গত সংখ্যার পর

কয়েক দিনের মধ্যে আহত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়ে গেলে মেজর খালেদ তাঁর মত বদলাতে বাধ্য হন। দুই মাসের মধ্যে গড়ে ওঠে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর দেহরক্ষী হাবুল ব্যানার্জীর আনারস বাগানে ৪৮০ বেডের ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’। প্রবাসী সরকারের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রাথমিকভাবে কিছু অর্থ সাহায্য করেছিলেন। বেশির ভাগ খরচ ও সকল যন্ত্রপাতি পাঠিয়েছিল লন্ডনের বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন। হাসপাতাল তৈরির মূল কৃতিত্ব ডা. মবিনের। এই হাসপাতালে ২২ অক্টোবর মাথায় গুলিবিদ্ধ মেজর খালেদ মোশাররফ প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছিলেন, পরে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন লক্ষ্ণৌতে ভারতীয় সেন্ট্রাল কমান্ডের মিলিটারি হাসপাতালে।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন থেকে অপর চারজন চিকিৎসক কাজী কামরুজ্জামান, বরকত আলী চৌধুরী, আলতাফুর রহমান ও মাহফুজ অক্টোবরে ভারতে এসে বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা দেন। বিজয় প্রাক্কালে বিলেত থেকে আসেন ডা. মোশাররফ হোসেন জোয়ারদার, যাঁর ঢাকায় শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ছিল। ডা. বরকত চৌধুরী বর্তমানে অসুস্থ, আলহাইজাইমার রোগে আক্রান্ত; ডা. কাজী কামরুজ্জামান ঢাকায় মগবাজারের কমিউনিটি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ স্থাপন করেছেন। ডা. মাহফুজ একজন বিশেষজ্ঞ রেডিওলজিস্ট হিসেবে বিলেতে অবসর জীবনযাপন করছেন। তিনি বাংলাদেশের এনআরবি ব্যাংকের একজন উদ্যোক্তা পরিচালক। ডা. আলতাফ লন্ডনে অবসর জীবনযাপন করছেন। মাঝে মধ্যে বেড়াতে দেশে আসেন।

ওসমানীর অজ্ঞাতে ভারতের সঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের চুক্তি
ফরাসি সাহিত্যিক, রোমান্টিক রাজনীতিবিদ ও ফরাসি সরকারের সংস্কৃতিমন্ত্রী আঁদ্রে মালরো স্প্যানিশ সিভিল ওয়ারে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ষাটের দশকে নাইজেরিয়ায় বিয়াফ্রার যুদ্ধে মালরো বিয়াফ্রার বিদ্রোহীদের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। সেই যুদ্ধ হঠাৎ থেমে যাওয়ায় তাঁর কাছে বহু অব্যবহৃত অস্ত্র ছিল। মালরোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য সেপ্টেম্বর মাসে ওসমানী সাহেব আমাকে ফ্রান্সে যাবার নির্দেশ দেন। ভারত ত্যাগের প্রাক্কালে ভারতীয় পুলিশ আমার ডায়েরিটি এবং কাস্টম কর্তৃপক্ষ দামি ক্যামেরাটা রেখে দিলেন।

প্যারিসের উপকণ্ঠে আঁদ্রে মালরোর প্রাসাদসম বাড়ি। আমার কাছে ছিল ওসমানী সাহেবের একটি চিঠি। চিঠিতে তিনি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে মালরোর সঙ্গে দেখা করতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। চিঠিটি ভারতীয় পুলিশ পরীক্ষার নিমিত্তে রেখে দিয়েছিল। বিষয়টি জেনে লন্ডনস্থ ভারতীয় দূতাবাস চক্রান্ত করে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর ফ্রান্স যাত্রায় বাধার সৃষ্টি করে। আমি একলা আঁদ্রে মালরোর সঙ্গে দেখা করি। সাক্ষাৎ-কাহিনি পরে কখনও লেখার চেষ্টা করব।

