
ইংরেজ কোম্পানির শাসনে ইংরেজি শিক্ষা থেকে নিয়ে অন্য যেসব সুযোগ-সুবিধার সৃষ্টি হলো, হিন্দুরা তা পুরোপুরি গ্রহণ করেছিল। তবে মুসলমানরা বিভ্রান্তিবশত নবাবি মোগল শাসনকে নিজেদের শাসন মনে করে, তার অবসানের পর ইংরেজ শাসনকে বৈরী শাসন মনে করে তাদের দ্বারা সৃষ্ট সুযোগ-সুবিধা ও সেই সাথে ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করতে অনাগ্রহী হয়। ইংরেজ পূর্ববর্তী শাসনে উচ্চ শ্রেণির মুসলমানসহ অনেকে প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীতে চাকরি করত। সেটাই ছিল তাদের অবস্থানের শ্রেণিগত ভিত্তি। সেই ভিত্তি অপসারিত হওয়া এবং মোগল ও নবাবি আমলেও ভূস্বামী ও জমিদার হিসেবে তাদের কোনো অবস্থান না থাকায় তারা অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। তারা বিপুল সংখ্যায় গরিব হয়ে যায়। তার ওপর ইংরেজ শাসনে ইংরেজি শিক্ষা ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বর্জন করায় তাদের অবস্থা শোচনীয় হয়। হিন্দুদের থেকে শিক্ষাদীক্ষা, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থানের দিক থেকে তারা অনেক পিছিয়ে পড়ে।
মুসলমানদের এই পিছিয়ে পড়া অবস্থা একশ বছর ধরে চলার পর সিপাহি অভ্যুত্থানের পরবর্তী পর্যায়ে তারা উপলব্ধি করে– ইংরেজদের শিক্ষাদীক্ষা বর্জন করা ছিল বড় রকম ভ্রান্তি। এই ভুল সংশোধন করতে তারা উদ্যোগী হলো। এ সময় ভারতে কোম্পানি শাসনের অবসান হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সরাসরি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যিক সরকারের শাসন। তারা মুসলমানদের শিক্ষাদীক্ষার প্রতি মনোযোগ দেয়, কিছু সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে। তাদের কিছু কর্মসংস্থানও হতে থাকে।
হিন্দুরা এতদিন প্রায় নিরঙ্কুশভাবে শিক্ষা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছিল। এরপর মুসলমানরা এ ক্ষেত্রে আবির্ভূত হলে তাদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়। হিন্দুরা মনে করে– তারা এতদিন যে সুযোগ-সুবিধা একচেটিয়াভাবে ভোগ করে আসছিল, তার পরিবর্তে তাদেরকে প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে; তাদের ভাগ থেকে একটা অংশ মুসলমানদের দিতে হচ্ছে।
এর ফলে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মুসলমানদের সঙ্গে হিন্দুদের একটা দ্বন্দ্বের পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো। হিন্দু জাতীয়তাবাদের আবির্ভাব এই সময়ে। ষাটের দশকে নবগোপাল মিত্র ও রাজনারায়ণ বসুর নেতৃত্বে হিন্দু মেলা নামে এক সম্মিলনীর আয়োজন হয়, যেখানে ঘোষণা করা হয়– হিন্দুরা এক স্বতন্ত্র জাতি।
এই জাতিতত্ত্বের উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুদের মুসলমান থেকে পৃথকভাবে উপস্থাপিত করা। পরে বঙ্কিমচন্দ্র হয়ে দাঁড়ালেন এই জাতিতত্ত্বের এক প্রবল প্রবক্তা। মুসলমান সমাজের নেতা হিসেবে বাংলায় নবাব আবদুল লতিফ ও সৈয়দ আমীর আলী এবং উত্তর প্রদেশে স্যার সৈয়দ আহমদ আবির্ভূত হন। তাঁরা মুসলমানদের অগ্রগতির জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেন এবং ব্রিটিশ সরকারের কাছে দেনদরবার করেন। এই চেষ্টা করলেও তাঁরা অবশ্য মুসলমানদের কোনো পৃথক জাতি হিসেবে উপস্থিত বা ঘোষণা করেননি। ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার সময়েই মুসলমানদের দ্বিজাতি তত্ত্ব প্রথম সূত্রায়িত হয়।
