- কালের খেয়া
- কতটা মৌলিক সৃজন তারা, কতটাই বা প্রভাবজাত
শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত ও ইন্দ্রনাথ
কতটা মৌলিক সৃজন তারা, কতটাই বা প্রভাবজাত
জন্মদিন
![শরৎচন্দ্র চট্টােপাধ্যায় [১৫ সেপ্টেম্বর ১৮৭৬–১৬ জানুয়ারি ১৯৩৮]](https://samakal.com/uploads/2023/09/online/photos/Untitled-20-samakal-650351beef6fd.jpg)
শরৎচন্দ্র চট্টােপাধ্যায় [১৫ সেপ্টেম্বর ১৮৭৬–১৬ জানুয়ারি ১৯৩৮]
প্রভাতজীবনে এ নেশায়ে কে মাতাইয়া দিয়াছিল?
১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা সাহিত্যে এমন দুই কিশোরের আবির্ভাব ঘটে; যারা দুরন্ত। তুলনারহিত দুরন্ত। তাদের চরাচরে, কখনও কখনও তাদের দু’জনকেই সুবোধ-শান্ত রূপেও বিরাজ করতে দেখা যায়। কিন্তু ওই আপাত সুশান্ত-দশাটি মূলত শিগগিরই আরও বড় কোনো ঝঞ্ঝা-ঝঞ্ঝাট বাধিয়ে তোলার এক পূর্ব-অবস্থা হয়েই বিরাজমান থাকে। অচিরেই তারা তাদের আশপাশকে জ্ঞাত করিয়ে দেয় যে, নিজেদের ওই আপাত অক্রিয়– প্রশান্ততার মোড়কে তারা– কোন দুর্দমনীয় আর অশঙ্ক দামালপনাকে মুড়ে রেখেছিল। তাদের জীবনের দিন-কয়েকের থির অক্রিয়তা হচ্ছে অন্য নব কোনো কর্মে বা কোনো এক নব রোমাঞ্চময় দায়-পালনে ঝাঁপিয়ে পড়ারই পূর্ব প্রস্তুতি মাত্র। তাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠতে উঠতে আমাদের মনে এই বোধ জেগে উঠতে থাকে যে, যেন তাদের মধ্য দিয়ে তাদের স্রষ্টা– মনুষ্যজীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ অথচ স্বল্পায়ু যে কিশোরবেলাটি আছে, সেই কৈশোরকালকেই আমাদের সামনে স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করে তুলেছেন।
তাদের আবির্ভাব কাল থেকেই বাংলা সাহিত্য তাদের দিয়ে বিস্ময়-চমকিত। সাধারণ পাঠকের মুগ্ধতা তারা যতটা পায়, তারও চেয়ে ঢের বেশি অনুরক্তি-মোড়ানো স্তব তারা পায় পণ্ডিতজনের কছে থেকে। তারা গণ্য হতে থাকে আমাদের সাহিত্যের আদি মানবকিশোর বলে।
বাহ্যত চরিত্র দুটির স্বভাবে কোনো সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া কঠিন। একজন বিদ্যুৎক্ষিপ্র। দুনিয়াকে সে বোঝেশোনে ভালো, বোঝে তার নিজের বুঝ অনুসারে। সে আপনা থেকেই সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, এই জগৎ-সংসারকে পরোয়া করারও কোনো কারণ নেই। চলতে থাকে নিজ অন্তরের তাগাদামাফিক। চরাচরের অন্য দশজনের চক্ষে নিজেকে সুবোধ প্রতিপন্ন করার কোনো তাগাদা নেই তার। সামাজিক নিন্দা আর অখ্যাতির শঙ্কা কদাপি স্পর্শ করে না তাকে। কণ্টক তাকে বিদ্ধ করার জন্য শানিয়ে থাকে, সে