প্যারিস থেকে লন্ডন, লন্ডন থেকে কলকাতা ফেরার পরপরই ওসমানী সাহেব আমাকে লক্ষ্ণৌতে গিয়ে মারাত্মকভাবে আহত খালেদ মোশাররফকে দেখে আসতে অনুরোধ করেন। খালেদ মোশাররফ নিজে আমাকে দেখতে চেয়েছেন। খালেদ মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়কের অত্যন্ত প্রিয়জন। কলকাতা থেকে সরাসরি লক্ষ্ণৌর ফ্লাইট না পাওয়ায় দিল্লি হয়ে লক্ষ্ণৌ যাত্রা করি। দিল্লিতে কয়েকজন বিশিষ্ট বাঙালি ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তা সাক্ষাতে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, ‘সব ঠিক হয়ে গেছে, আপনারা ডিসেম্বরে ঢাকা ফিরতে পারবেন। প্রবাসী সরকারের সঙ্গে ভারতের চুক্তি হয়েছে।’ আশ্চর্য হলাম, ওসমানী সাহেব তো আমাকে কিছুই বলেননি।

লক্ষ্ণৌ সেন্ট্রাল কমান্ড হাসপাতালে খালেদ মোশাররফ আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আমাকে লন্ডনে নিয়ে চলুন, ভারতীয়রা আমাদেরকে ভুটান-সিকিম বানাবে। তারা আমাদের চাইনিজ অস্ত্র নিয়ে ভারতীয় নিম্নমানের অস্ত্র দিচ্ছে, আমাদেরকে তাদের পদানত করে রাখার জন্য। আমি বললাম, ‘আপনার জন্য টিকিটের ব্যবস্থা তো আমিই করতে পারি, কিন্তু ভারতীয়রা আপনাকে ভারত ছাড়ার অনুমতি দেবে তো? বিষয়টি আমি সর্বাধিনায়ককে জানাব।’

ফেরার পথে একটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। দিল্লি-কলকাতার একটা ফ্লাইট লক্ষ্ণৌ হয়ে যায়। প্লেনে উঠে দেখি আমার পাশে আবদুস সামাদ আজাদ এমএনএ। তিনি দিল্লি থেকে উঠেছেন। তাঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। তিনি ন্যাপ-ভাসানী দল করতেন। অনেকটা সময় জেলে ছিলেন। চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এলে, ওনার পুলিশ গার্ডকে আমাদের ক্যান্টিনে বসিয়ে ভালো করে খাওয়াতাম এবং সামাদ ভাইকে গোপনে তাঁর আগামসি লেনের বাসায় পাঠিয়ে দিতাম। স্ত্রীর সঙ্গে সারাদিন কাটিয়ে বিকেলে জেলে ফেরত যেতেন। তাঁর চিকিৎসাপত্রে পুনরায় পরের সপ্তাহে চিকিৎসার জন্য আসার নির্দেশ লিখে দেবার ব্যবস্থা করতাম। আমি তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র-সংসদের সাধারণ সম্পাদক, আমার দোর্দণ্ড প্রতাপ, আমি সবার প্রিয়। সামাদ ভাই বললেন, ‘তুমি কিন্তু আমাকে দেখোনি। কাউকে বলবে না। এয়ারপোর্টে আমার গাড়ি থাকবে, সেটা নিয়ে তুমি চলে যেও। আমার জন্য অন্য একটি গাড়ি থাকবে। তুমি আমার কথা কাউকে বলো না।’ আমার অনুসন্ধিৎসা বাড়ল, জিজ্ঞেস করলাম, ‘দিল্লিতে কী করলেন? কোনো চুক্তি হয়েছে কি?’ সামাদ ভাই উত্তর দিলেন না। আমার সন্দেহ দৃঢ় হলো। কলকাতা পৌঁছে সোজা থিয়েটার রোডে ওসমানী সাহেবের রুমে। রেগে বললাম, ‘দেশ তো বেচে দিয়েছেন’। তিনি আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। আমি খালেদ মোশাররফ ও আবদুস সামাদ আজাদের সঙ্গে আমার কথোপকথনের কথা বললাম। আবদুস সামাদ আজাদের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে তাঁদের সঙ্গে আলাপের বিস্তারিত তথ্য জানালাম। আরও জানালাম দিল্লির বিশিষ্টজন আমাকে কী বলেছেন। ওসমানী সাহেব সোজা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেবের ঘরে ঢুকে উচ্চৈঃস্বরে বললেন, ‘You sold the country, I will not be a party to it.’ তাজউদ্দীন সাহেব কর্নেল ওসমানীকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন, নিচু স্বরে কী বললেন, আমি শুনতে পেলাম না। আমি দরজার বাইরে ছিলাম।

