ধারাবাহিক
একদা সোভিয়েত ইউনিয়নে

রেড স্কয়ার, মস্কো, ১৯৮৬
হাসনাত আবদুল হাই
প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০
ভূমিকা
‘একদা, সোভিয়েত ইউনিয়নে’, ধারাবাহিকের এই নাম দুই অর্থে। প্রথমত, আমি একদা সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়েছিলাম, এই লেখা সেই সফরের অভিজ্ঞতার ওপর। দ্বিতীয় অর্থ হলো, একদা সোভিয়েত ইউনিয়ন বলে একটি দেশ ছিল, সেই দেশের কাহিনি বলার চেষ্টা করা হয়েছে এখানে। বর্ণনা করা হয়েছে দুইভাবে: (ক) ভ্রমণ অভিজ্ঞতা হিসেবে এবং (খ) বই পড়ে কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয়ের তথ্য পরিবেশনার মাধ্যমে।
একদা, সোভিয়েত ইউনিয়নে আধুনিক যুগের রূপকথা। পার্থক্য এই, যে দেশ নিয়ে এই কাহিনি সেটি কল্পিত নয়, একদিন বাস্তব ছিল। খুব খোলামেলা ছিল না সেই রূপকথার দেশ, বেশ রহস্যঘেরা। অনেক কিছু ছিল ধূসর অথবা ছায়াচ্ছন্ন। এমন যে দেশ তাকে নিয়ে গল্পগাথা লেখা হবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই, লেখা হয়েছেও বিস্তর। এখন যে দেশটি আগের চেহারায় খুঁজে পাওয়া যায় না, সেটাও এক ধরনের কৌতূহল সৃষ্টি করে, সেই সঙ্গে নস্টালজিয়া। সেই মিশ্র অনুভব থেকেই এই কাহিনি বলার সূত্রপাত।
লেখার কথা ছিল অনেক আগে, ১৯৭৮ সালে, যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে ১০ দিনের সফরে যাই আমি। যে দেশ সম্বন্ধে এত শুনেছি, এত বই পড়েছি, তাকে স্বচক্ষে দেখা এক পরম সৌভাগ্য বলেই মনে করেছি। দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখার ইচ্ছা ছিল প্রথম থেকেই, যে জন্য যা দেখেছি, যা শুনেছি, তার ওপর নোট নিয়েছি প্রচুর। কিছু সংলাপও তার মধ্যে ছিল। কিন্তু মাত্র ১০ দিনে এত বিশাল এবং জটিল দেশ সফর ছিল পাখির চোখে দেখার মতো। তার ওপর ভিত্তি করে সেই দেশকে জানা গেছে মনে করা অর্বাচীনের মতো শোনাবে। কিন্তু পাখির চোখে দেখে ভাসাভাসা ভাবে লেখা, সেটাও হয়ে ওঠেনি দেশে ফিরেই কেমব্রিজে একটা কোর্স করতে যাওয়ার জন্য। তারপর ঢাকা থেকে অন্য জায়গায় বদলি। কাজ উপলক্ষে আবার বিদেশে যাওয়া। আবার কর্মস্থল পরিবর্তন। আধুনিক যাযাবরের এই জীবন যাপন করে সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর লেখার বাসনা একসময় উবেই গিয়েছিল।
এত যে ঠিকানা পরিবর্তন, সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর নেওয়া নোট কিন্তু হারায়নি, আমার অজান্তেই সঙ্গে সঙ্গে ঘুরেছে। তারপর দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর পর, কর্মজীবন থেকে অবসর নেওয়ার তেইশ বছর অতিক্রম করে এলে সামনে এসে বলল, এবার?
