ঢাকা মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

গণঅভ্যুত্থানের সাহিত্য

একনায়কদের আখ্যান

একনায়কদের আখ্যান

প্রচ্ছদ :: আনিসুজ্জামান সোহেল

উম্মে ফারহানা

প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২৪ | ২২:৩৯

অবাক করার মতো ব্যাপার মনে হলেও লাতিন আমেরিকান সাহিত্যে ডিক্টেটর নভেল বা ‘নোভেলা দেল ডিকতাদো’র বলে একটি ক্যাটেগরি আছে। একে ঠিক জনরা ফিকশনের কাতারে ফেলা যাবে না– যেভাবে আমরা ডিটেকটিভ, সাই-ফাই বা গথিক উপন্যাসকে লিটারেরি ফিকশন থেকে আলাদা করি, সেভাবে একনায়কদের আখ্যান আলাদা জনরার নয়; বরং বলা যেতে পারে এটি উপন্যাসের একটি ধরন কিংবা ধারা। লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে এই ধারার উপন্যাস লিখেছেন অনেকেই। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি একনায়ক আখ্যান সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য তুলে ধরা হলো।
 ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট (এল সেনর প্রেসিদেন্তে)’
১৯৬৭ সালে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী গুয়াতেমালার লেখক মিগুয়েল আনহেল আস্তুরিয়াসের লেখা ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট’ (১৯৪৬) উপন্যাসটিতে জাদুবাস্তবতা বলে পরিচিত টেকনিকটি ব্যবহৃত হলেও এর মূল থিম ছিল একনায়কতন্ত্র। বইটি লেখা শেষ হয় ১৯৩৩ সালে, কিন্তু প্রকাশিত হয় ১৩ বছর পর মেক্সিকোতে। প্রেসিডেন্টের চরিত্রকে খুব বেশি সামনে না এনে অন্যান্য চরিত্রের মাধ্যমে লেখক দেখিয়েছেন একনায়কের অধীনে থাকা নাগরিকদের অভিজ্ঞতা। প্রেসিডেন্টের চরিত্রটি যার ছায়া অবলম্বনে আঁকা হয়েছে, তিনি হলেন ১৮৯৮ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট মানুয়েল এস্ত্রাদা সাবরেরা; যিনি দেশের শিল্প-বাণিজ্য এবং পরিবহন খাতে বেশ কিছু উন্নয়ন ঘটিয়েছিলেন, কিন্তু সেটা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানাধীন ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির সঙ্গে নানা ধরনের আপস করে। ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানি এমন একটি করপোরেশন, যেটি নিজেদের শোষণমূলক ব্যবসায়িক কৌশল অবলম্বন করে লাতিন আমেরিকায় নব্য উপনিবেশ কায়েম করেছিল। দীর্ঘ ২২ বছর গুয়াতেমালার প্রেসিডেন্টের পদে আসীন থাকার কালে বেসামরিক এই একনায়ক ১৯০৪, ১৯১০ ও ১৯১৬ সালে মোট তিনবার নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করেন। বলা হয়ে থাকে, ১৮৯৮ সালে য়োসে মারিয়া রেইনা বারিয়োস নিহত হওয়ার পর ইমার্জেন্সি কেবিনেট মিটিংয়ে পিস্তল হাতে প্রবেশ করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন সাবরেরা। দুর্নীতির দায় নিয়ে শেষ জীবন জেলে কাটাতে হয় তাঁকে, সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সবচেয়ে বিখ্যাত হলেও ‘মিস্টার প্রসিডেন্ট’ই তাঁকে নিয়ে লেখা একমাত্র বই নয়। রাফায়েল আরেভালো মারতিনেজ তাঁর জীবন, ক্ষমতা দখল এবং পতন নিয়ে লিখেছেন ‘এসসে পেরিকলেস’ (পেরিক্লস হিয়ার) নামে একটি গ্রন্থ। অস্কার ওয়াইল্ড ওস্পিনা লিখেছেন ‘এল আউতোক্রাতা’ (দি অটোক্র্যাট) নামে এই একনায়কের জীবনী।
