প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২৩ । ০০:০০ । প্রিন্ট সংস্করণ
ফলো করুন-
রোদে ছায়া বুজে আছে দেখি
এই নিরজন কানাকানি
আপাতত শেষ হয়ে গেল
সুনামগঞ্জের সীমান্তঘেঁষা গ্রাম চাইর গাঁওয়ে ২০২২ সালের ১৪ জুলাইয়ের শেষ বিকেলে বাউল মকদ্দস আলম উদাসীকে গোর দিয়ে আসার পর মধ্যরাতে পরের তিনটি পঙ্ক্তি কেন যে মাথায় এসেছিল জানি না। উদাসী যেখানে দেহ রেখেছিলেন, মধ্য জুলাইয়ের গনগনে রোদে ঘেমে-নেয়ে এবড়োখেবড়ো রাস্তা পার হয়ে আমরা যখন সেখানে পৌঁছাই, তখন বাড়ির উঠোনে অন্যরকম রৌদ্র-ছায়ার খেলা। কত কিছু যে মনে পড়ছিল আমার : উদাসী প্রায়ই বলতেন, ‘জানাজানির পরে আরও বহু কানাকানি থেকে যায়।’ কিন্তু আমাদের কানাকানি তো শেষ হলো না। তাঁর আগ্রহের ফকির মজির উদ্দিন আহমদের ফকিরি গ্রন্থ ‘ভেদ জহুর’ তো বের হয়নি আজও। একবার সৈয়দ শাহনূরের কয়েকটি কালাম নাগরী থেকে লিপ্যন্তরিত করে দিয়েছিলেন, যাতে সহজেই তাঁকে নিয়ে লিখে ফেলতে পারি কোনো গদ্য। বাউল রহমত উল্লার গানও আজও সংকলিত হলো না। এ ছাড়া তাঁর নিজের লেখা কয়েক হাজার গানও যে অমুদ্রিত রয়ে গেল, তার কী হবে?
নশ্বর দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য যে মোট বাঁধতে শুরু করেছিলেন উদাসী, তা কিছুটা আগে থেকেই একটু-আধটু বোঝা যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে অসুস্থতা বেড়ে গেলে কল দিয়ে আমাকে ও আরও দু-একজনকে তাঁর পাণ্ডুলিপি গ্রহণ করবার কথা বলতেন। করোনা শেষ হতে না হতেই একদিন সুন্দর হস্তাক্ষরে তৈরি করা অন্য এক মহাজনের একটি পাণ্ডুলিপিও হাতে দিয়ে গেলেন, যার ফটোকপি রাখারও প্রয়োজন বোধ করলেন না। শেষমেশ, ২০২২ সালের সিলেটের ভয়াবহ বন্যার সময় আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছেই সম্ভবত পানি কমার অপেক্ষা করছিলেন। পানি কমতেই যে-স্বজনের কাছ থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছিলেন সেখানে না-গিয়ে সরাসরি চাইর গাঁও ভাগনির বাড়িতে পৌঁছে উঠোনের পাশে কবরের জায়গাটিও দেখিয়ে দিয়েছিলেন। আসলে বেশ আগে থেকেই নানারকম রোগব্যাধি তাঁকে কাহিল করেছিল। শুভানুধ্যায়ীদের চেষ্টায় বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। কিন্তু ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা বললেই বলতেন, ‘যে-দেহ বছর বছর ধরে বয়ে বেড়াচ্ছি আমি, ডাক্তার এক দিনেই কি তার খবর আমার চেয়ে বেশি জেনে ফেলবে? তাঁর এই অবিশ্বাস আর সপ্রশ্ন জিজ্ঞাসার জবাব কে দেবে?
