
ছোট্ট কাঞ্চন যখন দুপুরের ভাতঘুমের তোয়াক্কা না করেই রোদের জাফরিতে মিশে দমাদম পুবের ঘরের জানালায় ধাক্কা দিচ্ছিল, দীপা রানী তখনও নানান ভঙ্গিতে বিছানার নরম পালকে শুয়ে। ঘুমের মধ্যেও নিসাড়ে দু’পাল্লার একটি নির্জন দরজার ফুটোয় তৃষ্ণার্ত চোখ রেখে ইতিউতি খোঁজে, আহা, সে কই? কই গেল? তাকে তো তিন নম্বর বেডে ভর্তি করা হয়েছিল! তাহলে সে কোথায়? আশ্চর্য, একসময় যখন দেখে– হাসপাতালের সারি সারি বেডের শেষের একটিতে শশীকান্তের নিলাজ বেহায়া মুখটি মুমূর্ষু আর্তিতে বাম থেকে ডানে, ডান থেকে বামে দোল খাচ্ছে তখন সে খানিকটা স্বস্তি পায়। যদিও একজন সুস্থ মানুষ কেন এমন বারবার মাথা ঘোরায়– এর নিগূঢ় অর্থ খুঁজতে সে যখন আরও কাছে গিয়ে দরজার ওপাশে চোখ রেখে খানিকটা উবু হয়ে দাঁড়ায়, হঠাৎই দরজার একখানা পাল্লা নিঃশব্দে খুলে যায়। আর দীপা রানী– শশীকান্তর বিয়ে করা বউ– দরজা থেকে ক্রমশ পিছিয়ে আসতে আসতে দেয়াল আর থামের মাঝখানে এসে পিঠে ধাক্কা খায়! শশীকান্ত যেন জলে ডোবা পাহাড়– বিছানায় খাবি খেতে খেতে কামার্ত গলায় বলে, ‘ভুগ লাগছে রে দীপা! খাইতে দে...’ অন্তলীন ঘুমের মধ্যেও দিশেহারা ডোঙাঘাটের ফ্রক পরা দীপা– নাকডিহির দীপা রানী– মঙ্গলাপুরের দীপা রানী শীল অস্ফুট ঠোঁট নাড়ে, ‘কী খাবা– কী খাবা?’ শশীকান্তর হারানো স্বরটা মিথ হয়ে শূন্যে মিলিয়ে যাবার আগেই একেকটি ডুবো শব্দ বাতাসকেও ভারী করে দেয়, ‘তোরে, তোরে খামু রে! ইকান থেইকা নিয়া যা...’
সেই তো এক কথা! হায়রে, মানুষটার এইসব দ্বিধাহীন কথাবার্তাই একদিন মোক্ষম অস্ত্র হয়ে ঘায়েল করেছিল দীপা রানীকে। না হলে সে এক কাপড়ে, এক দিনের তফাতেই এই শীলবাড়ির বউ হয়ে উঠত না! এইসব ছেঁড়াখোঁড়া ভাবনা যখন ঘটনার আট মাস পরের দুপুরেও ঘুমের অতলে এসে খাবি খায় তখনও ফ্যাঁসফেঁসে কচি কণ্ঠের ডাকটা ‘ও মামিমা, ছোডো মামিমা! দোরডা খুলো না...’ বলে দীপা রানীর এই নির্ভেজাল স্বপ্নভীতির মাঝখানে দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়! তড়িঘড়ি ঘুমের পাকদণ্ডি বেয়ে অবচেতন থেকে সে আয়ুর পৃথিবীতে ঢোকে। ধীরে ধীরে দু’চোখের পাপড়ি মেলে। শাঁখা-পলাহীন বিহ্বল হাতে অবিন্যস্ত শাড়িটা গুছিয়ে বুক ঢাকে। পরনের পেটিকোটও পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত নামিয়ে দেয়। এরপর কোনো রকমে ঘুমঘুম টালমাটাল পায়ে কাঁসার