
পড়ছিলাম বিভূতিভূষণের ছোট গল্প ‘চিঠি’। পড়া শেষে আস্তে করে বইটা মুড়ে রাখলাম। চিঠির আর্তিটি কেন জানি মনের মধ্যে ঘুরতে থাকল - ‘লিপিখানি ডাকঘরের কর্মচারীরা এতকাল লুকিয়ে রেখে কি রসিকতা করতে চেয়েছিল আমার সঙ্গে? ত্রিশ বছর পরে এ চিঠি পেয়ে লাভ কি আমার?’
...কত রকমের কাগজে আসত চিঠি। ফকফকে সাদা, গাঢ় নীল, আকাশী নীল, হাল্কা গোলাপি। মোটা কাগজ, পাতলা কাগজ, দাগ টানা, দাগ ছাড়া। লেফাফার রকমফেরও তো ছিল মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার মতো - লম্বাটে, চৌকো, মুখ আটকানোর জায়গাটা ঢেউ খেলানো খাঁজ কাটা অথবা সমান, আঠা লাগানো অথবা আঠা ছাড়া।
ছিল তো বিমানে আসা নীল রঙের ‘এরোগ্রাম’। খামের মধ্যেই চিঠি লেখা, তারপর ক’টা ভাঁজ দিলেই খাম ও পত্র - একের ভেতর ‘দুই’। আভিজাত্য ছিল বটে এরোগ্রামের - পাতলা কাগজ, ওপরে কোনায় বিমানের ছবি, বিদেশ থেকে আসা চিঠি। আম-জনতার চিঠির মাধ্যম নয় এটা, কিছু কিছু সুনির্দিষ্ট পরিবার আর মানুষের জন্যেই মাত্র।
আরো তো ব্যাপার ছিলো। তখন আমরা তিনতলা এক বাড়ীর দোতলায় থাকি একটি সরু রাস্তার ওপরে। আশে পাশে আরও বাড়ি-ঘর, দালান-কোঠা আছে - অনেকটা গা ঘেঁষাঘেঁষি করে।
পাশের বাড়ির নীরা বৌদি যখন প্রবাসী স্বামীকে চিঠি লিখতেন, তখন লেফাফার কোনায় একটা ছোট্ট গোলাপ ফুল এঁকে দিতেন। জানতাম কারণ, তাঁর চিঠিগুলো ডাকবাক্সে ফেলার দায়িত্ব তিনি দিয়েছিলেন আমাকে। বিনিময়ে পূজোর প্রসাদ - বাতাসা, নাড়ু, কাটা শসা পাওয়া যেত।
ওপরের তলার আসমা আপার কাছে চিঠি আসত দু’বাড়ি পেরিয়ে খালেদ ভাইয়ের কাছ থেকে। গোপনীয় সাবধানতা অবলম্বন করার জন্য ও চিঠি আসত আমাদের বাড়ির ঠিকানায়। অসুবিধে নেই। বাড়ির বড় ছেলে হিসেবে চিঠির বাক্সের চাবি থাকত আমার কাছে এবং চিঠি বের করে আনার দায়িত্বও। খালেদ ভাইয়ের চিঠি সন্তর্পণে আলাদা করে সঙ্গোপনে নিয়ে যেতাম আসমা আপার কাছে। চিঠি প্রতি দু’আনা পাওয়া যেত। আয়ের অমন সহজ পথ আর পেলাম না এ জীবনে! কত রকম সম্বোধন ছিল চিঠির - ‘শ্রীচরণকমলেষু’, ‘পূজণীয়া মা’, ‘সন্মানীয় আব্বাজান’। শেষটাতেও চমক কম ছিল না - ‘প্রণত’, ‘দোয়া খায়ের’। মা’র বাক্স থেকে চুরি করা উপন্যাসে পেয়েছিলাম ‘সুচরিতাসু’ এবং ‘প্রিয়তমাসু’। অর্থ বুঝিনি প্রথমটির এবং দোষও দেখিনি দ্বিতীয়টিতে। অতএব, দ্বিতীয়টি ব্যবহার করে পাশের বাড়ীর খেলার সঙ্গিনীকে চিঠিও লিখেছিলাম একটি। তারপর মায়ের হাতে মার খেয়েছিলাম, কারণ সে অর্বাচীন বালিকা চিঠিটি আমার মা’র হাতে তুলে দিয়েছিল।
চিঠির আসল অত্যাচার শুরু হলো স্কুলে এসে। বাংলা দ্বিতীয় পত্রে চিঠি ও আবেদন পত্র লেখার ছড়াছড়ি এবং পরীক্ষা পর্যন্ত গড়াগড়ি। আর কী ভয়ংকর সব বিষয়– ‘পিতার কাছে টাকা চাহিয়া পত্র লিখ’, ‘স্কুলে বিনা বেতনে পড়িবার জন্য প্রধান শিক্ষকের কাছে আবেদনপত্র লিখ’। সব পত্রের মূল কথা হচ্ছে ‘ভিক্ষে চাও’। ‘যথাবিহিত সম্মানপূর্বক ...’ - ঐ সব পত্রের প্রথম লাইন মনে করলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়। কিন্তু এই সব পেরিয়ে চিঠির ব্যাপারে একটি কথা সবসময়ে আমাকে টেনেছে– ‘আকাশের ঠিকানায় চিঠি দিও।’ রুদ্রের সেই কবিতার লাইন প্রথম কবে পড়েছি, বিস্মৃত হয়েছি, কেমন করে মনের মধ্যে গেঁথে গেছে, তা ও ভুলে গেছি। কিন্তু এখনও কোথাও কথাটা যখন শুনি, পড়ি বা দেখি -চুপ করে যাই। কী যেন আছে কথাটায়, ধরতে পারি না, কিন্তু কেমন যেন লাগে! মনে পড়ে যায় জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের ‘পঁচিশ নম্বর মধুবংশীর গলি’র সেই পঙ্ক্তিটি শম্ভু মিত্রের কণ্ঠে ‘কোন এক অমোঘ দুপুরে চিঠি পাই, চিঠি পাই - জীবনের’। ‘মৃণ্ময়ী’ গল্পের মৃণ্ময়ীর চিঠিটি মনে পড়ে - ‘তুমি ফিরে এসো, ইতি তোমার পাগলী’।
কিন্ত চিঠি নিয়ে একটি লেখার (কবিতার) শেষ পর্যন্ত কখনও যেতে পারি নি - রবীন্দ্রনাথের ‘শেষ চিঠি’ -
‘অমলার ঘরে বসে সেই আখোলা চিঠি খুলে দেখি,
তাতে লেখা -
তোমাকে দেখতে বড্ডো ইচ্ছে করছে।
আর কিছুই নেই।’
বিষয় : বিন্দু বিন্দু
মন্তব্য করুন