এত দিনের পুরোনো দেহ, যাকে তিনি পঁচাত্তর বছর ধরে বয়ে নিয়ে বেড়ালেন, তার সম্পর্কে নিশ্চয়ই তাঁর অগাধ জ্ঞান ছিল, থাকবারই কথা। নাহলে এত এত নিখুঁত দেহতত্ত্ব কীভাবে রচনা করলেন উদাসী। মনে পড়ল তাঁর ‘হায় রে আমার ম্যাচ লাইটে/ কিতার লাগি আগুন উঠে না/ জংকারেণু ধরিলিছে/ চাক্কায় আর পাত্থর কাটে না’ গানটির কথা। কিন্তু আমার কাছে এইসব নিখুঁত দেহতত্ত্বের চেয়ে যে-গানগুলোতে রাগ আর প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে সেগুলোই বেশি প্রিয়। যেমন :
ও তুই পরার জমিন খেত করছ কেনে
যার জমিন তার বইট্টা থাখউক
ভালা বুরা তার জানে ॥
চাষ করি খাছ খাজনা দেছ না
ই কথানু হখলর জানা
কোন মালিকর মালিকানা
আইনে ইতা দেখবনে ॥
ইনফরম গায় হাতে নোটিশ
আইবনে সরকারি পুলিশ
মারতে মারতে কবর পালিশ
থানায় বাইন্ধা নিবনে ॥
কুবাই থাকি করছ কিতা
কেমনেদি হারাইছছ মাথা
মকদ্দসর পলর যাতা
হেষে ইতা বুঝবেনে ॥
পীরমুর্শিদ-মানা কোনো বাউলের গানে রাগের প্রকাশ এমনি এমনি ঘটে না, তার পেছনে সামাজিক নানাবিধ কারণ থাকে। একদিন বললেন, ক্যারমের ঘুঁটি আঘাত খেতে খেতে যতক্ষণ না নেটে লেগেছে ততক্ষণ তার গায়ে আঘাত পড়তেই থাকে। শাহজালালের মাজারের পেছনের এক রেস্তোরাঁর আলো-আঁধারিতে বসে এই কথাগুলো যখন বলেছিলেন উদাসী, তখন জানতে পারি, দীর্ঘদিন ধরে বাইরে-থাকার কারণে স্বজনেরা তাঁর জায়গাজমি কেড়ে নিয়ে ভিটেছাড়া করেছে এবং তা নিয়ে কীভাবে তাঁর পারিবারিক অশান্তিও তৈরি হয়েছে। ২০০৩ সালে বা তার কাছাকাছি সময়ে কথাগুলো যখন বলেছিলেন তখন তাঁকে অনেকটা ক্ষুব্ধ আর সরবই মনে হয়েছিল, কিন্তু আমার মনে পড়ল গত শতকে ১৯৯৯ সালের আরও এক আশ্চর্য সন্ধ্যার কথা।
অনেক দিন পর উদাসী ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো, কিন্তু তাঁর মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হচ্ছে না। আমার আবার সেই রাতেই অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্যসহ বগুড়ায় নিসর্গ-আয়োজিত জীবনানন্দ জন্মশতবর্ষ অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য রাতের ট্রেন ধরার কথা। তবু আমি কোনোরকম তাড়াহুড়ো না করে মুখোমুখি বসে রইলাম। দীর্ঘক্ষণ পর তিনি যা বললেন, তা শুনে আমি নির্বাক। দীর্ঘদিন বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করে উদাসী তাঁর গ্রামে ঢোকার সময় সেদিন শুনলেন, কয়েক দিন আগেই তাঁর ছেলেটি মারা গেছে। তিনি আর গ্রামে ঢুকলেন না। কোন মুখে কী নিয়ে বাড়িতে যাবেন? তাই আর গ্রামে না ঢুকে মন শান্ত করার জন্য এখানে এসেছেন।