কয়েক দিন পরে উভয়ের মধ্যে পুনরায় বাগ্‌বিতণ্ডা ভারতীয় একটি প্রস্তাবনা নিয়ে। ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হলে আইনশৃঙ্খলা স্থাপনের জন্য বেশ কয়েকজন ভারতীয় বাঙালি প্রশাসনিক ও পুলিশ অফিসাররা বাংলাদেশের সব বড় শহরে নির্দিষ্ট মেয়াদে অবস্থান নেবেন। ওসমানী সাহেব বললেন, ‘এটা হতে পারে না, আমাদের বহু বাঙালি অফিসার আছেন। কেউ কেউ পাকিস্তানে আটকা পড়েছেন। এরা নিশ্চয়ই ফিরে আসবেন।’

ওসমানী সাহেবের সঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীদের মতপার্থক্যের কথা জেনে ভারতীয়রা আরও সতর্ক হলেন। ওসমানী সাহেবকে তাঁরা কড়া নজরে রাখলেন। কাগজে-কলমে যৌথ কমান্ডের কথা থাকলেও বস্তুত তাঁরা ওসমানী সাহেবকে একাকী করে দিলেন। ভারতীয়রা সব কমান্ড নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করলেন। ওসমানী সাহেবের সঙ্গে ভারত কর্তৃপক্ষের সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটল।

১৬ ডিসেম্বরের বিমান দুর্ঘটনা, তাৎপর্যটা কী?
পরিকল্পনা মোতাবেক বাংলাদেশি গেরিলাদের সঙ্গে নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী অতর্কিতে সরাসরি যশোর সীমান্তে আক্রমণ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পর্যুদস্ত করে। যৌথ কমান্ড বাহিনীর অন্যতম এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানীর যশোর পরিদর্শনে বাধা সৃষ্টি করা হলে তিনি ছাত্রনেতা কে এম ওবায়দুর রহমান ও আমাকে ৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ যশোরের অবস্থা দেখে আসার জন্য নির্দেশ দেন। ওই দিনই আমরা যশোর ক্যান্টনমেন্ট পৌঁছে রীতিমতো হতভম্ব হয়ে পড়ি। ভারতীয় সেনারা একের পর এক পাকিস্তানি অফিসারদের বাসস্থানের এসিসহ বিভিন্ন সামগ্রী, অস্ত্রাগার, এমনকি যশোর সিএমএইচের যন্ত্রপাতি লুট করছে। বলছে, ‘বেঙ্গল রেজিমেন্ট এত বৈভব ও আরাম-আয়েশে ছিল, কেন বিদ্রোহ করেছে?’ বিষয়টা ফোনে ওসমানী সাহেবকে জানানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে ৭ ডিসেম্বর আমি কলকাতা ফিরে আসি। ওবায়দুর রহমান তাঁর জেলা ফরিদপুরের পথে অগ্রসর হবার সিদ্ধান্ত নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। কলকাতায় পৌঁছে সঙ্গে সঙ্গে আমি পুরো বিষয়টি ওসমানী সাহেবকে জানানোর পর, তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদকে সেটা অবহিত করেন। ভীষণ দুঃখের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘তাহলে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর তফাৎটা কোথায়?’ ওসমানী সাহেব বললেন, ‘বুঝতে পারছেন, ভারতীয়রা আমাকে কেন সরাসরি সমরাঙ্গনে যেতে দিচ্ছে না, তাদের উদ্দেশ্য ভালো না।’

কয়েক দিন অক্লান্ত চেষ্টার পর, কুমিল্লা হয়ে সিলেট পরিদর্শনের জন্য একটি বড় হেলিকপ্টার, সম্ভবত এম-৮ দেয়া হলো ব্রিগেডিয়ার গুপ্তের তত্ত্বাবধানে। ১৩ ডিসেম্বর বিকেলে আমরা কুমিল্লা পৌঁছি। বিশ্রামের জন্য কুমিল্লা সার্কিট হাউসে পৌঁছে আমরা হতভম্ব হয়ে যাই। ওসমানী সাহেবকে হাত বাড়িয়ে ‘রিসিভ’ করছেন কয়েকজন ভারতীয় বাঙালি। একে একে পরিচয় দিলেন, ‘আমি মুখার্জি IAS, আমি গাঙ্গুলী IPS, ইত্যাদি।’ তাঁরা বললেন, ‘কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে গতকাল এখানে পৌঁছেছি কুমিল্লা মুক্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে আমরা শহরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও নিরাপত্তা দেবার জন্য। অবশ্য এখনও কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে যুদ্ধ চলছে।’ ওসমানী সাহেব ভারতীয় অফিসারদের সঙ্গে সার্কিট হাউসে রাত্রি যাপন করতে রাজি না হওয়ায় আমরা ওয়াপদা গেস্ট হাউসে যাই। পরের দিন ভোরবেলা থেকে ওসমানী সাহেব কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকা পরিদর্শনে বিভিন্ন পথে গেরিলাদের পাঠান এবং বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর সেনাদের সম্মুখ আক্রমণে উৎসাহ দান করেন। ফলে পাকিস্তানি সেনাদের মনোবল ভেঙে যায়। পরের দিনই তারা আত্মসমর্পণ করে। খবর পাই, ঢাকার পতন আসন্ন। আমরা ঢাকা যাবার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকি।

