আমার দাদি মৃত্যুর গন্ধ পেতেন। যেদিন তিনি ঘোষণা করতেন, আজ তিনি মৃত্যুর গন্ধ পেয়েছেন সেদিন এক মুহূর্তের মধ্যেই সারা বাড়ি স্তব্ধ হয়ে যেত। চাচা-জ্যাঠা-মা-চাচি-জেঠিরা সেদিন আর কেউ বাড়ি ছেড়ে নড়তেন না। আমাদের ছোটদেরও থাকতে হতো মুরুব্বিদের ছায়ায়-ছায়ায়। বিশাল একান্নবর্তী পরিবার আমাদের। বিশ-বাইশজন মানুষ। এর সঙ্গে কাজের লোকজন, আত্মীয়স্বজন তো থাকতই প্রতি বেলায় পাঁচ-সাতজন। পরিচিত পরিমণ্ডলে একশ-দেড়শজন মানুষকে আমরা এমনিতেই চিনতাম। সুতরাং দাদির মৃত্যুর গন্ধ ঘোষণা পাওয়ার পর সারা পাড়াতেই একটা সাড়া পড়ে যেত। আমরা সারাক্ষণ আতঙ্কিত হয়ে থাকতাম– কে মরে!
দাদি সাধারণত কাছের মানুষদেরই মৃত্যুর গন্ধ পেতেন। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি তিনি ঘোষণা করার পরপর সত্যি সত্যিই কাছের কেউ মারা যায়। একদিন সন্ধ্যাবেলায় মাগরিবের নামাজ শেষ করে সালাম ফিরিয়ে নাক টেনে বললেন, মৃত্যুর গন্ধ পাইতাছি। সে-রাতেই মেজো চাচার ছ’দিন বয়সী ছেলেটা মারা গেল চাচির হাতের নিচে চাপা পড়ে। ঘুমের মধ্যে চাচি মোটা হাতটা তুলে রেখেছিলেন ছেলের নাকেমুখে। এমন মৃত্যুর কোনো সান্ত্বনা হয় না। মেজো চাচি ছয় মাসের মধ্যেই পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। দুটো মেয়ের পর তার ছেলে হয়েছিল, সেই ছেলেকে তিনি নিজের হাত চাপা দিয়ে মেরে ফেলেছেন, এর চেয়ে দুঃখ আর কী হতে পারে! অনেকে তাকে বোঝাল মৃত্যুর গন্ধ তো তার শাশুড়ি আগেই পেয়েছেন, সুতরাং কেউ না কেউ মরতই। কিন্তু তার ছেলেটাই কেন মরল, তাও তার হাতের নিচে চাপা পড়ে? চাচি দিনের পর দিন শুধু এই বিলাপ করতেন!
একদিন গোসল করতে যাবার সময় দাদি হঠাৎ করেই উঠানের মধ্যে দাঁড়িয়ে নাক টেনে বললেন, মৃত্যুর গন্ধ পাইতাছিরে। বাড়ির যে যেখানে ছিল ছুটে এলো, অসাবধানে কেউ যেন মরে না যায় এ জন্য সবাই যতটুকু পারে নিজেকে নিরাপদ রাখার চেষ্টা করল। সারাদিন পুকুরঘাটেও কেউ নামল না যদি হঠাৎ পা-পিছলে পড়ে মরে যায়। তখন তো আর মোবাইলের যুগ না, চিঠিপত্রের যুগ, ঢাকায় আব্বাকে চিঠি লেখা হলো, আব্বা যেন সাবধানে থাকেন, মা মৃত্যুর গন্ধ পেয়েছেন। আব্বা চিঠি পেয়ে বাড়ি এসে দেখেন আমাদের মাঝি হোসেন মিয়া সাপের কামড়ে মারা গেছে। দাদির ঘোষণা হোসেন মিয়া শুনেছে, তারপরও রাতে টেঁটা নিয়ে বেরিয়েছিল মাছ ধরতে। টাকিমাছ ভেবে সে এক পানোসাপের লেজে ঘাই দেয়, টেঁটায় গাঁথা অবস্থাতেই সাপ হোসেন মিয়ার হাঁটুতে ছোবল মারে। হোসেন মিয়াকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাকে আর জীবিত ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় নাই।
দাদির এ ঘোষণায় সবাই আতঙ্কিত হলেও অনেকে বলে, এটা ভালোই, আগে থেকে সাবধান হওয়া যায়। অনেকে বলে, দাদি ঘোষণা দেয় বলেই এমন অপ্রত্যাশিত মৃত্যু হয়। কিন্তু দাদি জোর গলায় বলেন, মৃত্যু হয় বলেই তিনি গন্ধ পান।
ঠিক কবে থেকে দাদি মৃত্যুর গন্ধ পান? দাদি বলেন, ছোটবেলা থেকেই। ছোটবেলায় দাদির মা একদিন দাদির মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছিলেন। দাদি হঠাৎ নাক টেনে বললেন, মা, কেমন মরা মরা গন্ধ পাইতাছি। দাদির মা বললেন, তেলের গন্ধ। তেলটা মনে হয় নষ্ট হইয়া গেছে। দাদি বললেন, না, মরার গন্ধ আমি চিনি। মা দাদির মাথায় চাটি মেরে বললেন, মরার গন্ধ তুই চিনস? তুই মরামানুষ দেখছস জীবনে? দাদি বললেন, কেন, দাদিরে আমি মরতে দেখি নাই?
