
রবীন্দ্রনাথ যখন তেরো-চৌদ্দ বছর বয়সের ছেলেদের বালাই হিসেবে চিহ্নিত করে বলেন, তাদের ‘শোভাও নাই, কোনো কাজেও লাগে না। স্নেহও উদ্রেক করে না’, তাদের সঙ্গসুখও কেউ বিশেষভাবে কামনা করে না, ঠিক সে সময় এই ‘বালাই’দের একটা নিজস্ব জগৎ তৈরি হয়। সে জগতে তারা কিছুটা নিঃসঙ্গ, পৃথিবীর কোথাও ঠিক খাপ খাচ্ছে না বলে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সবসময় লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে থাকলেও তখন তাদের ভেতর কিছু তৈরি হয় কিছু বিষয়ের প্রতি গোপন মুগ্ধতা। বয়ঃসন্ধির সেই সময়ে দেহে ও মনে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটতে থাকে, তার তাড়নায় তাদের কারও কারও মধ্যে অত্যাশ্চর্যভাবে জেগে ওঠে নিষিদ্ধ স্বপ্নের মতো নারীদের প্রতি সকুণ্ঠ মুগ্ধতা, যে কথা কারও কাছে কখনোই প্রকাশ করা যায় না। ওদের বেমানান অস্তিত্বের সঙ্গে বেখাপ্পা মনে হওয়া এমন বহু কিছুই অবদমিত রয়ে যায় নিজের মধ্যে। তবে সেই বয়সের অবদমিত আবেগ বিমুক্ত হওয়ার বিকল্প পথ আবিষ্কৃত হলে সেটি কেন্দ্রীভূত হয় অন্যত্র।
ঠিক সে রকম বয়সে কারও কারও প্রথম মুগ্ধতা তৈরি হয় বইয়ের প্রতি, কারণ সেটি অনেকের কাছে সহজলভ্য এবং খুলে যাওয়া একটা নতুন বাতায়ন হয়ে আসে, এই পত্রকারও তার ব্যতিক্রম ছিল না। বড় ভাই ও বোনদের মধ্যে ছিল বই পড়ার নেশা। বাড়ি ফেরার সময় হাতে করে নিয়ে আসা যে কোনো বই সেই বয়সে সেগুলো পড়া যথার্থ ছিল কি না, সেটি তখন বিবেচ্য বিষয় থাকে না আর। গুরুজনদের ভাষায় ‘আউট বই’ পড়ার প্রতি নিষেধাজ্ঞা থাকলে সেই আকর্ষণ আরও বেড়ে যায়। ফলে কিছু না বুঝেই বড়দের বই হাতের কাছে পেলে পড়ে ফেলার এক আশ্চর্য নেশা পেয়ে বসেছিল আমাকে। কোনো কিছু না বুঝেই পড়ে ফেলেছিলাম তারাশঙ্করের ‘জঙ্গলগড়,’ এখন যার কিছুই স্মরণে নেই। উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়া চাচাতো বোনের কলেজপাঠ্য ‘বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন’ পড়ার পর সবচেয়ে আলোড়িত হয়েছিলাম তাঁরই র্যাপিড রিডারের একটা গল্প ‘দ্য মাংকি’জ প’ অর্থাৎ ‘বানরের থাবা’ পড়ে। ভৌতিক সেই গল্পটি বহুবার পড়ার পরও তখন জানতাম না গল্পটি কার। পরবর্তী সময়ে জানা হয় ওটার লেখক ডব্লিউ ডব্লিউ জ্যাকব।
শঙ্করের ‘যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ’ যে কতবার পড়া হয়েছে, সেটি বোঝা গিয়েছিল সুলভ সংস্করণের পাতাগুলো খুলে আসার পর। টাইপরাইটার মেকানিক ছেনোদা চরিত্রটির বিপরীতে নিজেকে সদ্য লেখালেখি শুরু করা উপন্যাসটির কথক মনে হতো তখন। তাই কথকের অপরাধে ছেনোদার তিন মাস জেলখাটা বিষয়টি সেই কিশোর পাঠকের প্রাণে খুব লেগেছিল। অসৎ মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী রাজপালের কাছে প্রায় ক্রীতদাসের মতো আটকে থাকা দক্ষিণেশ্বরবাবু