উনিশ শতকে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ শব্দটির প্রচলন হয়নি। বিশ শতকে ব্রিটিশরাই হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ্বকে প্রথম সাম্প্রদায়িক হিসেবে আখ্যায়িত করে। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা শব্দটির প্রচলন না হলেও হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যে প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়, তার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ নিহিত ছিল। পরে হিন্দু-মুসলমানের এই প্রতিযোগিতা ও রেষারেষি বিশ শতকের গোড়া থেকেই বিকশিত হয়ে তিরিশ-চল্লিশের দশকে রাজনীতি ক্ষেত্রে প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছিল। শুধু তাই নয়, রাজনীতির এক নিয়ামক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল।
এই পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য পরিকল্পিতভাবে ব্রিটিশ সরকার চেষ্টা করে। সিপাহি অভ্যুত্থানের পর মুসলমানদের শিক্ষার জন্য উৎসাহ প্রদান এবং তাদের জন্য কিছু সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করার মূল উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের হিন্দুদের সাথে প্রতিযোগিতা করার পর্যায়ে উঠিয়ে এনে তাদের মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টি। তাদের বিভক্ত করে নিজেদের শাসন অনেকটা বিপদমুক্ত ও মসৃণ করার চিন্তা থেকেই তারা এই নীতি গ্রহণ করে। এ ক্ষেত্রে তাদের এক উপায় হয় ইতিহাস চর্চা। বিখ্যাত পণ্ডিত ও ইতিহাসবিদ জেমস মিল তাঁর বিখ্যাত বই The History of India-তে ভারতের ইতিহাসকে হিন্দু, মুসলমান ও ব্রিটিশ– এই তিন ভাগে বিভক্ত করেন। প্রথম দুই কাল পর্বকে ধর্মের ভিত্তিতে নামকরণ করলেও ব্রিটিশ শাসনকে খ্রিস্টান না বলে তিনি ব্রিটিশ আখ্যা দেন। আগে ব্রিটিশপূর্ব ভারতের ইতিহাসকে এভাবে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করার ব্যাপার না থাকলেও জেমস মিল একজন সাম্রাজ্যবাদী ও ইতিহাসবিদ হিসেবে সেটা করে ভারতে সাম্প্রদায়িক চিন্তার বিকাশ ঘটানোর শর্ত সৃষ্টি করেন। তাঁর এই চেষ্টা বিফল হয়নি। ব্রিটিশ আমলে ভারতীয়রা যে ইতিহাস চর্চা করেছিলেন, সেটা অনেকাংশেই জেমস মিল-এর দেখিয়ে দেওয়া পথ ধরে গঠিত হয়েছিল এবং ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বিকাশে সহায়ক হয়েছিল।
ভারতে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হতে সময় লেগেছিল। ১৯২৭ সালের আগে রাজনৈতিক দলগুলো স্বাধীনতার দাবি করেনি। তারপর স্বাধীনতার যে সংগ্রাম শুরু হলো, সেটা ব্রিটিশ সরকারকে শত্রু নির্ধারণ করে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ছিল না। সেটা ছিল ভারতে ব্রিটিশের ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য তাদের ওপর চাপ সৃষ্টির মতো। এমনকি অনেকটা আবেদন-নিবেদনের মতো, যাকে মৌলানা মহম্মদ আলী বলেছিলেন– Begging and Praying Politics.
