কথা
মানুষের কথা, কথার মানুষ

মাকিদ হায়দার
প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০
মানুষের বুদ্ধিমত্তার শ্রেষ্ঠতম আবিষ্কার ভাষা। মনের কথা ভাষাকে পেয়ে হলো ব্যক্ত। যার অর্থ– কথা ভাষারও প্রাচীন। মানুষ কথা বলে প্রয়োজনে, কখনও শিল্পের আঙ্গিকে। কখনও ভাষার শক্তিশালী উপস্থিতি সত্ত্বেও কথা থাকে অব্যক্ত। তার আদিম অস্তিত্বটি তখন অনুভবে উপস্থাপিত হয়। সেই অনুভব কখনও ইশারায়, কখনও নীরবতায় বাঙ্ময়। ‘কথা’ই মানুষের আত্মপ্রকাশের সবচেয়ে বড় শক্তি।
পৃথিবীতে কবে কখন থেকে মানুষ কথা বলেছিল, সে তথ্য আজ পর্যন্ত কেউ সঠিকভাবে দিতে পারেনি। আজকের পৃথিবীতে জনসংখ্যা ছয়-সাতশ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। দার্শনিক অ্যারিস্টটল আমাদের জানিয়েছিলেন, খুব সম্ভবত প্রথম মানব-মানবী কথা বলেছিলেন কয়েক হাজার বছরের ব্যবধানে। যেহেতু কথা এবং ভাষাকে মানুষ কোনোদিনই একসঙ্গে পায়নি। এখন বলা যেতে পারে পৃথিবীর জনসংখ্যা ছয়-সাতশ কোটি যা-ই হোক না কেন; মানুষের কথা, ভাষা, ধর্ম, আহার্য, পোশাক, সামাজিক রীতিনীতি প্রায় একই বলা যায়। হয়তো কিছুটা বৈচিত্র্য থাকলেও খুব বেশি তফাত থাকে না। পৃথিবীতে মানুষের ভেতরে কথাবার্তার আদান-প্রদান কল্পনা করতেও আনন্দের শিহরণ ঘটে।
বিগ ব্যাং তত্ত্ব অনুযায়ী ছোট একটি বিন্দুর বিস্ফোরণের পর সৃষ্টি হয়েছিল মহাকাশের অজস্র গ্রহ-উপগ্রহ-নক্ষত্র নিয়ে বিশাল ব্যাপ্তি। আমার বিশ্বাস, তা এখনও বিস্ফোরিত হচ্ছে। ফলে বেড়েই চলেছে সীমানা। মানবসভ্যতার তুলনা করা যায় এর সঙ্গে। মানবসভ্যতার যাত্রা শুরু হয়েছিল আফ্রিকার কোনো একটি অঞ্চল থেকে। পরে মানবগোষ্ঠী ছড়িয়ে পড়ে নানা দিকে। একদল চলে যায় মধ্য এশিয়ায়। সেখান থেকে পারস্য, চীন, ভারত হয়ে পৌঁছে যায় অস্ট্রেলিয়ায়। পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে, কানাডায়। প্রায় লক্ষ বছরের এই মানবজাতি একেক দেশে নিজেদের মধ্যে নিজেদেরই তৈরি কথার মাধ্যমে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছিল কথা বা ভাষা। বিভাগপূর্ব কালে তৎকালের ভারতীয় জনগণ বহু ধর্ম, জাতি ও ভাষায় বিভক্ত। যেমন– আমি আমার মাতৃভাষা বাংলাতে কথা বলি। পড়ালেখার সূত্রে যখন বিদেশে ছিলাম তখন বাধ্য হয়ে ইংরেজিতেই কথা বলতে হয়েছিল। আমাদের ভাইবোন পিতা-মাতার সাথে কথা বলতেন মাতৃভাষাতেই। অগ্রজ জিয়া হায়দার যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছর পড়াশেষে দেশে এসে কোনোদিন ভাইবোনের সাথে বিদেশি ভাষায় কথা বলেননি। সেজো ভাই রশীদ হায়দার দুই বছর যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে পড়ালেখা শেষ করে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করেননি। এমনকি আমি ফিলিপাইনের ম্যানিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শেষে স্বেচ্ছায় ইংরেজি কোথাও ব্যবহার করিনি।
আমাদের পিতা শেখ মোহাম্মদ হাকিম উদ্দিন নন-এন্ট্রান্স। ম্যাট্রিক পাস না করেই তিনি ব্রিটিশদের অধীনে চাকরি করেছেন আসাম বেঙ্গল রেলওয়েতে, মুসলিম কোটায়। তবে পিতা খুব ভালো ইংরেজি জানতেন, লিখতেন। সেই তুলনায় আমাদের মা রহিমা খাতুনের বিদ্যাশিক্ষা হয়েছিল ক্লাস থ্রি-ফোর পর্যন্ত। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই স্বামীর সংসারে এসেছিলেন তিনি।
