ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫

নির্ঘুমের তারায় তারায়

বিন্দু বিন্দু

নির্ঘুমের তারায় তারায়

ফজলে এলাহী গোলাম কাদের [

বদরুজ্জামান আলমগীর

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ২৩:৫১

বহুদিন হয়, মেলা বছর– দেশ থেকে চলে গ্যাছি দূর ভিনদেশ– সাইবেরিয়ান লরেস হিউগলিনি যেমন ঘোরে দেশদেশান্তর, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গানের তরফে বললে হয়তো এমন শোনাবে–
শূন্যে দিলাম উড়ারে ভাই যাইতে চান্দের চর,
ডানা ভাইঙ্গা পড়লাম আমি ফিলাডেলফিয়ার উপর।
তোমরা আমায় চিনোনি, তোমরা আমায় চিনছোনি।
আমার দেশে যাওয়া হয় খুব কম। কিন্তু যখনই যাই, মৌলিক পরিবার ও পরিবারসূত্রের বাইরে যাঁর কথা সবার আগে মনে আসে, তিনি আমার কলেজের অধ্যাপক ফজলে এলাহী গোলাম কাদের– আমাদের কলেজের ইংরেজির শিক্ষক। আমার বিদ্যায়তন বাজিতপুর কলেজেই তাঁর আগে ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন কবি মোহাম্মদ রফিক।
স্যারের সঙ্গে যে দিনরাত গল্প করেছি, সময় কাটিয়েছি তা কিন্তু নয়; ভাবলেই মনে হয়, এটি আজগুবি একটা ব্যাপার : তিনি আমার রাজনৈতিক দর্শনের নিয়ামক নন, এলাহী স্যারের কাছে কবিতা, নাটক বা শিল্পবোধির মনস্তাত্ত্বিক সবক নিয়েছি– তাও নয়, কিন্তু তিনিই আমার গোটা জীবনের সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষক। যিনি প্রিয় শিক্ষক হবেন, তিনি বোধকরি কেবল ক্লাসরুম থেকেই প্রণম্যতা ও হেজিমনি অর্জন করেন না, তিনি তা অর্জন করেন তাঁর ব্যক্তিত্বের সামূহিক চারুময়তা দিয়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগে পড়াকালীন কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেনের তত্ত্বাবধানে আমরা স্টাইলাস নামে একটা দেয়াল পত্রিকা বের করতাম; এলাহী স্যার ওই দেয়াল পত্রিকায় তাঁরই ছাত্রের একটি কবিতা দেখে বেধড়ক উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলেন, এবং আমার সঙ্গে আনন্দের একটি মায়াভা ভাগ করে নিয়েছিলেন এভাবে– শিক্ষকের প্রকৃত আনন্দ আর জয় হয় সেদিন, যেদিন শিক্ষক তাঁর ছাত্রের কাছে পরাজিত হন। সেদিন আমি লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়েছিলাম, আবার এমন অসাধারণ একটি অভিব্যক্তির সারবত্তায় বুঝি হয়ে উঠেছিলাম আত্মবিশ্বাসীও।
এতদিন বাদে যখন ফিরে তাকাই, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে স্যারের ইংরেজি ক্লাসটা নিরিখ করি, তখন বুঝি এলাহী স্যার জায়গেন্টিক পাণ্ডিত্য রাখেন– তা কিন্তু নয়; তাহলে ঘটনাটা কী আদতে– একজন সত্যিকার শিক্ষক যতটা না বই পড়ান, তার থেকে বেশি পড়ান তাঁর নিজের ব্যক্তিত্ব, একজন অকুতোভয় সক্রেটিসের মতো নিরেট ন্যায়-অন্যায়ের বিভেদ রেখা। এখানেই যত শিক্ষক দেখেছি জীবনে– হিমালয়ের শৃঙ্গছাড়ানো পাণ্ডিত্য রাখেন তাদের কেউ কেউ, কিন্তু আড়াল আবডালের এক মফস্বল শহর বাজিতপুরের ফজলে এলাহী গোলাম কাদের সবাইকে ছাড়িয়ে স্মৃতি সত্তায় অমূল্য আকর হয়ে ওঠেন।
যখন বাংলা অঞ্চলের ঝড়জলে নিরলে কান পাতি– তাতে মহাকালের যাত্রার যে ধ্বনি মরমে পশে, তাতে বুঝি– তিনিই সেরা শিক্ষক, যিনি তার জনপদের অন্তরকুঠুরির কেন্দ্রীয় মর্মটি তাঁর ব্যক্তিত্বে ধারণ করেন– এলাহী স্যার জনমভর আসলে তা-ই করেছিলেন। কেবল অনুচ্চকিত ও বিনয়ী হয়ে থাকাও যে এক দুঃসাহস– তাই এলাহী স্যার জীবনের শেষদিন অবধি পরিচর্যা ও রোপণ করে দেখিয়ে গেলেন।
এই ভার্চুয়াল যুগে কেউ হয়তো কোনোদিন আর সত্যিকার একজন শিক্ষকের দেখা পাবেন না; মনে হচ্ছে, কালের সর্বশেষ ভাগ্যবান আমরাই– যারা নিরাভরণ, ভণিতাহীন একজন ফজলে এলাহী গোলাম কাদেরের ছাত্র হবার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম।
আমার বইগুলো যেভাবেই হোক এলাহী স্যারের হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতাম; স্যার যে ২০ এপ্রিল ২০২৪ বাস্তবিক দুনিয়ার পাতার আড়ালে চলে গেলেন, এবার কোথায় পাবো তারে; এভাবে ভাবছি কেন– যে থাকে মায়া আর নির্ঘুমের তারায় তারায়– তাকে সরাবে কে!

আরও পড়ুন

×