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঐক্য ছিল না। বিশেষ করে তিরিশের দশক থেকে তা দ্বিধাবিভক্ত হয়েছিল। এর ফলে ব্রিটিশ বিরোধিতা যতটা ছিল, তার থেকে অনেক বেশি ছিল হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক বিরোধিতা। এ বিরোধিতার কারণেই শেষ পর্যন্ত ভারত ভাগ হয়েছিল। ভারত ভাগে হিন্দু-মুসলমান, কংগ্রেস-লীগ উভয়েরই অবদান ছিল।
স্বাধীনতা আন্দোলনের চরিত্র আপসমুখী ও চাপ সৃষ্টির আন্দোলন হওয়ায় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ কারও মধ্যে তীব্র ব্রিটিশ বিরোধিতা ছিল না। ‘আন্দোলন’ ও আপস আলোচনার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন অগ্রসর হচ্ছিল। আন্দোলন যাতে সরাসরি সংঘর্ষের পথে না যায়, এজন্য গান্ধী অহিংসার প্রচারক হয়েছিলেন। অহিংস আন্দোলন ছিল তাঁদের রাজনীতির মূল ধারা। অন্যদিকে মুসলিম লীগের সাথেও তীব্র ব্রিটিশ বিরোধিতা ও সশস্ত্র লড়াইয়ের কোনো সম্পর্ক ছিল না। চল্লিশের দশকে তারা ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ আওয়াজ তুলেছিল। কিন্তু তাদের সে লড়াই ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ছিল না, ছিল হিন্দু ও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে।
লক্ষ্য করার বিষয় ছিল, গান্ধীর অহিংসা শুধু প্রযোজ্য ছিল ভারতীয়দের ক্ষেত্রে। তারা যাতে আন্দোলনের সময় কোনো ধরনের সহিংসতা না করে, এটাই ছিল তাঁর অহিংসার আদর্শের মূল কথা। কিন্তু ব্রিটিশের সহিংসতার কোনো বিরোধিতা তাঁর মধ্যে ছিল না। চৌরিচৌরার সহিংসতার তিনি বিরোধী ছিলেন। কিন্তু জালিয়ানওয়ালাবাগের ব্রিটিশ সহিংসতার সময় তিনি তার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ না করে বিস্ময়করভাবে নীরব ছিলেন। গান্ধী পেশোয়ারে কিসসাখানি বাজারের ঘটনার সময় ভারতীয় সৈন্যদের দেশপ্রেমমূলক ব্রিটিশ বিরোধিতা এবং জনগণের ওপর গুলি না চালানোর জন্য তাদের সমালোচনা করেছিলেন। গান্ধী ভগৎ সিং-এর কার্যকলাপের বিরোধী ছিলেন এবং ব্রিটিশরা তাঁকে ফাঁসি দিলে তার বিরুদ্ধে তিনি কোনো প্রতিবাদ না করে নীরব ছিলেন।
ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের চরিত্র মূলত ছিল সাংবিধানিক। শ্রেণিগত কারণে গান্ধী, জিন্নাহ উভয়েই আন্দোলন সংসদীয় কাঠামোর মধ্যে আটকে রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। মুসলিম লীগ তো প্রকৃতপক্ষে ব্যাপক সরকারবিরোধী আন্দোলন কখনও করেনি। গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস অহিংস আন্দোলন করে আন্দোলনকে সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে ধরে রাখার ব্যবস্থা করত। কখনও কখনও আন্দোলন সহিংস আকার ধারণ করলে বা তার আশঙ্কা দেখা দিলে গান্ধী হস্তক্ষেপ করে তা থামিয়ে দিতেন।
কংগ্রেস-লীগের স্বাধীনতা আন্দোলন চলাকালে তারা সব সময়ই ব্রিটিশ ভারতীয় সরকারের সাথে সম্পর্ক রাখত এবং তাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করত। এই আলাপ-আলোচনা চল্লিশের দশকে নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছিল। ভাইসরয়ের সাথে আলোচনা, সিমলা সম্মেলনের মতো মতবিনিময় সভা, কেবিনেট মিশনের সাথে আলাপ-আলোচনা এবং মাউন্টব্যাটেনের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা হয়েছিল।
