ঢাকা শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪

মানিকের সরীসৃপ: মানব চরিত্রের গহীন অতল

মানিকের সরীসৃপ: মানব চরিত্রের গহীন অতল

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় [১৯ মে ১৯০৮–৩ ডিসেম্বর ১৯৫৬]

সমকাল ডেস্ক

প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০২৪ | ২২:৩৮

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নির্দয় কাহিনিকার বাংলা সাহিত্যে খুব একটা নেই বোধহয়। তিনি নির্দয়, কারণ– তিনি ভালোবাসতে জানতেন। সত্যিকার অর্থে ভালোবাসতে না পারলে সত্যিকার অর্থে নির্দয় হওয়া সম্ভব নয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অনেকটাই সাহিত্যিকের নিরুপায় রূপে বিশ্বাস করতেন। তাঁর দৃঢ় ধারণা ছিল– সত্যিকার শিল্পী তিনি, যিনি ঠেকায় পড়ে সৃষ্টি করেন। প্রেমেন্দ্র মিত্রও একই অর্থে লিখেছিলেন, ‘প্রাণের দায়ে লেখক।’ অর্থাৎ শিল্প রচনার দরকার না হলেই ভালো হতো, অথচ পারিপার্শ্বিক রাজনৈতিক, সামাজিক আর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এমনভাবে ঘোঁট পাকাচ্ছে যে না লিখে পারাও যাচ্ছে না, এমন একটি ঝুলন্ত অবস্থা। প্রসব বেদনা উঠলে পরে জন্ম দেওয়াই একমাত্র সমাধান। নিজেকেও মানিক স্রেফ ‘কলম পেষা মজুর’ বলেই মনে করতেন। যে সমাজ ব্যবস্থা তাঁকে লিখতে বাধ্য করেছে, সেই সমাজের প্রতি তাঁর ভেতর জন্ম নিয়েছে ক্রোধ। মানিকের লেখার পরতে পরতে তাই ক্ষোভের উত্তাপ।
সাহিত্যে নির্দয় হওয়া মানে কী? কোনো ধরনের অকারণ রোমান্টিকতা আরোপ না করে সম্পূর্ণ নির্মোহভাবে মানুষ, জীবন ও জগৎকে দেখা। সে অর্থে মহোত্তম সকল লেখকই ভয়ানক নির্দয় ছিলেন। বিশ্বসাহিত্য বাদ দিয়ে শুধু বাংলা সাহিত্যের দিকে যদি তাকাই– ‘পথের পাঁচালী’তে বিভূতিভূষণ দুর্গার করুণ মৃত্যু দেখিয়েছেন, ‘আরোগ্য নিকেতন’-এ মশাইয়ের নিদারুণ পরাজয় দেখি তারাশঙ্করের কলমে, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’-এ স্বাধীনতাপূর্ব ধাক্কা দেওয়া বাস্তবতা, ওয়ালীউল্লাহর ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’তে উদ্বাস্তুদের নিরাপত্তাহীন মনস্তত্ত্ব, আবু ইসহাকের ‘জোঁক’ গল্পে নিচুতলার মানুষের শোষিত হওয়ার বিবরণ। বাস্তব যদি নির্দয় হয়, লেখককে নির্দয় শব্দচয়নেই সেটা দেখাতে হয়। মানুষের চোখে স্বপ্নের সুরমা মেখে দেওয়া লেখকের সাজে না, সে দায়িত্ব বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলো নিয়ে রেখেছে।
মানিক কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৪৩ সালে। এই সময়ের আগে ও পরে লেখা তাঁর গল্পগুলোর মধ্যে কিছু মৌলিক ফারাক থাকলেও মূল বিষয়বস্তু প্রায় একই। ১৯৪৩-এর পর মানিকের গল্প-উপন্যাসের মধ্যে সরাসরি বস্তুভিত্তির দেখা পাওয়া গেল। তাঁর লেখায় পাঠক মধ্যবিত্ত রোমান্টিকতা থেকে ধপ করে নেমে এল সম্পূর্ণ বস্তুবাদী জগতে। এর আগের লেখাগুলো কি তাহলে কল্পনাবিলাসী ছিল? না। চট করে তো তিনি কমিউনিস্ট হননি। কমিউনিজমকে চর্চা করার আগের ধাপই হলো জীবন-জগৎকে নির্দয় চোখে দেখা অথবা বলা যায়, কল্পনার উষ্ণ কম্বল ঝেড়ে ফেলে সত্যের বরফঢাকা মেঝেতে নগ্নপায়ে হাঁটাচলা করা। এখানে সুনির্দিষ্ট একটি গল্প– মানিকের ‘সরীসৃপ’ নিয়ে কথা বলবো।  ‘সরীসৃপ’ও ১৯৪৩-এর আগেই লেখা। নির্মম এই গল্পে দুই নারী আর এক পুরুষের কাহিনি বিধৃত হয়েছে সম্পূর্ণ বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে। শেষ পর্যন্ত এটি নিছক ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনি নয়, বরং মানব চরিত্র উন্মোচক হয়েই পাঠকের মনে রয়ে যায়। গল্পটিতে লেখক মানুষ নামক প্রাণীটির ঠিক কোন দিকটাতে ইঙ্গিত করেছেন, তা শেষ বাক্যে মোটামুটি পরিষ্কার হচ্ছে: ‘ঠিক সেই সময় মাথার উপর দিয়া একটি এরোপ্লেন উড়িয়া যাইতেছিল। দেখিতে দেখিতে সেটা সুন্দরবনের উপর পৌঁছে গেল। মানুষের সঙ্গ ছাড়িয়া বনের পশুরা যেখানে আশ্রয় লইয়াছে।’ অর্থাৎ মানুষ এমন এক প্রাণী, বনের পশুরাও যার মুখ দেখতে চাইবে না।
এই গল্পে যৌনতা একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। তবে সেই বিশেষও আলাদা বিশেষত্ব পেয়েছে মানিকের কলমে। মানিক দেখিয়েছেন যে এমনকি যৌনতাও স্রেফ শরীরের তাড়না নয়, বরং হতে পারে কুৎসিতভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বনমালী যখন অতি সাধারণ ছিল, চারু তাকে পাত্তা দিত না, তবে তাকে নিয়ে খেলত। সে বুঝত যে বনমালী তার প্রতি মারাত্মক শারীরিক আকর্ষণ বোধ করে। এমনকি সে বনমালীকে পাশের ঘরে শুতে দিয়ে মাঝের দরজাটা খোলা রাখত, তবুও বনমালীর সাহস হতো না অগ্রসর হওয়ার। কিন্তু পরবর্তীতে যখন বনমালী পাটের ব্যবসার দালালি করে ধনী হয়েছে এবং বিধবা চারুর শ্বশুরের করে যাওয়া বাড়িটিও বন্ধক রেখেছে বা তার দাবি, কিনে নিয়েছে, তখন চারু বাড়িটি উদ্ধার করার জন্য বনমালীকে তার দেহ দিতেও প্রস্তুত থাকে। কিন্তু বনমালী ‘চারুর মাথার চুলের কালিমা ফ্যাকাশে হইয়া আসিয়াছে কেবল এইটুকু লক্ষ করিয়া আবার সে আহারে মন দিল।’ এই আপাত-সামান্য বর্ণনা পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দেয় যে বুড়িয়ে আসা চারুর প্রতি বনমালীর বিশেষ আকর্ষণ নেই। তার আকর্ষণ এখন প্রধানত চারুর ছোট বোন পরীর প্রতি। পরীও বিধবা এবং এক সন্তানের মা। বিধবা পরীকে দেখতে বনমালীর কাছে অল্পবয়সী চারুর মতো মনে হয়েছিল। তার আকর্ষণ কেবলই অল্পবয়সী শরীরে। সে কাউকে বিশেষভাবে ভালোবাসে না। লোভই তার প্রধান চালিকাশক্তি এবং এই কথা মানুষের ক্ষেত্রেও সত্য। মনেপ্রাণে যারা সে সময় সমাজতান্ত্রিক ছিলেন, তাদের একটি প্রধান দুঃখ ছিল— ক্ষমতাবানের বিজয় আর মনুষ্যত্ব থেকে মানুষের পতন। যখন বনমালী দুর্বল ছিল আর চারুর ছিল রূপের শক্তি, সে বনমালীকে নিয়ে খেলেছে। এখন সময়ের প্রাকৃতিক চাবুকে চারুর সেই দাপট গেছে, এদিকে বনমালী হয়ে গেছে টাকাপয়সায় শক্তিধর আর পুঁজিবাদী সমাজে টাকার শক্তিই প্রকৃত শক্তি। চারুর আসন্ন বার্ধক্যকে উপেক্ষা করে এখনও যুবতী পরীর দিকে নজর দেওয়া তার পক্ষে খুব একটা কঠিন নয়। কারণ সে জানে, বিধবা পরীও এখন দুর্বল। এই দুই বোনের নিজের বাড়ি নেই, স্বামীর বাড়ি নেই, স্বামী নেই, এমনকি টাকাও নেই। সুতরাং দুজনের মধ্য থেকে যাকে সুবিধা হয় তাকেই সে ভোগ করতে পারে। পরীর সাথে তার শারীরিক সম্পর্ক গল্পে মোটামুটি পরিষ্কার। স্বামী হারিয়ে শিশুসন্তানকে নিয়ে পরী মহাবিপদে পড়েছে। সেই সাথে তার শরীরের ক্ষুধাও আছে। বনমালীকে সন্তুষ্ট করে সে নিজে সন্তুষ্ট হতে চায় এবং তার সন্তানের ভবিষ্যৎও নিশ্চিত করতে চায়, সেই ভবিষ্যৎ রোমান্টিক কিছু নয় বা অল্প বয়সের সংসারের স্বপ্নে বিভোর মনের আশা নয়, একেবারে কাঁচা বাস্তব। এমনকি এক রাতে সন্তানকে সে ধমকেও ওঠে, ‘কেন তুই এসেছিলি, হারামজাদা!’ কারণ খোকা জেগে আছে বলে হয়তো বনমালী তার কাছে আসছে না আর তার ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত হচ্ছে।