দেখলাম নোটের বয়স হয়েছে, আমার মতোই জীর্ণশীর্ণ ভঙ্গুর। মুখের বলিরেখার মতো তারও পৃষ্ঠায় দাগ, অস্পষ্ট পড়া যায় কি যায় না। কিন্তু আমারই তো হাতের লেখা, তাই পড়ে বোঝা গেল তিন-চতুর্থাংশ। দেখলাম কী নিবিষ্ট হয়ে নিয়েছিলাম নোট, কত তথ্য, কত উপাত্ত। মনে হলো, এদের প্রতি সুবিচার করতে হয়। কত দেশ নিয়ে লিখলাম, এর ওপর না লিখলে অন্যায় হবে।
সঙ্গে সঙ্গে এ-ও মনে পড়ল, দেশটা এখন নেই। এরপর যেন নোটই বলে উঠল, তাতে কী? একদিন তো ছিল। সেই সময়ের কথাই না হয় তুমি লেখ, সেই একদা সোভিয়েত ইউনিয়ন নামে দেশটার কথা, যে দেশের জন্য নিযুত কোটি মানুষ ঝরিয়েছে ঘাম, ফেলেছে অশ্রু, করেছে রক্তপাত। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন দেশ কখনও ছিল না, হতে পারে এ কথা বিশ্বাস করেনি কেউ। কিছু ঘোরগ্রস্ত (obsessed) মানুষ জীবনযাপনের রীতিনীতি বদলে দেওয়ার জন্য মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে নিয়ে এসেছিল নতুন জীবনের মন্ত্র, উপকথার প্রমিথিউস যেমন নিয়ে এসেছিল মানুষের মুক্তির জন্য আগুন। অনেক অশ্রু, স্বেদ আর রক্তের বিনিময়ে সেই দেশটা গড়ে উঠেছিল। একের পর এক কঠিন পরীক্ষার পর দেখাতে পেরেছিল শোষণহীন সমাজ গড়া সম্ভব যেখানে মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটানো যায় উৎপাদন– সম্পদের ওপর ব্যক্তিমালিকানা ছাড়াই।
সেখানে ন্যায়ের সঙ্গে বেশ কিছু অন্যায় ছিল, বিচারের হাত ধরেছিল কখনও কখনও অবিচার। ভালো-মন্দ মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত এসে ভালোর দিকটাই ছিল বেশি, আমার তাই মনে হয়েছে। আরও ভালো হতে পারত যদি না এত বৈরিতার মুখোমুখি হতে হতো প্রথম থেকেই।
এটা ছিল রূপকথার মতোই একটা দেশ যে জন্য বাস্তবে যা স্বাভাবিক নয়, তাই ঘটেছিল সেই দেশে। দেশটির কাহিনি এমন ছিল যে মনে হয়েছে দারুণ রোমাঞ্চকর, মাঝে মাঝে ভীতির সঞ্চারও করেছে বটে, আবার যখন সুখকর কিছু ঘটেছে আনন্দে উল্লসিত হয়েছে মন। মতাদর্শের দিক দিয়ে আমি সব সময় নিরপেক্ষ, নতুন সমাজ গঠনের জন্য যে অভূতপূর্ব ভাঙাগড়ার ইতিহাস লেখা হচ্ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে তার প্রতি ছিল কৌতূহল আর জানার আগ্রহ। অনুরাগ কিংবা বিরাগ নিয়ে নয়, নির্মোহ হয়ে অনুসরণ করেছি তার খবর।
সেই রূপকথার দেশটির যে হঠাৎ পতন হলো তার কারণ কী? টাকাকড়ির অভাবে ব্যর্থ হয়ে গেল অন্য দেশের চেয়ে ভিন্নভাবে চলতে গিয়ে? তাই যদি হবে দীর্ঘ পঁচাত্তর বছর পর কেন? নাকি নেতৃত্বের ব্যর্থতা? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য বইটি লেখা হয়নি। পঁয়তাল্লিশ বছর আগে দেশটিকে আমি যেমন দেখেছিলাম, দেখেশুনে যা মনে হয়েছিল আমার, সে কথা জানাবার জন্য এই বই লেখা। দেখার ভিত্তিতে বিষয়গুলো যেভাবে আসার কথা, সেভাবেই এসেছে। কিছু সংলাপ লিখে রেখেছিলাম নোট করার সময়, সেভাবেই লিপিবদ্ধ হয়েছে বইতে। বেশির ভাগ সংলাপ কল্পনা করতে হয়েছে, কিন্তু যেহেতু এই কল্পিত সংলাপগুলো বাস্তব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃত চরিত্র সম্পর্কিত, সেই জন্য বাস্তববর্জিত নয়। যে বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে তা দ্রুত সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ন্যারেটিভের এই কৌশল অবলম্বন।