চল্লিশের দশকে কংগ্রেস-লীগের স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যে স্বাধীনতার থেকে নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার ভাগ-বাটোয়ারা ও বখরা ভাগের আলোচনা অধিক গুরুত্ব পেয়েছিল। ১৯৪৪ সালে গান্ধী-জিন্নাহর মধ্যে আপস মীমাংসার জন্য যে দীর্ঘ আলোচনা বেশ কয়েক দিনের জন্য হয়েছিল এবং কোনো মীমাংসা ছাড়াই শেষ হয়েছিল, সেটা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক কেলেঙ্কারি ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। স্বাধীনতা আন্দোলন করতে গিয়ে আসল শত্রু ব্রিটিশ ভারতীয় সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন কেন্দ্রীভূত হওয়ার পরিবর্তে কংগ্রেস-লীগের মধ্যে এই ধরনের আন্দোলন যেভাবে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়েছিল, এটা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক বিরল ও ব্যতিক্রমী ব্যাপার।
এই ভাগ-বাটোয়ারার দ্বন্দ্বে আসল শত্রু ব্রিটিশ সরকার অনেকটা মধ্যস্থতার কাজ করেছিল! ক্ষমতা হস্তান্তর কীভাবে হবে সেটা শাসক ব্রিটিশ সরকার এবং কংগ্রেস-লীগ টেবিলে বসে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করেছিল। এটা ছিল ভারতের জনগণের বিরুদ্ধে এক চক্রান্তমূলক ব্যাপার। জনগণের মাথায় ঘোল ঢেলে, জনগণের সাথে প্রতারণা করেই তারা ভারত ভাগ করেছিল।
হিন্দু-মুসলমান বা কংগ্রেস-লীগের মধ্যে দ্বন্দ্ব এভাবে ভারত ভাগের মতো পরিণতি ঘটাত না এবং সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ ও দাঙ্গায় লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হতো না, যদি স্বাধীনতা সংগ্রামের ব্যাকরণ মেনে ভারতের রাজনীতি অহিংসার নীতি পরিহার করে আন্দোলনকে তার স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে যেতে দেওয়া হতো। গান্ধী তাঁর ঘোষিত এবং অনুসৃত অহিংস নীতি এবং জিন্নাহ তাঁর নীরব অহিংস নীতির মাধ্যমে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে স্বাভাবিক পথে অগ্রসর হতে দেননি। এ কারণে সংগ্রামের উত্তাপ সৃষ্টি হলেও সে উত্তাপ ব্রিটিশকে দগ্ধ না করে ভারতীয়দেরকেই দগ্ধ করেছিল। এই প্রক্রিয়ার সর্বোচ্চ রূপ হিসেবে দেখা দিয়েছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা।
ভারত ভাগের কুশীলব
ইংরেজরাই হচ্ছে একমাত্র, যারা এ দেশে এসে আক্রমণ-দখল করেছে, এখানে থাকেনি। এরা এ অঞ্চলের মানুষের ভেতর দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে রাজত্ব কায়েম করতে চেয়েছে। আগেকার আক্রমণকারীদের সঙ্গে ইংরেজদের তফাত এখানে। তারা সাম্প্রদায়িকতা তৈরি করে তার সুযোগ নিতে চেয়েছে। দেশভাগ দেখতে হলে দেখতে হবে ইংরেজ সময়কাল থেকে। মোগল বা সুলতান– এরা দেশভাগের চিন্তা করেনি। ইংরেজরা উনিশ শতক থেকেই মতলব এঁটেছে। তাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছিল– সাম্রাজ্য বিস্তার, উপনিবেশ স্থাপনের পরিকল্পনা।