গ্লাসটা উপুর করে মুখে জল ঢালে। মুখে জল ঢালতে গিয়েও আরেক বিপত্তি! অন্যমনস্ক হয়ে খেতে গিয়ে কিছুটা অংশ গলায়, কিছুটা ব্লাউজে গড়িয়ে পড়ে। ততক্ষণে পুবের জানালায় কাঞ্চনের দমদমাদম ঘা-ও থিতিয়ে আসে। কী জন্যে সে ছোট মামির ঘরে পড়িমড়ি করে ছুটে এসেছিল– জঙ্গলে ঢোকা শিশু হরিণের মতো বেমালুম ভুলে যায়। জানালার শিকে নুয়ে থাকা চির ধরা কলাপাতার কচি অংশ পেড়ে সেটিতে বাঁশি বানিয়ে সুর ভাঁজতে ভাঁজতে পুকুরপাড়ের দিকে আবার হেঁটে যায় আপনমনে। পুবের জানালা খুলে এই অভাবনীয় দৃশ্য দেখে দীপা রানী কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে থাকে। এগারো বছরের ছেলেটা যেন অবিকল শশীকান্ত! চোখের চাহনি, গড়নে-চলনে-বলনে সবকিছুতেই। দুপুর হতেই আজকাল এদিকে প্রায়ই আসে। একে সদ্য বিধবা, তায় আবার পাহাড়ি, নাগেশ্বরীর চাঁপা নাকের ফণা তোলা কন্যা– শাউড়ি, ননদ, জা-রা তাই যাকেতাকে এদিক পানে আসতে দিতে চায় না! দীপা রানী বুঝতে পারে সবকিছুতে তার অধিকার থাকলেও, শশীকান্ত চলে যাবার পর থেকে তার রাজ্যপাট ধীরে ধীরে অন্যের অধিকারে চলে যাচ্ছে। শশীকান্তকেও অনেক চোখ রাঙিয়ে বউয়ের কাছ থেকে দূরে রেখে লাভ হয়নি। বরং সে প্রতিদিনের মতো দোকান বন্ধ করে সরাসরি দোর দিয়ে না ঢুকে, পুকুরপাড় দিয়ে এসে পুবের ঘরের জানালায় ঠেস দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। এরপর কলাপাতা মুড়ে তাতে ফুঁ দিয়ে প্রিয় গানের সেই বিচ্ছেদী সুর ধরে– ‘কেমনে ভুলিব আমি– বাঁচি না তারে ছাড়া– আমি ফুল– বন্ধু ফুলের ভ্রমরা...’
সেবার আশ্বিনের শুরুতে বর্শার ফলার মতো বিঁধে যাওয়া বৃষ্টি হলো খুব। পুবপাড়া-পশ্চিমপাড়া সমস্ত ফসলের মাঠ ভেসে গেল উজানের ঢলে। আস্ত একটা পৃথিবী যেন গিলে নিতে থাকে জলদানবের হাঁ-করা মুখ। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শস্যভান্ডারের শেষ বীজকণাটুকুও ঢুকে যায় নিঃসীম জলের ট্র্যাজিকে। সরকারি-বেসরকারি কোনো সাহায্যও ঠিকঠাক এসে পৌঁছায় না। তাও গাঁয়ের গাঁওবুড়ো আর সমাজপতিরা সামান্যটুকু পায়। কিন্তু সাধারণের পেটে-ভাতে কিছু মেলে না। শেষে হতাশাগ্রস্ত জীবনকে পেছনে ফেলে নাকডিহিতে এসে থিতু হয় দীপা রানীর বাবা। তখন সে কালো কেশরাশিতে ভরপুর ছিপছিপে এক কিশোরী আর ভাইটা ছিল ওর বছর দুয়েকের বড়। ওদের কাছে নাকডিহি যেন ফুটন্ত এক গোলার্ধ, আর নাগেশ্বরী– আশ্চর্য