![কাজী নজরুল ইসলাম [২৫ মে ১৮৯৯–২৯ আগস্ট ১৯৭৬]](https://samakal.com/uploads/2023/05/online/photos/Untitled-38-samakal-646660c3cb5fa.jpg)
কাজী নজরুল ইসলাম [২৫ মে ১৮৯৯–২৯ আগস্ট ১৯৭৬]
কোনো কবি আপন দেশকে ভালোবেসে যতখানি আপনার করে নেন, দেশও তাঁকে ঠিক ততখানি আপনার করে নেয়– তাতেই ধরা পড়ে কবির কবিত্ব কত।
–ওয়াল্ট হুইটম্যান (১৯৭৫: ৭৬২)
কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ‘জাতীয় কবি’ বলা হয়। এই বলায় নজরুল ইসলামের ইজ্জত কতখানি বাড়ে কওয়া মুশকিল। তবে আমাদের রাষ্ট্রের তাঁব যে তাতে বেশ ছড়িয়ে পড়ে তাতে সংশয় নাই। তবুও বলা যায় এ ছবি বাইরের। ভিতরের কথা এক, বাইরের কথা আর।
বাংলা ভাষায় নজরুল ইসলামের আত্মপ্রকাশকে মহান মুজফ্ফর আহমদ ‘অভ্যুদয়’ বলে বর্ণনা করেন। এ বর্ণনা যথার্থ। আশি বছর আগের সেই অভ্যুদয় থেকে কাজী নজরুল ইসলামের নাম বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নেমেছে। সে নাম উঠে যায় নাই আজও। তবে বাংলা ভাষার ইতিহাসে তাঁর নাম ঠিক কি কারণে আমরা মনে রাখতে বাধ্য সেই মীমাংসা এখনো হয় নাই। নজরুল ইসলামকে আমরা ঠিক কোন কামরায় রাখব তা ঠিক করাও সম্ভব হয় নাই। এই নিবন্ধে কিছু পরিমাণে এই প্রশ্নের কারণ ও ফলাফল নির্দেশের আশাই প্রকাশ করেছি।
১.
আমাদের রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র-সমাজে যেমন, সাহিত্য আর ভাষা সমাজেও তেমনি অভিজাততন্ত্র ও গণতন্ত্রের লড়াই থেমে নাই। স্থূল বিচারে কবির জন্ম যে বর্ণ বা শ্রেণিতে তা ছাড়িয়ে ওঠা সম্ভব নয়। কবির ধর্মে তারই ফসল ফলে। সূক্ষ্ম বিচারে ধর্মান্তর সম্ভব। জাতি কথার আদি অর্থ বর্ণ। সে অর্থ বাদ দিয়ে যদি একালের অর্থেই গ্রহণ করি তো বলা যায় কবির মন বর্ণ বা শ্রেণি পার হয়ে জাতির আওতায় গড়া হয়। প্রসিদ্ধ দার্শনিক হুমায়ূন কবির–উদাহরণের খাতিরে দেখাচ্ছি– বাংলাদেশে বৈষ্ণব কবিতার বিকাশের ভিত্তি পেয়েছিলেন সুবর্ণবণিক জাতির শক্তি ও গতিতে। অথচ তিনিই দেখিয়েছেন এই আন্দোলনের দুই সেরা কবির একজনও– বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস– সুবর্ণবণিক নন, ব্রাহ্মণ। (কবির ১৯৯২: ভূমিকা) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথাও হুমায়ূন কবির একই কারণে তুলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নিজে অভিজাত। ‘কিন্তু অভিজাত হয়েও’– কবিরের কথায়–
তাঁর বন্ধুবান্ধব ও মনোবৃত্তি নবজাগ্রত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়কে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল। এ নতুন মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মানসে ভারতের চেয়ে ইউরোপের প্রতিবিম্বই ছিল সেদিন প্রবলতর। তাই সে সম্প্রদায়ের বহু মনীষীই ভারতের হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত সংস্কৃতি সাধনাকে হয় অস্বীকার অথবা বিকৃত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের বেলায় তা হয়নি। (কবির ১৯৯২: ৪৫)
কবিরের কথা তথ্যসমর্থিত কিনা বিচার করে দেখা যায়। আমাদের আলোচনার জন্য সে বিচার জরুরি নয়। রবীন্দ্রনাথ বা অন্য যে কারও বেলায়ই এমনটি না হওয়া অন্তত সম্ভব– এ কথা আমরা মেনে নিতে পারি।