পরবর্তী সময়ে এখানকার জনবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা ইংরেজদের সাথে আপস করে তথাকথিত স্বাধীনতা আন্দোলন করেন। একদিকে আন্দোলন করেন, আরেকদিকে আপস করেন। এমনটা রাশিয়াতেও হয়নি, চীনেও হয়নি। তারা লড়াই করেছে। এখানে লড়াইয়ের আরেক দিক হচ্ছে, এটা সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে থেকেছে। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী যেমন বিভ্রান্তকারী ছিলেন, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহও ছিলেন তেমনই বিভ্রান্তকারী। তবে বিভ্রান্তি তৈরিতে গান্ধী তুলনামূলক এগিয়ে। আরেকজন ছিলেন প্রায় একই রকম বিভ্রান্তকারী– জওহরলাল নেহরু। তাঁরা ইংরেজদের সঙ্গে একদিকে যোগসাজশ করেছেন, আবার আন্দোলনও করেছেন। এভাবে তথাকথিত লড়াইটা একটা সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে থেকেছে। প্রকৃত লড়াই হয়নি। বরং লড়াই হতে গেলেই তাঁরা বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে অপপ্রচার চালিয়েছেন।
গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন ছিল শুধু ভারতীয়দের জন্য। ভারতীয়রা যাতে কোনো হিংসা না করে ইংরেজের বিরুদ্ধে, শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে যেন সশস্ত্র আন্দোলন না করে। করলে তা থামানোই ছিল যেন গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের উদ্দেশ্য। ইংরেজরা যত হিংস্রতা দেখিয়েছে, গুলি করেছে, নির্যাতন করেছে ভারতীয়দের ওপর, একটা উদাহরণও নেই ওসবের কোনো একটার বিরুদ্ধে গান্ধী দাঁড়িয়েছেন। অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগে যখন হত্যাকাণ্ড হলো, হাজার মানুষ মেরে ফেলল ইংরেজরা, গান্ধী কোনো প্রতিবাদ করেননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এ নিয়ে গান্ধীর ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন। এমন আরও আছে। ১৯২১ সালে চা বাগানের শ্রমিকরা অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে সিলেট ছেড়ে তাদের দেশে চলে যেতে চাইছিল বিহার-উত্তর প্রদেশ-মাদ্রাজ। বলছিল– থাকব না এখানে। ধর্মঘট করেছিল তারা। তাদের ওপর নৃশংস নির্যাতন চালিয়েছে ইংরেজ সরকার। তখন গান্ধী বলেছেন, কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। এত বড় বিভ্রান্তকারী!
গান্ধীকে ভুল বোঝা হচ্ছে না, বরং তাঁকে যে পথে ঠিকটা বোঝা দরকার তা হয়ে ওঠেনি; তাঁকে উল্টো ভালো বোঝা হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকাকালে তিনি ইংরেজদের গোলামি ছাড়া আর কিছু করেননি। এ নিয়ে তথ্যবহুল বই আছে। গান্ধী বলেছিলেন, ভারত ভাগ করার আগে আমাকে ভাগ করো। ভণ্ড কথাবার্তা। আমার বাবা আবুল হাশিমের সাথে শেষ দিকে ওনার খুব সখ্য হয়। তবে বিচ্ছিন্নভাবে গান্ধীর ওপর কিছু বললে দেশভাগ বোঝা যাবে না। গান্ধীর বিষয়ে এতটা এজন্য বলা যে, গান্ধীকে স্বাধীনতার পুরোধা ব্যক্তিত্ব, নেতা ইত্যাদি বলা হয়। বিহারসহ অনেক জায়গায় গান্ধীর পূজা হয়। গান্ধী দেখাতেন তিনি গরিব লোকের মতো থাকেন। থার্ড ক্লাস ছাড়া চড়েন না। কিন্তু তাঁর থার্ড ক্লাসকে ফার্স্ট ক্লাসের চেয়ে বেশি বানিয়ে দেওয়া হতো। গান্ধী থাকতেন বিড়লার বাড়িতে। বিড়লা তাঁর খাওয়াদাওয়া থেকে আরম্ভ করে সব দেখাশোনা করতেন। গান্ধী ছাগলের দুধ খেতেন, সেই ছাগলকে পেস্তা বাদাম খাওয়ানো হতো। এ কারণে সরোজিনী নাইডু বলেছিলেন, গান্ধীকে দরিদ্র অবস্থায় রাখার জন্য প্রভূত অর্থসম্পদ খরচ করতে হয়!