বিদ্ধও হয়; কিন্তু সেসবে ভ্রূক্ষেপও করে না। লোকচক্ষে তার চলাচলতি হঠকারিতা আর চরম খামখেয়ালিতে ভরা সর্বনাশা ক্রিয়াকাণ্ড বলে গণ্য। সর্ব সংসারী লোকের চক্ষে সে ‘লক্ষ্মীছাড়া, নষ্ট-দুষ্ট, সর্বনেশে, বখে-যাওয়া’ একজন; যার সান্নিধ্য থেকে নিজ নিজ পুত্রদের তফাতে রাখার জন্য সকলে মরিয়া। অথচ ভেতরে ভেতরে সে বিপন্নের ত্রাতা। গৃহে-সংসারেই সে বাস করে, তবে সেটা নিতান্তই যেন; থাকতে হয় বলেই থাকা। যেন গৃহত্যাগের সঠিক লগ্নটির জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে তাকে। যে কোনো বিপদাপন্নের সহায় হবার জন্য সদাপ্রস্তুত। এই যে অন্যপথ-উতলা, বুনো আর নিয়ম ভঙ্গ করার জন্য উদগ্র কিশোর; তাকে আমরা ইন্দ্রনাথ নামেই চিনতে থাকি। তার সহচর অন্য যে জন, তার ওই এই কিশোরকালেই যেন সে হয়ে উঠেছে, কেবলই এক দর্শক। সমাজ-সংসারকে কেবলই নির্লিপ্ত চোখে চেয়ে চেয়ে দেখে যেতে থাকা এক দর্শক। সে আছে সমস্ত কিছুতেই। বড়দের ফরমাশমাফিক চলনে আছে, বিধিরীতি মতো কর্মসম্পাদনে আছে; বিদ্যাপীঠের পড়া মুখস্থকরণে আছে, পড়া ফাঁকি দেওয়ায়ও আছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই তার কোনো লগ্নতা নেই। সবকিছুতেই সে আছে সন্তর্পণ আলগোছে।
এইজন বাহ্যিকভাবে নিতান্ত শান্ত, সংসারের নিয়ম-নির্দেশ মান্য করায় তার যেন কোনো আপত্তি নেই, বরং ওটি করে যেতে থাকে সে বিকারশূন্য মনে ও শরীরে। উচ্চকণ্ঠ বাদ-বিসম্বাদে নেই সে। সে সুগাঢ় মৌনতা নিয়ে বাস করে চলে। তার অন্তরের ওঠাপড়া বা অস্থিরতার কোনো সংবাদ কেউ জানে না। বা তার ভেতরে, তারই অন্য আরেক সত্তার বসত আছে; যেই সত্তা তীব্র জেদি ও উচ্চণ্ড রাগী; এমনটা তার পরিজনদের কেউ ভাবতেও পারে না। নিতান্ত সাদাসিধে চলন-বলন তার। সে কাউকেই তার অন্তরের পরিচয় জানতে দিতে কিছুমাত্র আগ্রহী নয়। যেন থাকে ছায়ার মতো। ধীর ছায়া। সুবোধ নম্র ছায়া। কিন্তু ভেতরে-গহিনে সে ইন্দ্রনাথের মতোই বিধি-ছন্নভন্ন করে তোলার জন্য প্রস্তুত। যদিও তার বাহ্যিক সত্তা, তার অন্তরের সেই বিদ্যুতের কণা-কিঞ্চিৎ ঝলককেও প্রকাশ করে না। সেও পথে নেমে নেমে, পথ হারিয়ে ফেলার তাগাদাকে বোধ করে তার সর্বসত্তায়। কিন্তু ওই কিশোরকালে সেই তাগাদাকে প্রকাশ করে ওঠার সামর্থ্য যেন সে পায় না। আমরা জেনে উঠি যে, এই তার নাম শ্রীকান্ত।
