- কালের খেয়া
- কিশোর অপরাধ ও গ্যাং কালচারের স্বরূপ উন্মোচন
বইয়ের ভুবন
কিশোর অপরাধ ও গ্যাং কালচারের স্বরূপ উন্মোচন

নন্দিত শৈশব এবং বাংলাদেশে কিশোর অপরাধ ও গ্যাং কালচার, লেখক -শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন, প্রকাশক-পাঠক সমাবেশ, প্রচ্ছদ-আনিসুজ্জামান সোহেল, দাম-৩৯৫ টাকা
রৌদ্রকরোজ্জ্বল শিশির ভেজা ঘাসে, ফুলের বনে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ানো শৈশব-সারল্যের চাদরে মোড়া থাকে নবীন কিশোরের রঙিন প্রজাপতি-জীবন। কিন্তু ভুল পথে নানা অপরাধে জড়িয়ে অনেক কিশোর এই সময়টা ভয়ংকর করে ফেলে, ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে দুষ্কর্মে। শিশু-কিশোরের মধ্যে এমন ভয়ংকর রূপ নেওয়া সমসাময়িক সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম গ্যাং কালচার। সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদের ভিত্তিতে দেশে অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে কিশোর গ্যাং কালচার ভয়াবহ চিত্রের দেখা মেলে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ার পাশাপাশি স্থানীয় নানা কারণে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোররা ব্যবহৃত হচ্ছে অবলীলায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের অপরাধের ধরনও পরিবর্তিত হচ্ছে। নিজ নিজ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, চুরি-ছিনতাই থেকে শুরু করে খুনাখুনিসহ নানা অপরাধে কিশোর-তরুণ জড়িয়ে পড়ছে। মাদক ব্যবসা ও দখলবাজিতেও তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে পরিণাম না ভেবেই।
এমন এক পরিস্থিতিতে নন্দিত শৈশবে অপরাধ ও গ্যাং কালচারের নানা বিষয়ের রূপরেখা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন সংক্ষিপ্ত পরিসরে রচনা করেছেন তথ্য-উপাত্তভিত্তিক এক বিশেষ গ্রন্থ ‘নন্দিত শৈশব এবং বাংলাদেশে কিশোর অপরাধ ও গ্যাং কালচার’।
দেশে বিদ্যমান কিশোর অপরাধ ও গ্যাং কালচারের বিশ্লেষণ, সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসাব ও বাস্তবতা, বযঃসন্ধিকালের আবিষ্কার, শৈশব ও কৈশোরের গুরুত্ব, তাত্ত্বিক আলোচনায় বিশেষ মনোযোগ দিয়েছেন লেখক। মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে বাংলাদেশের কিশোর অপরাধের বাস্তবতা ও বিস্তৃতি এবং গ্যাং কালচারের উৎপত্তি, বৈশিষ্ট্য ও বিস্তার সম্পর্কে নানা বিষয়ের অবতারণা আমাদের দৃশ্যমানভাবে দেখিয়ে দেয়, এটি নতুন কোনো সমস্যা নয়। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই সমস্যা এখন প্রকৃতপক্ষে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে উঠেছে। তবে দলীয়ভাবে অপরাধের সংস্কৃতিতে জড়িয়ে পড়া কিশোর ও কিশোরীরা সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্রের জন্য কতটা ভয়াবহ সংকট তৈরি করতে পারে বা করছে তা উপলব্ধি করার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানের কিশোর গ্যাংয়ের দ্বারা সংঘটিত কিছু মর্মান্তিক ঘটনা কেস স্টাডি আকারে দারুণভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা রয়েছে এ গ্রন্থে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ঢাকা শহরে ৭৮ এবং চট্টগ্রামে ৩১টিসহ সারাদেশের শহরগুলোতে কয়েকশ কিশোর গ্যাং দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ব্যক্তিজীবনের ওপর শৈশবের অমোচনীয় প্রভাব এবং অস্বাভাবিক শৈশব কীভাবে একজন ব্যক্তিকে অপরাধী, এমনকি সিরিয়াল কিলারে পরিণত করে, এর বাস্তুবচিত্র মিলবে এই গ্রন্থে। কিশোর অপরাধ ও গ্যাং কালচার-বিষয়ক তথ্য-উপাত্ত ও বাস্তবতার আলোকে পাঠককে শেষ পর্ব পর্যন্ত ধরে রাখবে প্রতিটি পর্বের গুরুত্বপূর্ণ লেখা। দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী জিতু কর্তৃক নৃশংসভাবে শিক্ষক উৎপল কুমার হত্যাকাণ্ড, বরগুনায় ০০৭ গ্যাং কর্তৃক রিফাত শরীফ হত্যা, গ্যাং লিডার নদী আক্তারের অপকর্ম, নারী পাচারকারী ও যৌন নির্যাতনের কুশীলব টিকটক হৃদয়সহ কিশোর অপরাধ ও গ্যাং কালচারের কেস স্টাডিতে লেখক উদাহরণ হিসেবে এবং আলোচনার সুবিধার্থে তুলে ধরেছেন কিছু ভয়াবহতার চিত্র। এ ছাড়া ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও দলগত এই দুর্ধর্ষ কিশোর অপরাধী দল গড়ে ওঠার গল্প তিনি পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন নিজস্ব ভঙ্গিতে।
নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও বিশ্বায়নের যুগে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আসছে। তথ্যপ্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আগমনে যেমন নতুন নতুন সমস্যা ও পরিস্থিতি তৈরি হবে, তেমনি সম্ভাবনার নতুন দুয়ার উন্মোচিত হবে। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই বইটিতে দেশের পাঁচ কোটির বেশি শিশু-কিশোরের শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও মূল্যবোধের বিকাশকে নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। যদিও তিনি এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সহজগম্য কোনো পথের নির্দেশ করেননি, তবুও দায়িত্বশীল কল্যাণরাষ্ট্র ও মানবিক সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে শিশু-কিশোরের জন্য অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে শুধু সমস্যা নির্ধারণ কিংবা বাস্তবচিত্র উপস্থাপনই নয়, লেখক অভিভাবক, সমাজ ও রাষ্ট্রের করণীয় সম্পর্কেও আলোকপাত করেছেন সমসাময়িক বাস্তবতায়। আবার এতে শুধুই যে সমসাময়িক বিষয় নিয়েই আলোচনা করেছেন তা নয়, তিনি ঐতিহাসিক বাস্তবতাকেও নির্দেশ করেছেন। কৈশোরকালীন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলি যা পথচ্যুত করতে পারে যে কাউকে, সেইসব বিষয় চিহ্নিত করেছেন। শিশু-কিশোরের সুস্থ জীবন থেকে বিচ্যুত হওয়া, সমাজবিরোধী ও অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে যাওয়ার বাস্তবতা বোঝার জন্য প্রয়োজন ব্যক্তির শৈশব ও কৈশোরের সুখস্মৃতি, সংগ্রাম ও আনন্দ-বেদনার প্রভাব বিশ্লেষণ। এ গ্রন্থে নানা আলোচনা, বিশ্লেষণ ও ঘটনাগুলোর অনুপুঙ্খ বর্ণনার মধ্য দিয়ে বিষয়গুলো পরিপূর্ণ উপলব্ধির মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়েছে। শিশুর কগনিটিভ ডেভেলপমেন্ট অর্থাৎ বুদ্ধি, যুক্তি ও আবেগীয় বৃত্তির বিকাশে প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বহু অনুষঙ্গ তুলে এনেছেন। যার পাঠ ও বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে পাঠক খুঁজে পেতে পারেন আগামী প্রজন্মের শিশু-কিশোরকে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনদানের পথনির্দেশ।
মন্তব্য করুন