(১)
২১ আগস্ট, ১৯৭৮
যাত্রাপথে
অন্ধকারে মুখ দেখা যায় না, তবু যাত্রীরা টার্মিনাল ভবন থেকে বাইরে আসতেই অদূরে টার্মিনালের ছাদে অপেক্ষমাণ আত্মীয়স্বজন হর্ষধ্বনি দিয়ে উঠল। টারমাকে উড্ডয়ন প্রস্তুত একমাত্র এরোফ্লোটের ইলিউশিন বিমান। সুতরাং বাইরে বেরিয়ে আসা যাত্রীদের গন্তব্য যে সেটিই, এমন অনুমান করতে বেগ পেতে হয়নি উৎসাহী বিদায়দানকারীদের। দূরপাল্লার বিমানযাত্রা বহুদিন হলো এ দেশে চালু হয়েছে কিন্তু প্রথম দিকে যেমন, এখন এই এত বছর পরও বিদেশযাত্রীদের বিমানবন্দরে এসে বিদায় জানাতে আসা কিংবা অ্যারাইভালের পর অভ্যর্থনাকারী আত্মীয়স্বজনের উপস্থিতি কিছুমাত্র কমেনি। ইউরোপে বা আমেরিকায় এই দৃশ্য বিরল, কদাচিত দুই-একজন আসে, তাও হয়তো বিশেষ প্রয়োজনে। প্রাচ্যদেশে দূরপাল্লার যাত্রীদের জন্য নিকটজনের এই যে অনুভূতি এবং উচ্ছ্বাস সে কি দূরদেশে যাচ্ছে পরমাত্মীয় কেউ বা ক’জন সেই জন্য, না তাদের চোখে যে রোমান্স জড়িয়ে রয়েছে বিমান ভ্রমণের সঙ্গে, সেই কারণে? এর উত্তর আমার জানা নেই।
আমার সংবিৎ ফিরে এলো যাত্রীদের সহাস্য কলরোলে। দেখলাম যাত্রীদের অনেকে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেই ওপরে হাত তুলে প্রবলভাবে হাত নেড়ে ছাদে দাঁড়ানো বিদায় জানাতে আসা মানুষের উদ্দেশে কিছু বলছে। অন্ধকারে কাউকে দেখা যাচ্ছে না, কে বা কারা কাকে হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে কিছুই বোঝার উপায় নেই। কিন্তু তার জন্য কোনো পক্ষেরই মাথাব্যথা নেই এবং উৎসাহে একটুও ভাটা পড়েনি। এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর গ্রাউন্ড স্টাফের তাগাদায় জমাটবাঁধা যাত্রীদের লাইন সচল হলো, রাশিয়ায় শীতের পর বসন্তের আগমনে যেমন বরফ গলে। উপমাটা সহজেই মনে এলো। কেননা, আমরা অপেক্ষমাণ প্লেনে করে রাশিয়া যাচ্ছি। এয়ারপোর্টের ম্লান আলোয় তাকিয়ে দেখলাম যাত্রীদের অধিকাংশ তরুণ ও যুবক। তাদের গলায় ফুলের মালা। সহযাত্রী হোসেন সাহেব বললেন, সব ছাত্র। রাশিয়ান সরকারের স্কলারশিপে পড়তে যাচ্ছে সেখানে। আমি এদের কথা শুনেছি, এই প্রথম দেখলাম। হয়তো এটা তাদের প্রথম বিমান ভ্রমণ, তার ওপর যাচ্ছে উচ্চশিক্ষার জন্য। বেশ ফুর্তির মেজাজে আছে সবাই, কথা বলছে জোরে জোরে, যেন আড্ডার আসরে জমায়েত হয়েছে। হোসেন সাহেব কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললেন, “বাঙালিদের এই এক সমস্যা। পরিবেশ জ্ঞান থাকে না যখন একত্রিত হয় নিজেদের মধ্যে। হাসাহাসি করে জোরে, কথা বলে চেঁচিয়ে।”
তিনি এমনভাবে কথাগুলো বললেন যেন নিজে বাঙালি নন। [ক্রমশ]
- বিষয় :
- ধারাবাহিক