আমাদের সমাজেও অভিজাততন্ত্র ও গণতন্ত্রের একটা লড়াই–একটু আগেই বলেছি– জারি আছে। লড়াইয়ের নকশাচিত্র বলে নজরুল ইসলাম জনসাধারণের কবি, অভিজাত শ্রেণির সাহিত্যে তাঁর পঙ্ক্তি নাই। মুশকিলের ব্যাপার একটা আছে এই স্থলে। অভিজাত ও অমার্জিত শ্রেণির লড়াইটা সবসময় স্বনামে চলে না। আমাদের দেশের ইতিহাসের বিশেষ সংস্থান অনুসারে শ্রেণির লড়াই আজ পর্যন্ত প্রধানত ধর্মের লড়াই হিশাবেই ব্যক্ত হয়েছে। গত একশ বছরে ‘ধর্ম’ শব্দটির জায়গায় ধীরে ধীরে ‘সংস্কৃতি’ কথাটি চালু হয়েছে। (বিদ্যাভূষণ ১৯৮২: ১-৬) এখন আমরা বলি সংস্কৃতির সংঘাত।
এর পরিণতি দাঁড়ায় বাঙ্গালি সংস্কৃতি থেকে বাঙ্গালির বৃহত্তর অংশকে বহিষ্কার করা। এর ফলে বাঙ্গালি সংস্কৃতি বলতে যা বোঝায় তা ‘কলকাতার উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবোধের চর্চা’ হয়ে দাঁড়ায়। (মজহার ২০০১)
নজরুল ইসলামকে নিয়ে বিপদ এইখানে যে তিনি উচ্চবর্ণের হিন্দুয়ানি সংস্কৃতির দ্বারা– পাকিস্তানি যুগের কবি গোলাম মোস্তফার নালিশ সত্ত্বেও বলছি– পুরাপুরি বিজিত হন নাই। ফলে তাঁকে বাঙ্গালি বলা যায় কিনা সেই প্রশ্ন কেউ তুললে আজ অবাক হবার কিছু থাকবে না।
হিন্দু-মুসলমানের প্রশ্ন একদিন আমাদের জমিদারির প্রশ্ন ছিল। আজ সে প্রশ্ন– রবীন্দ্রনাথের তৈরি একটি শব্দ ব্যবহার করে বলা যায়– আসমানদারি মাত্র। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের যুগে হিন্দু অর্থে বাঙ্গালি শব্দ চালু ছিল। মুসলমান অর্থে বাংলাদেশি চালু হয় হয়। ফলে এককালের হিন্দু-মুসলমান লড়াই এখন বাঙ্গালি-বাংলাদেশি লড়াইয়ের আকার ধারণ করেছে।
সত্য হচ্ছে এই দুই লড়াই অন্য যুদ্ধের নামান্তর বা লক্ষণা মাত্র। সেই কথা সবসময় লুকানেরও প্রয়োজন হয় না। অভিজাত শ্রেণির সন্তান বা কর্মচারীরা প্রায়ই বলেন, নজরুল ইসলামের লেখায় কেবল আবেগ আর আবেগ– যুক্তির লেশমাত্র নাই। এই ধরনের বক্তব্য ভাবের ঘরে শ্রেণিসংগ্রাম তৈরিতে সাহায্য করে ঠিকই। প্রকাশ্যে বললে এই লড়াই সস্তা হয়ে যায়, তাই– যাকে বলে– ‘লুকাইয়া ইহার গৌরব বাড়াই’।
২.
কাজী নজরুল ইসলাম যখন কলকাতায় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির দপ্তরে এসে ওঠেন ততদিনে এয়ুরোপে সাড়ে চার বছরের যুদ্ধ শেষ, হিন্দুস্তানে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় হয়। নবীন নজরুলের প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সঙ্গে অসহযোগ আন্দোলনের একটা সহযোগ গুণীদের চোখ এড়ায় নাই। ঘটনার দুই যুগ পরে হুমায়ূন কবির লিখেছিলেন: ‘অসহযোগ আন্দোলনের আলোড়ন বাঙলা কাব্যে বোধহয় নজরুল ইসলামের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জেগেছিল এবং সে জন্যই বর্তমান শতাব্দীর তৃতীয় দশকে তাঁর এত প্রতিষ্ঠা।’ (কবির ১৩৯৯: ৬৬)
১৯০৫-১৯১১ সনের আন্দোলন বাংলাদেশের বর্ণহিন্দু সমাজে যে সবল ও সমৃদ্ধ সাহিত্যসৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, হুমায়ূন কবির দেখেছেন, ১৯২০ দশকের আন্দোলন তেমন কোন ঘটনা ঘটায় নাই। রবীন্দ্রনাথের তখন বয়স হয়েছে। ‘অসহযোগ আন্দোলনের অব্যবহিত পরেই একদিকে তাঁর গদ্য কবিতা রচনার সাধনা, অন্যদিকে পূরবীতে যৌবন বেদনার সে উচ্ছল দিনগুলির নতুন জয়গান’– লিখেছেন রবির ভক্ত কবির। (কবির ১৩৯৯: ৬৬) তবু– আমাদের দার্শনিক জানেন– ‘রবীন্দ্রনাথ অসহযোগ আন্দোলনের কবি নন।’ তিনি আরো জানাচ্ছেন: ‘অসহযোগে আন্দোলনের যুগে ভারতবর্ষের জীবনধারায় যে বিপুল আলোড়ন জাতির প্রায় সমস্ত স্তরকেই তা স্পর্শ করেছিল। মহাত্মা গান্ধীর মন্ত্রবলে কুম্ভকর্ণের নিদ্রাভঙ্গ যেন আসন্ন হয়ে উঠল, দিকে দিকে তার চাঞ্চল্য নির্জীবকেও চঞ্চল করে তুলল।’ করল না শুদ্ধ মধ্যবিত্ত বর্ণহিন্দু বাঙালিদের। ফলে বাংলার সাহিত্য এই জাগরণের যুগেও একপ্রকার ঘুমেই পড়ে রইল। এর কারণ কি হতে পারে?