এই দুই কিশোর– শ্রীকান্ত ও ইন্দ্রনাথ, বাংলা উপন্যাসে তাদের আগমন ঘটে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীকান্ত প্রথম পর্ব ( ১৯১৭) উপন্যাসের মধ্য দিয়ে। শরৎচন্দ্র দেখিয়েছেন, বাহ্যিকভাবে দুই বিপরীত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন দুরন্ত দুই বালক ইন্দ্রনাথ ও শ্রীকান্ত চালিত হয় নিজ প্রাণের বাসনা, বিবেচনা ও বাঞ্ছা দিয়ে। যেই বাঞ্ছা ও বিবেচনাকে স্থিরমন্থর, নড়ন-অনীহ সমাজ ও সামাজিকেরা চিরকাল ধরে গণ্য করে আসছে মন্দমতি বালকের দুর্বুদ্ধি বলে। তাদের পরোয়াহীন দুরন্তপনা শুধু পাঠককেই অভিভূত করেছে, সাহিত্য-সমালোচকগণকে প্রবল রকম মোহিত করেছে। আখ্যানের প্রকাশকাল থেকেই মনে করা হতে থাকে, এমন অভিনব দুরন্ত কিশোর নায়কের দেখা, বাংলা সাহিত্য, এর আগে অমন তীব্রভাবে আর কখনও পায়নি। পণ্ডিতজনেরা তাদের দু’জনের অভিনবত্ব ও দুর্দণ্ড প্রতাপশালিতার মহিমা রচনায় হয়ে ওঠেন অক্লান্ত ও মুখর। তারা জানাতে থাকেন, ওই দু’জন শুধু অভিনবই নয়; তারা আমাদের সাহিত্যে প্রবল রকম মৌলিক সৃষ্টি এবং তারাই আদিকিশোর। তাদের আগে এই বঙ্গসাহিত্য ভূখণ্ড অমন কিশোর নায়কের উপস্থিতি আর কখনও পায়নি। আমরা এখন বিবেচনা করে দেখতে পারি, ওই কিশোর নায়ক দু’জন কতটা মৌলিক-সৃজন বলে গণ্য হতে পারে। নাকি তারা অন্য কোনো প্রভাবজাত সৃষ্টি! এই দু’জনের আগে অমন ছুট-তুরন্ত কিশোর নায়কের উপস্থিতি কি বাংলা সাহিত্যে আদৌ আমরা পেয়েছি? নাকি তারা দু’জনই প্রথম পথিক?
তারা এমনিই এসে ভেসে যায়
বাংলা সাহিত্যের অতি দূরকালের দিকে যদি আমরা নজর রাখি– দেখতে পাব, আছে তারা। আছে ওই নবীন কিশোরের উপস্থিতি। আমাদের তল্লাটে শ্রীকান্ত বা ইন্দ্রনাথের এসে ওঠার বহু আগে থেকেই তারা আছে আমাদের সাহিত্য ভূখণ্ডে। আছে তাদের দুর্দান্ত প্রাণশক্তি ও অচল সংসারে উপদ্রব সৃজন করার মহাশক্তি নিয়ে।
একটি বা দুটি ব্যতিক্রম বাদে, এই কিশোরদের কেউই সুশান্ত অচপল নয়। তারা ধীরতার সন্ধান জানে না। বা, স্থিরতার সঙ্গে তাদের জানাশোনা নেই। যেন তাদের সঙ্গে শুধু ঝঞ্ঝারই তুলনা করা চলে। পারিপার্শ্বের টালমাটাল করে দেওয়া ঝঞ্ঝা। অমনই দুর্নিবার তারা। বা, তাদের সঙ্গে যেন বা তুলনা করা চলে সুতীব্র স্রোতধারার। কূল ভেঙে অকূলের দিকে ছুটে চলে যেই প্রখর স্রোত। অমনই খর-তীক্ষ্ণ তারা প্রায় প্রত্যেকে। এবং বাংলা সাহিত্যের একেবারে সেই আদি থেকেই, শ্রীকান্ত (প্রথম পর্ব) প্রকাশিত হবার বহু শতাব্দী আগে থেকেই, এই কিশোরদের ওই পরোয়াশূন্যতা ও বিধিলঙ্ঘনকরণের স্পর্ধার স্তবে– বাংলা সাহিত্য গভীররকমে মগ্ন হয়ে আছে। আমাদের সাহিত্যে প্রথম যে দুদর্ম্য আর অশঙ্ক মানব-কিশোরের দেখা আমরা পাই, তার নাম কৃষ্ণ। যদিও পণ্ডিতজনেরা বাংলা সাহিত্যের দস্যি-দামাল কিশোর নায়কের আদি উদাহরণ হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (১৮২০-১৮৯১) রাখালকেই