ঢাকা সোমবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৩

পুরোনো ফুলের গন্ধ

‘ফুল ফুটেছে, গন্ধে সারা মন...’ 

‘ফুল ফুটেছে, গন্ধে সারা মন...’ 

টোকন ঠাকুর

প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০

তাহলে আমরা কি কিছুটা স্মৃতির ভেতর দিয়েই বাঁচি? অতীত কিছুটা টান মেরে ধরে, যখনই একটু নিজের কাছে বসি? ভবিষ্যৎ তো আমরা দেখিইনি, তাই ভবিষ্যৎ আমাদের জ্বালায় না, কিছু মনেও করায় না। ভবিষ্যতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অনেকটা স্বপ্নের মতো, যার সঙ্গে আমাদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ঘটেনি। ঘটবেও না। ভবিষ্যৎ এমনই, যার স্বরূপ আমরা কোনোদিন দেখব না। কিন্তু ভবিষ্যৎ যেই আমাদের এগিয়ে আসতে থাকে, একেবারে যখন আমাদের মুখোমুখি হয়ে যায়, তখন তা আর ভবিষ্যৎ না। তখন তা বর্তমান। বর্তমান একটি মুহূর্ত মাত্র। অনুভব করতে করতে বা দেখতে দেখতেই চলে যায়। ভবিষ্যৎ, বর্তমানের ভেতর দিয়ে এসে সামনাসামনি দাঁড়ায়, তারপর মুহূর্তেই তা কোথায় চলে যায়? প্রতিটি মুহূর্ত প্রতি মুহূর্তেই অতীত হয়ে যায়। অতীতকে আমরা স্মৃতি হিসেবে মেনে নিই। এভাবেই মানবজীবন ফর্মুলায়িত হয়েছে, চলছে। অতএব, অতীতকে আমরা অস্বীকার করব কীভাবে? কেননা তা আমরা অতিক্রম করে এসেছি। বাল্যকাল অতিক্রম করে এসেছি, নিজের বাল্যকালকে আমি অস্বীকার করব কীভাবে? 