হুমায়ূন কবির নিজের মাপে একটা জবাব তৈরি করেছেন। উনিশ শতকের পরাধীন সভ্যতার কল্যাণে বাংলাদেশে একটি হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছিল। ১৯০৫ সনের আন্দোলন সেই শ্রেণিরই স্বার্থ– হুমায়ূন কবিরের পদানুসারে ‘স্বাধীন স্বজাতিক রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার আলোড়ন। তার প্রাণশক্তি একমুখী ছিল, সাহিত্যও বেশ তৈরি হয়েছে সেই পর্যন্ত। অন্য পক্ষে ১৯২০ সনের পরের আন্দোলনে অমার্জিত শ্রেণির মাথাও চাড়া দিতে দেখা গেল। ‘গান্ধীজীর আবেদন ছিল,’ কবির লিখেছেন, ‘দেশের বিপুল জনসাধারণের লুপ্ত সত্তার পুনরুজ্জীবন, কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন মধ্যবিত্ত শ্রেণী-মানসের স্বধর্মচ্যুতি।’ ‘সাম্প্রতিক ব্যবস্থার সংরক্ষণেই যাদের স্বার্থ, তারা চিরদিনই পরিবর্তন বিরোধী। সজ্ঞান বুদ্ধিতে পরিবর্তনকে প্রয়োজনীয় বলে গ্রহণ করলে আবেগ ও ইচ্ছার ক্ষেত্রে পরিবর্তন-স্পৃহাকে সক্রিয় করে তোলা সহজ নয়।’ (কবির ১৩৯৯: ৬৬)
সেজন্যই– কবিরের সিদ্ধান্ত– বাংলাদেশের সাহিত্যে অসহযোগ আন্দোলন এমনই নিষ্ফলা।
নজরুল ইসলাম– আগেই দেখেছি– এই নিয়মের ব্যতিক্রম। তাঁর আবির্ভাব যতই বিস্ময়কর হোক, তেমন আকস্মিক নয়। নজরুল বাংলা সাহিত্যকে সবসময়ই বাংলার হিন্দু-মুসলমান উভয় জাতির মিলিত সাহিত্য ধরে নিয়েছেন। এই ধরে নেওয়াটি আকস্মিক নয়। নজরুলের কলকাতায় ফেরার আগের বছর এক বক্তৃতায় খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লাও অভিমত প্রকাশ করেন, ‘বঙ্গ-ভাষা বলিলে একটি অবিচ্ছিন্ন ভাষা বুঝিতে হইবে।’
কেহ কেহ বলেন যে, হিন্দু ও মুসলমানদিগের জন্য স্বতন্ত্র বঙ্গ-ভাষা– আবার কেহ কেহ বলেন পশ্চিম ও পূর্ববঙ্গের জন্যও স্বতন্ত্র ভাষা হওয়া আবশ্যক। বঙ্গের ব্যবচ্ছেদ হইয়াছে বটে, কিন্তু বঙ্গভাষার ব্যবচ্ছেদ হয় নাই। জাতি ও বর্ণভেদ অনুসারে ভাষার ভেদ হওয়া অযৌক্তিক। (আহছানউল্লা ১৯৮৩: ১৯-২০)
বাঙ্গালি মুসলমানের মাতৃভাষা বাংলা– এই মতবাদ ১৯১৮ নাগাদ সকলে আমল করেছেন। আমল করেছেন ‘বঙ্গীয় মুসলমান সমাজের উন্নতি সাধন করিতে হইলে বঙ্গ-ভাষায় সাহিত্য রচনা করা আবশ্যক।’ সাহিত্য ক্ষেত্রে বঙ্গীয় মুসলমান সমাজের এই অবনতির যুগে উন্নতির বাসনা তৈরি হয়েছিল। কাজী নজরুল ইসলামের নামই সেই বাসনার উত্তর। সেই বাসনা বাংলা ভাষায় একটি ভাব বিপ্লবেরও সূচনা ঘটায়। বাঙ্গালি মুসলমানের বাসনা, অভিজ্ঞতা ও কল্পনার সাথে বাংলা ভাষার নবযোগ ঘটালেন নজরুল।
বাংলাদেশের হিন্দু ও মুসলমান এক ভাষায় কথা বলার মতন এক পাতে খেতেও পারবে এমন ভাবনা ভাবার সাহসও নজরুল ইসলাম তৈরি করলেন। সবশেষে সমাজের সকল নিপীড়িত মানুষের পক্ষে দাঁড়ালেন নজরুল। নজরুল ইসলাম নামের অর্থই দাঁড়াল এই তিন ঘটনা। আহমদ ছফা লিখেছেন:
তাঁর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই বাংলা কবিতার ভারকেন্দ্রের পালাবদল ঘটে– কবিতা গজদন্ত মিনার ছেড়ে রাজপথে নেমে এলো এবং সামাজিক শক্তির অংশ হিসেবে স্বরূপ প্রকাশ করলো। সমাজের নির্যাতিত মানুষেরা কবিতায় স্বীকৃতি পেলো, কাজী নজরুলের কবিতা তাঁদের ভাগ্যলিপি হয়ে দেখা দিলো। (ছফা ১৩৯৯: ৭২)
৩.