আই, দ্য সুপ্রিম (ইয়ো, এল সুপ্রেমো)
প্যারাগুয়ের নির্বাসিত লেখক অউগুস্তো রোয়া বাস্তোসের লেখা এই উপন্যাসের মূল চরিত্র প্যারাগুয়ের একনায়ক হোসে গ্যাসপার রদরিগেজ দে ফ্রান্সিয়া, যিনি নিজেকে ‘এল সুপ্রেমো’ বা ‘দ্য সুপ্রিম’ হিসেবে সম্বোধন
 করতে ভালোবাসতেন। ১৮১১ সালে স্পেনের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পর ডক্টর ফ্রান্সিয়া নামে পরিচিত এই একনায়ক দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। তিনি বলতেন, ‘আমি ইতিহাস লিখি না, আমি ইতিহাস তৈরি করি এবং আমিই নিজের ইচ্ছেমতো ইতিহাস পরিবর্তন করতে পারি।’ নার্সিসিস্টিক এই শাসকের অফিশিয়াল পদবি ছিল ‘সুপ্রিম অ্যান্ড পারপাচুয়াল ডিক্টেটর অব প্যারাগুয়ে’। ফ্রান্সিয়ার শাসনামল থেকে প্যারাগুয়েতে একনায়ক শাসনের দীর্ঘ ধারা তৈরি হয়। উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে প্যারাগুয়েতে, ইংরেজি অনুবাদ বেরোয় ১৯৮৬ সালে। এই উপন্যাস যখন লিখছিলেন বাস্তোস, তখন প্যারাগুয়েতে চলছিল আলফ্রেডো স্ত্রোয়েসনারের শাসন। ধরে নেওয়া হয়, উপন্যাসের মূল চরিত্র ডক্টর ফ্রান্সিয়া হলেও, লক্ষ্য ছিল ৩৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা স্ত্রোয়েসনারের প্রতি প্রচ্ছন্ন আক্রমণ। যে কোনো ধরনের প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য দমনপীড়ন এবং কয়েদ করার প্রবণতার দিক থেকে জেনারেল স্ত্রোয়েসনার ঠিক ফ্রান্সিয়ার মতোই কঠোর এবং বদ্ধপরিকর ছিলেন। আর্জেন্টিনায় নির্বাসিত বাস্তোস স্ত্রোয়েসনারের শাসনামল শেষ হওয়ার আগে নিজের দেশে ফিরতে পারেননি। কেননা যে তিনজন নাগরিকের প্যারাগুয়েতে ফেরা নিষেধ ছিল, বাস্তোস ছিলেন তাদের একজন। মেটাফোরের ব্যবহারের দিক থেকে বাস্তোসের লেখায় আর্জেন্টিনার লেখক হোর্হে লুই বোর্হেসের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। জাদুবাস্তবতা প্রয়োগের ক্ষেত্রেও বাস্তোসের এই উপন্যাস অনবদ্য। খুব বেশি পাঠকপ্রিয় না হলেও ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস হিসেবে এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
দ্য ফিস্ট অব দ্য গোট (লা ফিয়েস্তা দেল শিভো)
পেরুর নোবেল পুরস্কার বিজয়ী লেখক মারিয়ো ভার্গাস য়োসার এই উপন্যাসের পটভূমি ডোমিনিকান রিপাবলিক। তিনটি ভিন্ন পারস্পেকটিভ থেকে লেখা ২০০০ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাস লিপিবদ্ধ করেছে রাফায়েল লিয়োনার্দো ত্রুহিয়ো মোলিনা নামে স্বৈরশাসকের নিহত হওয়ার সময়কাল (মে ১৯৬১) এবং ৩৫ বছর পর (১৯৯৬) ডোমিনিকান রিপাবলিকের তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি। উরানিয়া নামে একটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক নারী চরিত্রের দেশে ফেরার অংশে বর্তমান কাল দেখা যায়। আখ্যানের অন্য অংশে দীর্ঘকাল বশংবদ রাষ্ট্রপ্রধানদের সামনে রেখে নির্মম শোষণের মাধ্যমে