গান্ধীর চেয়েও দলিত হিন্দুদের বড় শত্রু ছিল। দলিতদের তিনি হরিজন– পিপল অব গড আখ্যা দিয়ে, তাদের জন্য আমি কাজ করছি– এ কথা বলতেন। একটা পত্রিকাও বের করতেন। কিন্তু দলিতদের কোনো মৌলিক প্রয়োজন মেটার মতো তিনি কিছু করেননি। এজন্যই আম্বেদকারের (ভিমরাও রামজি আম্বেদকার) সঙ্গে তাঁর গন্ডগোল।
আরেক বিভ্রান্তকারী ছিলেন জওহরলাল নেহরু। বল্লভভাই প্যাটেল তো সোজাসুজি একটা ডাকাতসুলভ আচরণের মানুষ ছিলেন। ভীষণ প্রতিক্রিয়াশীল। কিন্তু তাঁর ভেতর নেহরুর মতো ভণ্ডামি ছিল না। তাঁর মতো জনবিরোধী নেতা খুব বেশি ছিলেন না। তবে তাঁর একটা সদগুণ তা হলো, তাঁর লেখাপড়া ছিল। কিন্তু যখন সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্ন এসেছে, নিম্নবর্গের কথা এসেছে তখন নেহরু আর প্যাটেলের ভেতর কোনো পার্থক্য ছিল না। তখন তাঁদের অবস্থান ছিল একই। তা সত্ত্বেও নেহরু অনেক রকম বাক্য বিস্তার করতেন। আর কোনো জটিলতা দেখা দিলেই চুপ করে থাকতেন। গান্ধীর সাথে মিলে সুভাষ বসুকে তাড়িয়েছিলেন। সুভাষ বসুকে খুব ভয় করতেন। তাঁর সময়ে ভারতে অনেক নির্যাতন হয়েছে, গুলি চলেছে, নেহরু কোনো ভূমিকা নেননি। কিন্তু বড় বড় কথা বলতে তাঁর জুড়ি ছিল না। জেলখানায় বসে ডিসকভারি অব ইন্ডিয়ায় লিখেছিলেন– ভারত যখন স্বাধীন হবে তখন ভারতের আশপাশের দেশগুলো সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে, বাদবাকি ক্ষেত্রে ভারতের অধীনস্থ থাকবে; নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান। এতটাই সাম্রাজ্যবাদী তিনি।
কাশ্মীরের ব্যাপারে তাঁর ভূমিকা ছিল ভীষণ নিন্দনীয়। মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে নেহরু চাকরের মতো ব্যবহার করতেন। মাউন্টব্যাটেনও শেষ দিকে নেহরুর সঙ্গে চাকরের মতো আচরণ করেছেন। আর লেডি মাউন্টব্যাটেনের সাথে তাঁকে ব্যস্ত করিয়ে দিলেন। নেহরু পড়ে থাকতেন সেখানে। এই মাউন্টব্যাটেনকে পরে বানানো হলো ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল। এটা চিন্তা করা যায়? ভারত স্বাধীন হলো, আর সেই স্বাধীন দেশের প্রথম প্রধান হচ্ছেন ব্রিটিশদের শেষ ভাইসরয়। এটা কি চীন, রাশিয়া, ভিয়েতনাম, কিউবা এসব দেশে কল্পনা করা যায়? যতদিন মাউন্টব্যাটেন গভর্নর জেনারেল ছিলেন, অবিকল একই ক্ষমতা ভোগ করেছেন, যে ক্ষমতা তিনি এম্পায়ারের গভর্নর হিসেবে ভোগ করেছিলেন। অন্যদিকে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল ছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। অর্থাৎ জিন্নাহ ও মাউন্টব্যাটেন সমান্তরালভাবে দুই রাষ্ট্রের প্রধান হন। তাঁরা এভাবে যে স্বাধীনতা এনেছিলেন, তারই ফল ভোগ করছি আমরা। সাধারণ মানুষের কাছে সব ধরা পড়ে না। নেহরুর বোলচালে অনেকে মোহিত হয়ে যায়। এখন নেহরু-গান্ধীর অন্ধকার দিক নিয়ে ভারতেও প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে। যদিও তাঁদের পক্ষপাতীও আছেন অনেক।
মন্তব্য করুন