ঢাকা শনিবার, ২৫ জানুয়ারি ২০২৫

আমার দেশে যৌথ স্মৃ‌তিভ্রংশতা আছে

আমার দেশে যৌথ স্মৃ‌তিভ্রংশতা আছে

এলিফ শাফাক [জন্ম: ২৫ অক্টোবর ১৯৭১]

এলিফ শাফাক

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২২:৫৯

“টেন মিনিটস থার্টি সেকেন্ডস ইন দিস স্ট্রেঞ্জ ওয়ার্ল্ড”-এর লেখক এলিফ শাফাককে আমেরিকান সাময়িকী স্পটলাইট পত্রিকায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তাঁকে প্রাণিত করা লেখকদের কথা ব্যক্ত করেছিলেন তিনি, যারা তাঁর দেখার চোখ খুলে দিয়েছিলেন। শাফাক তাঁর লেখার বিশেষ কিছু ‘খ্যাপাটে’ দিক নিয়েও কথা বলেছেন খোলাখুলি। ৫ জুলাই, ২০২৪ প্রকাশিত এ সাক্ষাৎকারের উল্লেখযোগ্য অংশ পত্রস্থ হলো।
অনুবাদ করেছেন মণিকা চক্রবর্তী
lশৈশবে কোন বইটি আপনার কল্পনাকে আলোড়িত করেছিল? কেন এবং কীভাবে তা আপনার মধ্যে আজও রয়ে গেছে?
ll ‘এ টেল অব টু সিটিজ’। শৈশবের এক গ্রীষ্মে আমার নানি আমাকে নিয়ে ইজমির গেলেন এবং আমাকে ওখানে আমার দাদির কাছে রেখে এলেন যেন আমি আমার বাবাকে অনেক বছর পরে প্রথমবারের মতো দেখতে পারি। সেই গ্রীষ্মটা ছিল বিষাদময়, অদ্ভুত আর নিঃসঙ্গতার। আমার খুব স্পষ্ট মনে পড়ে, ঠিক সেই সময়েই বইটি তুর্কি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল। চার্লস ডিকেন্সের লেখা এই বইটি আমি প্রথম পড়ি। প্রচুর রঙিন ছবিযুক্ত এই বইটি আমার মনকে যেন উড়িয়ে নিয়ে যায়। গ্রীষ্মকাল জুড়ে বইটি আমি বেশ কয়েকবার পড়েছিলাম। এভাবে বইটি পাঠের মধ্য দিয়ে ডিকেন্স আমার বন্ধু হয়ে গেল।
প্রশ্ন: সে বইটি সম্পর্কে বলুন, যা আপনাকে একজন লেখক হতে বলেছিল। কীভাবে তা আপনাকে আপনার লেখক জীবনের সৃষ্টিশীলতায় সাহায্য ও অনুপ্রাণিত করেছিল?
ll মিগেল দা সার্ভেন্তেসের ‘দন কিহোতে’ বইটি আমাকে নাড়া দিল, প্রাণিত করল এবং সার্বিকভাবে আমাকে বদলে দিল। আমি তখন কিশোরী, মাদ্রিদে থাকার সময়ে এটি প্রথমবারের মতো পড়ি। আমি যেসব গল্প পড়ে বড় হয়েছিলাম সেগুলো ছিল মধ্যপ্রাচ্য, বলকান অঞ্চল ও এশিয়া মাইনর অঞ্চলের এককেন্দ্রিক ধরনের গল্প। কিন্তু ‘দন কিহোতে’ উপন্যাসের গঠনে আমি প্রথমবারের মতো খুঁজে পেলাম প্রচণ্ড শক্তিশালী পটভূমি, উদ্ভাবনী কাঠামো, নানা স্তরের বিন্যাস ও আবেগ, হাস্যরস ও দুঃখবোধ। এই বইটি গল্প বলার ভেতর দিয়ে বুনন করে দেয় কল্পনা, জ্ঞান, অন্তর্দৃষ্টি ও সাহস। এটি আমি জীবনের নানা পর্যায়ে বহুবার পড়েছি, আর প্রতিবারই ভিন্ন অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়েছি। প্রথমত পাঠক হিসেবে এবং পরবর্তী সময়ে লেখক হিসেবে বইটি আমার মধ্যে পরিবর্তন এনেছিল।
lসব সময়ের জন্য, আপনার প্রিয় উপন্যাস কোনটি? কীভাবে সে আপনার ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে এবং সাম্প্রতিককালে আপনি তা আবার উল্টেপাল্টে দেখেছিলেন কিনা?
ll আমি একই সঙ্গে দুটি উপন্যাসের কথা বলতে চাই। একটি হলো ভার্জিনিয়া উলফের ‘অরলান্ডো’, যেটি আমার হৃদয়ে বিশেষ স্থান নিয়েছে। অরলান্ডো পড়ার আগ পর্যন্ত আমি জানতাম না, একজন লেখক কীভাবে এত ঝুঁকি নিতে পারেন, কীভাবে এমন একটি গল্প সাজানোর সাহস করতে পারেন এবং কল্পনা করতে পারেন; যা আমাদের প্রচলিত ভূগোল, সময়, সংস্কৃতি, পরিচয় ও স্মৃতি সব সীমান্ত অতিক্রম করে যায়। পুরো বইটি যেন পানির মতো ভাসছে– খুঁজছে কী যেন, আবার প্রবাহিত হচ্ছে। এই উপন্যাসটি আমি যুক্ত করি স্বাধীনতার চেতনার মধ্যে। অন্য উপন্যাসটি যা আমাকে তীব্রভাবে প্রভাবিত করেছে, তা হলো দস্তয়েভস্কির ‘দ্য ব্রাদারস কারমাজভ’। এই বইটিতে আবেগ ও দর্শন দুটিই রয়েছে। এটি হৃদয় ও বুদ্ধিকে একই সঙ্গে যুক্ত করে। বিভিন্ন জটিল বিষয় নিয়ে আসে; যেমন– বিশ্বাস, সন্দেহ, নৈতিকতা, ইতিহাস, পরিবার, স্বাধীন ইচ্ছা, একক সত্তা বনাম ব্যক্তির যৌথ পরিচয়। আমি পছন্দ করি তাঁর সাহিত্যের কাঠামো ও চরিত্রগুলো, যারা বহুমুখী ও অন্তর্গতভাবে সংযুক্ত। তা কখনও আপনাকে একটি সুতার মধ্যে আসার সুযোগ দেবে না।