প্রতিভা সকল ক্ষেত্রেই অলৌকিক, সুতরাং তার বিশ্লেষণের চেষ্টা বৃথা– অন্তত নজরুল ইসলামের ইতিহাসে এ সিদ্ধান্ত বুদ্ধির সদ্ব্যবহার বলে মনে হয় না। বাংলা কবিতার সবচেয়ে বুদ্ধিমান আলোচকদের মধ্যে অগ্রগণ্য হুমায়ূন কবিরও সেই সদ্ব্যবহার করার সুযোগ পুরাপুরি গ্রহণ করেন নাই। নজরুল ইসলামের অভ্যুদয় পর্যন্ত বাংলা কবিতার ইতিহাস বিচার তিনি করলেন প্রধানত হিন্দু মধ্যবিত্ত ও মুসলমান মধ্যবিত্ত– এই দুই শ্রেণির ইতিহাস মোতাবেক। কবিরের মতে, অসহযোগ আন্দোলনের সূত্রপাত নাগাদ বাংলাদেশের হিন্দু মধ্যবিত্তের বিকাশ সম্ভাবনা শেষ হয়ে আসে। বাংলাদেশের হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণির সাহিত্য সাধনার দ্রুত অভ্যুদয়, বিস্ময়কর পরিণতি এবং অকালমৃত্যুর কারণ হুমায়ূন কবির খুঁজে পেয়েছেন সমাজ গড়নের ভিতর।
উনিশ শতকের বাংলা কবিতা ও সাহিত্য ইংরেজিনবিশ নব্যশিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাতে গড়ে উঠেছিল। এই বিশেষ শ্রেণির বিকাশ দেশের নির্বিশেষ ইতিহাসের সাথে যুক্ত ছিল না বলেই তার শেষ পরিণতি হয়ে ওঠে বিশেষ শোকাবহ। কবির লিখেছেন:
বাঙলার হিন্দু সমাজের দুর্ভাগ্য যে শিক্ষিত ও অশিক্ষিতের ব্যবধান বহুক্ষেত্রে জাতি-উপজাতীয় পার্থক্যের ফলে আরো প্রবল হয়ে দেখা দিল। মোটামুটিভাবে বাঙলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হিন্দু, বর্ণহিন্দু এবং অশিক্ষিত জনসাধারণ অবর্ণ ও অনুন্নত। শিক্ষাদীক্ষায় মানস আদর্শের যে পার্থক্য বেড়ে উঠছিল, জাতিভেদের কাঠামো তাকে আরো কায়েমী করে তুলল। তারই ফলে হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিস্ময়কর বিকাশ ক্ষণজীবী হয়ে পড়েছে। (কবির ১৯৯২: ৬১-৬২)
এর তুলনায় মুসলমান সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণির কোন ইতিহাসই নাই বললেও কম বলা হয়। তবু তার আবির্ভাব যে ঘটেছে– অন্তত হিন্দু মধ্যবিত্তের পরাজয়ের দিনে– সেটাই প্রশ্নের বিষয়। নজরুল ইসলামের অভ্যুদয়ের আগে বাংলাদেশের মুসলমান সমাজে মধ্যশ্রেণির সাহিত্য সামান্যই লেখা হয়েছে। হুমায়ূন কবির নির্মম ভাষায় তার সারমর্ম লিখেছেন:
হয় মোসলেম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাব্যসাধনার কোন স্বতন্ত্র ইতিহাস নাই অথবা যেখানে সে ইতিহাস স্বতন্ত্র, সেখানে স্বাতন্ত্র্যই এত প্রবল যে কাব্যসাধনার পথে তা অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবেশের প্রতিকূলতার ফলে কায়কোবাদের মতন শক্তিশালী সাহিত্যিকের উপস্থিতি সত্ত্বেও গত শতকে বাঙালি মুসলমানের কাব্যসাধনা তাই পঙ্গু ও অনুকৃতি মাত্র। (কবির ১৯৯২: ৫৯-৬০)
নজরুল ইসলামের প্রবেশ ঠিক এই দৃশ্যেই। নজরুলের আদি বন্ধুদের একজন– নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়– দৃশ্যের বর্ণনা অলৌকিক করে তুলেছিলেন। তিনি লিখেছেন:
অনেক ভালো কবির মধ্যে নজরুল শুধু একজন ভালো কবি নয়, অনেক গায়কের মধ্যে নজরুল শুধু একজন ভালো গায়ক নয়; অনেক ভালো সুরকারের মধ্যে নজরুল শুধু একজন ভালো সুরকার নয়; বাংলা কাব্য সাহিত্যে, বাংলার সঙ্গীতে, বাংলার সুর সৃজনলোকে নজরুলের নেই কোনো পিতৃপুরুষ, নেই কোনো উত্তরাধিকারী। সে দাঁড়িয়ে আছে স্বতন্ত্র, একক, একটা সম্পূর্ণ নতুন ব্যক্তিত্ব ও শক্তি। (উদ্ধৃত, ইসলাম ২০০১: ৫৭)
এই নতুন শক্তিরও একটা উৎস– পিতৃপুরুষ না হোক মাতৃপ্রকৃতি– আছে এবং আছে একটা পরিণতিও।