জল পিপাসার ঠিকানা। পাখি যেমন খাঁচার বাইরে এলেই রাজসিক উড়ালে চলে যেতে চায় একেবারে পৃথিবীর ভরকেন্দ্রে, ওরাও ভাইবোন দুটিতে ছাড়া পেলেই হরিহর আত্মার মতো নৌকায় করে ঘুরে বেড়ায় নাগেশ্বরীর ক্ষীণতোয়া শরীরের খাঁজে, শুকনো খালবিলে। আবার কখনও সবুজ ঘাসের জঙ্গলে ছাগল চরাতে যায়, কখনও দুরন্ত ভেড়ার পাল খেদায়। নাকডিহির নতুন বাড়িতে উঠে এক পৌষসংক্রান্তিতে মা ভেড়ার মাংস, বিন্নি ভাত আর নানা রকমের শাক-ভর্তার পদ রান্না করে। সাথে গরম গরম পিঠা, গরুর দুধের পায়েস। গাঁওবুড়োসহ বাবা কাছের ক’জন বন্ধুকেও নিমন্ত্রণ করে বাড়িতে ডাকে। সেদিনই এত আয়োজনের মধ্যে ঠাকুরদার দাড়ি কামাতে আসে মঙ্গলাপুরের শীলের পুত শশীকান্ত। তিন রাস্তার মাথায় তেলেভাজার যে দোকানটা– তার সাথে লাগোয়া l
‘মায়ের দোয়া’ নামের স্যালুনের একাংশের মালিক শশীকান্ত– মিশমিশে কালো, ঠাকুরমার ভাষায় যেন শিমূল বাজারের কাঠকয়লার গুঁড়ো। আহারে, বাড়িতে ঢুকেই এমন ঢ্যামনা ছেমড়া বারকতক পানি খাওয়ার ছলে ঘুরঘুর করে রান্নাঘরের আনাচে-কানাচে। অকারণে কাপ-গেলাস রাখতে গিয়েও গোলপানা টোল পড়া গালের দীপা রানীকে দেখে যায় অলিখিত শুভদৃষ্টির বিনিময়ে। এসবই অবশ্য ঠাকুরমার নিজস্ব বয়ান, যেরকম ফাজিল টাইপ মহিলা, তার শশীকান্তও যে তাই। এক্কেবারে সেয়ানে-সেয়ানে। তা নইলে এমনতর বহু তীক্ষ্ণ সরু প্রশ্নবিদ্ধ চোখ এড়িয়ে শুধুমাত্র দাড়ি কামানোর উছিলায় এক দিনের ভক্তিরসে টইটম্বুর হয়ে কেউ অন্য বাড়ির মেয়েকে বগলদাবা করে দূরের পথে সটকে পড়তে পারে! অবশ্য শশীকান্ত বলে কথা। তখন সে বেজায় অসুখী, পার্টনারে ভরসা পায় না। আর এই পাহাড়ি বাড়িতে এসে সংক্রান্তির দিনে মনের বীজটা পোঁতা হয়ে গিয়েছিল, এখন শুধু উপড়ে নিয়ে বাড়ি ফেরার অপেক্ষা। সুযোগটা হাতের মুঠোয় এলো, সান্ধ্য আয়োজনে তাকেও যখন রাতের খাবার খেয়ে যেতে বলা হলো। দীপা তার পাতে মাংস তুলে দিচ্ছিল। শশীকান্ত মুচকি হাসিতে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘তুমি অনেক সোন্দর! অ-নে-ক... বিশ্বাস করো– এর আগে গালে টোল পড়া যুবতী দেহি নাই! হাসতেছো? সত্যি বলতেছি...’ –এই প্রথম কথা। সেই কথা বলা নিয়েও কত কথা! এরপর তো কথার পিঠে কথা। আর থামতেই চায় না সে কথা...
‘কী কত্তাম, আফনের কতা হুইনা হাসন আসে! আমার ঠাকুম্মা কয়, টোল পড়া মাইনষের সঙ্গী বাঁচে না!’