স্মরণ করে থাকেন; কিন্তু রাখালের আগমনের অনেক আগে, অনেক শতাব্দী আগেই; দেখা দেয় আমাদের সাহিত্যে-ভূভাগের প্রথম কিশোর-নায়কটি। সে আবির্ভূত হয় বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের (১২০১-১৮০০ খ্রি.) মাঝামাঝি সময়ে। ‘দুষ্ট-বিনাশন’ কৃষ্ণ-কিশোরের আগমনের কয়েক শতাব্দী পরে যে দেখা দেয়, সে রাখাল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর বর্ণপরিচয়-প্রথম ভাগ (১৮৫৮) গ্রন্থে ওই নিয়মছিন্নকারী, স্থির-ধীর সংসারে দৌরাত্ম্য ও উৎপাত সৃজনকারী কিশোরের গল্প বলেন। রাখালের সঙ্গেই এইখানে বিরাজ করে গোপাল। সে বড়ো ‘সুবোধ’, ভারী নম্র ও সুশীল। রাখালের একটু পরেই আমরা পাই মোহনলালকে। তাকে আমরা পাই যোগীন্দ্রনাথ সরকার (১২৭৩-১৩৪৪ বঙ্গাব্দ)-এর জয় পরাজয় (প্রকাশকাল অজ্ঞাত, তবে আনুমানিক ঊনবিংশ শতকের শেষাশেষি রচিত ও প্রকাশিত) উপন্যাসে। এ-কিশোর, যার নাম মোহনলাল, সেও দুর্দান্ত দুষ্ট। উত্তম পুরুষে বর্ণিত এই আখ্যানের গোড়াতেই মোহনলাল আমাদের জানিয়ে দেয়, পিতৃহীন সচ্ছল সংসারে, মায়ের দরদের অপব্যবহার করে করে কতটা উচ্ছন্নে সে যেতে পেরেছে।
মোহনলাল চরিত্রটি অসাধুতা-সংশোধন-প্রক্রিয়ার এক দৃষ্টান্ত হওয়ার জন্য বলিপ্রাপ্ত হয়; অন্যদিকে ফটিক হয়ে ওঠে রূঢ়, বিরুদ্ধ পরিবেশের পেষণে পিষ্ট এক অসহায় প্রাণের উদাহরণ মাত্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) ‘ছুটি’ গল্পটি বেরোয় পৌষ ১২৯৯ বঙ্গাব্দে। কিশোর ফটিকও অফুরন্ত প্রাণশক্তির তেজে সদা ধাবমান আর সদা চঞ্চল। মূঢ় সংসারের ‘চারিদিকের স্নেহশূন্য বিরাগ’ যার কিশোরবেলাকে ‘পদে পদে কাঁটার মতো’ বিদ্ধ করে করে, একেবারে বিষবিষাক্ত করে দিতে সমর্থ হয়; এবং প্রাণের ও দেহের মৃত্যু অবধারিত করে তোলে। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীও (১৮৬৩-১৯১৫) গড়েন এমনই দুই কিশোর নায়ককে, তাঁর ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ (প্রকাশকাল অজ্ঞাত, সম্ভবত ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে বিংশ শতকের একেবারে গোড়ার দিকের কোনো সময়ে রচিত) আখ্যানে। আমাদের সাহিত্যের অন্য কিশোর নায়কের তুলনায় তারা বরং অতি শান্ত-ধীর। একটি বিশেষ কর্ম করে ওঠার গোঁ আছে বটে তাদের দু’জনেরই; ওটি করে ওঠার জন্য আকুল-ব্যাকুল এবং মরিয়াও হয়ে ওঠে তারা। গ্রামের এক দরিদ্র মুদি দোকানির পুত্র হচ্ছে গুপী। সেই গুপী সর্বক্ষণ শুধু গানই গাইতে থাকে। এদিকে, গানও সে জানে মাত্র একটিই। অন্য আরেক গ্রামে বাস করে বাজনা-পাগল ছেলে বাঘা। সেই ছেলে জগতে আর কিচ্ছু চায় না, কেবল চায় ঢোল বাজাতে। ওই গোঁ-টুকু ছাড়া তারা নিতান্ত নিরীহ মানুষ।