lআপনার উপন্যাস “টেন মিনিটস থার্টি এইট সেকেন্ডস ইন দিস স্ট্রেঞ্জ ওয়ার্ল্ড” ২০১৯-এর বুকার প্রাইজের সংক্ষিপ্ত তালিকায় রয়েছে। ইস্তাম্বুলে একজন যৌনকর্মীর বাস্তব মৃত্যু আপনাকে প্রাণিত করেছিল বইটি লিখতে। গল্পটিতে আসলে কী ছিল, যার জন্য আপনি উপন্যাস লিখলেন এবং সমাজের এ রকম একক ব্যক্তি নিয়ে কেন আপনি লিখতে পছন্দ করেন?
ll লেখক হিসেবে আমি শুধু গল্প আর গল্প বলাতেই আগ্রহী নই, আমি নীরবতা ও  নিশ্চুপতাকেও তুলে ধরি। আমার মধ্যে একটি অংশ আছে, যা বুঝতে চায় আমাদের সমাজের নীরবতাগুলো কোথায়, কারা নিশ্চুপ রয়েছে। ইস্তাম্বুলে একটি সমাধি রয়েছে, যেখানে আমি যেতাম। সমাধিটির নাম ছিল সঙ্গীহীনদের সমাধি। গত কয়েক বছরে দ্রুত এটি বড় হয়েছে। এটি বিশাল। সমাজ যাদের মনে করে অন্য মানুষ, যাদের শেষকৃত্যের কাজটি সম্পূর্ণভাবে ঠিকঠাক হয়নি, যেমন– যৌনকর্মীদের, যেসব মানুষ এইচআইভি-তে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, যারা আত্মহত্যা করেছেন, অভিবাসী যারা জীবন হারিয়েছেন ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টায়– তাদের সবাইকেই এখানে পাশাপাশি সমাধিস্থ করা হয়েছে। সমাধিগুলোর গায়ে পরিচিতির বদলে দেওয়া আছে নম্বর। এটি এমন একটি জায়গা, যেখানে মানুষকে নম্বরে পরিণত করা হয়েছে। আর গল্পগুলো হচ্ছে নীরবতার। আমি আমার উপন্যাসে সেই গল্পগুলো আনতে চেয়েছি, একটু ওলটপালট করে দেখতে চেয়েছি। আমি একটি নম্বর তুলে তাকে একটি নাম, একটি গল্প, বন্ধুদের সঙ্গ দিতে চেয়েছি, বিমানবিকীকরণের প্রচেষ্টার বিপরীতে।
lআপনার এই টেন মিনিটস-এর বইটি বিভিন্ন সামাজিক বিষয় ছুঁয়ে গেছে, এর মধ্যে রয়েছে মানবাধিকার, লিঙ্গবিষয়ক, যৌনতা ও প্রান্তীয়করণ। এ ধরনের বিষয়ের প্রতি উপন্যাসের ভূমিকা কী হওয়া উচিত?
ll গল্প বলার কৌশলে গল্পের বাইরের বিষয়গুলো গল্পের ভেতরের কেন্দ্রে নিয়ে আসা আর অদৃশ্যকে আপাত দৃশ্যমান করে তোলে। যা শোনা হয় না, তাকে কিছুটা শ্রবণযোগ্যা করে তোলা। আমি এমন একটি দেশ থেকে এসেছি যেখানে একটি যৌথ স্মৃতিভ্রংশতা আছে। তুরস্ক, তার একটি বিশাল ঋদ্ধ ইতিহাস আছে কিন্তু তা তার স্মৃতির মধ্যে থাকে না। ঠিক উল্টাভাবে, যেভাবে বলা হয় এবং যেভাবে শেখানো হয়, তা অনেকটাই পুরুষদের গল্প, কখনও নারীর কথা নয়। এবং সেসব পুরুষের