– ‘কইছে, তোমারে! গণকঠাকুরে হাত দেইখা নিদান দিছে– আমার পরমায়ু একশ বছর! – আমার লগে যাবা? অনেক যত্নে রাখুম তোমারে...’ হারিকেনের মৃদু সলতে আলোয় সেদিনের সেই জ্বলজ্বলে চোখ দুটোতে কী দেখেছিল দীপা রানী? – এরপর আরও কিছুক্ষণ বাজনা, আরও পাহাড়ি গান, দলীয় নাচ, পানাহার শেষে চাঁদ যখন মাঝ আকাশে ছিন্নভিন্ন আকাশে উঁকি দেয় তখন যে যেখানে পারে নিজেদের শয্যা পাতে। এদিকে নাপিত ছেলেটাও তক্কে তক্কে থাকে। দীপা রানীর হাত স্পর্শ করে। সেই স্তব্ধ রাতে কুড়িয়ে নেয় পথের দূরত্ব। এরপর ভোরে ভোরে কোন অনন্তের জোর ইঙ্গিতে দীপা রানীকে মনের সাথে শক্তপোক্ত বেঁধে রওনা হয় বাসস্ট্যান্ডের দিকে...। আহা, সেই দেহটা আর নাই, মানুষটাই নাই হয়ে গেছে! কিন্তু মানুষটার আইঢাই করা হইচইয়ে মেতে থাকা মনটা দীপার সাথে এমন গেঁথে আছে, বরং তা থেকে বেরুতে গেলেই ক্যামন হাঁসফাঁস লাগে, রাত বাড়লে আরও অস্বস্তি হয়। সেদিন বাস থেকে নেমেই সোজা মঙ্গলাপুরের বাড়িতে ঢুকে একটা হইহই রইরই ব্যাপার ঘটে যায়। মা-ভাইদের দিকে তাকিয়ে শশীকান্ত সোজাসাপটা সরাসরি বলে, ‘দেহো তোমরা– যুবতী কইন্যা রে ভালোবাইসা নিয়া আসছি, তারে সম্মান দিতে চাইলে বউ কইরা ঘরে উডাও, না চাইলে সাফ সাফ বইলা দাও...’ ছেলের তেজ দেখে মা তখন চোখ মুছতে মুছতে বধূবরণের আয়োজন করে, ভাইয়েরা কলাগাছ পুঁতে বিয়ের মঞ্চ বানায়, বিয়ের পুরুত ডাকে। ভাইয়ের বউ-বোনেরা দীপা রানীকে মুখ কালো করে কনের সাজে সাজায়। ভাবে পাহাড়ি কন্যার গালে হাসতে গেলে টোল পড়ে, টুকটুকে ফর্সা ছিপছিপেও, মাথায় আবার লম্বা-কালো কেশরাশি– আর কীসে সে ছোট ভাইটার মন ভোলাল, একরোখা বাউণ্ডুলেটাকে ঘরে ফেরাল?...
দীপা রানী আসলেই জানে না, কীভাবে, কোন মন্ত্রবলে সে শেষমেশ একটা চ্যাংড়া নাপিতের হাত ধরে জাতপাতের কথা না ভেবেই তার ঘর করতে চলে এসেছে! কিন্তু বিয়ের মন্ত্র শেষে, বাস্তবে মেয়ে-বুড়ো সবার গা টেপাটেপি আর চাপা হাসিতে টের পায়, জাতপাত ছাড়াও সমাজ বলে একটা ব্যাপার দেশে-দেশে, ঘরে-ঘরে আছে। এই পৃথিবীর সবচেয়ে আপন মানুষদের ছেড়ে অচেনা এক বাড়িতে এভাবে হুট করে চলে আসাটা তার ঠিক হয়নি কো। হায়রে, ভাইকে খুব মনে পড়ে– এখন কার সাথে পাল্লা দিয়ে নাগেশ্বরীর বুকে সে নাও ভাসাবে? মায়ের বাস্তুদেবীরে পুজো দেবার সময় কে মায়ের ফুল, জল, নৈবেদ্যর থালাডা সাজায়ে দেবে! ওরে, বিরাট ভুল হয়া গেছে, তোমরা আইসো গো, নিয়া যাও মোরে...