এই ভবিষ্যৎ নিয়েই দুই বোনের মধ্যে এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা গল্পজুড়েই লক্ষণীয়। আপাতদৃষ্টিতে দুই বোনের মধ্যে মিলমিশ আছে ঠিকই, কিন্তু কাহিনির পরতে পরতে লেখক বুঝিয়ে দিয়েছেন যে ক্ষমতাবান বনমালীর পদলেহন করে আপন জীবন গড়ে নেওয়ার জন্য দুই বোনই ইঁদুর দৌড়ে শামিল। কমিউনিজমে বিশ্বাসী হিসেবে মানিক এই গল্পে বনমালীকে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার একটি প্রতীক হিসেবে হাজির করেছেন, যাকে সন্তুষ্ট করার মধ্যেই সাধারণ মানুষের উন্নতি নিহিত আর সেই উন্নতির জন্য জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় থেকে শুরু করে যৌবন সবকিছুই বিলিয়ে দেওয়া অলিখিতভাবে গ্রহণযোগ্য। দুই বোনের ইঁদুর দৌড় এমন জায়গায় পৌঁছুল যে চারু তার আপন ছোট বোনকে মেরে ফেলার সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র করে, যদিও শেষ পর্যন্ত নিজেই মারা পড়ে। মৃত বোনের ওপরও প্রতিশোধ নিতে ছাড়ে না পরী। চারুর বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ছেলেকে একা ট্রেনে তুলে দেয় সে। এমনভাবে তাকে দিকনির্দেশনা দেয় যাতে করে সে চলন্ত ট্রেন থেকে পড়ে মারা পড়ে। এই প্রতিশোধে বনমালীরও ছিল প্রচ্ছন্ন সায়, কারণ ভুবনের নিরুদ্দেশ হওয়া প্রসঙ্গে সে বলে, ‘আপদ গেছে, যাক।’ যে চারুর প্রতি একসময় বনমালী দুর্দমনীয় কামনা বোধ করেছিল, তার মৃত্যু তাকে স্বস্তি দিয়েছে এবং সেই স্বস্তি পূর্ণতা পেয়েছে ভুবনের মৃত্যুতে। কারণ, এই বাড়িটি পুরোপুরি হস্তগত করাতে আর বিশেষ বাধা নেই। পরী তো তার হাতের পুতুল, তাকে যেমন ইচ্ছে নাচানো চলে।
এই গল্পের সবচেয়ে করুণ চরিত্র চারু। আর্থার মিলারের আত্মা নাড়িয়ে দেওয়া নাটক ‘ডেথ অব আ সেলসম্যান’-এ দেখা যায় একসময়ের সফল বিক্রয়কর্মী উইলি লোম্যান বৃদ্ধ বয়সে এসে আক্ষেপ করে কেন সে আজীবন সততার সাথে দায়িত্ব পালন করেছে, কেন সে তার ভাই বেঞ্জামিনের সাথে আফ্রিকায় গিয়ে ব্যবসা করেনি, কেন সে পুঁজিপতিদের একজন হয়নি, কেন সে নৈতিক আবেগকে প্রশ্রয় দিয়েছে। ‘সরীসৃপ’ গল্পেও চারু প্রথম বয়সে বনমালীকে নিয়ে খেলেছে ঠিকই কিন্তু খেলতে গিয়ে নিঃসন্দেহে তাকে নিজের দৈহিক চাহিদাকেও নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে। অর্থাৎ দুর্বলকে নিয়ে খেলার সাথে সাথে নিজের সতীত্ব বজায় রাখাও তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল আর না বললেও বোঝা যায় স্বাভাবিক শারীরিক চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ সহজ নয়। চুলে পাক ধরার পর সে আক্ষেপ করছে কেন ছোট বোন পরীর বয়সে থাকা অবস্থায় সে বনমালীকে শরীর দিয়ে হাত করে রাখেনি। পুঁজিবাদী বাস্তবতা এমনকি পরপুরুষের কাছে দেহ বিলিয়ে না দেওয়াকেও আক্ষেপে পরিণত করতে পারে।
বিশ্বসাহিত্যে বেশ কিছু লেখক মানব চরিত্রের সারবস্তুকে খুঁড়ে বের করে আনার জন্য প্রসিদ্ধ। জোনাথন সুইফটের ‘গালিভারস ট্রাভেলস’, উইলিয়াম গোল্ডিংয়ের ‘লর্ড অব দ্য ফ্লাইজ’-এর মতো উপন্যাস আমাদের চপেটাঘাত করে বলে যায় যে আমরা নিজেদের যা ভাবি আসলে আমরা তা নই। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সরীসৃপ’সহ বেশ কিছু গল্প পড়লে মনে হয় যে বাংলা সাহিত্যে নির্মোহভাবে মানব চরিত্র ফুটিয়ে তোলার কৃতিত্বটা তাঁরই। v

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×