ঢাকা শনিবার, ২৫ জানুয়ারি ২০২৫

ধারাবাহিক

চীন দেশে কয়েকবার

চীন দেশে কয়েকবার

ফাইল ছবি

হাসনাত আবদুল হাই

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:০১

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কথাশিল্পী হাসনাত আবদুল হাই। তাঁর জন্ম ১৯৩৭ সলের ১৯ মে। বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন।
রচনা করেছেন অনন্য সব ভ্রমণলিপি। ১৯৭৯ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি পাঁচ বার চীনে গেছেন। প্রতিবারই তাঁর চোখে দেশটির স্বতন্ত্র ও চমকপ্রদ কিছু পরিবর্তন ধরা পড়েছে। সুচারু ভ্রমণগদ্যে উঠে এসেছে পরিবর্তনের কথা। আজ পত্রস্থ হলো এর প্রথম পর্ব।   

৮ আগস্ট, ১৯৭৯
হংকং/ক্যান্টন
ভোর ৭টায় উঠে নাশতার জন্য বেশ ঘুরতে হলো। রেস্তোরাঁ, দোকানপাট তখনও বন্ধ। রাতে দোকানপাট খোলা রাখার জন্য হংকংয়ের দোকানিরা সকালে বেশ দেরি করে ওঠে। দোকান খোলে ৯টার পর, অনেকে ১০টায়। আজ রোববার, হয়তো অন্যদিনের চেয়ে আজ দেরিতে খুলবে। হাঁটতে হাঁটতে ফরচুনা হোটেলে গিয়ে রেস্তোরাঁ খোলা পেয়ে তাড়াতাড়ি নাশতা শেষ করি আমরা। খেতে খেতে আলী হোসেন বলেন, এ যে দেখি আজব শহর। দিনে দুপুরে ডাকাতি করে দোকানি। সকালে নাশতা খাওয়ার জন্য নিজের হোটেল ছেড়ে অন্য জায়গা খুঁজে নিতে হয়। অথচ পাশেই অতি শৃঙ্খলার দেশ কম্যুনিস্ট চীন। এখন থেকেই যদি স্বভাব না বদলায় তাহলে মাও সে তুং-এর রেড গার্ডরা এলে বেশ নাকানিচুবানি খাবে।
তাচ্ছিল্যের সঙ্গে মোহাম্মদুল্লা বললেন, রেড গার্ড এখন আর কোথায়? মাও-এর মৃত্যুর পর এখন তারা পালাবার পথ খুঁজছে। পালের গোদা ছিল যারা, সেই গ্যাং অব ফোর এখন গ্রেপ্তার হয়ে বিচারের অপেক্ষায়।
মস্কোপন্থি আলী হোসেন কিছু বলেন না। চুপচাপ খেতে থাকেন। মনে হয়, তিনি এখনও এক লকের স্যুটকেস কিনে ঠকার শোকে মুহ্যমান।
নাশতা শেষ করে গ্যালাক্সি হোটেলে ফিরে হোটেলের পাওনা চুকিয়ে ব্যাগেজ নিয়ে আমরা কাউলুন স্টেশনের দিকে রওনা হই। ৮টা বাজতে ২০ মিনিট বাকি। আমাদের সেখানে ৮টার মধ্যে পৌঁছাতে বলা হয়েছে।
স্টেশনে পৌঁছে চাইনিজ ট্রাভেল এজেন্সির অফিসে সবাই যার যার স্যুটকেস জমা দিলাম। আলী হোসেন তাঁর এক লকবিশিষ্ট স্যুটকেসের নিরাপত্তার জন্য নাইলনের কর্ড দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছেন। ট্রাভেল এজেন্সির পুরুষ কর্মচারী প্রত্যেকের স্যুটকেসে নম্বর লেখা ট্যাগ লাগিয়ে একই নম্বর লেখা একটা অ্যাঢেসিভ স্টিকার প্রত্যেকের বুকে সেঁটে দিল। এর ফলে বেশ এক ধরনের আসামির মতো মনে হলো আমাদের। এমন না করে নম্বর লেখা রিসিপ্ট দিতে পারত পকেটে রাখার জন্য। দেখা যাচ্ছে এদের কায়দাকানুন বেশ অন্য রকম। বেশি লোকের দেশ হওয়ার জন্য তারা হয়তো নম্বর দিয়েই মানুষ শনাক্ত করতে চায়। যাওয়ার পর বোঝা যাবে দেশটা আর কোন কোন দিক দিয়ে আলাদা। মোটাদাগের পার্থক্যগুলো তো আগে থেকেই জানা আছে। এখন এইসব খুঁটিনাটি জানা যাবে। খুঁটিনাটি দিয়ে একটা জাতকে, সংস্কৃতির মানুষকে যেমন জানতে পারা যায়, মোটাদাগের পার্থক্যগুলি ঠিক তেমন পারে না, কেননা শেষেরগুলি অফিসিয়াল, ওপর থেকে চাপানো। নব্বই কোটি মানুষের দেশ কম্যুনিস্ট চীন, নম্বর ছাড়া সে দেশে সবকিছু অচল। গোঁফ নয়, বোধ করি নম্বর আছে বলেই তা দিয়ে যায় চেনা।
লক্ষ্য করি আলী হোসেন ঘন ঘন তাঁর বুকে লাগানো স্টিকার দেখছেন। মনে হয় নিশ্চিত হতে চান সেটা লেগে আছে, না স্থানচ্যুত হয়ে পড়ে গিয়েছে নিচে। সেই স্টিকার তাঁর স্যুটকেসের রক্ষাকবচ। কিন্তু চাইনিজ স্টিকার পাকা আম নয় যে টুক করে পড়ে যাবে। ঠিকই বসে আছে বুকের ওপর মৌরসি পাট্টা হয়ে, ম্যাডোনার কোলে যেমন থাকে শিশু। দারুণ নাছোড়বান্দা আঠা ব্যবহার করা হয়েছে নিশ্চয়ই।
কাউলুন স্টেশনে খুব একটা ভিড় নেই। বেশ ছিমছাম ভাব। সকালবেলা প্রথম ট্রেনে বেশির ভাগ প্যাসেঞ্জার বিদেশিই। তারা আসে সীমান্ত অতিক্রম করে চীন দেশে যাওয়ার জন্য। ওদিক থেকে সকালে যে ট্রেন আসে যেখানে চীনা যাত্রীই বেশি। হংকংয়ে কাজের জন্য আসে তারা, যার জন্য ডেইলি প্যাসেঞ্জার হয়ে আসা-যাওয়া করতে হয় তাদের।
একটু পর ইউনিফর্ম পরিহিত ট্রাভেল এজেন্সির কর্মচারী এসে আমাদের ট্রেনের নির্ধারিত কামরায় তুলে দেয়। আমাদের কামরা প্রথম শ্রেণির। ভেতরটা বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। গদি আঁটা আসন। কোনো সিট নম্বর নেই। যেখানে খুশি বসা যায়। ফ্রেঞ্চ উইন্ডোতে স্বচ্ছ পর্দা। আমরা বসতে না বসতেই তিনজন যুবক বয়সের শ্বেতাঙ্গ ঢুকল কামরায়। তাদের হাতে বিয়ারের খোলা ক্যান। তারা জোরে জোরে কথা বলতে থাকল নিজেদের মধ্যে, সেই সঙ্গে মাঝে মাঝে ক্যানে চুমুক। হাবেভাবে, আচরণে আর ভাষা শুনে বোঝা গেল তারা আমেরিকান। বেশ অপ্রকৃতিস্থ হয়ে আছে সবাই। আমাদের দিকে ভালো করে তাকায়নি কেউ, মনে হলো আমাদের উপস্থিতি তারা ধর্তব্যের মধ্যেই আনছে না। হঠাৎ তাদের একজন সিট থেকে উঠে এসে মোহাম্মদুল্লার চোখ থেকে রোদচশমা নিয়ে নিজে পরে বলল, নাইস কালার। রে বান। হাহ।
তার মুখে আকর্ণবিশিষ্ট হাসি। তাকে দেখে অন্য দু’জনও হেসে উঠল, যেন মজার খেলা শুরু হয়েছে।
ঘটনার আকস্মিকতায় মোহাম্মদুল্লাহ হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন, যা খুব স্বাভাবিক। তারপর রাগে তাঁর মুখ লাল হয়ে গেল। তিনি উঠে ছেলেটার চোখ থেকে চশমা নিয়ে চড়া গলায় ধমক দিলেন। ধমক খেয়ে ছেলেটা মারমুখী হয়ে এগিয়ে এলো।
[চলবে]

আরও পড়ুন

×