১৬ ডিসেম্বর সকালে ব্রিগেডিয়ার গুপ্ত জানালেন, আজ ঢাকায় পাকিস্তান সেনারা আত্মসমর্পণ করবে। ভাবলাম নিশ্চয়ই মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়কের কাছে। কিন্তু আশ্চর্য, ওসমানী সাহেব একবারে চুপ, কোনো কথা বলছেন না। খটকা লাগল।
জেনারেল ওসমানীর এডিসি আমাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে শেখ কামাল আমাকে বলল, ‘স্যার কখন রওনা হবেন, তা তো বলছেন না। জাফর ভাই, আপনি যান, জিজ্ঞেস করে সময় জেনে নিন। অধীর আগ্রহে আমরা সবাই অপেক্ষা করছি।’ আমি গিয়ে জিজ্ঞেস করায় ওসমানী সাহেব বললেন, ‘I have not yet received PM’s order to move to Dacca.’ আমি বললাম, ‘আপনাকে অর্ডার দেবে কে? আপনি তো মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক।’ ওসমানী বললেন, ‘I decide tactics, my order is final for firing, but I receive orders from the cabinet through PM, Mr. Tajuddin Ahmed.’ কথাগুলো বললেন অত্যন্ত বিষণ্ন কণ্ঠে। পরিষ্কার হলো তিনি আসন্ন ঢাকা পতনের সংবাদ জানেন এবং প্রবাসী সরকারের নির্দেশের অপেক্ষা করছেন। আমাদের অস্থিরতা বাড়ছে আর বাড়ছে। শেখ কামাল বারবার আমাকে চাপ দিচ্ছে পুনরায় ভালো করে বুঝিয়ে বলে ওসমানী সাহেবকে রাজি করাতে ঢাকা রওনা হবার জন্য। ঘণ্টাখানেক সময় পরে, পুনরায় ওসমানী সাহেবের সামনে দাঁড়ানোর পরপরই তিনি অত্যন্ত বেদনার্ত কণ্ঠে যা বললেন তার মর্মার্থ হলো, ‘আমার ঢাকার পথে অগ্রসর হবার নির্দেশ নেই। আমাকে বলা হয়েছে পরে প্রবাসী সরকারের সঙ্গে একযোগে ঢাকা যেতে, দিনক্ষণ তাজউদ্দীন সাহেব জানাবেন। গণতন্ত্রের আচরণে যুদ্ধের সেনাপতি প্রধানমন্ত্রীর অধীন, এটাই সঠিক বিধান।’ মনে হলো, তিনি জেনেশুনে বিষপান করছেন। পরে ব্রিগেডিয়ার গুপ্তকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সিলেটের কী অবস্থা?’ ব্রিগেডিয়ার গুপ্ত জানালেন ‘সিলেট ইজ ক্লিয়ার’। ওসমানী বললেন, ‘তাহলে চলুন আমরা সিলেট যাই, সেখানে গিয়ে আমার পিতামাতার কবর জিয়ারত করব, শাহজালালের পুণ্য মাজারে আমার পূর্বপুরুষরা আছেন।’ ওসমানী সাহেব শেখ কামালকে ডেকে সবাইকে তৈরি হতে বললেন। আধাঘণ্টার মধ্যে আমাদের আকাশে নিরুপদ্রব যাত্রা। ভারতীয় এম-৮ হেলিকপ্টারে সিলেটের পথে চলেছি। পরিষ্কার আকাশ। হেলিকপ্টারের যাত্রী জেনারেল ওসমানী ও তাঁর এডিসি শেখ কামাল, মুক্তিবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল এম এ রব এমএনএ, রিপোর্টার আল্লামা, ব্রিগেডিয়ার গুপ্ত, ভারতীয় দুই পাইলট এবং আমি। কেউ কথা বলছেন না, সবাই নীরব।

