![শহীদুল জহির [১১ সেপ্টেম্বর ১৯৫৩–২৩ মার্চ ২০০৮]](https://samakal.com/uploads/2023/09/online/photos/Untitled-40-samakal-64fa17d969d46.jpg)
শহীদুল জহির [১১ সেপ্টেম্বর ১৯৫৩–২৩ মার্চ ২০০৮]
আধুনিক ও সাম্প্রতিক বাংলা কথাসাহিত্যের বর্ণনাপ্রধান ধারার যাঁরা পথিকৃৎ, শহীদুল জহির তাঁদের অন্যতম। তাঁর ভাষা ও গল্প মানুষকে বিস্মিত করে। যৌগিক ও জটিল বাক্যে সবল ও সচল ছবি তৈরি করে তাঁর ভাষা, আর গূঢ় পদার্থবিদ্যার মতো একই চরিত্রের একই সময়ে একাধিক স্থানে থাকার সম্ভাবনা রাখে তাঁর গল্প। মুখের দিকে দেখি, সে রাতে পূর্ণিমা ছিল, জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। গুরুত্বপূর্ণ এই কথাশিল্পীর লেখা চিঠিতে তাঁর চরিত্রের নানা দিক প্রকাশিত। বন্ধু, সহপাঠী ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুর রশীদকে লেখা তাঁর চিঠিগুলো উল্লেখযোগ্য। পাঠক সমাবেশের সৌজন্যে শহীদুল জহিরের লেখা চিঠি পত্রস্থ হলো...
চিঠি –এক
রশীদ,
“তোর সবগুলো চিঠিই, শেষ চিঠিটাসহ, আমার হাতে এসেছে। তোকে দীর্ঘ করে লেখার আমার প্রচুর ইচ্ছা আছে এবং পর্যাপ্ত সময়ও আছে হাতে, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে- একটাই সমস্যা, কী লিখব তোকে?
আমলা হয়ে একটা ব্যাপার ক্রমে আমার উপলব্ধিতে স্পষ্ট হচ্ছে। এখান থেকে আমরা যখন চারদিকে তাকাই, ঘটনা অবলোকন করি তখন এর ভেতর নিজেকে খুঁজে পাই না। কোনো তাড়না মেটার সঙ্গে দেয়ালের বাইরের জীবনের যোগ আছে সেটা আমাদের তাড়িত করে না। অনেক কিছু হয়তো বুঝি বুদ্ধিমানের মতো, কিন্তু যে বোধ তাড়নার জন্ম দেয় না সে বোধ শুধু নিষ্ফলা নয়, সেটা অতি জড়। আমাদের প্রকাশ অনেক কম। বলার কথা থাকে না। যে বলে অনেক, করে না কিছুই, সে প্রতারক। কিন্তু যারা বলে না কিছুই, করেও না কিছু তারা?
আমি একটা কথা তোকে বলতে পারি, তোরা বিদেশে বসে দেশ সম্পর্কে যেটুকু ভাবিস কিম্বা চেষ্টা করিস, এখানে এই দেশে বসে কেউ তা করে না। আমাদের দেশটা দারিদ্র্যের কোন ভয়াবহ স্তরে আছে এবং একে টেনে তুলতে হলে সত্যিকারভাবে কতটুকু উদ্যোগ প্রয়োজন সেটা না বোঝাটা কিংবা বুঝতে চেষ্টা না করাটা সবার জন্য মঙ্গলজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্যানসার রোগীর মতো। ডাক্তারের কাছে যেতেও যার ভয়। জাতি হিসেবে আমরা মরে যাচ্ছি দ্রুত। এখানে শুধু দুটো জিনিস আছে এই মুহূর্তে। বিচ্ছিন্নভাবে অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই, সম্পদ লাভের প্রচেষ্টা এবং সেই তৎপরতায় ব্যর্থ হয়ে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যেটা ঘটে, হতাশায় নিমজ্জিত হওয়া। এই ব্যাপারটা অবশ্য আমাদের ভেতরেই, মধ্যবিত্ত আর কি, সীমাবদ্ধ। বাকি জনগোষ্ঠী স্বপ্ন দেখে না, তুই জানিস। এই জনগোষ্ঠীর কী যে অবস্থা দাঁড়াবে সেটা আমার চিন্তায় আসে না। প্রত্যেকটি গতকাল এদের জন্য আজকের তুলনায় ভালোয় দাঁড়াচ্ছে। এভাবে আর কতদিন টিকবে। এদের জন্য দুঃখ বোধটাও এখন সত্যিকার অর্থে কুমিরের অশ্রুর সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে। তবু কেমন যেন খারাপ লাগে আমার। আমার জীবনে বিষাদের কারণসমূহের মধ্যে এটাও একটা। বিশ্বাস করতে পারিস। এই মানুষগুলোকে আমরা বাঁচতে দিচ্ছি না। ঢাকা শহর ঘরছাড়া, গৃহছাড়া মেয়েতে ঠাসা। এরা অতি সস্তায় আমাদের শ্রম দেয় এবং একদম বিনে পয়সায় সম্ভোগের জন্য দেহ দেয়। এর মধ্যে ঈদ গেল। ঈদের সময় তৎপর জনগোষ্ঠীকে দেখলে আগে মনে হতো না দেশটা এমন পরিব। এখন মনে হয় দেশটা সম্পদে উপচে পড়ছে। তোরা বিদেশ বিভূঁইয়ে এইসব দিন কীভাবে কাটাস
আমি এক মাস হয় গ্রিন রোডে (কাঁঠাল বাগান) ব্যাচেলর অফিসার ডরমিটরিতে উঠেছি। তুই ঢাকা এলে আমার এখানে উঠবি। তোর খারাপ লাগবে না। আমার কক্ষ নম্বর ১০, বিল্ডিং নম্বর ২।
আর নয়। তুই প্রতিশোধ না নিয়ে তাড়াতাড়ি লিখিস। নয়াটোলার ঠিকানায় ভালোবাসা রইল। শহীদ।
ঢাকা - ১৩/৯/৮৪
চিঠি–দুই
রশীদ,
তোর দুটো চিঠিই পেয়েছি। খুব শালা enjoy করছিস, অ্যা? করছিস না? তুই মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইলি বুলগেরিয়া গিয়ে! এর কোনো মানে হয়! প্রকৃতি এখন ভীষণ শীতল সেটা তো এই নিরক্ষীয় এলাকায় বসেও অস্থিমজ্জায় টের পাচ্ছি। কিন্তু শীতের পরেই তো বসন্ত এসে দাবড়াবে। তোর যা অবস্থা। বসন্ত তোর দরজায় টোকাও দেবে কিনা সন্দেহ হচ্ছে আমার।
বুলগেরিয়ায় কি বাঙালি একেবারেই নেই? একটাকে পটকে ফেল না। তোর মনের মাধুরীর জালে তুই অনায়াসেই সুবর্ণ প্রজাপতি আটকে ফেলতে পারিস। ভাবিস না আমি তোর জন্য মেয়ে খুঁজে না পেয়ে এ রকম পরামর্শ দিচ্ছি। তোর জন্য মেয়ে পাওয়া কঠিন স্বীকার্য। অমন গুণবতী কোথায় পাই বল! তবুও, চেষ্টা করে হয়তো তোর জন্য একটা বউ আমি বের করতে পারব। কয়েক দিন আগে হাসিনার (সহপাঠী বন্ধু এবং ড. আহরার আহম্মদের স্ত্রী) বাসায় গিয়েছিলাম। কত দিন পর ভদ্রমহিলাকে দেখলাম জানিস? তিন থেকে চার বছর পরে। I am dead । দুঃখ করিস না। আমি বহু ভেবেছি, চেষ্টা করেছি, কিন্তু এই জীবনত অবস্থা থেকে বেরোতে পারছি না। আমি দেখা করি না, টেলিফোনে কথা বলি না, তার পরও যখন এই অবস্থা তখন এ নিয়ে জোরাজুরি, টানাহেঁচড়া করে আর কী হবে। একটা বিচ্ছিরি অবস্থা। মুখে করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। পায়ে পায়ে সময় যাচ্ছে। যাচ্ছে না? এটা একটা। great ব্যাপার। তাই না? সময় বসে থাকে না। সময়কে ধন্যবাদ জানানো যেতে পারে। আমরা বসে থাকতে পারি কিন্তু সময় আমাদের চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাচ্ছে। কোথায়, বুঝতেই পারছিস। হাসিনাকে তোর কথা বললাম। সে তো বলল তোর জন্য একটি উপযুক্ত কনে বের করা কঠিন ব্যাপার । তবু সে আমাকে বলেছে সে কথাটা মনে রাখবে। এইসব রসুন বোনা দেখে খুশি হতে পারছিস না বোধহয়, তবু দেখ না কী হয়।
ভীনা এখন ঢাকায়। আমার সঙ্গে এখনো দেখা হয় নাই। একদিন রিকশায় হঠাৎ দেখলাম। সে আমাকে দেখে নাই। একদিন যেতে হবে। খুব মুটিয়ে গেছে। তোর সাম্প্রতিক ইউরোপ ভ্রমণের সময় কি ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল তোর?