এরপর এত বুক চাপরানো আর এত হায় হায় আহাজারি! চোখের জল, নাকের জলে এক করা দীপা রানীর মনের ভাও বুঝতে না পেরে শশীকান্ত নিজেই তব্দা খেয়ে যায়। শেষে বাসরঘরের দরজায় শক্তভাবে খিল আটকে দিয়ে কাঁচুমাচু হয়ে দীপা রানীর পায়ের কাছে বসে ওর হাতে সোনার কাঁকন, আঙুলের আংটি খুলতে খুলতে কাকুতিমিনতি করে, ‘সেদিন কী বলছিলাম– তোমার এই টোল পড়া গালে আটকা পড়ছি আমি! এহন কীভাবে ছাড়াইবা– তুমিই শুধু জানো! আর কাইন্দো না, জাদুপাখিডা আমার... সারাজীবন বুকের মইদ্যে তোমারে যত্নে রাখুম, সোনা...’ এ যেন বাংলা সিনেমা। নায়কও কাঁদে, নায়িকাও কাঁদে। মাঝখানে শ্বশুরবাড়ির সতর্ক দৃষ্টি এদের দুটিকে পাহারায় রাখে।
সেদিনে– মাঘের রাত্তিরে ওরা শুধু সুনসান রাতটুকু না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয় রাতভর রতির পৃথিবীতে। পৃথিবীতে এরপর কত বদল এলো। দিন গেল, রাত এলো! শীলবাড়ির শশীকান্ত নাপিতের কাজ নিয়ে দুবাই গেল। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা পাঠাল। মঙ্গলাপুরে তাদের জমিজিরেত হলো, মা-বাবার কাছে আবার যাওয়াযাওয়ি হলো, ওখানেও জমিজিরেত হলো, গরু-বলদ কেনা হলো...
কিন্তু সব সত্যির এক সত্যি শেষমেশ একদিন হয়েই গেল! পূজার ছুটিতে শশীকান্ত দুবাই থেকে দেশে ফেরে। অনেক দিন ধরেই সে দেশে প্রস্রাবের সাথে রক্ত যাওয়া নিয়ে খুব ভুগছিল। হোমিওপ্যাথির চিকিৎসার পর অ্যালোপ্যাথিতে এসে দু’দিনের নোটিশে যখন হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো, তখন ডাক্তার নানা টেস্টের পর জটিলতা বুঝে জেনারেল ওয়ার্ড থেকে সোজা আইসিইউতে পাঠিয়ে দিল।
নাকে নল, কোনো কিছু খেতে না পারা, প্রস্রাব দিয়ে অবিরত রক্ত যাওয়ার ফলে শশীকান্তকে লাইফ সাপোর্টে দিতে হলো। দীপা রানী– পাহাড়ের মেয়ে। লাইফ সাপোর্টের কিছুই বোঝে না। আইসিইউর বড় দরজাটার একটা পাল্লা খুলে গেলে একছুটে শশীকান্তকে জিজ্ঞেস করে আসে, ‘কিছু খাইতে মন চায়?’ শশীকান্ত হাত নাড়িয়ে কত কিছু বলে! কিন্তু মুখে নল নিয়ে কথা বলা বারণ, তাই শুধু ইঙ্গিতেই ভাববিনিময় হয়। এর মধ্যে একদিন শশীকান্তর লাইফ সাপোর্টও খুলে দেওয়া হলো। সবাই বেজায় খুশি! শাউড়ি-জা-ননদ-ন’কাকিমা সবাই এসে হাসপাতালে ভিড় করে। নিজের বাবা, ভাইটাও একদিন এসে দেখা করে যায়। এর দু’দিন পরের ঘটনা– গভীর রাতে শশীকান্তর ক্যামন বুক ধড়ফড় করে! ক্ষীণ গলায় ডাকে, ‘ও দীপা, দীপা গো! আমার দীপা রানী রে ডাকো তো? ক্যামন ক্যামন লাগে!’