অতর্কিতে একটি প্লেন এসে চক্কর দিয়ে চলে গেল। হঠাৎ গোলা বিস্ফোরণের আওয়াজ, ভিতরে জেনারেল রবের আর্তনাদ। পাইলট চিৎকার করে বলল, ‘উই হ্যাভ বিন অ্যাটাকড।’ রবের ঊরুতে আঘাতের পরপরই তার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলো। আমি এক্সটার্নাল কার্ডিয়াক ম্যাসাজ দিতে শুরু করি। পাইলট চিৎকার করলেন, ‘অয়েল ট্যাংক হিট হয়েছে, তেল বেরিয়ে যাচ্ছে, আমি বড়জোর ১০ মিনিট উড়তে পারব।’ কো-পাইলট গুনতে শুরু করলেন– ওয়ান, টু, থ্রি... টেন... টুয়েন্টি ... থার্টি ... ফোরটি ... ফিফটি ... নাইন সিক্সটি-ওয়ান মিনিট গন। এভাবে মিনিট গুনছেন উদ্বিগ্ন চিন্তিত সহ-পাইলট। অন্য পাইলট ধীরস্থিরভাবে পাইলটের আসনে বসা। ওসমানী সাহেব লাফ দিয়ে উঠে, অয়েল ট্যাংকের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করলেন, ‘জাফরুল্লাহ্, গিভ মি ইয়োর জ্যাকেট’। আমি আমার জ্যাকেটটা ছুড়ে দিলে, ওসমানী সাহেব সেটা দিয়ে তৈলাধারের ছিদ্র বন্ধের চেষ্টা করতে থাকলেন। বললেন, ‘Do not worry my boys, I know Sylhet like the palm of my hands.’ কার্ডিয়াক ম্যাসাজ দেবার ফাঁকে ফাঁকে আমি ভাবছিলাম, আজ ১৬ ডিসেম্বর, দেশ স্বাধীন হবে। কিন্তু আজ আমরা সবাই কিছুক্ষণের মধ্যে মারা যাব। আগামীকাল পত্রিকায় শোক সংবাদ কলামে কী লেখা হবে? বীরের মৃত্যু, অপঘাতে মৃত্যু? কার গোলাতে এই দুর্ঘটনা? পাকিস্তানের সব বিমান তো কয়েক দিন আগেই ধ্বংস হয়েছে কিংবা গ্রাউন্ডেড করা হয়েছে। তাহলে আক্রমণকারী বিমানটি কাদের? গোলা ছুড়ে সেটি কোথায় চলে গেল? গৌহাটির পথে? চিন্তা বিঘ্নিত হলো ওসমানী সাহেবের চিৎকারে। নিচে একটা জায়গার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘Land here’। আরও বললেন, ‘Let me land first to taste the enemy attack if there is one’। লাফ দিয়ে তিনি নামলেন, ‘ধরুন’ বলে আমি জেনারেল রবকে ছুড়ে দিলাম, সঙ্গে নামলাম নিজেও। আমার পিছনে পিছনে অন্যরা লাফিয়ে নামলেন। হেলিকপ্টারটা আমাদের চোখের সামনে দাউ দাউ আগুনে পুড়ছে।

হঠাৎ গ্রামবাসী এসে ওসমানী সাহেবকে ঘিরে ধরল, ‘দুশমন আইছে রে বা দুশমন আইছে, দুশমনরে ধর।’ পরপরই ভালো করে তাকিয়ে দেখে হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, ‘আমাদের কর্নেল সাব রে বা।’ তারপর তাঁকে নিয়ে নাচতে শুরু করল।
জনতার বিজয় উল্লাসে যেন জেনারেল রবের ঘুম ভাঙল, তিনি চোখ খুলে তাকালেন, দেখলেন আমার মুখে হাসি। জেনারেল রব সবাইকে বলতেন, ‘ডা. জাফরুল্লাহ্ আমাকে দ্বিতীয় জীবন দিয়েছেন।’ হেলিকপ্টারে ব্রিগেডিয়ার গুপ্ত এবং শেখ কামালও সামান্য আহত হয়েছিলেন।

ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কখনও এই ঘটনার তদন্ত প্রকাশ করেননি। ভারত সরকার সব সময় এই ঘটনার ব্যাপারে নীরব, নিশ্চুপ।

স্বাধীনতার বিজয় উল্লাসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারও দুর্ঘটনাটির তদন্তের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব উপলব্ধি করেননি। সবাই উদ্বিগ্ন, প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবের দেশে জীবিত প্রত্যাবর্তনের কামনায়।

আবু সাঈদ চৌধুরীর পরিশ্রমের ফসল
একাত্তরের ২৬ মার্চ বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জেনেভা থেকে লন্ডন পৌঁছান। ঢাকার ধ্বংসযজ্ঞের আরও বিস্তারিত সংবাদ দেখলেন পরের দিন বিবিসি ও লন্ডন টাইমস পত্রিকায়। আবু সাঈদ চৌধুরীর সাথে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৬২ সালে। তখন তিনি পাকিস্তান হাইকোর্টের নবীন বিচারপতি। আমার ভাইয়ের শ্বশুর বিচারপতি ইমাম হোসেন চৌধুরী তখন হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি। দেশে আইয়ুব খানবিরোধী আন্দোলন চলছে। এরই মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপিত হচ্ছে। আইয়ুব খান-মোনেম খানের কোনো মন্ত্রীকে প্রধান অতিথি করা যাবে না। প্রধান বিচারপতিকে প্রধান অতিথি করার সিদ্ধান্ত হয়। আমি আপত্তি তুলি, কারণ বিচারপতি ইমাম হোসেন চৌধুরী অত্যন্ত রক্ষণশীল প্রাচীনপন্থি এবং সামরিক সরকারঘেঁষা। তাই তাঁর পরিবর্তে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জুনিয়র, পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের স্পিকার টাঙ্গাইলের আব্দুল হামিদ চৌধুরীর পুত্র ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি, ব্যারিস্টার আবু সাঈদ চৌধুরীকে প্রধান অতিথি হবার জন্য অনুরোধ জানাই। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র-সংসদের রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানে একটি জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দেন; যা খুব প্রশংসিত হয়েছিল।

২৮ মার্চ আমি লন্ডনের বালহাম এলাকায় গিয়ে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। সামান্য পরিচয় দিতেই উনি আমাকে চিনলেন, বললেন তিনি সত্বর ঢাকা ফিরে যাচ্ছেন। তাঁর ছাত্রদের মারা হচ্ছে, বিহিত করতে হবে। আমি বললাম, ‘সর্বনাশ, এত বড় ভুল করবেন না। ঢাকায় প্রতিবাদ করতে গেলে আপনার জীবননাশের যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। আপনি বরং লন্ডনে থেকে বাংলাদেশের সপক্ষে জনমত গড়ে তুলুন। ব্রিটেনে আপনার উপস্থিতির একান্ত প্রয়োজন রয়েছে। প্রবাসী বাঙালিদের আপনি নেতৃত্ব দিন। প্রবাসী বাঙালিরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, উপদলে বিভক্ত। প্রগতিশীল বাম সংগঠনগুলো বিভিন্ন মতবাদে বিচ্ছিন্ন। আপনি হবেন সম্মিলিত প্রবাসী বাঙালিদের নেতা।’ তিনি হেসে বললেন, ‘গত দু’দিনে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এসেছিলেন এবং তাদের সঙ্গে যোগদানের জন্য অনুরোধ করেছেন। আপনি সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলছেন।’ বিচারপতি চৌধুরী ওই দিনই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে ইস্তফা দেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বার্থে সক্রিয়ভাবে সব প্রবাসী বাঙালিদের একত্রিত হওয়ার মূল দায়িত্ব পালন শুরু করেন। তাঁর জীবনের সাধনা দাঁড়াল বাংলাদেশের পক্ষে ব্রিটেন, ইউরোপ ও আমেরিকায় জনমত সৃষ্টি এবং আমাদের নেতা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন বাঁচানো।

এপ্রিল থেকে জুলাই– চার মাস বিচারপতি চৌধুরী অক্লান্ত পরিশ্রম করে চরকির মতো এক শহর থেকে অন্য শহরে ঘুরলেন, দেখা করলেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর, ডিন এবং বিচারপতিদের সঙ্গে। কয়েকবার হাজির হলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে, সাক্ষাৎ করলেন মন্ত্রী ও ছায়া-মন্ত্রীদের সঙ্গে, দীর্ঘ আলোচনা করলেন রক্ষণশীল দলের নেতা স্যার জেরাল্ড নবারো, রেভারেন্ড ইয়ান পেইসলি এবং বামপন্থিদের কণ্ঠস্বর ইয়ান মির্কাডো ও এন্ড্রু ফাউলসের সঙ্গে।