দাদির দাদি তাঁকে সাথে নিয়ে ঘুমাতেন। এক সকালে দাদি ঘুম থেকে উঠে দেখেন তাঁর দাদি তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছেন। হাতটা সরাতে গিয়ে দেখেন হাতটা কেমন শক্ত হয়ে আছে আর গায়ে কী রকম এক গন্ধ। দাদি ডাকলেন, ও, দাদি, ওঠো, সকাল হইয়া গেছে। কিন্তু বৃদ্ধার কোনো রা-শব্দ নাই। অন্যদিন তিনিই আগে উঠে যান। ধাক্কা দিতেই তাঁর দাদির হাত কেমন গড়িয়ে পড়ল। শোয়া থেকে উঠে গিয়ে দাদি মাকে ডাকলেন, মা দেখো, দাদি কেমন কাঠ হইয়া আছে, নড়েচড়ে না! দাদির মা এসে দেখেন তাঁর শাশুড়ি নাই।
দাদির বয়স নাকি তখন নয়-দশ। দাদির মা যখন দাদির মাথায় তেল মেখে দিচ্ছিলেন তখন দাদির বয়স বারো-তেরো। যেদিন সকালে দাদি তার মায়ের কাছে প্রথম মৃত্যুর গন্ধ পান বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন সেদিন দুপুরেই দাদির আব্বা ক্ষেতে কাজ করতে করতে হঠাৎ ঘুরে পড়ে গেলেন। লোকজন তাকে ধরে বাড়ি আনতে আনতেই তিনি মরে গেলেন। ওই তাঁর প্রথম মৃত্যুর গন্ধ পাওয়া। দাদির ভাষ্য মতে, তিনি তাঁর মায়ের মৃত্যুর গন্ধও আগাম পেয়েছিলেন।
জ্যাঠা-জেঠিরা বলেন, দাদি তাঁর শ্বশুর-শাশুড়ির মৃত্যুর গন্ধও পেয়েছিলেন। এ পর্যন্ত কতজন আত্মীয়স্বজন, কাছের লোকের মৃত্যুর গন্ধ দাদি পেয়েছেন হিসাব করতে গিয়ে দেখি প্রায় শখানেক হবে। দাদির বয়স প্রায় নব্বই। বছরে গড়ে একজন মৃত্যুর গন্ধ তিনি পান। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজনের মধ্যে বছরে একজন মরে যাওয়া তেমন বড় ঘটনা না। এটাই স্বাভাবিক। তবে দাদির কিছু মৃত্যুর গন্ধ কিছু অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর বয়ে আনে। যেমন ছোট চাচার মৃত্যুটি। ছোট চাচা মাদ্রাসায় পড়তেন। তিনি এসব আগাম খবরকে কুসংস্কার মনে করতেন। তিনি বলতেন, কার কখন মৃত্যু হবে, এটা জানে আল্লাহপাক। আগাম এসব খবর দেওয়া ঠিক না। তিনি দাদির কথা বিশ্বাস করতেন না। তিনি বলতেন মৃত্যু আসলে তো ঘরে বসে থাকলেও মরব। এত চিন্তার কী আছে! একবার দাদি মৃত্যুর গন্ধ পেয়েছেন ঘোষণা দেওয়ার পরও ছোট চাচা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। ফিরলেন পরদিন লাশ হয়ে। এক বন্ধুর সাথে মোটরসাইকেলে করে কোথায় যাচ্ছিলেন। পেছন থেকে বাস এসে ধাক্কা দিয়েছে, মোটরসাইকেল যিনি চালাচ্ছিলেন এক হাত এক পা ভেঙে তিনি বেঁচে গেছেন, ছোট চাচা মারা গেছেন সাথে সাথেই। ছোট চাচার লাশ বাড়ি আসার পর দাদির কী বুকভাঙা কান্না, খোদা, এ কী রহস্য তুমি আমার সাথে করতেছ? বাপের মৃত্যুর গন্ধ পাইছি, মার মৃত্যুর গন্ধ পাইছি, এখন তুমি আমারে সন্তানের মৃত্যুর গন্ধ পাওয়াইতেছ! আমার কি মরণ নাই, খোদা, আমারেই তুমি নেও। আর সহ্য হয় না, খোদা।