কাশবনের ধারে, হয়তো নদীপাড়ে ছিল আমার বাল্যকাল। কাশফুল ফুটত বছরে একবার। কাশফুলের ঘ্রাণ নেই। সেই কাশফুলের বাল্যকাল অতীত হয়ে গেছে। কিন্তু সুষমাদের বাড়ির পেছনে, পুকুরের ধারে ছিল দীর্ঘ এক বকুলগাছ। ভোরবেলা সেই বকুল কুড়োতে যেতাম। বকুল ফুল একসময় শুকিয়ে যেত। শুকনো বকুল ফুলেরও কী গন্ধ! মনে আছে। এই মনে থাকার নাম স্মৃতি। আর বই বা ডায়রির পৃষ্ঠার ভাঁজে কেউ কেউ পুরোনো ফুল খুঁজে পায় বটে, আমি পাইনি। আমাকে কেউ তা দেয়ওনি। কেউ না দিলে আমি কী করব? তবে কাউকে কাউকে তা পেতে দেখেছি। আমি তো নিজেই ফুলের বাগান করেছি ছোটবেলায়, বাড়ির সামনে। সেই বাগানে কত ফুল ফুটেছে, ঝরে গেছে। আমিও কাউকে আমার বাগানের ফুল দিতে পারিনি। তাহলে ফুলবাগান করতাম কেন? এখন তো আর সেই বাড়িতে থাকি না, বাড়ির সামনের ফাঁকা জমি নেই। তাই বলে কি আমি ফুলচাষি নই? তাই বলে কি আমি বই বা ডায়রির পৃষ্ঠার ভাঁজে ফুল গুঁজে দিতে চাচ্ছি না? চেয়েছি, চাইও। তাই কবিতার ভেতরে ফুল চাষ করি, সেই কবিতা ছাপা হয়ে বই হয়ে যায়। সেই বই একসময় পুরোনো হয়। আমি জানি, আমার কবিতার বই খুললে হয়তো এখন পুরোনো ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়বে। অর্থাৎ স্মৃতি উপচে পড়বে। স্মৃতি থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারি না। স্মৃতির ভেতরে পুরোনো ফুলের ঘ্রাণ থেকেও পালাতে পারি না। কোনো কোনো স্মৃতি বর্তমানকে চেপে ধরে আধিপত্য দেখিয়ে চলে। কোনো কোনো স্মৃতি বর্তমান হয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকে। দেখি, তুমি আমার সামনে বসে আছ, আমি তোমার সামনে বসে আছি। রেললাইন বহে যাচ্ছে সমান্তরাল। দূর থেকে দেখে মনে হয়, ওই তো মিলেছে। কিন্তু মেলেনি। আমরা মিলতে পারিনি। শীত কুয়াশার ফিনফিনে ওড়নায় ঢাকা চারপাশে। খুব বেশি দূরত্ব চোখে আসে না। তুমিও আছ, আমিও আছি, শুধু আমরা আর সেই আমরা নেই। তুমি আর সেই প্রজাপতি নেই, আমিও সেই ফড়িং ফড়িং নেই। হাওয়া আছে, বাতাসে দুলছে গাছের পাতা, আমরা অনড়। আমরা যে যার জায়গায় অনড় আছি। তুমি চলে গেছ অন্য কোথাও, আমি চলে গেছি কোথায় বা আর! কোথাও সেই শুকনো বকুল ফুল কি আছে? গোলাপের পাপড়ি কিছু আছে?  না, নেই। আমরা বেঁচে আছি তবু আমাদের দেখা নেই। দিন শেষে আমাদের পরস্পরের প্রতি তাকানো নেই, কথা নেই। আমার কবিতার বইখানি কি তোমার কাছে আছে এখনও? পুরোনো হয়ে যাওয়া বইয়ের পৃষ্ঠার ভাঁজে কি আমিই শুকনো বকুল হয়ে মুদ্রিত অবস্থায় নেই? নাকি তোমার কাছে আমি আর বকুল হয়ে নেই? তুমিও কি আছ? তুমিও কি আমার কাছে আছ পুরোনো ফুল? আমি জানি, দিন আরও চলে যাবে। দিন আরও পুরোনো করে দেবে আমার কবিতার বইটিকে। যদি কবিতার ভেতরে আমার সেই বাল্যকালের বাগান আমি রোপণ করে থাকি, সেই বাগানের ফুল আরও পুরোনো হতে থাকবে। ভালোবাসা ফুল হয়ে থেকে যাচ্ছে কবিতার প্রতিটি শব্দে, প্রতিটি বাক্যে। আমি ভালোবাসা লিখে রাখছি শাদা কাগজের ওপরে, কাগজ আস্তে আস্তে মলিন হয়ে যাচ্ছে! ভালোবাসাও কি মলিন হয়ে যাচ্ছে?  ভালোবাসা কি স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে? স্মৃতি মানেই তো অতীত সত্ত্বা? ভালোবাসা কি অতীতে পতিত হচ্ছে? একে পুরোনো হওয়া থেকে এড়াব কী করে?  আমরা কি কেবলই পুরোনো থেকে আরও পুরোনো হতে থাকি বা থাকব? আমরা কি নিজের কাছেই নিজেকে পুরোনো মনে করতে থাকি বা থাকব? 