আবু সাঈদ চৌধুরী একাধারে বিচারপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সে কারণে গণ্যমান্য সবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা তাঁর জন্য সহজ হয়েছিল। ২৪ এপ্রিল তাঁর আত্মবিশ্বাস, দৃঢ়তা ও নিরপেক্ষতায় বিলেতের কভেন্ট্রি শহরে গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি’ এবং কর্মপরিচালনার জন্য পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি স্টিয়ারিং কমিটি। আজিজুল হক ভুঁইয়া মনোনীত হলেন আহ্বায়ক। ওই সভার সভানেত্রী ছিলেন শিক্ষিকা লুলু বিলকিস বানু।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও সোশ্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সাধারণ সম্পাদক মার্টিন এনালস ও হ্যানস ইয়ান্টসেককে শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য চেষ্টা করতে রাজি করালেন। আবু সাঈদ চৌধুরীর পরামর্শে ব্রিটিশ এমপি জন স্টোনহাউজ, ব্রুস ডগলাসম্যান ও পিটার শোর ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্যদের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বর নিষ্ঠুরতার বিষয়ে আলোচনার জন্য ১৪ মে তারিখে পার্লামেন্টের আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করতে সমর্থ হন। আলোচনার আগের দিন ‘নীরব বিবেক’ নামে দৈনিক গার্ডিয়ান পত্রিকা একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে।

উল্লেখ্য যে, মার্চে ঢাকায় ধ্বংসযজ্ঞের বিবরণ দিতে গিয়ে বিলেতের অবজারভার পত্রিকায় বাঙালি চরিত্রের বর্ণনা দেয় এইভাবে যে, দু’বাঙালি দু’জনে আলাদা দুই দল গঠন করে আবার দু’জন মিলে তৃতীয় দল তৈরি করে। বাঙালিরা শান্তিপ্রিয় কিন্তু ভীতু প্রকৃতির। তারা এবার ক্ষেপেছে, রুখে দাঁড়াবে, হয়তোবা অচিরেই পৃথিবীতে একটি নতুন দেশ তৈরি হবে।

ব্রিটেনের ছায়া-সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেনিস হিলি পার্লামেন্টে শেখ মুজিবের মুক্তির ওপর বিশেষ জোর দেন এবং বলেন ‘শেখ মুজিবই সমস্যা সমাধানের চাবিকাঠি।’ প্রবাসী সরকারের পরামর্শে ২৪ মে বিচারপতি চৌধুরী গ্লাসগো থেকে নিউইয়র্ক গেলেন। শুরু করলেন একে একে অনেক সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ। যুক্তিতর্ক দিয়ে বোঝালেন তাঁদেরকে বাংলাদেশের পক্ষে থাকার জন্য। বললেন, শেখ মুজিব তো তাঁদেরই মতাদর্শের মানুষ ও পুঁজিবাদের প্রবক্তা, উপমহাদেশে শান্তির জন্য শেখ মুজিবের অনতিবিলম্বে মুক্তি অত্যাবশ্যক।

বিচারপতি চৌধুরীর প্রচেষ্টায় জুন মাসে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের চারজন বিশিষ্ট সদস্য– কনজারভেটিভ দলের জেমস রেমস্টেন ও টবি জোসেফ এবং শ্রমিক দলের আর্থার বটমলি ও রেজিনান্ড প্রেনটিস– বাংলাদেশ ও ভারত সফর করে যে তথ্য প্রকাশ করেন তাতে বিশ্ববাসীর বিবেক জাগ্রত হয়।

২৬ জুলাই তারিখে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশের মানচিত্র ও শেখ মুজিবের ছবিযুক্ত দুটি ডাকটিকিট উন্মোচিত হয়। ১ আগস্ট ট্রাফলগার স্কয়ারের জনসভায় লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাস স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

