ঢাকা শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪

কাইয়ুম চৌধুরীর রঙ

কাইয়ুম চৌধুরীর রঙ

কাইয়ুম চৌধুরী [৯ মার্চ ১৯৩২–৩০ নভেম্বর ২০১৪]

মোহাম্মদ ইকবাল

প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০২৪ | ২২:৪০

কাইয়ুম চৌধুরী আমার শিক্ষক ছিলেন। আমার বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক ছিলেন না যদিও। আমি ছিলাম পেইন্টিং বিভাগের ছাত্র, তিনি ছিলেন গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের শিক্ষক। ছাত্র হিসেবে তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছি, পরবর্তী সময়ে শিক্ষক হওয়ার পরও। ছাত্র থাকাকালে স্বাভাবিকভাবেই ছাত্র-শিক্ষক সহজাত দূরত্ববোধের জায়গা থেকে কিছু জড়তা কাজ করত, যা শিক্ষক হওয়ার পরও পুরোপুরি কখনও কাটেনি। কিন্তু সেই বাধা ডিঙিয়ে, স্যারের গুণে, অনেকটাই কাছে যেতে পেরেছিলাম। এজন্য নিজেকে ধন্য মনে করি। একসঙ্গে দেশের বাইরেও গিয়েছি আমরা। কোরিয়ার স্মৃতি মনে পড়ে বিশেষ করে। কাইয়ুম চৌধুরীর অভিজ্ঞতার পরিধি বিস্তর।  ফেনীতে জন্ম, এরপর স্কুলজীবনে চট্টগ্রামে আসা, দেশের নানা স্থানে শিক্ষাজীবনের অতিবাহন; সেই সূত্রে প্রাণপ্রকৃতির সঙ্গে একটা নিবিড় যাপন, সর্বশেষে ঢাকায় শিল্পাচার্যের সান্নিধ্য, তাঁর সময়ের যত স্বাধিকার আন্দোলন সমস্ত কিছুর সঙ্গে যুক্ততা একঝাঁক শিল্পী সহযোদ্ধাসহ এবং এক দীর্ঘ সাংস্কৃতিক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া। এই সবকিছু তাঁকে অতুল সমৃদ্ধ করে তুলেছিল। তিনি আমাদের ভাষাসংগ্রামীদেরও একজন। তাঁর অগ্রজ সহযাত্রী ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান; তাঁর সময়ে সহযাত্রী ছিলেন দেবদাস চক্রবর্তী, মুর্তজা বশীর, মোহাম্মদ কিবরিয়া, ইমদাদ হোসেন, আমিনুল ইসলাম,  রফিকুন নবীসহ অনেকেই। শিল্পীদের মধ্যে কাইয়ুম স্যারেরই বোধহয় সবচেয়ে বেশি লেখক বন্ধু ছিলেন।

তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, শামসুর রাহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, হাসনাত আবদুল হাই প্রমুখ। তাদের সময়টা অনেকখানি ভিন্ন ছিল এখনকার চেয়ে। এখনকার শিল্পী-সাহিত্যিকদের তুলনায় তাদের সময়ে চিত্রশিল্পী, লেখক, সংগীতশিল্পী অর্থাৎ শিল্পের সমস্ত ভুবনের মানুষদের ভেতর অনেক বেশি পরিচয়, ঘনিষ্ঠতা, আড্ডা হতো এবং পরস্পরকে তারা সমৃদ্ধ করতেন।
কাইয়ুম চৌধুরী যে বিষয় নিয়েই কথা বলতে শুরুর করতেন, বিস্তৃত বলতে পারতেন। সংগীত ভালো বুঝতেন। সমঝদার ছিলেন। রবীন্দ্রসংগীত ব্যাখ্যা করতেন যখন, অবাক হয়ে শুনতাম। তিনি প্রচুর চলচ্চিত্র দেখতেন, দেখেছেন তারুণ্যে। তখন দেশে প্রচুর ইংরেজি চলচ্চিত্র আসত। পুরান ঢাকার বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হতো। যেসব চলচ্চিত্র তাঁকে মুগ্ধ করত, সেগুলোর কথা বলে যেতেন অনর্গল। আমরা শুনতেই থাকতাম।
তাঁর কাজের পরিধি কতটা ব্যাপক তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁর পেইন্টিং, ইলাস্ট্রেশন, প্রচ্ছদ সবই তো অনন্য। তাঁর নিজস্ব অক্ষরশৈলী তো সবার চেনা।  তিনি জানতেন কিনা জানি না, আমরা কিন্তু আমাদের তরুণ বয়সে তাঁকে দেখে ভীষণ অনুপ্রাণিত হতাম। তাঁর বহুবিচিত্র শিল্পীসত্তা, তাঁর দক্ষতা, কাজের  পরিধি সবকিছুই আমাদের ভীষণ অনুপ্রাণিত করত।  কাইয়ুম চৌধুরী একটা অনুসরণীয় নিজস্ব ধারা তৈরি করে গিয়েছেন। এই ধারার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিল আমাদের জল, মাটি, পাখি, মানুষসহ গ্রামীণ নানা অনুষঙ্গ তো বটেই; সেই সঙ্গে শহুরে অনুষঙ্গও। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে আমাদের নিজস্ব শৈলী তৈরি করতে হতো। তাঁর আঁকা আমার ওপরও ছাপ ফেলেছিল। আমার স্বতন্ত্র স্বর আবিষ্কারের আগে, প্রথম তারুণ্যে আমি তাঁর মতো কাজ করার চেষ্টা করতাম।বেঙ্গলের আয়োজনে, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শিল্পপতি আবুল খায়ের লিটু, বেঙ্গল গ্যালারির পরিচালক শিল্পী সুবীর চৌধুরী উদ্যোগে লেখক, চিন্তক, শিল্পীদের একটা আড্ডা হতো; নাম মঙ্গলসন্ধ্যা। প্রতি মঙ্গলবার হতো এ আড্ডা। সেখানেও আড্ডায় তাঁর জ্ঞানের সান্নিধ্যে আসতে পারি। সুরের প্রতি কাইয়ুম স্যারের আলাদা অনুরাগ ছিল। তা সেই সুর পশ্চিমাই হোক কি প্রাচ্যের। কাইয়ুম স্যারের চিত্রশৈলীর ভেতর আমি কিউবিজমের কিছু প্রভাব দেখতে পেয়েছি। একই প্রভাব কামরুল হাসানের ভেতরও ছিল। তাদের আঁকায় কিউবিজম এসেছিল দেশীয় ঢঙে। ছবি অন্তঃপ্রাণ মানুষ ছিলেন বলে স্বাভাবিকভাবেই আঁকা ছিল ধ্যানের মুহূর্ত। সেই ধ্যান ছবি শেষ করার আগে ভাঙত না। আমরা একটা আর্ট ক্যাম্পে গিয়েছিলাম কুষ্টিয়া, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ির ওখানে। ক্যাম্পে আমরা যখন কাজের মাঝে বিশ্রাম নিচ্ছি, তখনও তাঁকে দেখেছি অবিশ্রাম কাজ করে যেতে, শেষ করে তবেই থামতেন।                                                                           
তাঁর জীবনের শেষ দিনও তাঁকে দেখেছি। দুপুরের দিকে তিনি চলে গেলেন বেঙ্গল আয়োজিত উচ্চাঙ্গ সংগীতানুষ্ঠানে। তারপর তাঁর দেহ রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে এলে আমি, রফিকুন নবী স্যারসহ চলে গিয়েছিলাম। সেখানে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে আমাদের দেখা হলো। আগের দিনও আমি তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম একটা কাজে। একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের ক্যালেন্ডার তৈরির জন্য কাইয়ুম চৌধুরীর কিছু কাজ সংগ্রহ করতে চেয়েছিল। ওরা বলেছিল, আমি যেন স্যারকে রাজি করাই, ছবিগুলো সংগ্রহ করে দিই। স্যার শুনে রাজি হলেন এবং কাজে লেগে গেলেন। এই পর্যায়ে একটি কথা যোগ না করলেই নয়। সেটি হলো, কাইয়ুম চৌধুরী অত্যন্ত অঙ্গীকারপরায়ণ মানুষ ছিলেন। তিনি যখনই কথা দিয়েছেন, তখনই আঁকতে বসে গেছেন, শেষ করে উঠেছেন। তিনি যখনই ছবি আঁকতেন, আমি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখেছি, শেষ করে উঠেছেন। v

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×