ওরফে ডাকিন বাবু, স্কুলের কানাইবাবু স্যার, তারপর শাজাহান হোটেলের রিসেপশনিস্টের ভূমিকায় থাকার সময় সত্যসুন্দর বোস ওরফে স্যাটা বোস, কিংবা নিত্যহরি ওরফে ন্যাটাহারি বাবু– এসব চরিত্র সেই কিশোর বয়সে যেভাবে মনের ভেতর দাগ কেটেছিল, সেটা আজ অবধি মুছে যায়নি। রাজপালের হাঁড়ির মতো গোল মুখে চকচক করে ওঠা বসন্তের দাগ আর ডাকিন বাবুকে বলা তার সেই কথা ‘রুপেয়া? মেরা রুপেয়া লে আও,’ কথাটা এখনও স্পষ্ট মনে আছে। শাজাহান হোটেলের আখ্যান পরবর্তী সময়ে ‘চৌরঙ্গী’ উপন্যাসেও পড়া হয়, তবে ‘যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ’ নিয়ে কিশোর বয়সের যে মুগ্ধতা, পরিণত বয়সে সেটি সৃষ্টি করতে পারেনি ‘চৌরঙ্গী’।
‘যোগ বিয়োগ’ পড়তে পড়তে যখন প্রায় মুখস্থ হয়ে যায়, তখন প্রথমবারের মতো হাতে আসে কিশোরোপযোগী বই ‘নতুন আলোর ঝলকানি,’ ঢাকা থেকে আনা বোনের উপহার। আমেরিকা আবিষ্কারকারী দলটি নতুন ভূখণ্ডে পৌঁছার পরের নানান ঘটনার নিবিড় ও চমকপ্রদ বর্ণনা দেওয়া ফ্রাঙ্কলিন পাবলিকেশন্সের বইটি যাবতীয় মুগ্ধতা আদায় করে নিয়েছিল। বর্ণনার সঙ্গে মিল রেখে পাতায় পাতায় ছিল সুচারু হাতে করা ইলাস্ট্রেশন। বহুদিন ধরে বইটি বারবার পড়েও আশ মিটত না যেন। কিশোরদের জন্য লেখা বইটি পরবর্তী সময়ে বহু খোঁজ করেও পাওয়া যায়নি কোথাও।
সে সময় গোয়েন্দা কাহিনির প্রতিও বিশেষ আকর্ষণ জন্মায়। না, অন্য সবার মতো দস্যু মোহন সিরিজের একটি বইও পড়িনি, তবে রোমেনা আফাজের বনহুর দুয়েকটা পড়লেও বিশেষ দাগ কাটেনি মনে। এখন পরিণত বয়সে বুঝতে পারি বনহুর ভালো না লাগা প্রমাণ করে যে কিশোর বয়স থেকেই পাঠক হিসেবে নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ তৈরি হয়ে গিয়েছিল আমার। গোয়েন্দা কাহিনির মধ্যে নীহাররঞ্জন গুপ্তের ‘কালো ভ্রমর’ ও আরও কয়েকটা ততদিনে পড়া শেষ। ব্যাক ব্রাশ করা চুল, পায়ে ঘাসের চপ্পল পরা কিরীটি রায় চরিত্রটি মুগ্ধতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। তারপর কাজী আনোয়ার হোসেন যখন হাতে তুলে দিলেন মাসুদ রানা, তখন থেকে যাবতীয় আকর্ষণ কেন্দ্রীভূত হয় বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের এই দুর্দান্ত এজেন্টটির ওপর। বইগুলো সে সময়ে পড়া যে আমার বয়সী কিশোরদের উপযোগী নয়, সে কথা বুঝতে পেরেই বোধকরি এই সিরিজের বইগুলোর প্রতি আকর্ষণ আরও বেশি ছিল। মাসুদ রানাকে পেয়ে মনসুর আলী ওরফে ‘কুয়াশা’ জলো মনে হতে থাকে। তবু প্রায় নিরামিষ খাওয়ার মতো কুয়াশাতেও কিছুদিন মজে ছিলাম, তবে সেটি যে মনে কোনো দাগ কাটতে পারেনি তার প্রমাণ কুয়াশা সিরিজের কোনো কাহিনি কিংবা চরিত্রের পরিপূর্ণ বিস্মরণ। অথচ মাসুদ রানার বিভিন্ন কাহিনি, সোহানা কিংবা গিলটি মিয়ার মতো চরিত্রগুলো আজ এত বছর পরও স্মৃতিতে উজ্জ্বল। কাজী আনোয়ার আরেকটি কাজ করে