১০ আগস্ট পাকিস্তান সরকার রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে ফাঁসি দাবি করে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু করে। চিন্তিত বিচারপতি চৌধুরী বিভিন্ন সহানুভূতিশীল রাষ্ট্রের সহায়তায় জাতিসংঘে শেখ মুজিবের বিচার বন্ধের দাবি উপস্থাপন করলেন এবং পুরো সেপ্টেম্বর মাস পরিভ্রমণ করলেন একে একে স্ক্যান্ডিনিভিয়ান দেশসমূহ– নরওয়ে, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড ও সুইডেন। দেখা করলেন ওইসব দেশের প্রধান বিচারপতিদের সঙ্গে। অর্থনীতিবিদ গুনার মিরডাল শেখ মুজিবের মুক্তির লক্ষ্যে সুইডেনস্থ বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিতে রাজি হলেন। অসলো বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানের গণহত্যা সংক্রান্ত কমিশন গঠনে উৎসাহিত হলো।

ভারতের দৃষ্টি এড়িয়ে বাংলাদেশকে সমর্থন ও স্বীকৃতিদানের জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম যৌথভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রথম চিঠিটি লেখেন যেটি ২৬ মে ১৯৭১ বার্লিন থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে পাঠানো হয়। ২৮ সেপ্টেম্বর খন্দকার মোশতাক কলকাতাস্থ মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে বৈঠক করে বলেন যে, শেখ মুজিবের মুক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেয়ে কম মূল্যবান নয়। এই আলোচনায় সৈয়দ নজরুল ইসলামের সম্মতি ছিল। শোনা যায় আওয়ামী লীগের জহিরুল কাইয়ুমসহ অপর ৪৩ জন জাতীয় সংসদ সদস্য আলোচনা সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন।

খন্দকার মোশতাক মার্কিন দূতাবাসকে বুঝিয়েছিলেন, শেখ মুজিববিহীন বাংলাদেশ হবে পুরোপুরি কমিউনিস্ট নিয়ন্ত্রিত ভারতের করদ রাজ্য। অক্টোবর মাসে ভারত প্রবাসী সরকার ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন আলোচনার সংবাদ পেয়ে ইন্দিরা গান্ধীর পররাষ্ট্র-বিষয়ক পরামর্শদাতা ডি.পি. ধর কলকাতায় এসে মোশতাককে বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দেন এবং প্রবাসী সরকারকে পরামর্শ দেন। আবদুস সামাদ আজাদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হন।

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী প্রকৌশলী এফ আর খান ও অন্যদের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনকে প্রভাবিত করেন শেখ মুজিবের বিচার স্থগিতের জন্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা থেকে রেহাই দিয়ে ফাঁসির দণ্ড থেকে মুক্তি দেবার জন্য ইয়াহিয়া খানকে অনুরোধ করেন। মার্কিন প্রশাসন বিশ্বাস করে যে, কেবল শেখ মুজিবই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে কমিউনিস্ট ও ভারতের কবল থেকে মুক্ত রাখতে পারবেন। নভেম্বর মাসে পাকিস্তান শেখ মুজিবের বিচার প্রক্রিয়া স্থগিত করে।

১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। ২০ ডিসেম্বর পাকিস্তানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়। জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবকে বিনা শর্তে মুক্তি দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন, ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে নিয়ে কনফেডারেশন গঠনের প্রত্যাশায়।

১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি রাত ৩টায় পাকিস্তান এয়ারলাইনসের বিমানে ইসলামাবাদ থেকে লন্ডনের পথে যাত্রা করেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। জুলফিকার আলী ভুট্টো বিমানবন্দরে উপস্থিত থেকে তাঁকে বিদায় জানান এবং ফোনে সংবাদটা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথকে জানিয়ে দেন। ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের অনুরোধে অসম্মত হয়ে, ভারতীয় বিমানের পরিবর্তে ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ারফোর্সের প্লেনে বাংলাদেশের প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন নয়াদিল্লি হয়ে। তারিখটি ছিল সোমবার, ১০ জানুয়ারি ১৯৭২। ১২ জানুয়ারি শেখ মুজিব গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তাজউদ্দীন আহমদের পদাবনতি ঘটে। তিনি অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী হন। পাকিস্তানকে সহায়তা করার অপরাধে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বরখাস্ত আইয়ুব খানের প্রিয়পাত্র এস.এম.এস. সফদর পিএসপি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে তাঁর পূর্বপদে যোগ দেন একই দিনে, ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে।   

[সমাপ্ত]

বিষয় : জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী

মন্তব্য করুন