দীর্ঘকাল ক্ষমতায় টিকে থাকা ‘দ্য গোট’ খ্যাত এই স্বৈরাচারীর একদা অনুগত হন্তারকদের দৃষ্টি থেকে দেখানো হয়। তৃতীয় আরেকটি পারস্পেকটিভে এই সামরিক শাসকের জীবনের শেষ সময়টুকু বর্ণিত হয়েছে তাঁর নিজেরই বয়ানে। বাস্তব এবং কল্পনার মিশেলে রচিত এই উপন্যাসে লেখক বিভিন্ন জায়গায় স্বাধীনভাবে সংযোজন বিয়োজনের কথা স্বীকার করে বলেছেন, ‘এটি একটি উপন্যাস, কোনো ইতিহাসের বই নয়। আখ্যানের প্রয়োজনে বিভিন্ন জায়গায় স্বাধীনভাবে অনেক কিছু যোগ-বিয়োগ করলেও আমি ঐতিহাসিক তথ্যগুলোর প্রতি সম্মান দেখিয়ে সেগুলোকে যথাসম্ভব অবিকৃত রাখার চেষ্টা করেছি।’ উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাফায়েক ত্রুহিয়োর দ্বারা কিশোরী বয়সে মূল চরিত্র উরানিয়ার ধর্ষিত হওয়ার ঘটনাটি কাল্পনিক হলেও সর্বৈব মিথ্যা নয়। কেননা এই শাসকের নারীলিপ্সা এবং চরম পৌরুষিক ক্ষমতা চর্চার আরও অনেক প্রমাণ রয়েছে। ত্রুহিয়োর চরম পুরুষত্ববাদী আচরণ, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় মাচিসমো, এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে তিনি মন্ত্রীদের আনুগত্য পরীক্ষা করার জন্য তাদের স্ত্রীদের নিজের শয্যাসঙ্গিনী হিসেবে ডেকে নিতেন। তাঁর পৈশাচিক বর্বরতার বহু উদাহরণ আছে, যার মধ্যে অন্যতম মিরাবাল সিস্টার্স খ্যাত এক পরিবারের তিন নারীকে নির্মমভাবে খুন করা। য়োসা মনে করেন নিষ্ঠুরতা এবং হত্যার হিসাবে ত্রুহিয়ো লাতিন আমেরিকার অন্য সব একনায়ককে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর যে অনুগত অনুসারীরা তাঁকে খুন করার ষড়যন্ত্র সাজায়, সম্ভবত তাঁরা নারী হত্যার বীভৎসতাটুকু হজম করতে পারেনি বলেই বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল প্রভুর সঙ্গে।   
ইন দ্য টাইম অব দ্য বাটারফ্লাইজ (এন এল তিয়েম্পো দে লাস মারিপোসাস)
হুলিয়ো আলভারেজের এ উপন্যাস ইংরেজিতে প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে। পরে ২০০১ সালে স্প্যানিশে। এ উপন্যাসের প্রধান ভিলেইনও ডোমিনিকান রিপাবলিকের এই নারীলিপ্সু ‘চিফ’ রাফায়েল ত্রুহিয়ো এবং মূল চরিত্ররা হলো সেই মিরাবাল সিস্টার্স, যারা ত্রুহিয়োর অনুগত সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হয়েছিলেন ১৯৬০ সালে। মিনের্ভা, দেদে, মারিয়া আর পাত্রিয়া নামে এই চার বোনের মধ্যে দেদে ব্যতীত সবাইকে ত্রুহিয়োর গুন্ডারা পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল। ত্রুহিয়োর শাসন ব্যবস্থার মূলনীতি ছিল একটি– যার বা যাদের কাছ থেকে চরম আনুগত্য না পাওয়া যাবে, সামান্যতম অবাধ্যতার লক্ষণ যারা দেখাবে তাদেরকেই হত্যা করা। ত্রুহিয়ো তাঁর শাসনামলে তিরিশ হাজার, মতান্তরে পঞ্চাশ হাজার মানুষকে হত্যা করেছিলেন তাঁর পেটোয়া বাহিনী দিয়ে। লাতিন আমেরিকার অনেক দেশেই ২৫ নভেম্বর, নিরস্ত্র তিন বোনের নিহত হওয়ার দিনটি ‘নারীর প্রতি সহিংসতাবিরোধী দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। ২০০১ সালে এ উপন্যাসের ভিত্তিতে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়, যেখানে মিনের্ভা মিরাবালের চরিত্রে অভিনয় করেন জনপ্রিয় হলিউড তারকা সালমা হায়েক এবং ছোট আরেকটি চরিত্রে ছিলেন মার্ক এন্টোনি।