সুকুমার রায়ের দাশু বা দাশরথির জগৎটা বিশেষ বড়ো কোনো ভূভাগ নয়। দাশুর পূর্বসূরি, কৃষ্ণ থেকে গুপী-বাঘা, প্রত্যেকেরই আছে বিশাল পৃথিবী। কিন্তু দাশুকে আমরা ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ এক গণ্ডীতেই বরাবর অবস্থান করতে দেখি। এই দাশরথির পরে আমাদের সাহিত্যে আসে তারা দু’জন– শ্রীকান্ত আর ইন্দ্রনাথ।
তাদের জন্যে যত স্তব
শ্রীকান্ত ও ইন্দ্রনাথকে আমরা গণ্য করতে পারি ওই অগ্রবর্তীগণের অতি-বিকশিত দুই উত্তরসূরি রূপে। পূর্ববর্তীদের সর্ববিধ দামালপনা যেমন তাদের দু’জনের মধ্য দিয়ে রূপ পরিগ্রহ করেছে, তেমনি এই দু’জনের নিজেদেরও আছে কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য; যা কিনা তাদের করে তুলেছে স্বতন্ত্র আর অভিনব। তাদের ভুবন শুধু গৃহ ও বিদ্যালয়ের সীমানার মধ্যে বিরাজমান এক ভূভাগ নয়। ওটি বিশাল এক ভুবন। অবাধ ও প্রাণময় সমস্তটা প্রকৃতি এবং থিতু সংসারের সবটুকু ওইখানে এঁটে যায়। অমাবস্যার গহন রাত আর ভরা বর্ষার নদীর তেজ– ওই ভুবনে স্বমহিমায় বিরাজমান। মৃত্যু, মমতা, মহামারি, বেদনা আর ওইসব কিছুকে পেরিয়ে যাওয়ার পণ– এইখানে একত্রে অবস্থান করে চলে। অবস্থান করে চলে শ্রীকান্ত আর ইন্দ্রনাথের সঙ্গে, কদমে কদমে। তাদের আবির্ভাব কাল থেকেই, শ্রীকান্ত আর ইন্দ্রনাথের সকল বৈশিষ্ট্য দিয়ে, সকল পণ্ডিতজনই মোহিত হয়ে আছেন। তবে তারা ইন্দ্রনাথকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়েছেন বেশি, শ্রীকান্ত পেয়েছে তার থেকে ঢের কম মনোযোগ-উচ্ছ্বাস। পণ্ডিতগণের কারও কারও কাছে ইন্দ্রনাথ গণ্য হয়েছে দুর্জ্ঞেয় আর অমীমাংসিত রহস্যেরই অন্য নাম বলে। কারও কারও কাছে ইন্দ্রনাথ হচ্ছে অতুল্য অসাধারণ এক সত্তা, বাস্তব দুনিয়ায় কখনও তার দেখা পাওয়া যায় না। শুধু শিল্পের পৃথিবীতেই তার সঙ্গে আমাদের দেখা হওয়া সম্ভব। তাকে পাওয়ার ভাগ্য, বাস্তব সংসারের কদাপি হয় না বলেই মত দেন তারা। কারও কারও কাছে ইন্দ্রনাথ স্বতন্ত্র কোনো মনুষ্য-সন্তান নয়, সে আদতে মানব-কিশোর কৃষ্ণেরই অন্য আরেক রূপ মাত্র। এই জন্মে যে-কিনা ইন্দ্রনাথ নামে আবির্ভূত হয়েছে।