যাদের বাড়ির মানুষ মৃত্যুর গন্ধ পান তাদের জীবন স্বাভাবিক হওয়ার কথা না। আমাদের বাড়ির সবারই বোধ হয় তাই একটু মাথা খারাপ। মেজো জ্যাঠার বড় মেয়ে দুলি আপা তাই ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় এক ছেলের হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। চিঠি লিখে জানিয়েছিল এই পাগলের বাড়িতে সে থাকবে না। দুলি আপাকে অবশ্য ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। এখন তার মেয়েও আমার সমান প্রায়। কিন্তু সেসব দিনের গল্প দুলি আপা এখন হেসে হেসে করে। মা-চাচিদের মধ্যে সেজো চাচিই দেখতে বেশি সুন্দর। তিনি স্কুলে পড়ান। সারাক্ষণ খালি হাসেন। যখন যা মন চায় করে বসেন। রাতবিরাতে বৃষ্টিতে ভিজে গোসল করেন। পূর্ণিমা রাতে আমাদের নিয়ে দিঘির পাড় হাঁটতে যান। রাতদুপুরে মন চাইলে মোরগপোলাও রান্না করে খান। কিছু বললে বলেন, কোন দিন মইরা যাই ঠিক নাই, যা মন চায় কইরা লই। সবার ধারণা সেজো চাচির সাথে জিন আছে। মৃত্যু আতঙ্কে আমার এক চাচাতো দাদা এতটাই পাগল হয়ে গেছেন যে সারাক্ষণ মসজিদে পড়ে থাকেন। বলেন, মরলে তিনি মসজিদেই মরবেন। সবচেয়ে স্বাভাবিক আমার আব্বা। আব্বা অবশ্য কারও সাথেই কথা বলেন না। মাসে একবার তিনি বাড়ি আসেন, সারাদিন বাড়িতেই বসে থাকেন। আমি যে আব্বার সামনে দিয়ে ঘুরে বেড়াই, কোনোদিন ডেকে জিজ্ঞেস করেন না, কিরে, তোর পড়াশোনা কেমন চলছে? আমি যে কোন ক্লাসে পড়ি তাও বোধ হয় আব্বা জানেন না। আমার ধারণা, আব্বার মাথাই সবচেয়ে বেশি খারাপ।
আসলে সবচেয়ে বেশি খারাপ আমার মাথাই। সারাক্ষণই আমি মৃত্যুর ভয়ে অস্থির হয়ে থাকি। না পারি লেখাপড়ায় মন দিতে, না পারি খেলাধুলায় মন দিতে। যখন যা-ই করতে যাই খালি মনে হয় কোনদিন মরে যাই তার নাই ঠিক, কী হবে লেখাপড়া করে! ফুটবল খেলতে গিয়ে সমানে গোল খাওয়ার পর মনে হয়, একদিন তো মরেই যাব, কী হয় কয়েকটা গোল খেলে! আমার বন্ধুরা খেলায় হেরে গেলে কান্নাকাটি শুরু করে, আমার হাসি পায়। মানুষের পুরো জীবনটাকেই আমার বেহুদা মনে হয় মৃত্যুর কাছে। এই যে মানুষ এত কষ্ট করে লেখাপড়া করে, চাকরি করে, টাকাপয়সা জমায়, বাড়ি করে, আমার কাছে মনে হয় এসব হুদাই। দাদি মৃত্যুর গন্ধ পাক আর না পাক একদিন তো সবাইকে মরতে হবেই। একদিন যখন মরে যাবেই কী মানে আছে এসবের? তার চেয়ে বরং আনন্দ করাই ভালো। কিন্তু আনন্দও আমি কিছুতে করতে পারি না। ধর্মকর্ম যতটুকু বুঝি তাতে মনে হয় একমাত্র আমলই যখন যাবে সঙ্গে, তখন যত বেশি পারি নামাজ-রোজা করা ভালো। আমারও সুন্দর আলী দাদার মতো মসজিদে পড়ে থাকতে ইচ্ছা করে। কিন্তু নামাজেও আমার মন বসে না। আমার বরং মন চায় হরিদাশ গায়েনের বাড়ি গিয়ে দিনরাত গান শুনি। কী সব আধ্যাত্মিক কথা সেসব গানের, ঠিকমতো অর্থও বুঝি না। তবু আমার ভালো লাগে। মরিলে সব হবে মাটি, ত্বরায় এ ভেদ নাও জেনে/ শুনি মলে পাবে বেহেস্তখানা, আসলে তো মন মানে না, বাকির লোভে নগদ পাওনা কে ছাড়ে এ ভুবনে।