দিয়েছিলেন, সেটি হচ্ছে অসাধারণ কিছু রোমাঞ্চ কাহিনি অনুবাদ করে কিংবা বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে লিখে আমাদের পাতে তুলে দিয়ে বদলে দিয়েছিলেন আমাদের পাঠাভ্যাস। সে রকম একটা বই ছিল ছয় রোমাঞ্চ। মাংসভুক মাকড়সা খুঁজতে গিয়ে সেই মাকড়সাভর্তি গর্তে পড়ে যাওয়া, কিংবা সর্বনাশা পিঁপড়ে নামের পঙ্গপালের মতো এক মাংসভুক পতঙ্গের আক্রমণ থেকে উদ্ধার পাওয়ার গল্পসহ আরও কয়েকটা রোমহর্ষক গল্প অসাধারণ অনুবাদে কিশোরচিত্ত হরণ করতে পেরেছিলেন তিনি।
হাইস্কুলের চৌকাঠ পার হওয়ার পর নতুন দরজা খুলে দেয় স্কুলের লাইব্রেরিটি। তখন আর একটি বই বারবার পড়তে হয় না। মায়ের পড়ার জন্য লাইব্রেরি থেকে বই আনার সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব হয় এবার। এখন তাঁর জন্য আনা সত্যেন সেনের ‘বিদ্রোহী কৈবর্ত,’ ‘অভিশপ্ত নগরী,’ ‘পুরুষমেধ’ ইত্যাদির মতো কঠিন সব বই পড়ে ফেলা যায় অবলীলায়। জহির রায়হানের ‘বরফ গলা নদী,’ ‘আরেক ফাল্গুন’ ইত্যাদি সত্যেন সেনের বইগুলোর মতো কঠিন বিষয় নিয়ে নয় বলে এই বইগুলো পড়ে কিছুটা আশ্বস্ত হই যে, বড়দের বইগুলোর কিছু বুঝতে পারি। কৈশোরোত্তীর্ণ এই বয়সে সবকিছুতে যে মুগ্ধতা আসে, তার কিছুটা ভবিষ্যৎ জয়ী স্বপ্নের আবেশে, কিছুটা অপাংক্তেয় অথচ অনাগত যৌবনের তাড়নায়।
স্কুলের একদম ওপরের ক্লাসে ওঠার পর নিজের জমানো টাকায় প্রথম কেনা বইটি ছিল মহাদেব সাহার ‘এই গৃহ এই সন্ন্যাস,’ তার পরেরটি ছিল আবুল হাসানের ‘রাজা যায় রাজা আসে।’ নির্মলেন্দু গুণের ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ পেয়েছিলাম উপহার হিসেবে। ততদিনে আমিও কবিতার জগতে ঢোকার প্রবল চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম বলে এই বইগুলো ছিল মুগ্ধতার প্রথম পাঠ। সেই কিশোর বয়সে মহাদেব সাহার দুটি চরণ প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিল আমাকে, ‘তুমি না থাকলে মেয়েদের রূপ কিংবা ফাহমিদা খাতুনের/রবীন্দ্রসংগীত কিছুই আমাকে আকর্ষণ করে না।’
স্কুলজীবনের মুগ্ধ স্বপ্নেরা চারপাশ ঘিরে ওড়াউড়ি করতে করতে এসে যায় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পরম্পরায় কিশোরস্বপ্নে মুক্তিযুদ্ধের সোনালি সময়। মুগ্ধতার ক্ষেত্র বদলে যায়, গোপনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সম্প্রচার শুনতে শুনতে মুগ্ধতা জন্মায় অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি, যাদের একজন আপন সহোদর। সেই মুগ্ধতায় এক কাকভোরে পেছনের সব বন্ধন ছিন্ন করে বেরিয়ে পড়তে হয় মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোদ্ধা হওয়ার জন্য। গ্রামের মেঠোপথ বেয়ে দীর্ঘ পদযাত্রায় নিজের অজান্তে একসময় মুক্তাঞ্চলে ঢুকে পড়লে সাবমেশিনগান হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে মুগ্ধতা তীব্রতর হয়। চূড়ান্ত যাত্রার আগে গ্রামের যুবকদের সংকল্পবদ্ধ শপথ এবং সমবেত জাতীয় সংগীত গাওয়া মুগ্ধ চোখে দেখতে দেখতে নিজেকে একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কল্পনা করি। কিন্তু অবিভাবকদের ত্বরিত পদক্ষেপে সে অভিযান ব্যর্থ হয়। