেই! বাচ্চা মানুষ, এতদূর এসে কীভাবে তার মন টেকে? একটা মুঠোফোন নাম্বার দিয়ে রেখেছেন, সেটা বন্ধ রাখেন। মেইল অ্যাড্রেসও নেই। খুব বদনাম হয়ে গেল। হার্টের সমস্যা নিয়ে বাচ্চাকে দেশের বাইরে পাঠানো কি উচিত? আপনি কেমন বাবা মশায়? বাবার দায়দায়িত্ব জ্ঞান এমন হতাশাজনক হলে বাচ্চাদের শুধু পড়াশোনা শিখিয়ে আমরা কি চাঁদের দেশে নিয়ে যাব?
তার অনবরত ভর্ৎসনায় কাতর আমি আমতা আমতা করে বললাম,
না মা...নে..., জি...
যাহোক পেপারসগুলো রেডি করেছি। আজকেই পোস্ট করার কথা। ওগুলো আপনাকে হ্যান্ডওভার করছি। আমার মুখ ফসকে হঠাৎ বেরিয়ে গেল,
ইয়ে; আমার ছেলে...মানে ... কোনো সমস্যা?
সব সমস্যার ওপারে সে। আরে মশায়, কেমন বেকায়দা বলুন? পত্রিকায় প্রতিবেদন এসেছে যে, এই স্কুল আরশোলায় ভরা। আরশোলার ভয় পেয়েই সায়েম... কী যে ঝামেলায় পড়েছি ...
আরশোলা?
হ্যাঁ! আচ্ছা ও কি বাসায় আরশোলা নিয়ে কিছু বলত? আমি এতক্ষণে কখন শিশুটার বাবা হয়ে গেছি। বললাম,
হ্যাঁ, তেলাপোকা সে ভয়ই পেত।
অবাক হয়ে যাই, বাচ্চাটা শুধু বলে, আমার বুকের ভেতর আরশোলা ঢুকেছে। আর শুধু ওর মাকে ডাকত। যেন ওর মা এলেই আরশোলাটা ভয়ে ওর বুক থেকে বের হয়ে যাবে।
এখন...? কোথায় আমার সায়েম?
দেখুন মিস্টার, আপনার ছেলেকে বাঁচানোর চেষ্টায় কোনো ত্রুটি করিনি। তেলাপোকার ভয় দূর করার বুদ্ধি না পেয়ে ওকে আমরা ডাক্তারের কাছে নিয়েছিলাম। ডাক্তার হার্ট টেস্ট করে বলল, ওর জরুরি বাইপাস সার্জারি করতে হবে।
প্রাণফাটা কান্না বেরিয়ে এল আমার ভেতর থেকে। বললাম,
কী বলছেন আপনি?
আমরা আপনাকে শুধু ‘সরি’ বলতে পারি। অপারেশন থিয়েটারে নেওয়ার আগে বন্ড সইটা আমিই দিয়েছি। আপনি ব্যাপারটা মেনে না নিলে বিপদে পড়ে যাব। স্কুলের খুব বদনাম হয়ে গেল! সবাই পত্রিকার রিপোর্ট পড়ে অযথাই ভাবছে, স্কুলটায় আরশোলা-ভর্তি। যেসব বাচ্চা আরশোলা ভয় পায়, তাদের বাবা-মা বাচ্চাগুলোর টিসি নিয়ে নিচ্ছেন।
আমার ছেলে... মানে আমার সায়েম? হাসপাতালে?
এত ছোট বাচ্চা বাইপাস সার্জারি সইতে পারে? জানেন একজন শিক্ষিকা আপনার ছেলের অসাধারণ কিছু গুণের কথা বলত। হুল্লোড়ে মাতত না সে। পড়াগুলো ট্র্যাকে রাখত না। অথচ অবাক ব্যাপার, সে পরীক্ষায় অসাধারণ ফলাফল করত। প্রথম হতো। আর রেজাল্ট হয়ে গেলেই ওর বুকের আরশোলার অত্যাচার বেড়ে যেত।
আমার চোখের সামনে সায়েমের মুখ ভাসতেই থাকল। কে যেন আমাকে হঠাৎ প্রশ্ন করল, ‘সাঁতার শেখার আাগে মায়ের হাত ছেড়ে দিলে অনেক সময় সন্তান ডুবে যায়, মায়েরা তা কি জানে?’
মাস্টার সাহেব; আমার ছেলে?
ওর ধারণা পরীক্ষা শেষ হলেই ওর মা আর আপনি আসবেন। ভালো ফলাফল হলে তবেই বাড়ি ফেরা হবে ওর। ছোট বাচ্চা অথচ কী অদ্ভুত শান্ত! বড় হয়ে ও অসাধারণ এক কবি হতো...
কেন?
অসংখ্য কবিতা দিয়ে খাতা ভর্তি করে রেখেছে। এই যে দেখুন ওর লেখার খাতা।
‘এক বছর শেষ। আমি প্রথম হয়েছি। এবার বাড়ি ফিরব আমি। তাই না মা? তুমি আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেবে গল্প বলে বলে? আমাদের বাসার পাশে বড় আম গাছটায় কাঠবিড়ালী কি এখনও ঘুরে বেড়ায়? এবার বাসায় এলে খরগোশটা কিন্তু আমাকে দেবে। কিন্তু মা; বাসায় যেন কোনো তেলাপোকা না থাকে। দ্যাখো না আরশোলাটা আমার বুকের ভেতরে ঢুকে কেমন ভয় দেখায়। আমার দম আটকে আসে মা!’
চলুন– হিমঘরে ওর লাশটা আছে...
আমি চেয়ারের হাতল শক্ত করে ধরে দাঁড়ালাম। ‘চলুন– হিমঘরে ওর লাশটা আছে’– হাজার প্রান্ত হতে বাক্যটা ধ্বনি-প্রতিধ্বনি হয়ে আমার সমগ্র অস্তিত্বে ছড়িয়ে পড়ে স্নায়ুতন্ত্রের সব স্নায়ুকে অবশ করেই চলল। অনুভূতিহীন শরীরটা মন্ত্রমুগ্ধের মতো সারাদিনের সব আনুষ্ঠানিকতা কীভাবে যেন সহ্য করল। যদিও সারাটিক্ষণ আমার বুকের ভেতর এক আরশোলা তার চঞ্চু-নল দিয়ে ঠুকরে চলছে আমার অলিন্দের সব অলিগলি, আমার ক্লান্ত রক্তস্রোত হিমঘর পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে এক বিষণ্ন আত্মার জগতে। জীবনে চাকুরি হলো না, বিয়ে হলো না, স্বপ্নগুলো রক্ত-মাংসের রূপ পেল না– তার আগেই স্বপ্নকাতর আমার রক্তস্রোত থেমে যাচ্ছে মানুষের সভ্যতা নামের পুঁজগন্ধভরা এক পঙ্কিল জগতের সামনে।
মৃত সন্তানের বাবা হয়েছি আজ– বেকার জীবনে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী আছে!
মন্তব্য করুন