আর কেমন কাটছে তোর? ঢাকায় কিন্তু অন্যান্য বছরের চাইতে এবার শীতটাকে বেশ অনুভব করা যাচ্ছে। অফিসে বসে বসে তোকে চিঠি লিখছি। বাইরে আকাশ মেঘলা। কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হচ্ছিল। সূর্য আজকে ঘুম থেকে ওঠেনি। শীতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। তোরা যেখানে আছিস ওইসব দেশে লোকে শীতের জন্য তৈরি থাকে। এখানে তো তেমন নয়। তোর লেখাপড়া কেমন হচ্ছে? আরও বেশ কিছুদিন থাকতে হবে তোকে। কী করা বল। এটাই নিয়ম। তোর তো একটা Purpose আছে। অন্তত বিদেশ বিভূঁইয়ে উদ্দেশ্যহীনতার নিদারুণ যন্ত্রণায় তোকে ভুগতে হচ্ছে না। এইটুকু হয়তো তোর সৌভাগ্য। সেজন্য তোর খুশি হওয়া উচিত এবং মোটামুটিভাবে সময়টা পার করে দেওয়া উচিত। শামীমের সঙ্গে দেখা হয় তোর? এই ব্যাটা কিন্তু মোটামুটি ভালো আছে। ও ওর সব কিছুই টিকিয়ে রেখেও Rome-এ গিয়ে Roman হয়ে থাকতে পারে। ওর চিঠি পাই মাঝেমধ্যে। এই বছরের ভেতর ওর পড়ালেখা শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। ইকরামেরও (কানাডা প্রবাসী, গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ভাই) চিঠি পাই মাঝেমধ্যে। কয়েক দিন আগে ওর ছেলের ছবি পাঠিয়েছিল কয়েকটা। চমৎকার শিশু। ঈর্ষান্বিত হব না হব না করেও ঈর্ষা জাগতে চায়। আমার ভেতরের পিতৃত্ব মাথাচাড়া দেয় না, তবুও, কেমন যেন মনে হয় (২০০৬ সালে ডাস্টবিনে কাকে ঠোকরানো একটি মেয়েশিশুকে দত্তক নিতে চেয়ে পরে ব্যর্থ হন শহীদুল জহির)। ইকরামটাও বোধহয় নানা ঝামেলার ভেতরেও কিঞ্চিত সুস্থির ফলত সুখী।
আর তেমন কিছু নয় । মজনু বিয়ে করেছে। আমি আর রিজভী (ড. আহম্মদ শরীফের বড় ছেলে ও সহপাঠী) ভোলা গিয়েছিলাম ওর বিয়েতে। কনে সুন্দরী এবং অল্পবয়স্কা। বহুদিন পর লম্বা চিঠি লিখলাম। অনভ্যাসের জন্য হাফ ধরে যাচ্ছে। কাজেই এবার জিরানো দরকার। একই যুক্তিতে তোর কিন্তু খাটো চিঠি লেখা উচিত নয়। লম্বা সুন্দর করে লেখার অভ্যাস তোর আছে। সেটা কেন যে তুই আজকাল ত্যাগ করতে চাচ্ছিস। কেন যে দু-কথার চিঠি লিখে দায় সারিস। এটা খুব খারাপ কথা।
আমার লেখালেখি কিছুটা হচ্ছে। মুক্তধারা বইটা এখনো বের করেনি। একটা উপন্যাস ছাপা হয়েছে কিছুদিন হয় এক সাপ্তাহিকে। Spare না থাকায় এই মুহূর্তে তোকে একটা কপি পাঠিয়ে তোর বিদগ্ধ মতামত জানতে চাওয়া গেল না। ভাবিস না, তোকে আমি ওটা পড়াব ।
হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। আজকে শেষ করা যাক। তুই আমার বাসার, মানে নয়াটোলার ঠিকানায় লিখবি। কারণ আমার অস্থায়ী ঠিকানাগুলো এতটা অস্থায়ী যে তোর চিঠি আমার হাতে নাও পৌছতে পারে। সেটা আমি চাই না। ভালোবাসা রইল তোর জন্য। ইতি ।
শহীদ। ঢাকা। ২৩/১/৮৪
চিঠি–তিন
ঢাকা ২৫/১১/৮৬
রশীদ,
অনেক দিন হয় তোর কোনো খবর-পাত্তা নাই। আমার চিঠি পাস নাই বুঝতেই পারছি, কিন্তু তুই তো লিখতে পারতিস? মাস দুয়েক আগে ওই ঠিকানায় তোকে একটা চিঠি লিখেছি আমি। তোর কোনো উত্তর না পেয়ে আজকে ডোরার অফিসে গিয়ে জানতে পারলাম, তুই এখনো বিলেতে রয়ে গেছিস। তুই এখানে বসে বসে করছিসটা কী? তোর পড়ালেখা নেই? কি রে? আসলেই তুই আছিস কেমন? বুলগেরিয়ায় কবে ফিরবি? আগামী বছর মাঝামাঝি নাগাদ কি তোর ফেরা হবে দেশে? ভালো কথা, ডোরাকে নিয়ে যাবি নাকি? একটা কথা তোকে বলি, যদি কিছু মনে না করিস, আমি যতটুকু বুঝতে পারি, আমার মনে হয় তুই একজন ভালো রমণীকে বিয়ে করেছিস। কিন্তু ওর বিবেচনাবোধ এবং ত্যাগে যেন তুই অভ্যস্ত হয়ে যাস না, তুই যেন ভুলে না যাস যে ওর প্রাপ্তিরও অধিকার আছে তোর কাছে, অর্বাচীনের মতো তোকে বলি, ওকে নিয়ে যা না কেন এই বাকি কটা মাসের জন্য।
ঢাকায় আমরা সকলে মোটামুটি ভালো আছি। জার্মানি থেকে শামীম এসেছে। দেশে থাকার ইচ্ছে আছে ওর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা জোটানোর চেষ্টা করছে। হয়তো পেয়ে যাবে। না পেলে ফিরে যাবে আবার। জালাল হাই নেদারল্যান্ড গেছে। আগামী মাসের শেষ নাগাদ হয়তো ফিরবে। আর সবাই মোটামুটি ভালো। হাসান এবং শামীম ও ভালো। আমি ভালোই। তুই থাকতে যে লেখাটা আমি লিখছিলাম সেটা দীর্ঘ দিন পর শেষ করতে পেরেছি। আজকেই একটা পত্রিকায় দিয়ে এলাম পাণ্ডুলিপি। আসছে ঈদসংখ্যায় ছাপা হলেও হতে পারে। আর একটি প্রকাশিত লেখা বই আকারে ছাপানো যায় কি না সে বিষয়ে চেষ্টা করছি। তিনজন প্রকাশকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। ভাবতে পারিস, আমার মতো অলস লোক এত কিছু করে ফেলছে। তিনজনের ভেতর দুজন কোনো কথাই বলেনি, একজন বলেছে ফেব্রুয়ারির পরে যেতে। হয়তো হবে না, হয়তো কিছু হবে। আমি আশাবাদী। এ দুটো বই উপন্যাস। প্রথমটির নাম, আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু এবং দ্বিতীয়টির নাম উড়াল। আরেকটি লেখা লেখার চেষ্টা করছি মাস খানেক হলো। কিছুতেই এগোতে পারছি না, কায়দা করা যাচ্ছে না। দেখা যাক কী হয় আর কি?
খবরাখবর মাঝে মধ্যে দিস। ভালোবাসা রইল তোর জন্য।
ইতি শহীদ। - খুব তাড়াতাড়ি লিখবি ।
মন্তব্য করুন