নজরুল ইসলাম একই সাথে দুর্বল মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির এবং প্রবল মুসলমান কৃষকজাতির প্রতিনিধির কাজ করেছেন। কৃষকের সাথে তাঁর এই আত্মীয়তাকেই অনেকে পুথিসাহিত্যের বা পুরানা ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন বলেছেন। হুমায়ূন কবিরের মতে, নজরুল ইসলাম ও জসীমউদ্দীন দুইজনেরই সৃজনী প্রতিভা যে অল্পদিনে শেষ হয়ে গেল তার কারণ তাঁরা যতটা কৃষক ততটা মধ্যবিত্ত হয়ে উঠতে পারেন নাই।
হুমায়ূন কবির নিজে মধ্যবিত্ত মানুষ। তাই তিনি যা ইঙ্গিতে বললেন আমি তার অর্থ সংগ্রহ করলাম এইভাবে– খোদ ঘোড়ার মুখে তা আরো ভাল শোনায়– ‘ভাষা ও ভঙ্গিতে নজরুল ইসলামের কাব্যে যে বিপ্লবধর্ম, পুরাতন ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবনের মধ্যেই তার পরিচয় মেলে।’ (কবির ১৯৯২: ৬৭) আহমদ ছফা এই কহতব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন নাই। নজরুল যা করেছেন তাকে তিনি পুনরুজ্জীবন বলতে নারাজ। ছফার বক্তব্য শোনার মতন:
‘নজরুল সাহিত্যে বাংলা কাব্যভাষার যেমন সৃষ্টিশীল প্রকাশ ঘটেছে, তেমনি এই পুথিসাহিত্যের ভাষাটিও সৃষ্টিশীল নির্বাচনের মাধ্যমে বিশিষ্টতা অর্জনের পর সাহিত্যে স্থান করে নিয়েছে। নজরুল পুথিসাহিত্যের প্রাণের আগুনটুকু গ্রহণ করেছেন। তার জীর্ণ কংকাল বহন করেননি। তাই নজরুল সাহিত্যে পুথিসাহিত্যের জীবাশ্ম দৃষ্টিগোচর হলেও সেই ভাষা-কাঠামো খুঁজে পাওয়া যাবে না। পুথিলেখকেরা বাঙালি মুসলমানের স্বাতন্ত্র্যচেতনা উজ্জ্বল করে দেখানোর উদ্দেশ্যেই এই বিশেষ ভাষারীতি তৈরি করেছিলেন। নজরুল স্বাতন্ত্র্যপ্রয়াসী এই মুসলিম সমাজটিকে বাঙালি সমাজেরই একটি অংশ হিসেবে প্রমাণ করার জন্যই ঐ ভাষা ব্যবহার করেছিলেন।’ (ছফা ১৩৯৯: ১১৪-১৫)
তো নজরুলের কোনো উত্তরাধিকারী নাই কেন? তার আগে জানা উচিত উত্তরাধিকারী কাকে বলে।
মাইকেল মধুসূদনের উত্তরাধিকারী হেমচন্দ্র বা নবীনচন্দ্র নন; বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ। একই প্রকরণে নজরুলের উত্তরাধিকারী সুভাষ মুখোপাধ্যায় কি সুকান্ত ভট্টাচার্য অথবা তালিম হোসেন কি ফররুখ আহমদ নন; শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ বা আহমদ ছফা স্বয়ং। নজরুল ইসলামের নামের পর অন্য যাঁর নামই লই মানুষ সন্দেহের চোখে দেখে। এর কারণ দুর্বোধ্য নয়। নজরুল নিজেও নিজেকে পার করতে পারেন নাই।
হুমায়ূন কবিরের ধারণা নজরুল ইসলাম ও জসীমউদ্দীন দুইজনই ‘পশ্চাদ্মুখী’। এই ‘পশ্চাদ্মুখিনতা’ আর কিছুই নয়, অ-মধ্যবিত্ত কৃষক মানসিকতার অপর নাম। কবির ১৯৪০ দশকেই লিখেছেন:
(নজরুল ইসলাম ও জসীমউদ্দীন) উভয় ক্ষেত্রেই পশ্চাদমুখী বলে সে শক্তি কল্পনা ও আবেগের নূতন নূতন রাজ্য জয়ে অগ্রসর হতে পারেনি। মানস সংগঠনে রূপান্তর হয়নি বলে দু’জনের বেলায়ই সৃজনী-প্রতিভা অল্পদিনেই নিঃশেষ হয়ে এল। আজ আত্মকেন্দ্রিক পুনরাবৃত্তির মধ্যেই তাঁদের সাধনা নিবদ্ধ। কালক্রমে মুসলমান মধ্যবিত্ত-শ্রেণীর সম্প্রসারণের সম্ভাবনা অত্যন্ত সংকীর্ণ এবং সেই জন্য বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতির মধ্যে মুসলমান সমাজে মহৎ কবির আবির্ভাবের সম্ভাবনাও অত্যন্ত অল্প। (কবির ১৯৯২: ৬৭)
৪.
বড় সাহিত্য মানেই বড় প্রাণের নিঃশ্বাস– আঠারো শতকের শেষে নবীন জার্মান কবি গ্যোটেকে এই বাক্য শেখান তদীয় গুরু দার্শনিক হার্ডার। বড় প্রাণ মানে জাতি গোষ্ঠী সম্প্রদায় ইতি আদি। হার্ডার বলেছিলেন জাতীয় ভাবনা ছাড়া বড় সাহিত্য হয় না। মহান ধর্মগ্রন্থ ও কাব্যগ্রন্থ সবই এই জাতীয় সাহিত্য। এসব গ্রন্থ এজন্য একজন মানুষের রচনা হবে– এমন কথা নাই। বাইবেল মাত্র একটি বই নয়, একটি লাইব্রেরি। হোমারের পরিচয় নিয়ে যে বাদানুবাদ তার কারণও এখানেই। মহাভারতের কথা মহা ব্যাপার।