সে কী এক আর্তি, কী সে কান্নাজড়ানো সরু গোঙানি! ঘুম থেকে সবাই ধড়মড়িয়ে জাগে। শশীকান্তর ডাকে দীপা ব্যাকুল হয়ে এ-দরজায় ঘা মারে, ও-দরজায় ঘা দেয়। সুপ্রশস্ত আইসিইউজুড়ে আলো জ্বলছিল। অথচ কোথাও কেউ নেই, চারদিকে সুনসান ভূতুড়ে স্তব্ধতা। ভোজবাজির মতো যেন সবাই গায়েব হয়ে গেছে! লাইফ সাপোর্টের মেশিনগুলোর দীর্ঘ আর্তনাদ ছাপিয়ে– না ডিউটি ডাক্তার, না নার্স, ওয়ার্ডবয়, আয়া কেউ একজনও দীপা রানীর ডাকে সাড়া দেয় না, বন্ধ দরজাটা খুলে দেয় না! অথচ শশীকান্ত ইনিয়েবিনিয়ে বলে, ‘দরজাডা ভাইঙ্গা ফেলো, জাদু! ইকান থেইকা বাইর করো আমারে...’
বজ্রাহত সেই অমঙ্গলে রাতটা ফুরিয়ে এলে দীপা রানী দরজার ফুটো গলিয়ে ওপ্রান্তে চোখ রেখে দেখে, শশীকান্তর নিথর দেহটা ভোরের অপার্থিব আলোয় অদ্ভুতভাবে ব্যথায় কুঁকড়ে আছে! অথচ সকাল ফুটতে না ফুটতে কেউই শশীকান্তর অমীমাংসিত মৃত্যুর দায়ভার নিতে রাজি হয় না! দীপা রানী যেন নিষ্প্রাণ কাঠের পুতুল। যে, যা-ই বিষে জর্জর হিংস্র কথা রং চড়িয়ে বলে, সে নিজেকে চুপচুাপ, শান্ত-স্থির রেখে শশীকান্তর মৃতদেহটা আইসিউইর বেড থেকে আলতোভাবে ট্রলিতে তুলে নেয়। মানুষটার মুখের কষে একটা মাছি বসেছিল, সেটাকে তাড়াতে গিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে দ্যাখে– আশ্চর্য, মুখখানা যেন শীতে তিরতির কাঁপছে! আর চোখের পাতা খুলে ব্যথা ভুলে শশীকান্ত যেন মিটিমিটি ওর দিকেই তাকিয়ে হাসছে...
‘কী মিটমিটাইয়া হাসো ক্যান?’
‘তোমার টোল পড়া গালে– আমার জন্যে যাতনা দেহি!’
পুবের জানালার শিকটা ধরে কাঞ্চন আবার কখন এসে দাঁড়িয়েছে। ফিসফিসিয়ে বলে, ‘মামিমা, মা ব্যাগ গুছায়া নিতে বলছে! তোমার বাপের বাড়ি থেকে লোক আসছে...’ জানালার এ-প্রান্ত থেকে কাঞ্চনের মাথাটা প্রবলভাবে জড়িয়ে ধরে, ‘তুইও চাস, চইলা যাই?’ সাথে সাথে দীপা রানীর আঁচলে মুখ লুকিয়ে বাচ্চা ছেলেটা কাঁদো-কাঁদো গলায় বলে, ‘না, চাই না তো! বড় হইলে তোমারে বাড়ি নিয়া আসবো। টোল পড়া গালডা খুব সোন্দর...’
বিষয় : প্রচ্ছদ সেঁজুতি বড়ুয়া
মন্তব্য করুন