ছোট চাচার মৃত্যুর পর একদিন পুরান মসজিদের বড় হুজুরকে ডেকে মিলাদ পড়ানো হলো। বড় হুজুরের বয়স সত্তরের মতো। মুখে দরবেশের মতো সাদা দাড়ি। তিনি এসে দাদিকে বললেন, মৃত্যুর গন্ধ পাওয়া তো ভালো। আল্লাহ আপনাকে আগে থাকতে সাবধান করে দিচ্ছেন। আসলে তো আল্লাহ আপনার মাধ্যমে আমাদের এ-ই জানাচ্ছেন যে, যে কোনো মুহূর্তে যে কারোরই মৃত্যু হতে পারে, তাই সাবধান, হুঁশিয়ার। একদিন মৃত্যু হবে জেনেও তো আমরা মৃত্যুর কথা ভুলে থাকি। মৃত্যুর কথা ভুলে থাকি বলেই তো দুনিয়াতে এত ফ্যাসাদ। মানুষ যদি সারাক্ষণ মৃত্যুর কথা স্মরণ রাখত তাহলে তো কোনো পাপ করতে পারত না। মা, আপনি তো আমাদের আগাম সাবধান করে দিচ্ছেন, আল্লাহর এক পরম বার্তা বহন করছেন আপনি। এ নিয়ে বিচলিত হবেন না, বরং আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেন, মরব তো একদিন আমরা সবাই-ই, সেই মৃত্যু যেন হয় সাহসের, শান্তির। আপনার মৃত্যুর গন্ধ পাওয়া তো আমাদের জন্য হুঁশিয়ারি, আমরা যেন যাওয়ার জন্য তৈয়ার থাকি।
এর ছ’মাস পর দাদি হঠাৎ এক রাতে মৃত্যুর গন্ধ পেলেন। বাড়ির সব মানুষ দাদিকে ঘিরে দু’দিন বসে রইল। দাদিকে ঘিরে বসেই খাওয়াদাওয়া, নামাজ, গল্পসল্প, ছোটদের পড়াশোনা। দাদি কাউকে কাছ ছেড়ে নড়তেই দেন না। দূরদূরান্তের আত্মীয়স্বজনের খবর দিয়ে আনা হলো। এ যেন মৃত্যুর উৎসব। পাড়া-প্রতিবেশী সকাল-বিকাল খবর নিতে লাগলেন। দাদি তাঁর সারাজীবনের সব গল্প উজাড় করে দিলেন। একবার একে ডাকেন, একবার তাকে ডাকেন। হঠাৎ কারও মুখ দু’হাতে তুলে ধরে বলেন, ইশ, তোরে কতদিন দেখি না। হঠাৎই দাদি বললেন, এ মৃত্যুর গন্ধ যেন আমারই মৃত্যুর গন্ধ। আমিই যেন মরব এইবার।
তিন দিন পর দাদি মারা গেলেন ঘুমের মধ্যে। এশার নামাজ পড়ে খেয়েদেয়ে শুয়েছিলেন। মাঝরাতে সেজ চাচি তাকে ডাকতে গিয়েছিলেন প্রস্রাব করার জন্য উঠবেন কিনা জানতে। কয়েকবার ডেকেও যখন সাড়া পেলেন না নাড়া দিয়ে দেখেন নড়েনও না। মা আর বড় জেঠি উঠে গিয়ে দেখেন তিনি আর নাই।
সেই মাঝরাতেই আমাদের সবাইকে ডেকে উঠানো হলো। সে-রাতে খুব জোছনা হয়েছিল। আমরা ঘরবার করছিলাম। উঠানের কোণে বসেছিলাম। মরা বাড়িতে যে ধরনের বিলাপ হয় সে-ধরনের কোনো কান্নাকাটি হলো না। দাদির ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি সবাই তখন বাড়িতে। আমি কী রকম মিষ্টি একটা ফুলের গন্ধ পাচ্ছিলাম।