এর কিছুদিন পর অন্য ছেলে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে চলচ্ছক্তি হারিয়ে তাঁরই অবর্তমানে কিছুদিন ভিক্ষা করল, অল্প বয়সে গান লেখাও শুরু করল। পরে অপুষ্টিতে ভুগে অচিরে সেও বিদায় নিল। কয়েক দিন পর উপযুক্ত ব্যবস্থার অভাবে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মেয়েটিও বিদায় নিল। এরও কয়েক দিন পর শাহপরানের ওরসে যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর স্ত্রীও চলে গেলেন। অবিরাম মৃত্যু ঘটনায় উদাসীকে তখন কিছুদিন কিছুটা বিষাদ-বিহ্বল আর অন্য গ্রহের বাসিন্দা মনে হতো। একদিন বললেন, ‘নতুন যে-জায়গায়ই যাই, মনে হয় সেখানে আগে গেছি, সবকিছু কেমন যেন চেনা চেনা লাগে।’ উদাসী কী কী ভেবে যেন একটি গানে লিখেছিলেন, ‘আমি স্ত্রী-সুখী হইলাম না রে’।
সংসারধর্ম পালন করেও এ-অঞ্চলের বাউলরাও যে বাউল, তার তত্ত্বগত ব্যাখ্যা রয়েছে শাহ আবদুল করিমের একটি গানে, আর সেই তত্ত্বেরই বাস্তব উদাহরণ যেন মকদ্দস আলম উদাসী। আধ্যাত্মিক গানের বাইরে তাঁর অসংখ্য আঞ্চলিক গানে সংসার আর বৈরাগ্যের যে-টানাপোড়েন আর দ্বন্দ্ব ফুটে উঠেছে, তার তুলনা বাংলা লোকগানে সুলভ নয়। উদাসী নিজে বেমুর্শিদা ছিলেন না। তাঁর পীরের নাম সুকুর আলী চিস্তী। পীরের খেলাফতি পেলেও তিনি নিজে মুরিদ বানাতে অনাগ্রহী ছিলেন। একদিন বললেন, ‘একটা মুরগি পালার সামর্থ্য আমার নাই, মুরিদ পালব কী করে?’ মনে হয়, পুরোদস্তুর আধ্যাত্মিক জীবন-দর্শন মনে লালন করেও সেই আধ্যাত্ম ধারাকেই যেন অস্বীকার করে বসেছিলেন উদাসী। আমাদের মনে পড়তে পারে করিমের সেই বিখ্যাত তত্ত্ব-গানটির কথা :
মন পাগলা তুই লোকসমাজে
লুকি দিয়ে থাক
মনমানুষ তোর মনমাঝে
আছে রে নির্বাক।
লোকসমাজে লুকিয়ে-থাকা এই সহজ মানুষ মকদ্দস আলম উদাসীকে ভালোভাবে জানবার আগেই এভাবে যে হারিয়ে ফেলব তা ভাবিনি।
তবে এমন অনেক সহজ মানুষই আমাদের আশেপাশে ঘোরেন, যারা পোশাকের আড়ালে নিজেদের ঢেকে রাখেন বলে একপ্রকার মওজুফ থেকেই একসময় হারিয়ে যান। করিম লিখেছিলেন, ‘অন্তর্যামী আছে যেজন/ সে জানে তোর অন্তর কেমন/ চায় না বাহিরের আবরণ/ বাহিরের পোশাক’।
আমার শিক্ষক মাস্টার আবদুল মতিন যে আধ্যাত্মিক গান লেখেন এবং আধুনিক পোশাক-আশাকের আড়ালে তিনি যে এক পাক্কা ফকির, সে কথা যখন জানলাম তখন তিনি জীবনের শেষপ্রান্তে এসে পৌঁছেছেন। আর তখনই কিছুটা আন্দাজ করতে পারি, গ্রামের ভেতরের বাড়ি ছেড়ে এসে মাগুরা নদীর পাড়ে কেন ঘর তুলেছিলেন। ১৯৯৮ সালের ১৭ জুনে নেওয়া সাক্ষাৎকারের এক প্রশ্নের জবাবে আবদুল মতিন আমাকে বলেন, ‘আমি গ্রামে থাকি বটে কিন্তু ওয়াজের জলসায় যেমন যাই না, গানের জলসায়ও যাই না।’ তখনও বিদ্যুৎ-সংযোগহীন সেই বাড়িটিতে খোলা হাওয়ার কোনো অভাব ছিল না, আর সেই পরিবেশে সেদিন তাঁর কাঁপা কাঁপা গলায় বেশ কয়েকটি গান গেয়েছিলেন। আজ আমার মনে পড়ছে সেই গানটির কথা :
মনু গাঙের তিনটি দাঁড়া নাও বাইমু কোন দাঁড়ায়
অবুঝ মনা বোঝ না পায় ঠেকিয়াছে বিষম দায় ॥
কোন দাঁড়ায় মাজনের বাড়ি কোন দাঁড়ায় ডাকাতের আরি
কোন দাঁড়ায় আপন ঠিকানা কে কান্ডারি আমার নায় ॥
...
