মনোবীক্ষণের জনক হিসেবে পরিচিত সিগমুন্ড ফ্রয়েড জানান, আমাদের স্বাভাবিক জীবনে যেসব আকাঙ্ক্ষা, তাড়না, অনুভূতি, চিন্তা আমরা প্রকাশ করতে পারি না, ঘুমন্ত অবস্থায় স্বপ্নের মাধ্যমে সেসব প্রকাশ পায় এবং আমাদের যা-কিছু চিন্তা, যা-কিছু সচেতন ব্যবহার তার সবই সেই অবচেতনের নিয়ন্ত্রণ মেনে চলে। ফ্রয়েডের এমন ভাষ্যের প্রামান্য উপস্থিতি পাওয়া যায় সিরাজুল ইসলামের ‘গুহা’ উপন্যাসে।
গল্পের প্রধান চরিত্রে মশিউল নামে একজন বিশ্ববিদ্যালয়-ছাত্র। মশিউল প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, নির্জনতা পছন্দ করেন। এ পছন্দের অন্তরালে রয়েছে আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা, নিজেকে নিয়ে ব্যস্ততা।
ক্যানভাসে বড়, আয়তনে হয়ত নয়। শব্দসংখ্যা কম, চিত্রপটে রয়েছে মুনশিয়ানা। স্বাভাবিকভাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে যে ধরনের গল্প, কবিতা বা উপন্যাস পড়ি, নাটক বা সিনেমার চিত্রায়ণ দেখি, সেখানে থাকে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য থাকে নিজের ভেতর তাড়া, পালিয়ে বেড়ানো, পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতার কাহিনি, মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতা, মা-বোনের সম্ভ্রম ছিনিয়ে নেওয়া, লাশের স্তূপসহ প্রভৃতির উপস্থিতি। কিন্তু লেখক ‘গুহা’ উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা হলেও পূর্বে উল্লিখিত বিষয়গুলো প্রকট নয়। প্রচ্ছন্ন।
লেখক জানান এ উপন্যাস আত্মজীবনীমূলক। তিনি নিজে তাঁর দেখা যুদ্ধ-সময়কার অনেক ঘটনা উপস্থাপন করেছেন। তখনকার রাজনৈতিক বিষয় সেভাবে না আনলেও, কিছু বর্ণনায় উপস্থাপন করেছেন।
কেন গুহা নামকরণ? মানবসভ্যতার ইতিহাসে গুহাকে বলা হয় অন্ধকার যুগ। যেখানে মানুষ অন্ধকারে বসবাস করত। মশিউল চরিত্রটিও সময়ে অন্ধকারের ভেতর বসবাস করে। সে এক অস্থিত, অশান্ত পরিবারে, তীব্র মুখনাড়া সয়ে, ক্রমশ নিজেকে গুটিয়ে, সরিয়ে, বেঁচেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের ইতিহাসে এক স্বর্ণময়ী নাম। সেসময় দুই পক্ষে বিভাজিত হয়ে পড়ে মানুষ। এক পক্ষ নিজের দেশের স্বাধীনতায় আত্মনিয়োগে ব্যস্ত, আরেক পক্ষ দোসরদের সাথে হাত মিলিয়ে স্বাধীনতায় বাধা দেওয়ায় উদ্যত। আর পক্ষে-বিপক্ষে কোনো অংশেই নেই মশিউল। এই ডামাডোলের ভেতর সে কীভাবে ভালো থাকবে, প্রেমিকাকে কীভাবে ঘরে তুলবে, খেতে পারবে প্রিয় খাবার প্রচুর পরিমাণে, ক্যম্পাসের হলে কীভাবে সবার আগে গোসল করতে পারবে, হলে কীভাবে একা একা রুমে থাকবে, হোটেলে খেয়ে কারফিউর জন্য বিল না দিয়ে পালাবে– ভয়াবহ, কলুষিত, সস্তা আত্মকেন্দ্রিকতা। দেশ কোন দিকে যাচ্ছে, তার সেসব নিয়ে তেমন আগ্রহ বা মাথাব্যথা নেই। বাবা-মায়ের সম্পর্কের গভীরতাও এমনকি সে তুচ্ছ করতে পারে তার সুবিধাদির কাছে, ক্রমশ এমন চারিত্র গড়ে ওঠে তার।
আমার কাছে মনে হয়েছে ঘটনার ঘনঘটা ও চরিত্রের গভীরতায় আরো তলিয়ে দেখার ও দেখানোর সুযোগ ছিল। সে সুযোগ সৃষ্টি করেও লেখক যেন কাজে লাগালেন না। তবে যেটুকু লাগিয়েছেন কাজে, সেটুকুও যোগ করেছে নতুন মাত্রা। u