 দ্য জেনারেল ইন হিজ ল্যাবিরিন্থ (এল হেনারেল এন সু লাবেরিন্তো)  
এতক্ষণ যে উপন্যাসগুলোর নাম বলা হলো, বিশ্বখ্যাত লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘দ্য জেনারেল ইন হিজ ল্যাবিরিন্থ’ সেগুলো থেকে সামান্য আলাদা। বহু সমালোচকই দ্য জেনারেল ইন হিজ ল্যাবিরিন্থকে সত্যিকার অর্থে উপন্যাস বলে মানতে নারাজ। লাতিন আমেরিকার আরও অনেক কবি, লেখক সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেও মার্কেজের জনপ্রিয়তা অন্য সবার থেকে আলাদা। ম্যাগনাম ওপাস হিসেবে তাঁর ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিটিউড’, অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে ‘নো ওয়ান রাইটস টু দ্য কর্নেল’, ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’ আর ‘দ্য মেমোরিজ অব মাই মেলানকলি হোরস’ ১৯৮২ সালে নোবেল পাওয়া এই কলম্বিয়ান লেখকের বহু কাজের মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। ম্যাজিক রিয়েলিজমের ব্যবহারকে লাতিন আমেরিকার বাইরে পরিচিত করে তোলার কৃতিত্বও অনেকটাই মার্কেজের। বহুদিন সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও মার্কেজ এর আগে কখনও গবেষণা করে ইতিহাসভিত্তিক বই লেখেননি। বন্ধু আলভারো মুতিসের অসমাপ্ত বই এল উলতিমো রোসত্রো থেকে প্লট ধার করে বন্ধুর অনুমতি সাপেক্ষে অবিভক্ত কলম্বিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বাধিনায়ক সিমন বোলিভারের জীবনের শেষ কয়েকটি দিন নিয়ে এ উপন্যাস লেখেন মার্কেজ। জেনারেল বোলিভার একনায়ক হলেও সেটি নেতিবাচক অর্থে নয়। স্পেনের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার যুদ্ধে বোলিভারের অবদান অনস্বীকার্য। ভেনেজুয়েলার এই নেতার স্বপ্ন ছিল একটি অবিভক্ত লাতিন আমেরিকান রাষ্ট্র কায়েম করা, যা তাঁর এগারো বছর মেয়াদি শাসনামলে অনেকটাই সফল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গ্রান কলম্বিয়া নামে সেই বিরাট দেশের বিভিন্ন প্রদেশে অস্থিরতা সৃষ্টি হতেও খুব বেশি সময় লাগেনি। অনেকগুলো গৃহযুদ্ধ পেরিয়ে ১৮৩০ সালে তাঁর শাসনামল যখন শেষ হলো, জেনারেল তখন অকালেই বুড়িয়ে গেছেন। প্রতিপক্ষের লোকেরা তাঁর নামে গ্রাফিতি আঁকছে, তাঁর ছবিতে ময়লা ছুড়ে ধিক্কার জানাচ্ছে, অনুসারী কিংবা সহযোদ্ধারা কেউই পাশে নেই। প্রাণ বাঁচাতে জেনারেল তখন হোসে পালাসিয়োস নামে বিশ্বস্ত পরিচারকের সাহায্যে পালিয়ে যান। উপন্যাসের শুরুতেই পালাসিয়োসের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে দেখতে পাওয়া যায় বোলিভারের আলিশান কামরার ভেতরটা, যেখানে পুরাতন এই ভৃত্য ছাড়া অন্য কারও প্রবেশাধিকার ছিল না। লাতিন আমেরিকার অনেকের মতে, মার্কেজ তাঁর এই গ্রন্থে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এই জেনারেলকে দুর্বল, ভঙ্গুর আর খুব সাধারণ জরাগ্রস্ত মানুষ হিসেবে দেখিয়েছেন। এতে