কে ধরাইল এমন পাড়ি কে ভাসাইল আমার তরী
দেখি না তার কুল-কিনারায় কান্দে মতিন নিরালায় ॥
লোকসমাজে লুকিয়ে-থাকা এই সহজ-সাধককেও আমরা হারিয়েছি। মৃত্যুর আগে তাঁর শরীরের একাংশ অবশ হয়ে গিয়েছিল। তাঁর সঙ্গে যখন শেষ দেখা তখন দৈহিক দুরবস্থা দেখে উক্ত গানের ভণিতা-চরণটির কথা বারবার মনে পড়ছিল।
মাস্টার আবদুল মতিনের মতো গ্রামের ভেতর থেকে বের হয়ে এসে সুনামগঞ্জের আক্তাপাড়ায় মাসিং নদীর পূর্বপাড়ে দরিদ্র জেলেদের পাশে ঘর তুলেছিলেন স্বজনপীড়িত ফকির সমছুল। এই ফকির ছিলেন নিঃসন্তান, কিন্তু কয়েকটি বিড়ালই তাঁর সন্তান। আনু, মিনু, ভানু নামে সুন্দর সুন্দর নামও আছে তাদের। সুনামগঞ্জের হাবিদপুরের অধিবাসী মুর্শিদ নয়ান ভানুর একনিষ্ঠ ভক্ত এবং সারাজীবন জুতা না পরে কাটানো ফকির সমছুলের সকল গান নিয়ে ২০১৪ সালে আমার সম্পাদনায় বের হলো আশিকের রত্ন সমগ্র। সমগ্র বের হওয়ার পর আর গান লিখছেন কিনা জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন, ‘গান মাঝেমধ্যে আসে কিন্তু আর লিখব না।’ শরীরের নানা অসুখবিসুখ আর বার্ধক্যের নির্যাস-ছেনে ঘোড়ার রূপকে লেখা সমছুলের দেহতত্ত্বমূলক গানটি পড়ে মনে হয়েছিল ঘন ঘন ডাক্তার দেখাতে এলেও, তিনিও বোঁচকা বাঁধতে লেগেছেন।
২০১৮ সালের সাত মার্চে মাসিং নদীর পাড়ে দেহ রাখলেন ফকির সমছুল। এই খবরের জন্য একেবারেই যে অপ্রস্তুত ছিলাম তা নয়। কারণ, তার কিছুদিন আগে কয়েকটি গানের একটি পাণ্ডুলিপি হাতে তুলে দেওয়ার জন্য আমার কর্মস্থলে এলেন ফকির সমছুল, বইয়ের নাম : যাওয়ার পথে। বললাম, ‘যাওয়ার পথে কেন?’, বললেন, ‘যাওয়ার পথে লেখা গানের বইয়ের নাম আর কী দেব?’ ফকির সমছুল আর মকদ্দস আলম উদাসীকে নিয়ে বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য এক রাতে বসা হয়েছিল আমাদের। এবার তাঁকে নিয়ে এককভাবেও বসা দরকার। কিন্তু আমাদের একসঙ্গে বসার আগেই তাঁর যাওয়ার সময় হয়ে গেল। কঠিন জগৎ ছেড়ে হঠাৎ একদিন সহজ মানুষেরা বিদায় নেন, কিন্তু এরা ঠিক কোথায় যান, কোথায় হারান জানি না। কারণ, লোকসমাজে লুকিয়ে-থাকা মানুষরতনের সঙ্গে আমাদের একটু-আধটু জানাজানি হয় মাত্র, কানাকানি বাকি থেকে যায়।
মন্তব্য করুন