গল্পও নয়, যারা অত্যন্ত গরিব বা সংখ্যালঘু সংস্কৃতি বা অন্যান্যের। মূলত সেসব পুরুষের কথাই বলা হয়, যাদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব আছে। যে মুহূর্তে আপনি জিজ্ঞেস করবেন এই বয়ানটা কে দিচ্ছে এবং কাকে বলতে দেওয়া হয়নি, তখন সবকিছুই পাল্টে যায়। ঔপন্যাসিক হিসেবে আমি সেসব গল্প বলতে আগ্রহী, যেসব গল্প বলা হয়নি। নারীদের গল্প, সংখ্যালঘুদের গল্প, যে গল্পগুলো মুছে দেওয়া হয়েছে, যে গল্পগুলো ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব বের করে আনা খুব সহজ ব্যাপার নয়, এবং যখন আপনি বের করতে যাবেন, প্রচুর আঘাত পাবেন। কিন্তু উপন্যাস সাহিত্যের একটি সূক্ষ্ম মাধ্যম হিসেবে বহুত্ববাদ, জটিলতা, সহমর্মিতার জন্য নির্বাসনে থেকেও একটি বাড়ি, একটি অতি প্রয়োজনীয় অভয়ারণ্য।
lটেন মিনিটস ...-এ স্থানের একটি বিশাল ভূমিকা দেখতে পাই ... পেছনে রয়েছে ইস্তাম্বুলের দৃশ্যাবলি, শব্দ, সৌরভ; যা বারবার নানারূপে পাই। এই স্থানের বিষয়টি আপনার কাজের ক্ষেত্রে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যখন স্থানের ব্যাপারে আপনার একটি শক্তিশালী ধারণা রয়েছে?
llস্থান আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন অভিবাসী লেখিকা হিসেবে এক জায়গায় থাকা বা না থাকা, এই বিষয়টা নিয়ে আমি অনেক ভাবি। এটার অর্থ কী যে আপনাকে ছিন্নমূল করে আরেক জায়গায় বসিয়ে দেয়া হয়েছে ... আমাদের কি নানা রকমের বাড়ি থাকতে পারে, নানা রকমের দায়বদ্ধতা আছে পৃথিবীর কাছে; যা আমাদের ছোট্ট একটি বাক্সের মধ্যে নিয়ে আসতে চাচ্ছে। এই প্রশ্নগুলো আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। জীবন আমাকে শিখিয়েছে, শারীরিকভাবে মাতৃভূমি থেকে দূরে থাকার অর্থ কোনোভাবেই সেই আবেগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া নয়। আমরা যেখানেই যাই সঙ্গে মাতৃভূমিকে বহন করে নিয়ে যাই। এর মধ্যে একটি বিষাদগ্রস্ততা আছে, হারিয়ে ফেলার অনুভব আছে। আবার একই সঙ্গে যুক্তরাজ্য আমার বাড়ি হয়ে গেছে এবং ইংরেজি ভাষাটাও আমার মাতৃভাষা হয়ে গেছে। আমি উপন্যাস লিখি যে ভাষায়, সেটি আমার নিজের ভাষা নয়। কাজেই এটা খুব জটিল, স্থানের সঙ্গে আমার সম্পর্ক এবং মূলের গভীরে আমি যা ধারণ করি।

আরও পড়ুন

×