শ্রদ্ধাঞ্জলি
কাঁধে সম্পাদকের হাত

কাজী শাহেদ আহমেদ
আব্দুর রহমান
প্রকাশ: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০
বিলুপ্ত ‘আজকের কাগজ’-এর সদ্যপ্রয়াত সম্পাদক কাজী শাহেদ আহমেদ বেশ ক’বছর ধরে ছিলেন লোকচক্ষুর আড়ালে, একান্ত নিজস্ব বলয় ছাড়া কোথাও তিনি যেতেন না বা কোনো কিছুতে তাঁর অংশগ্রহণ ছিল না। কাজী শাহেদ আহমেদের পরিবার তাঁকে কোনোরকম শারীরিক ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে চায়নি বলেই তাঁকে খুব একটা বাইরে বের হতে দিত না। অবশেষে ২৮ আগস্ট তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আমি আজকের কাগজে কাজ শুরু করি ১৯৯৮ সালে। সাব এডিটর হিসেবে যোগ দিই, পরে রিপোর্টিং শুরু করি। আজকের কাগজ আর সাপ্তাহিক খবরের কাগজ এরশাদশাহির বিরুদ্ধে একটি দ্রোহের নাম। দেশসেরা লেখক তো বটেই; কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক আর সচেতন মানুষের লেখার একটি উন্মুক্ত আকাশে পরিণত হয়ে উঠল পত্রিকা দুটি। আমি যখন আজকের কাগজে কাজ শুরু করি, তখন এর পড়ন্ত বেলা। কেননা, তখন ভোরের কাগজের রমরমা অবস্থা আর প্রথম আলোও আলো বিলাতে শুরু করেছে।
কাজী শাহেদ আহমেদ ছিলেন সাংবাদিক অন্তঃপ্রাণ। সাংবাদিকদের সঙ্গ তিনি উপভোগ করতেন। খবরের ভেতরের খবরটা জানার দিকেই ছিল তাঁর আগ্রহ। হয়তো ছাপা হবে না কিংবা ছাপানো যাবে না– এমন খবরও তাঁকে জানিয়ে রাখা হতো। কখনও কখনও তিনি পুরো দায়িত্ব নিয়ে প্রকাশ করে দিতেন। সংবাদ প্রকাশের জন্য ব্যক্তিগতভাবে তাঁর বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা হয়। এক জেলা থেকে আরেক জেলার আদালতে তিনি গিয়ে দাঁড়িয়েছেন, জামিন নিয়েছেন।
সিনিয়র-জুনিয়র সবার সঙ্গেই ছিল তাঁর বন্ধুর মতো সম্পর্ক। আমি তখন রিপোর্টিংয়ে। একদিন অফিসে এসে তিনি আমাকে পেলেন লিফটের গোড়ায়। লিফট থেকে নামার পর তিনি আমার কাঁধে হাত দিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন, পুরো অফিস এ মাথা থেকে ও মাথা যাচ্ছেন, এর-ওর সঙ্গে কথা বলছেন, কিন্তু আমার কাঁধ থেকে হাত আর সরান না। রিপোর্টারের কাঁধে সম্পাদকের হাত ভারী নয়, বরং মমতার, স্নেহের। এমন সম্পর্ক সবার সঙ্গেই ছিল তাঁর। রিপোর্টার লিখছেন, আর সম্পাদক তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে তা দেখছেন এবং কথা বলছেন। এ ছিল আজকের কাগজের নিয়মিত ও স্বাভাবিক ঘটনা।
কাজী শাহেদ আহমেদ ছিলেন আড্ডাপ্রিয় মানুষ। বার্তা বিভাগের সভাটি তাঁর উপস্থিতিতে প্রাণবন্ত আর দীর্ঘ হতো। সম্ভবত আড্ডাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতেই তিনি শুরু করেছিলেন ‘কাগজ বৈঠকি’ নামের একটি বিশেষ আয়োজন। যাতে অংশ নেন মন্ত্রী, বিচারপতি, শিল্পপতি, শিল্পী, সাহিত্যিকসহ নানা ক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠিত মানুষ। জিগাতলা, মহাখালীর আরজতপাড়া আর ধানমন্ডি ১৫– সব অফিসেই ছিল নানা পেশার মানুষের উন্মুক্ত পদচারণা।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি শিক্ষা, সংস্কৃতি, খেলাধুলা কিংবা কর্মসংস্থানমূলক উদ্যোগেও তিনি ছিলেন অগ্রভাগে। গড়ে তুলেছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস, ছিলেন শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক, আবাহনী ক্লাবের দুঃসময়ে তিন এর হাল ধরেন, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন ক্লাবটির সঙ্গে। সুপারশপ ‘মীনাবাজার’ দিয়ে তিনি বদলে দেন মানুষের কেনাকাটার ধারণা। পঞ্চগড়ে গিয়ে গড়ে তুলেছেন চা বাগান। সিলেটের বাইরে চা বাগান হতে পারে তা সম্ভবত তাঁর আগে কেউ ভাবেওনি। কত পুরস্কার কত মানুষ পেল, কত স্বীকৃতি এর-ওর পায়ে গড়াগড়ি খেলো, কিন্তু কাজী শাহেদ আহমেদের বিশাল কর্মযজ্ঞ আর অবদান সবাই দেখেও না দেখার ভান করে গেল।
মানুষের, বিশেষ করে তাঁর হাত ধরে যারা গণমাধ্যমে কাজ করা শুরু করেছেন বা কাজ করেছেন তাদের সম্মান, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা তিনি পেয়েছেন। তিনি সম্পাদক হিসেবে মৃত্যুবরণ করেননি, কিন্তু আজকের কাগজ সম্পাদক হিসেবে তাঁর পরিচিতিটা তিনি নিজের করে নিয়েছেন এবং সে পরিচয়েই তিনি অনেক দিন নিজেকে মানুষের মাঝে বাঁচিয়ে রাখবেন।
আব্দুর রহমান: সাংবাদিক, আজকের কাগজের সাবেক কর্মী
- বিষয় :
- শ্রদ্ধাঞ্জলি
- আব্দুর রহমান