স্মৃতি ঝাপটানি দিয়ে যাবে ঠিক, স্মৃতির কাছে আমরা হয়তো মনে মনে কিছুটা ফিরতেও পারি, কিন্তু স্মৃতিকে জীবন্ত করতে পারব আর? ফেলে আসা দিনগুলো আমরা শুধু হারিয়েই ফেললাম, আর ফিরে পাব না? ফেলে আসা সময় কি পুরোনো ফুল হয়ে গেল? তাতে গন্ধ আছে বটে, কিন্তু মানুষ তো তাজা টাটকা ফুলের দিকেই যায়! তুমিও কি টাটকা ফুলের দিকে হাঁটাহাঁটি করছ? আমাকে মনে পড়ছে না, একটুও? আমিই কি পুরোনো ফুল, তোমার কাছে? আমিও কি তাজা ফুলের দিকেই হাঁটছি ক্রমশ, তোমাকে মনে পড়ছে না? তুমিও কি পুরোনো ফুল, আমার কাছে? তাহলে এসব কথা লিখছি কেন? এসব কথা তো টাটকা ফুল নিয়ে লিখছি না, তোমাকে নিয়েই লিখছি। তাহলে তুমিই কীভাবে পুরোনো ফুল আমার কাছে? তুমি তো তাজা টাটকা ফুল হয়েই টিকে আছও মনে!   পাতাবাহারও একপ্রকার ফুল। গন্ধ নেই। কৃষ্ণচূড়া-রাধাচূড়ায় গন্ধ নেই। তোমার গন্ধ ছিল। তোমার গন্ধ আমার নাকে পাই এখনও। গন্ধ ছিল, গন্ধ পাই– মানেই কি একটা অতীত সত্ত্বার কাছে নিবেদিত হতে হচ্ছে আমাদের? নিজের ভেতরে তাকালেই দেখতে পাচ্ছি সেই বিস্তৃত বাগানখানি, বুকের জমিনের মতো, সেখানে অনেক ফুল ফুটেছে।  প্রজাপতি উড়ছে। হাওয়া নিজেই দোল খাচ্ছে। আমি দৌড়ে যাচ্ছি প্রজাপতির দিকে। কিছুতেই ধরতে পারছি না। প্রজাপতি উড়ে উড়ে যাচ্ছে, আমি প্রজাপতির পেছনে পেছনে দৌড়াচ্ছি। প্রজাপতি, আমাকে তুমি কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? আমাকে কি তুমি ট্র্যাপ করে পাহাড়ের দিকে টানছ? তুমি কি সেই বংশীবাদক? আমি কি তোমার দিকে দৌড়াতে দৌড়াতে পাহাড়ের ভেতরের কোনো পাহাড়ে হারিয়ে যাচ্ছি? ঝিম ভাঙলে দেখতে পাই, আমি হয়তো গাড়ির মধ্যে বসে ঝিমিয়ে পড়েছিলাম, সেই ঝিমুনিতেই চলে গেছি তোমার কাছে। কারণ, তুমি ফুল ছিলে, হয়তো ভুল ছিলে। যদিও ভুল যেহেতু আগে বোঝা যায় না, তাই ভুলকে আর ভুল বলার কোনো অর্থ নেই। ফুলেরও কি অর্থ নেই?  ইদানীং, ব্যাপক ফুল চাষ হচ্ছে দেশে। সব হাইব্রিড ফুল। কোনো গন্ধ নেই। মাটিতেই হয় কিন্তু প্লাস্টিকের ফুল হয়ে যাচ্ছে আধুনিক ফুলগুলো। ঘ্রাণহীন। কিন্তু এই প্লাস্টিক ও হাইব্রিড ফুলেরই বাজার বেশি, সে নেতার সংবর্ধনা থেকে শুরু করে বিপ্লবীর শবদেহ ঘিরেই হোক আর ফুলশয্যাতেই হোক। যদিও আমি যে ফুলের কথা জানি, সেই ফুল এই ফুল নয়। সেই ফুল আজ আর পাবই কোথায়?  কবিতায় পুঁতে রেখেছি কিছু ফুল, কবিতাটি বইয়ের ভেতরে ছাপা অবস্থায় থাকবে, কাগজ পুরোনো হয়ে যাবে, মলিন হবে, বইটিও পুরোনো হয়ে যাবে। কবিতারাও কি পুরোনো হবে না? হবে। নইলে নতুন কবি লিখবে কি? তরুণ কবি ছড়াবে কি?  তরুণ কবি ছড়াবে ঘ্রাণ, নতুন ফুলের, যে ফুল টাটকা, তাজা। তরুণ কবির বুকের মধ্যেই তো ছাতিম গাছ, ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ-সীমানা কতদূর! ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ কি লুকিয়ে থাকতে পারে? কামিনী ফুল যেমন পারে না। হাসনাহেনা পারে না। ছাতিম কীভাবে আত্মগোপন করবে? একবার ছাতিম ফুল-জন্ম পেলে তার আর লুকোনোর জায়গা নেই।  তবে কি আমি ছাতিম ফুলের মধ্যে নিজেকে রোপণ করেছিলাম একদিন? একদিন বলার পরে বুঝতে পারছি, এটা অতীতের কথা হচ্ছে। অর্থাৎ স্মৃতিসত্তার সমুজ্জ্বল উপস্থিতি লক্ষণীয়। যে স্মৃতি শাসন করে বর্তমানকে, তার মধ্যে বসেই প্রশ্ন করছি তোমাকে,  তুমি কি ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ পাচ্ছ? 

আরও পড়ুন