প্রসিদ্ধ শরৎচন্দ্র বিশেষজ্ঞ ড. সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত বলেন, ‘ইন্দ্রনাথের সবকিছুই বিস্ময়কর।’ তিনি বলেন, ‘ইন্দ্রনাথ রূপকথার রাজ্যে বাস করে না। তাহার কারবার কঠিন বাস্তবের সঙ্গে। অথচ ইন্দ্রনাথের কার্যকলাপের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের এমন একটা ছাপ আছে, যাহা অতিমানবের আচরণে পাওয়া যায়।’ সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন: ‘বাংলা সাহিত্যে ইন্দ্রনাথ ও শ্রীকান্ত– অসাধারণ দুই চরিত্র।’ ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে: ‘বর্ণপরিচয়ের রাখাল হইতে আরম্ভ করিয়া অনেক দুষ্ট, লেখাপড়ায় অমনোযোগী বালকের কাহিনী সাহিত্যে বা ইতিবৃত্তে লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু সমস্ত বাংলা সাহিত্য ইতিহাস তন্নতন্ন করিয়া খুঁজিয়াও ইন্দ্রনাথের জোড়া মিলে না।’ মোহিতলাল মজুমদার মনে করেন: ‘যেন সকল জ্ঞান, সকল প্রেম ও সকল শক্তি একটি চিরকিশোর রূপে লীলা করিতে নামিয়াছে।’
পণ্ডিতজনেরা ওই দুই কিশোরের মহিমা কীর্তন করেন; আর তাদের ব্যাখ্যা-ভাষ্য আমাদের জানাতে থাকে যে, ইন্দ্রনাথ ও শ্রীকান্ত হচ্ছে তাদের স্রষ্টা শরৎচন্দ্রের গভীরতম কল্পনা-প্রতিভার ফসল। শরৎচন্দ্র এদের গড়েছেন ‘আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে’, গড়েছেন নিজ কল্পনা দিয়ে। ওরা দু’জন দুরন্ত মৌলিক সৃজন, এরা কোনো প্রভাবজাত সৃষ্টি নয়। যদিও মার্ক টোয়েনের টম সয়্যার ও হাকলবেরি ফিনের অভিযানযাত্রা পাঠের পর দ্বিমত করার সুযোগ থাকে। আবার দু’একজন বিদ্বজ্জন, বিশেষ করে শরৎচন্দ্রের হিন্দিভাষী জীবনীকার বিষ্ণু প্রভাকর, একটু ভিন্ন ধারণাও পোষণ করেন। তার অনুমান, ইন্দ্রনাথ চরিত্রটি শরৎচন্দ্র, আসলে গড়েছেন তার বাল্যসখা রাজু-র আদলে। কিশোর বয়সে, ভাগলপুরে, মামাবাড়িতে থাকার কালে, ওই রাজু নামের কিশোরটির সঙ্গে শরৎচন্দ্রের প্রবল সখ্য গড়ে ওঠে বলে জানা যায়। বিষ্ণু প্রভাকর এমন তথ্য দেন: “অদ্ভুত চরিত্রের এই রাজু-শক্তিমান। বংশীবাদনে দক্ষ, ভালো অভিনেতা, কিন্তু নানাজনে নানা কথা তার বিষয়ে বলে। প্রতিভাশালী বংশে তার জন্ম,.. .. .. এই প্রতিভাই আবার তাকে কোনো জায়গায় কোনো একটা বিষয়ে টিকে থাকতে দিতো না। বদমাশ সে ছিল না, ছিল শুধু দুঃসাহসী। যোগ ও আনন্দে সে পূর্ণ থাকতো– যেমন গঙ্গাজল সবকিছুকে করে তোলে পবিত্র। নিজের একটা নৌকা ছিল, সেটাতে করেই রাজু ঘুরে বেড়াত। কখনও অন্ধকার রাতে, ভরা গঙ্গায়। শরৎকে বলত, ‘চল, নৌকো চড়ে বেড়িয়ে আসি।’ বিষ্ণু প্রভাকর মনে করেন, ‘শ্রীকান্ত’ প্রথম পর্বে রাজুই দেখা দেয় ইন্দ্রনাথ নামে, আর শ্রীকান্ত তার স্রষ্টারই কিশোর মূর্তি।”
চরিত্র দুটি বেপরোয়া কর্মাবলির অপার দৌরাত্ম্যগুণে শুধু চিত্তমুগ্ধকর বিস্ময়-জাগানিয়া আর অনন্যই হয়ে ওঠেনি; সাহিত্য-দুনিয়ায় অমরত্বও লাভ করেছে।
মন্তব্য করুন