তারপরও আমরা আর একটা কথা বলব বলে ব্যাকুল থাকি। নজরুল ইসলামের পূর্বসূরি ওয়াল্ট হুইটম্যানও জীবনের শেষ পাদে এসে বলেছিলেন: ‘আমাদের প্রবলতম আর সবচেয়ে বেশি প্রাণমাতানো গানগুলি আজও গাওয়া হয় নাই।’ (হুইটম্যান ১৯৭৫: ৫৮৪) নজরুলের বেলায়ও আমি একই কথা বলব। নজরুলের আপন গান গাওয়ার হিম্মত ছিল। তাই তিনি বাঙ্গালি মুসলমানের গান গেয়েছেন এবং সেজন্যই তিনি বাংলা ভাষার জাতীয় কবি হয়েছেন। তবুও তিনিই প্রথম কবুল করেছেন: বাংলার মানস গড়নের রূপান্তর দরকার সবার আগে।
নজরুল ইসলামের প্রথম আবির্ভাবে হিন্দু-মুসলমান দুই জাতির লোকই তাঁর সমঝদার ছিলেন। ধীরে ধীরে তিনি সাম্প্রদায়িক বিচারের মুখামুখি হন। সাম্প্রদায়িক বলে নিন্দিত হবার ভয়ে নজরুল বাংলাদেশের অনগ্রসর মুসলমান সমাজের পক্ষ নিতে ভয় পান নাই। মুসলমান সমাজের নতুনতর অংশও তাঁকে গ্রহণ করতে দেরি করে নাই। ১৯৩২ সনের সিরাজগঞ্জ বক্তৃতায় নজরুল এই সমঝদারিরই এক নাটকীয় বিবরণ দেন:
আমি তখন প্রথম কাব্য-কাননে ভয়ে ভয়ে পা টিপিয়া টিপিয়া প্রবেশ করিয়াছি– ফিঙে বায়স বাজপাখির ভয়ে ভীরু পাখির মত কণ্ঠ ছাড়িয়া গাহিবারও দুঃসাহস সঞ্চয় করিতে পারি নাই। নখচঞ্চুর আঘাতও যে না খাইয়াছি এমন নয়– এমনি ভীতির দুর্দিনে মানি-অর্ডারে আমার নামে দশটি টাকা আসিয়া হাজির। কুপনে শিরাজী সাহেবের হাতে লেখা: ‘তোমার লেখা পড়িয়া খুশি হইয়া দশটি টাকা পাঠাইলাম। ফিরাইয়া দিও না, ব্যথা পাইব। আমার থাকিলে দশ হাজার টাকা পাঠাইতাম।’ চোখের জলে স্নেহসুধাসিক্ত ঐ কয় পংক্তি লেখা বারে বারে পড়িলাম, টাকা দশটি লইয়া মাথায় ঠেকাইলাম। তখনো আমি তাঁহাকে দেখি নাই। (ইসলাম ১৯৯৩: ৯৩)
এই সমঝদারি বেশি দিন টেকে নাই। নজরুলের বিমূঢ় সমালোচনা নানা প্রকারের। বিদগ্ধ সমালোচনাও বহু প্রকারের। হিন্দু ও ব্রাহ্ম বিমূঢ়রা অভিযোগ করলেন নজরুল আরবি-ফার্সি শব্দ লেখে। এই বিমূঢ়দের শেষ প্রতিনিধি– সম্ভবত– নীরদচন্দ্র চৌধুরী। ১৯৮৭ সনে প্রকাশিত আত্মজীবনীর দোসরা খণ্ডেও ইনি সেই ঘৃণার কথাই অকপটে লিখেছেন:
১৯২২ সাল। মোস্তফা কামালের বিজয় উপলক্ষে একদল মুসলমান শোভাযাত্রা সহযোগে নজরুলের একটি কবিতা আওড়াইতে আওড়াইতে যাইতেছিল। আমি আমার ৪১ মির্জাপুর স্ট্রিটের বাসার জানালা হইতে দেখিতেছিলাম। দেখিয়া কি যে ঘৃণা অনুভব করিয়াছিলাম তাহার বিবরণ দেওয়া সম্ভব নহে। গানটি লম্বা, কথার ফুলঝুরি। শুনিলে স্বয়ং কামালও উহা পায়ের তলায় পিষিতেন। ইহার ধুয়াটা এই রকম: হুররা হো, হুররা হো, তু নে কামাল কিয়া, ভাই! ... ইহা বাংলা নহে, উর্দু ...। (চৌধুরী ১৯৮৭: ১৪৮)
প্রবন্ধের আয়তন-সীমার বাইরে না যাওয়ার চেষ্টা করছি। তাই অপর বিমূঢ়তার এক চতুর প্রতিনিধির কথা উদ্ধার করেই এ প্রসঙ্গে ক্ষান্ত দিতে চাই। গোলাম মোস্তফার মতে, নজরুল ইসলাম ‘হিন্দু কালচারের দ্বারা সম্পূর্ণ বিজিত হইয়াছিলেন।’ প্রমাণ? গোলাম মোস্তফা লেখেন: ‘ইকবাল নূতন মক্কার স্বপ্নে (Vision of a New Mecca) বিভোর ছিলেন, সমগ্র মুসলিম জগতের মুক্তি ও কল্যাণ যেমন তাঁর কাব্যের বিষয়বস্তু ছিল, নজরুলের ধ্যানে সেরূপ কোন সুচিন্তিত পরিকল্পনা ছিল না।’ (উদ্ধৃত, হক ২০০০: ৯৩)