প্রায় দেবতাতুল্য এই নেতার, যাকে লাতিন আমেরিকার বহু মানুষ ‘লিবারেটর’ হিসেবে মানে, ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। মার্কেজ অবশ্য সে কথা মানতে রাজি নন। দুই বছর রীতিমতো গবেষণা করে, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র, ডায়েরি ঘেঁটে তিনি এই উপন্যাস লিখেছেন। তিনি মনে করেন, প্রচলিত ইতিহাস বইগুলোতে নেতাদের সম্পর্কে এমন অনেক কথাই লেখা হয় না, যা ব্যক্তি হিসেবে তাদের চরিত্র বোঝার জন্য জরুরি। ১৯৮৯ সালে, ঠিক যে সময়ে সোভিয়েত রাশিয়ার পতন হচ্ছে, প্রকাশিত এই বই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আমেরিকার প্রভাব ও জোরপূর্বক অনুপ্রবেশ নিয়ে পুনরায় ভাবতে বাধ্য করে বলে মত দিয়েছেন কানাডিয়ান লেখক মার্গারেট অ্যাটউড। কিছু সমালোচকের মতে, পালিয়ে যেতে যেতে মৃত্যুবরণ করা এই জেনারেলের দেহটিই আসলে ল্যাবিরিন্থ কিংবা ভুলভুলাইয়া; যা থেকে মরণশীল মানুষের মুক্তি নেই।
  দি অটাম অব দ্য পেইট্রিয়ার্ক (এল ওতোনইয়ো দেল পাত্রিয়ারসা)
মার্কেজের পাঠকরা জানেন, তাঁর লেখার অন্যতম থিম হলো নিঃসঙ্গতা বা একাকীত্ব। ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসের শুরুতেই দেখা যায় একা মরে পড়ে থাকা একনায়কের শবদেহ ঠোকরাচ্ছে একপাল শকুন। একশ বছর ধরে রাজত্ব করতে থাকা এই শাসকের চরিত্রটি কাল্পনিক হলেও সত্যিকারের কয়েকজন স্বৈরশাসকের ছায়া দেখতে পাওয়া যায় তাঁর মধ্যে। বার্সেলোনায় বসে লেখা এই উপন্যাসে যেসব প্রভাবশালী নেতার ছবি আঁকতে চেয়েছেন মার্কেজ, ধরে নেওয়া হয় যে তাদের মধ্যে ফ্রান্সেস্কো ফ্রাংকোও একজন; যিনি তখনও স্পেনের ক্ষমতায় আসীন। বাদবাকিরা হলেন কলম্বিয়ার গুস্তাভো রোহাস পিনিলিয়া, ভেনেজুয়েলার হুয়ান ভিসেন্তে গোমেজ, এল সালভাদরের মাক্সিমিলানো হেরমান্দেজ মারতিনেজ, আর্জেন্টিনার হুয়ান পেরন, এমনকি রাশিয়ার জোসেফ স্টালিন। রচনাশৈলীর দিক থেকে অভিনব এই উপন্যাস। ছয়টি খণ্ডে বিভক্ত এই আখ্যানে ক্ষমতার পৌরাণিক আর ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকাশিত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ভবনের মেঝেতে মরে পড়ে থাকা জেনারেলের শব তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চয়তা দেয় না। আগেও একবার এমন মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল, পরে দেখা গেছে সেটি জেনারেল নন। ফিরে এসে তিনি তাঁর মৃত্যুতে বিজয়োল্লাস করতে থাকা জনতাকে মেরে ফেলেছিলেন আর শোকাভিভূত ভক্তকুলকে করেছিলেন পুরস্কৃত। জাদুবাস্তবতার আশ্রয়ে ক্যারিবিয়ান সমুদ্র উপকূলের সেটিংয়ে লেখা এই উপন্যাসে মার্কেজ দেখিয়েছেন একনায়করা কীভাবে ফিরে ফিরে আসে। আবার একই সঙ্গে পতনের আগে ও পরে তারা কতটা নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। এ উপন্যাসে পরম ও চরম ক্ষমতার নগ্ন নিষ্ঠুর দিকটির সঙ্গে করুণ দিকটিও উন্মোচিত হয়েছে স্পষ্টভাবে। 
উম্মে ফারহানা : কথাশিল্পী ও শিক্ষক, কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় 

আরও পড়ুন

×