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার ব্যর্থতা আত্মস্থ করে যাবতীয় মুগ্ধতা জড়ো হয় মুক্তিযোদ্ধা গেরিলাদের প্রতি, তাদের কালো শ্মশ্রুমণ্ডিত চেহারা, হাতে সাবমেশিনগান, গোপন দৃপ্ত পায়ে দ্রুত স্থানবদল– সবকিছুর নায়কোচিত কল্পনা দৃশ্যপটে ভেসে এলে দ্রুত বড় হয়ে যেতে ইচ্ছে করে।
আরও মুগ্ধতা জাগে যখন সর্বজ্যেষ্ঠ অগ্রজ ক্রিকেট ক্লাব করার জন্য চাঁদা চাইতে আসা পাড়ার কয়েকজন তরুণকে তীব্র ভাষায় ভর্ৎসনা করেন যে ওদের বয়সী ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধ করছে, আর ওরা ক্রিকেট ক্লাব করার জন্য চাঁদা চেয়ে বেড়াচ্ছে। সেই ভর্ৎসনা অবরুদ্ধ সময়ে যেমন অকল্পনীয় ছিল, তেমন ছিল বিপজ্জনকও। বর্তমান দুর্বৃত্তায়নের যুগে সেই বিপদ কতগুণ বেশি তার পরিমাপ আমাদের জানা নেই। যুদ্ধজয়ের পর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি এই মুগ্ধতা আরও বেড়ে যায় অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরের। বেশ ক’বছর পর ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ পড়ার পর উপলব্ধি ঘটে, সেই কৈশোরে স্বপ্ন ও মুগ্ধতা মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু কবির ভাষায় যৌবন আসেনি তখনও, তাই ঘটেনি যুদ্ধে যাওয়ার সুযোগ।
স্কুলের ওপরের দিকে ওঠার পর আকর্ষণের নতুন দুয়ার খুলে যায়। তখন ‘মধুমিতা’ সিনেমা হলে দুপুর ১টায় ‘স্পেশাল শো’ নামে একটা স্লট ছিল, যেখানে হলিউডের বিখ্যাত ছবিগুলো দেখানো হতো, টিকিটের দামও ছিল কম। সেই সুবাদে দেখা কিছু বিশ্ববিখ্যাত ছবির প্রতি নতুন মুগ্ধতা জন্মায়। ‘মেকানা’জ গোল্ড,’ ‘ডার্টি ডজন,’ ‘হোয়্যার ইগলস ডেয়ার,’ ‘গানস অভ নাভারন,’ ‘টাওয়ারিং ইনফার্নো,’ ‘স্পার্টকাস,’ ‘দ্য বার্ডস,’ ‘বুচ ক্যাসিডি অ্যান্ড সানডেন্স কিড,’ ‘ডক্টর জিভাগো’ কিংবা ‘ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই,’ দেখে সে সময় থেকেই বয়সের তুলনায় এক ধরনের পরিপক্বতা এসেছিল হয়তো। এগুলোর মধ্যে কোনটি ‘মধুমিতা’ সিনেমা হলে দেখা আর কোনটি অন্যত্র, সেটি এই মুহূর্তে স্মরণে নেই। তবে আরও দুয়েকটা ছবির কথা না বললে মুগ্ধতার কথাটা প্রমাণ করা যাবে না। তার একটি ছিল ‘সানফ্লাওয়ার।’ মার্শেলো মাস্ত্রোয়ানি আর সোফিয়া লরেনের অনবদ্য অভিনয়ে বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাত, প্রেম ও বিচ্ছেদের এই করুণ গাথাটি কিশোরমনে এমনভাবে গেঁথে গিয়েছিল যে, একাধিকবার দেখেও যেন আশ মেটেনি। একাধিকবার দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছিল আরও দুটো ছবিতে। ওমর শরিফ আর সোফিয়া লরেনের ‘দ্য ফল অব দ্য রোমান এম্পায়ার’ দেখা হয়েছিল মোট তিনবার, এমনই দুর্দান্ত মুগ্ধতা। সোফিয়া লরেনে মুগ্ধ ছিলাম বলেই বোধ হয় ‘সানফ্লাওয়ার’ কিংবা ‘দ্য ফল অব দ্য রোমান এম্পায়ার’ একাধিকবার দেখতে হয়েছে। তাই তখনকার জনমননন্দিতা সোফিয়া লরেন অভিনীত আলবার্তো মোরাভিয়ার উপন্যাস অবলম্বনে ‘টু উইমেন’ যে আগে পড়া উপন্যাসটির চিত্ররূপ দেখতেই গিয়েছিলাম সে কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। সে রকম আরও একটা ছবি তিনবার দেখতে হয়েছিল, ‘দ্য ট্র্যাপ।’ অলিভার রিডের দরাজ গলায় গানের সুর ভাঁজা কিংবা বোবা মেয়ের চরিত্রে রিটা টুসিংগামের অনবদ্য অভিনয় দেখার জন্য ছবিটা তিনবার দেখেও আশ মেটেনি। আশ্চর্য লেগেছিল, জনহীন অরণ্যের ভেতর সবাক অলিভার রিড আর মুক রিটা টুসিংগাম– এই দু’জন তৃতীয় কোনো চরিত্রের উপস্থিতি ছাড়া ডায়ালগবিহীন গল্পটির সঙ্গে কী অসাধারণ নৈপুণ্যে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন দর্শকদের, সেই মুগ্ধতা আজ অবধি যায়নি। ‘ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই’ একাধিকবার দেখার মুগ্ধতা নিয়ে থাইল্যান্ডে কাঞ্চনাবুরিতে কাওয়াই নদীর ওপর ঐতিহাসিক সেই সেতুটি দেখতে গিয়ে টয় ট্রেনে পার হয়েছিলাম সেটি। পরে জানতে পারি থাইল্যান্ড-বার্মা রেলপথ, যেটি ‘মরণ রেলপথ’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল, সেটির ওপর ঐতিহাসিক সেতুটি নির্মাণ ও ধ্বংস নিয়ে তৈরি ছবিটির শুটিং হয়েছিল শ্রীলংকাতে। যে সেতুটি সিনেমায় দেখানো হয়, সেটি দেশটির কিতুগালার কাছে কেলানি নদীর ওপর। এমনকি ছবিতে যে হাসপাতাল দেখানো হয়, সেটি আদতে ছিল কলম্বোর মাউন্ট লাভিনিয়া হোটেল। এই তথ্য জানার পরও যে ছবিটির ওপর মুগ্ধতা যে কমে গিয়েছিল তা নয়।
আমাদের সেই অপরিণত বয়সে রুপালি পর্দার নায়িকাদের দেখে যতটা না মুগ্ধ ছিলাম, তার চেয়ে বেশি মুগ্ধতা কেড়ে নিয়েছিল পল নিউম্যান, স্টিভ ম্যাককুইন, গ্রেগরি পেক, ডেভিড নিভেন, অ্যান্থনি কুইন, ক্লিন্ট ইস্টউড, কার্ক ডগলাস কিংবা টনি কার্টিসের মতো অভিনেতারা। অবশ্য মুগ্ধ হয়ে দেখা হলিউডের যে ছবিগুলোর নাম উল্লেখ করলাম, সেখানে বেশিরভাগ ছবিতেই অভিনেত্রীদের ভূমিকা প্রায় ছিল না বললেই চলে। সে কারণে ছবি আর অভিনেতাদের দেখেই মুগ্ধ হয়েছি। বাংলাদেশের কোনো ছবি তিনবার দেখার মতো আছে কি না জানি না, তবে একটি ছবি সত্যিই তিনবার দেখেছি উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র থাকার সময়। ছবিটি ব্যবসা সফল হয়নি বটে, কিন্তু তাতে আমার তিনবার দেখা আটকায়নি। সেটা হচ্ছে কবীর আনোয়ারের ‘সুপ্রভাত।’ মূল ভূমিকায় ছিলেন কমল ব্যানার্জি ও রিনি রেজা। কমল ব্যানার্জির অতি বাজে অভিনয় সত্ত্বেও ছবিটি তিনবার দেখা হয়েছে কেবল রিনি রেজার জন্য। ছবিটিতে কীর্তনাঙ্গের একটা গান ছিল, ‘তোকে আজ কেন এত ভালো লাগে ... তোরা মন দিয়া শোন সে যে আমার মনের মতন।’ আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে ছোট বোনের সঙ্গে গাওয়া রিনি রেজার এই গানটা শোনা ও দেখার জন্যই বোধ হয় ছবিটা এতবার দেখতে হয়েছিল। উল্লেখ্য, কমল ব্যানার্জির সেটিই বোধ হয় প্রথম ও শেষ ছবি। রিনি রেজারও বোধকরি তা-ই। ছবিটার সমাপ্তি দৃশ্যটা ‘স্পার্টাকাস’ সিনেমা থেকে অনুকরণ করা বলে সমালোচিত হলেও আমার মুগ্ধতা ছিল রিনি রেজায়।
স্কুলে থাকা অবস্থায় গান শোনার তেমন কোনো সুযোগ ছিল না বলে বিশেষ কোনো শিল্পীর প্রতি অনুরাগ জন্ম নেয়নি। তবে তখন কাদেরী কিবরিয়া এক বিরাট ক্রেজ হয়ে উঠেছিলেন, মনে আছে। ঢাকা রেডিওতে তাঁর ভরাট গলায় ‘কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া তোমার চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া’ শুনতে শুনতে একসময় নিজের অজান্তে কিশোর বয়স থেকে রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি যে আসক্ত হয়ে পড়েছিলাম, সে আসক্তি ইহ জনমে আর কাটবে বলে মনে হয় না। সত্তরের দশকে ঢাকা রেডিওতে সকাল সাড়ে ৭টায় ১৫ মিনিট রবীন্দ্রসংগীত প্রচারিত হতো। সে সময় জাহেদুর রহিম, মিলিয়া গনি আর সোনিয়া গনি, সেলিনা মালেক, বিলকিস নাসিরুদ্দীন, কাদেরী কিবরিয়ার গান শেষ হওয়ার পর কলকাতা রেডিওতে শুনতাম আরেক দফা রবীন্দ্রসংগীত। সে সময় একটা রেকর্ড চেঞ্জার গ্রামোফোন কিছুদিন হাতের কাছে ছিল বলে সীমিত কয়েকটা রেকর্ডের মধ্যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একটা বিশেষ লংপ্লেয়িং ভীষণ মুগ্ধ করেছিল। মনে আছে সেই রেকর্ডে ছিল ‘কাঁদালে তুমি মোরে,’ ‘চলে যায় মরি হায়,’ ‘কেন যামিনী না যেতে,’ ‘মরে রবে কি না রবে আমারে,’ ‘কাহার গলায় পরাবি গানের রতন হার,’ ‘শুধু তোমার বাণী নয় গো,’ ‘হে ক্ষণিকের অতিথি’সহ আরও কিছু গান। সেগুলো আমার কিশোর চিত্তকে এতটাই উতলা করেছিল যে কেবল গানগুলো নয়, আজ এত বছর পরও রেকর্ডটির জ্যাকেটের ওপরের চাদর গায়ে বারান্দার রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানো হেমন্তের ছবিটিও স্পষ্ট চোখে ভাসে। অবশ্য পরবর্তী সময়ে আরও পরিণত বয়সে আরও ভালো লাগা শিল্পী পরিবর্তিত হলেও সে বয়সে শোনা গানগুলো আজও স্মরণে থাকা প্রচণ্ড মুগ্ধতারই সাক্ষ্য দেয়।
মহাবিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যার মহাসমুদ্রে এসে পড়ার পর থেকে কৈশোর ও প্রথম তারুণ্যের বহু মুগ্ধতার বিষয় পরিবর্তিত হয়েছে, বদলে গেছে রুচিবোধ ও মনন, কিন্তু কৈশোরের অবিস্মরণীয় বহু কিছু আজও মুগ্ধতা নিয়ে অবিশ্বাস্য জেগে আছে। সেসবই বোধকরি গড়ে দিয়েছিল এখনকার সত্তাটিকে।
বিষয় : প্রচ্ছদ
মন্তব্য করুন