মাকে দেখতাম অবসর সময়ে রবীন্দ্রনাথের চোখের বালি, গোরা, শেষের কবিতা, নৌকাডুবি প্রভৃতি বই পড়তেন। আমি তখন নবম-দশম শ্রেণির ছাত্র, পাবনা শহরের এক ধনীর কন্যাকে আমার খুবই পছন্দ হয়েছিল। সাহস করে সে কথা মাকে কোনোদিন বলতে পারিনি। এমনকি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার মধ্যখানে চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ীর কন্যার সাথে পরিচয় হলেও সে কথা মা এবং জিয়া ভাইকে বলতে সাহস পাইনি। অগ্রজ তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের প্রধান ও প্রতিষ্ঠাতা। জীবনে অনেক কিছু চাওয়া-পাওয়ার ইচ্ছা ছিল। পিতা চেয়েছিলেন আমি যেন ব্যারিস্টার হই। আমারও ইচ্ছা ছিল হয়তো একদিন নামকরা ব্যারিস্টার হবো। সেটা হতে পারলাম না, আশা মিটল না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে একটি ফার্মে কয়েক বছর চাকরি করে একটা শিক্ষা হয়েছিল। প্রাইভেট ফার্মের মালিক একদিন বিনা নোটিশে বিদায় করলেন। শামীমা, জেসমিন, মুমু আরও দুই-একজন আমার কর্মক্ষেত্রে ফোন করত এবং তাদের অনেকবার বলেছিলাম–“বিকেল পাঁচটার পরে ফোন করো।” ধানমন্ডির শামীমা, কলাবাগানের জেসমিন, এমনকি মগবাজারের মুমুকেও বলেছিলাম। কেউ শোনেনি আমার কথা। প্রাইভেট ফার্মের মালিক একদিন জনাকয়েকের সঙ্গে ব্যবসাসংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা করছিলেন। ঠিক তখনই জেসমিন ফোন করায় ফোনটি ধরেছিলেন মালিক স্বয়ং। পরে তিনি অফিসের ম্যানেজারকে ডেকে কথাবার্তার পরে বিকেলের দিকে চিঠি ধরিয়ে দিলেন এবং মাসের কিছু টাকা। শামীমা, মুমু, জেসমিনের কথাগুলো এখনও কানে ভেসে আসে। জেসমিন বিয়ের আগে একদিন অনুরোধ করেছিলেন বিয়ের দিন যেন তাকে আমি দেখে আসি। আমি তাকে কথা দিতে পারিনি। পরে জেনেছি তিনি সিডনি প্রবাসী।
এক জীবনে কেন যে এতগুলো মেয়ের সঙ্গে ভালো লাগা জন্মেছিল মধ্যহৃদে, সে কথা আমি এখনও জানিনে। তবে একজন নিউজিল্যান্ড প্রবাসী ঢাকায় এলে, একদিন সশরীরে আমার অফিসে টেবিলের ওপর রাখা টেলিফোনের নম্বর নিয়ে এসে দিনদুয়েক পরে ফোন করে, অনেকক্ষণ নিজ পরিচয় না দিয়ে কথা বললেন। বেশ কিছুটা সময় পরে বললাম, “নাম না বললে ফোন ছেড়ে দেব।” তখন অপর প্রান্ত থেকে জানালেন, “আমি মুমু।” হাজার কথা সেদিন বলার শেষে বলেছিল– “তুমি কেন মুখ ফুটে বলোনি– তুমি আমাকে পছন্দ করো?” কথা দীর্ঘায়িত হতে দিইনি।
কিছুদিন আগে এক মনোবিজ্ঞানীর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল রাজশাহীতে। তিনি যখন জানতে পারলেন আমি গদ্য পদ্য লিখি, তখন উপযাচক হয়ে জানালেন, “আপনার সাথে পরিচিত হবো, কিছু কথা আপনার নিকট থেকে জানতে চাইব।”
বললাম– “বলুন!”
ভদ্রলোক জানালেন, “আমি একজন মনোবিজ্ঞানী। মনের শখে মাঝেমধ্যে কবিতা লিখি।” কথা শেষ করেই তিনি তাঁর কবিতার বইটি হাতে দিয়ে বললেন, “আমার গ্রন্থটি সম্পর্কে কিছু লিখে দিতে হবে আপনাকে।”
বললাম, “আমি আরও দিনকয়েক আছি। দেখা হবে।”
মনোবিজ্ঞানী খুশি হয়ে চলে গেলে একজন জানালেন- তিনি মানসিক ডাক্তার।
আমার বিবাহপূর্ব জীবনে চাকরি সূত্রে বেশ কয়েক দিন বগুড়াতে থাকতে হয়েছিল। বগুড়ার কবি ইসলাম রফিক বগুড়া লেখক চক্রের সভাপতি। তিনি এক বিকেলে স্যার আজিজুল হক কলেজের সুশ্রী এক তরুণীর সাথে পরিচয় করানোর পর, মেয়েটি আমার পা ছুঁতে চেয়েছিল। সেই সুযোগ তাকে দিইনি। কী ভেবে তরুণী বললেন, আপনার লেখা একটি দীর্ঘ কবিতা আমার কণ্ঠস্থ। আপনাকে শোনাই। ইসলাম রফিক বললেন, “শোনাও।”
“আপনার লেখা কবিতার নাম, ‘যে আমাকে দুঃখ দিল সে যেন আজ সুখেই থাকে’।
কবিতাটি পাঠ শেষে মেয়েটি জানতে চাইল, “মেয়েটি কি আপনাকে কথা দিয়েছিল?”
কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে পরে জানালাম, “কেউ কথা রাখেনি।”
- বিষয় :
- কথা
- মাকিদ হায়দার