পুরোনো ফুলের গন্ধ
‘ফুল ফুটেছে, গন্ধে সারা মন...’

টোকন ঠাকুর
প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০
তাহলে আমরা কি কিছুটা স্মৃতির ভেতর দিয়েই বাঁচি? অতীত কিছুটা টান মেরে ধরে, যখনই একটু নিজের কাছে বসি? ভবিষ্যৎ তো আমরা দেখিইনি, তাই ভবিষ্যৎ আমাদের জ্বালায় না, কিছু মনেও করায় না। ভবিষ্যতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অনেকটা স্বপ্নের মতো, যার সঙ্গে আমাদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ঘটেনি। ঘটবেও না। ভবিষ্যৎ এমনই, যার স্বরূপ আমরা কোনোদিন দেখব না। কিন্তু ভবিষ্যৎ যেই আমাদের এগিয়ে আসতে থাকে, একেবারে যখন আমাদের মুখোমুখি হয়ে যায়, তখন তা আর ভবিষ্যৎ না। তখন তা বর্তমান। বর্তমান একটি মুহূর্ত মাত্র। অনুভব করতে করতে বা দেখতে দেখতেই চলে যায়। ভবিষ্যৎ, বর্তমানের ভেতর দিয়ে এসে সামনাসামনি দাঁড়ায়, তারপর মুহূর্তেই তা কোথায় চলে যায়? প্রতিটি মুহূর্ত প্রতি মুহূর্তেই অতীত হয়ে যায়। অতীতকে আমরা স্মৃতি হিসেবে মেনে নিই। এভাবেই মানবজীবন ফর্মুলায়িত হয়েছে, চলছে। অতএব, অতীতকে আমরা অস্বীকার করব কীভাবে? কেননা তা আমরা অতিক্রম করে এসেছি। বাল্যকাল অতিক্রম করে এসেছি, নিজের বাল্যকালকে আমি অস্বীকার করব কীভাবে?
স্মৃতি ঝাপটানি দিয়ে যাবে ঠিক, স্মৃতির কাছে আমরা হয়তো মনে মনে কিছুটা ফিরতেও পারি, কিন্তু স্মৃতিকে জীবন্ত করতে পারব আর? ফেলে আসা দিনগুলো আমরা শুধু হারিয়েই ফেললাম, আর ফিরে পাব না? ফেলে আসা সময় কি পুরোনো ফুল হয়ে গেল? তাতে গন্ধ আছে বটে, কিন্তু মানুষ তো তাজা টাটকা ফুলের দিকেই যায়! তুমিও কি টাটকা ফুলের দিকে হাঁটাহাঁটি করছ? আমাকে মনে পড়ছে না, একটুও? আমিই কি পুরোনো ফুল, তোমার কাছে? আমিও কি তাজা ফুলের দিকেই হাঁটছি ক্রমশ, তোমাকে মনে পড়ছে না? তুমিও কি পুরোনো ফুল, আমার কাছে? তাহলে এসব কথা লিখছি কেন? এসব কথা তো টাটকা ফুল নিয়ে লিখছি না, তোমাকে নিয়েই লিখছি। তাহলে তুমিই কীভাবে পুরোনো ফুল আমার কাছে? তুমি তো তাজা টাটকা ফুল হয়েই টিকে আছও মনে!
পাতাবাহারও একপ্রকার ফুল। গন্ধ নেই। কৃষ্ণচূড়া-রাধাচূড়ায় গন্ধ নেই। তোমার গন্ধ ছিল। তোমার গন্ধ আমার নাকে পাই এখনও। গন্ধ ছিল, গন্ধ পাই– মানেই কি একটা অতীত সত্ত্বার কাছে নিবেদিত হতে হচ্ছে আমাদের? নিজের ভেতরে তাকালেই দেখতে পাচ্ছি সেই বিস্তৃত বাগানখানি, বুকের জমিনের মতো, সেখানে অনেক ফুল ফুটেছে। প্রজাপতি উড়ছে। হাওয়া নিজেই দোল খাচ্ছে। আমি দৌড়ে যাচ্ছি প্রজাপতির দিকে। কিছুতেই ধরতে পারছি না। প্রজাপতি উড়ে উড়ে যাচ্ছে, আমি প্রজাপতির পেছনে পেছনে দৌড়াচ্ছি। প্রজাপতি, আমাকে তুমি কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? আমাকে কি তুমি ট্র্যাপ করে পাহাড়ের দিকে টানছ? তুমি কি সেই বংশীবাদক? আমি কি তোমার দিকে দৌড়াতে দৌড়াতে পাহাড়ের ভেতরের কোনো পাহাড়ে হারিয়ে যাচ্ছি? ঝিম ভাঙলে দেখতে পাই, আমি হয়তো গাড়ির মধ্যে বসে ঝিমিয়ে পড়েছিলাম, সেই ঝিমুনিতেই চলে গেছি তোমার কাছে। কারণ, তুমি ফুল ছিলে, হয়তো ভুল ছিলে। যদিও ভুল যেহেতু আগে বোঝা যায় না, তাই ভুলকে আর ভুল বলার কোনো অর্থ নেই। ফুলেরও কি অর্থ নেই?
ইদানীং, ব্যাপক ফুল চাষ হচ্ছে দেশে। সব হাইব্রিড ফুল। কোনো গন্ধ নেই। মাটিতেই হয় কিন্তু প্লাস্টিকের ফুল হয়ে যাচ্ছে আধুনিক ফুলগুলো। ঘ্রাণহীন। কিন্তু এই প্লাস্টিক ও হাইব্রিড ফুলেরই বাজার বেশি, সে নেতার সংবর্ধনা থেকে শুরু করে বিপ্লবীর শবদেহ ঘিরেই হোক আর ফুলশয্যাতেই হোক। যদিও আমি যে ফুলের কথা জানি, সেই ফুল এই ফুল নয়। সেই ফুল আজ আর পাবই কোথায়?
কবিতায় পুঁতে রেখেছি কিছু ফুল, কবিতাটি বইয়ের ভেতরে ছাপা অবস্থায় থাকবে, কাগজ পুরোনো হয়ে যাবে, মলিন হবে, বইটিও পুরোনো হয়ে যাবে। কবিতারাও কি পুরোনো হবে না? হবে। নইলে নতুন কবি লিখবে কি? তরুণ কবি ছড়াবে কি?
তরুণ কবি ছড়াবে ঘ্রাণ, নতুন ফুলের, যে ফুল টাটকা, তাজা। তরুণ কবির বুকের মধ্যেই তো ছাতিম গাছ, ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ-সীমানা কতদূর! ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ কি লুকিয়ে থাকতে পারে? কামিনী ফুল যেমন পারে না। হাসনাহেনা পারে না। ছাতিম কীভাবে আত্মগোপন করবে? একবার ছাতিম ফুল-জন্ম পেলে তার আর লুকোনোর জায়গা নেই।
তবে কি আমি ছাতিম ফুলের মধ্যে নিজেকে রোপণ করেছিলাম একদিন? একদিন বলার পরে বুঝতে পারছি, এটা অতীতের কথা হচ্ছে। অর্থাৎ স্মৃতিসত্তার সমুজ্জ্বল উপস্থিতি লক্ষণীয়। যে স্মৃতি শাসন করে বর্তমানকে, তার মধ্যে বসেই প্রশ্ন করছি তোমাকে, তুমি কি ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ পাচ্ছ?
- বিষয় :
- পুরোনো ফুলের গন্ধ
- টোকন ঠাকুর