গোলাম মোস্তফার মতে, নজরুল ছিলেন ‘আগে ভারতবাসী পরে মুসলমান।’ মোস্তফা জানিয়েছেন, মুক্তি আন্দোলন সম্পর্কে নজরুল যত কবিতা ও যত গান লিখেছেন, ‘সমস্তই ভারতীয় মার্কা।’ গোলাম মোস্তফার সব কথা মিছা এমন ভাবার কারণ নাই। তিনি সত্য কথাও বলতে জানেন: ‘পাকিস্তানের কবি হওয়া দূরের কথা, নজরুল ছিলেন ঘোর পাকিস্তান-বিরোধী।’ প্রমাণ দিয়েছেন গোলাম মোস্তফা:
পাকিস্তানের কথা বলিতে তাই তিনি লজ্জিত ও কুণ্ঠিত হইতেন। ঐ সব বিষয়ে কবিতা বা গান লিখিলে পাছে তার ‘সাম্প্রদায়িক’ রূপ প্রকট হইয়া পড়ে, এই ছিল মনের আতঙ্ক। এই জন্যই পাকিস্তান বা কায়েদে আজম সম্বন্ধে তিনি একটি কবিতা বা গানও রচনা করেন নাই। (উদ্ধৃত, হক ২০০০: ৯৩)
প্রতিভাবান গোলাম মোস্তফা দেখিয়েছেন নজরুলের গোড়াতেই গলদ। ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থে মোট ১২টি কবিতা। যথা: ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘বিদ্রোহী’, ‘রক্তাম্বরধারিণী মা’, ‘আগমনী’, ‘ধূমকেতু’, ‘কামাল পাশা’, ‘আনোয়ার’, ‘রণভেরী’, ‘শাত ইল আরব’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘কোরবানী’ ও ‘মোহররম’।’ এর ভিতরে সাতটি ইসলামি ভাবাপন্ন। বাকি পাঁচটি– ‘প্রলয়োল্লাস, ‘বিদ্রোহী’, ‘রক্তাম্বরধারিণী মা’, ‘আগমনী’ও ‘ধূমকেতু– ইসলাম ও পাকিস্তানি আদর্শের সম্পূর্ণ বিরোধী।’ (দেখুন, হক ২০০০: ৯৮)
গোলাম মোস্তফা দাবি করেছেন– সেই ১৯৫০ সনের কথা বলছি– নজরুলকে ‘পাকিস্তানের জাতীয় কবি’ বলা ঠিক হবে না। তাঁর ভাষায়: ‘নজরুলের সবচেয়ে বড় অপবাদ যদি কিছু থাকে, তবে এই।’ মোস্তফা সাহেব ‘কাফের’ উপাধি না দিলেও কসুর করেন নাই ‘বিজাতীয়’ বলতে। কারণ নজরুলের ‘সর্পপ্রীতি’ বা ‘সর্পভীতি’। কি মর্মভেদী তাঁর সমালোচনা:
সাপ, সাপুড়ে, মনসা ইত্যাদির সঙ্গে মুসলিম মনের কোন নিবিড় যোগ নাই। ‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘প্রলয় শিখা’, ‘ফণি-মনসা’ ইত্যাদি নামের মধ্যে তাই লুকাইয়া আছে একটা বিজাতীয় গন্ধ। কি কারণে জানি না নজরুল এসব নামই বেশি করিতেন। মনসাদেবীর প্রতি তিনি অত্যধিক অনুরক্ত ছিলেন। তাঁর বহু কবিতা ও গানে সাপ ও সাপুড়িয়াদের Reference [দোহাই] দেখা যায়। ‘বিষের বাঁশি’, ‘ফণি-মনসা’ এবং সাপুড়ে (নাটক) তিনখানি পুস্তকেই দেখা যায় তাঁর সর্পপ্রীতি অথবা সর্পভীতি। (উদ্ধৃত, হক ২০০০: ৯৮)
নজরুল ইসলামের বিদগ্ধ সমালোচকদের মন বিমূঢ়দের চেয়ে আলাদা বলতে পারলে শান্তি পেতাম। বিধাতা সেখানেও বিমুখ।
কাজী আবদুল ওদুদকে বিদগ্ধ সমালোচকদের দলভুক্ত করলে বড় অন্যায় হয় না। তিনি নজরুল ইসলামকে বলেন ‘চিন্তালেশহীন ভাস্বর-ললাট’ চির তরুণ। নজরুল ‘পূর্ণাঙ্গ কবিতার রচয়িতা তেমন নন, তাঁর কবি প্রতিভা বরং প্রকাশ পেয়েছে উৎকৃষ্ট চরণের রচনায়’– কাজী ওদুদের এ উক্তি বিখ্যাত হয়েছে। এই বিচারের শেষ রায়ও ওদুদই দিয়েছেন: ‘নজরুলকে এ যুগের একজন অসাধারণ কবি ভাবা কঠিন কিন্তু এ যুগের একজন অসাধারণ ব্যক্তি তিনি অবিসংবাদিতরূপে।’ (ওদুদ ১৩৯৫: ৪২৮-৩০)
কাজী আবদুল ওদুদের বিবেচনায় বাংলামুলুকের যেসকল সাহিত্যরসিক নজরুল ইসলামকে একজন ‘যুগ-প্রবর্তক কবি’ জ্ঞান করেছেন তাঁরা একটা অনুচিত কাজ করলেন। ওদুদের বিচারে নজরুলের কবিতা ‘সম্পূর্ণ নতুন’ নয়। এই ধরনের কবিতা ‘বলাকা’ যুগের রবীন্দ্রনাথই প্রথম লেখেন। নজরুলের ত্রুটি শুধু নতুনত্বের অভাবেই সীমিত নাই– পূর্ণিমারও অভাব আছে। ওদুদ লিখেছেন: ‘একটু মনোযোগী হলেই চোখে পড়ে নজরুলের রচনা, বিশেষ করে তাঁর “বিদ্রোহী” যুগের রচনা অনবদ্য নয়। শ্রেষ্ঠ কবিদের বিশেষ বিশেষ কবি-কল্পনার যে পূর্ণাঙ্গতা প্রকাশ পায় নজরুলের রচনায় সেটির অভাব মাঝে মাঝে প্রায় বেদনাদায়ক হয়েছে।’
