ঢাকা সোমবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩

শ্রদ্ধাঞ্জলি

ময়মনসিংহের প্রিন্সিপাল স্যার

ময়মনসিংহের প্রিন্সিপাল স্যার

শেখ হাফিজুর রহমান

প্রকাশ: ২৯ আগu ২০২৩ | ১৮:০০

আমি তখন সদ্য বদলি হয়ে ময়মনসিংহ সদরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিসেবে যোগদান করেছি। আসবার পরপরই প্রিন্সিপাল স্যারকে কল দিতেই তিনি আমাকে ময়মনসিংহে স্বাগত জানান এবং সব দিক থেকে সহযোগিতা করবেন বলে আশ্বস্ত করেন। সেদিন স্যারের অভিভাবকসুলভ আচরণ ও আন্তরিকতায় ভীষণ মুগ্ধ হয়েছিলাম। বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদ ও সাবেক ধর্মমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক অধ্যক্ষ মতিউর রহমান স্যার গত ২৭ আগস্ট ৮১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন (ইন্নালিল্লাহি … রাজিউন)।
একদিন স্যার নিজেই কল দিয়ে বললেন, “ব্যস্ততার কারণে আপনার সাথে তো আর কথা হলো না। আমি সৌদি থেকে আপনার জন্য খেজুর, জায়নামাজ, তসবিহ উপহার পাঠালাম। উপহারটি গ্রহণ করিয়েন।” আমি তো অবাকই হলাম। সাধারণত উপহার পাঠিয়ে সৌজন্য কল করার নজির খুব বেশি দেখা যায় না। একদিন ফোন করে স্যারের নাটকঘর লেনের বাসভবনে গিয়ে দেখি, লোকজনের ভিড়। আমাকে দেখে সবাইকে বিদায় করে ভেতরের একটি কক্ষে নিয়ে গেলেন। ময়মনসিংহের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, ব্রহ্মপুত্র নদের অপর পারে প্রস্তাবিত বিভাগীয় শহর, নবগঠিত সিটি করপোরেশনের সীমানা বিরোধ, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন অনুদান, ময়মনসিংহের রাজনীতি, ব্রহ্মপুত্র নদ খনন ইত্যাদি বিষয়ে দীর্ঘক্ষণ স্যারের সঙ্গে আলোচনা হলো। স্যারের পরামর্শের কারণেই প্রায় ১০ বছর ঝুলে থাকা সদর উপজেলার ছয়টি ইউনিয়ন ও ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন খুব দ্রুত সময়ে সম্পন্ন করা গেছে।

তা ছাড়া ময়মনসিংহবাসীর বহু প্রতীক্ষিত ব্রহ্মপুত্র নদের অপর পারে বিভাগীয় অফিস কমপ্লেক্স নির্মাণে বেশ কয়েকটি বাধা ছিল। এসবের সমাধানে বসতভিটা রক্ষা কমিটিসহ অনেক পক্ষের সঙ্গে অনেকবার বসতে হয়েছে। বিভাগীয় শহর নির্মাণ ময়মনসিংহ এলাকার প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পের মধ্যে অন্যতম ছিল বিধায় আমরা প্রিন্সিপাল স্যারের কাছ থেকে আন্তরিক সহায়তা ও গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ পেয়েছি।
ময়মনসিংহের প্রাণখ্যাত ব্রহ্মপুত্র নদে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নাব্য ফিরিয়ে আনা, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন অনুদান, ময়মনসিংহ সদর উপজেলা পরিষদের সীমানাপ্রাচীর ও গেট নির্মাণ, ময়মনসিংহ শহরের ও ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবৈধ উচ্ছেদ কার্যক্রমের ব্যাপারেও স্যারকে সব সময় অবহিত রাখতাম এবং স্যার সব সময় সুপরামর্শ ও মতামত দিতেন। চেয়ারম্যান আশরাফ হোসাইনের সার্বিক সহায়তায় উপজেলা পরিষদের বাউন্ডারি নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রিন্সিপাল স্যারের অবদানের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ উপজেলা থেকে আকুয়া মোড়লবাড়ী পর্যন্ত সড়কটি বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ মতিউর রহমান স্যারের নামে করেছিলাম।

ময়মনসিংহ জেলা ও উপজেলায় মডেল মসজিদ নির্মাণের স্থান নির্বাচন নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হলে স্যারের পরামর্শেই সেটি সমাধান করতে পেরেছিলাম। এদিকে মুক্তিযোদ্ধা ভবন নির্মাণের জন্য নির্ধারিত জায়গায় কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধার অস্থায়ী শেড ও দোকান থাকায় ঠিকাদার নির্মাণকাজ শুরু করতে পারছিলেন না। এ ক্ষেত্রেও প্রিন্সিপাল স্যার বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন এবং পরে আমরা বলাশপুরের স্মৃতিস্তম্ভের পাশে মুক্তিযোদ্ধা ভবন নির্মাণকাজ শুরু করতে পেরেছিলাম।
স্যারের স্মরণশক্তি ছিল খুবই প্রখর, যার প্রমাণ পেয়েছি মুক্তিযোদ্ধা যাচাইয়ের সময়। তিনি একাত্তরের রণাঙ্গনের সকল সহযোদ্ধার নাম এত বছর পরও মুখস্থ বলতে পারতেন; মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন অপারেশনের কথা হুবহু বলতে পারতেন। মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইসহ অন্য সব ক্ষেত্রে স্যার নিরপেক্ষ মতামত প্রদান করতেন এবং স্যারের পক্ষপাতহীন
মতামত আমাদের সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহজ হতো।
নিরহংকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ মতিউর রহমান স্যারের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

শেখ হাফিজুর রহমান:
সিনিয়র সহকারী সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয় (সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ময়মনসিংহ সদর)
sajall13@gmail.com

আরও পড়ুন