আরো আছে অভাব। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ যুগের কবিতায়, ‘বিভিন্নভাবের একত্র সমাবেশের সঙ্গতি সুষমা অথবা যৌক্তিকতা বিষয়ে কবি বেশ উদাসীন হয়েছেন।’ (ওদুদ ১৩৯৫: ৪২৯)
সাহিত্যে উচ্চবর্ণামির উৎকৃষ্ট নজির কাজী আবদুল ওদুদের এই মন্তব্য। এই উচ্চবাচ্য দুর্ভাগ্যবশত অন্ধকারই বিতরণ করে। নজরুল কি করে একই সাথে ‘সাম্যবাদী’ আর ‘প্যান-ইস্লামী’ কবিতা লিখতে পারলেন? এই প্রশ্ন করে ওদুদ সাহেব বিমূঢ় হয়েছেন। এই বিমূঢ়তা গোলাম মোস্তফার অধিক। ওদুদ মহাশয় কখনো সংশয়ও প্রকাশ করেন নাই– এই দুই একসাথে কেন হতে পারবে না? অতয়েব সিদ্ধান্ত– এ হতে পারে না। সুতরাং নজরুল ইসলাম সাম্যবাদী হলেও ‘পুরোপুরি’ হন নাই। ওদুদ বলছেন:
তাঁর ‘বিদ্রোহী’ যুগের প্রায় সমস্ত কবিতায় এই সাম্যবাদের প্রভাব সুস্পষ্ট। কিন্তু পুরোপুরি সাম্যবাদী নজরুল কখনো হননি, হলে তার এই সাম্যবাদ প্রচারের দিনে ‘খালেদ’, ‘ওমর’, ‘জগলুল’ প্রভৃতি প্যান-ইসলামি ভাবের কবিতা লেখা তাঁর পক্ষে সম্ভবপর হতো না। (ওদুদ ১৩৯৫: ৪৩৩)
‘প্যান-ইসলামি ভাব’ কি বস্তু? আজকের দিনের কি রাতের সাংবাদিকরা এই বস্তুরই নাম রেখেছেন ‘মৌলবাদ’। এ যুগের মৌলবাদ যেমন একটা গালি এবং এয়ুরোপ ও আমেরিকার প্রবর্তিত শব্দ, সেকালের ‘প্যান-ইসলামিজম’ কথাটাও তাই। ১৮৮০ দশকে ওটা এয়ুরোপীয় সাংবাদিকরা চালু করেছিলেন। এয়ুরোপের অধীন সকল উপনিবেশ ও আধা উপনিবেশের মুসলমান জনগণের মুক্তিসংগ্রামকে হেয় করার মতলবে কথাটা চালু হয়েছিল।
কাজী আবদুল ওদুদ ‘প্যান-ইসলামি ভাবের কবিতা’র ফর্দ থেকে চতুরালি করে ‘কামাল পাশা’ কবিতাটি বাদ দিয়েছেন। না দিলে তিনিও দেখতে পেতেন নজরুল ইসলাম প্যান-ইসলামি যতটা নন, তার অধিক জাতীয় মুক্তির ব্যবসায়ী। সেই কারণেই তাঁর পক্ষে একই সঙ্গে ‘সাম্যবাদী’ আর ‘প্যান-ইসলামি’ হওয়া সম্ভব। এর একটা ইঙ্গিত খোদ আবদুল ওদুদের লেখাতেই পাই: ‘খালেদের মহিমা উদাত্ত কণ্ঠে গাইবার চেষ্টাই তিনি করেছেন, কিন্তু দেখা যাচ্ছে খালেদের বীরমূর্তি পূর্ণভাবে রূপায়িত করার চাইতে তাঁর মনে প্রবলতর তাঁর সমসাময়িক মুসলমান সমাজের জন্য বেদনা অথবা অস্থিরতা।’ (ওদুদ ১৩৯৫: ৪২৯)
কথাটা সত্য। তাতে সন্দেহ নাই।
দোহাই
১ অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ, রচনাবলী, যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য সম্পাদিত, ১ম খণ্ড (কলিকাতা, ১৯৮২)।
২ আহমদ ছফা, আহমদ ছফার প্রবন্ধ (ঢাকা, ১৩৯৯/১৯৯৩)।
৩ খান বাহাদুর, আহছানউল্লাহ, বঙ্গভাষা ও মুসলমান সাহিত্য, পুনর্মুদ্রণ (ঢাকা, ১৯৮৩)।
৪ আনোয়ারুল হক, নজরুল ও তাঁর বৈরী পক্ষ (ঢাকা, ২০০০)।
৫ কাজী আবদুল ওদুদ, রচনাবলী, আবদুল হক সম্পাদিত, ১ম খণ্ড (ঢাকা, ১৯৮৮/১৩৯৫)।
৬ কাজী নজরুল ইসলাম, নজরুল-রচনাবলী, আবদুল কাদির সম্পাদিত, ৪র্থ খণ্ড (ঢাকা, ১৯৯৩)।
৭ ফরহাদ মজহার, ‘নিরাপদে সাড়ে সাত কোটি মানুষ ভোট দেবে কি সেনা পাহারায়?’ যুগান্তর, ২৬ আগস্ট ২০০১।
৮ রফিকুল ইসলাম সম্পাদিত, শতবর্ষে নজরুল (ঢাকা, ২০০১)।
৯ হুমায়ূন কবির, বাঙলার কাব্য, পুনর্মুদ্রণ (ঢাকা, ১৯৯২)।
১০ Nirad C. Chaudhury, Thy hand, Great Anarch: India: 1921-1952 (London, 1987).
১১ Walt Whitman, The Complete Poems, ed. Francis Murphy (Harmondsworth, 1975)
মন্তব্য করুন