আগিলা যুগের আয়ু
প্রতীকী ছবি
মেহেদী উল্লাহ
প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:০২
এক শহরে দুই নাইকা। বড় আপায়ও নাইকা, ছোট আপাও নাইকা। মানে বড় বোনও নায়িকা, ছোট বোনও। শহরের অভিজাত এলাকায় একই ফ্ল্যাটে থাকত তারা। এখনও থাকে। তবে আর কয়দিন পর থাকবে কিনা এই বিষয়টায় সন্দেহ আছে। দু’জনেই নামকরা নাইকা। বড় আপার ছবির সংখ্যা চুয়ান্ন, ছোট আপার পঁয়ত্রিশ। বড় আপার ক্যারিয়ার ৯ বছরের, ছোট আপার এর চেয়ে একটু উন্নিশ, তিন বছরের কম। আসলে, এত ঘুরায়ে প্যাঁচায়ে বলে লাভ নাই। বড় আপার ক্যারিয়ার এক-দেড় বছর ধরে পড়তির দিকে। ছোট আপার জৌলুস দিনকে দিন আরও বাড়তি! কারণ শুনতে চান। যা ঘটে তা-ই। বড় আপা বেশ মুটিয়ে গেছে, গাল নিয়ন্ত্রণের বাইরে, থুতনির তলে চামড়া বেড়েছে। নায়কের সাথে মানায় না আর। অন্যদিকে ছোট আপা ইন্ডাস্ট্রিতে যেমন আসছিলেন তেমনই আছেন। দিন দিন স্লিম হচ্ছেন। হইচে যে, দুইজনেই ক্যারিয়ারসচেতন, স্বাস্থ্যসচেতন। ডায়েট-টায়েট যা লাগে করে। কিন্তু বড় আপার বেলায় কাজ করতেছে না। ছোট আপা বড় আপার দুই বছরের ছোট। কিন্তু এখন একসাথে দাঁড়ালে বড় আপারে কীরকম জানি লাগে। এক মায়ের পেটের বোন বোন লাগে না। বড় আপা ছবিই পাচ্ছে না। অনেকদিন বাদে একটা ছবি পেল। নাম লাশ পড়বে কবরস্থানে! ছোট আপার হাতে সময় নাই, খালি ছবি আর ছবি, কমচে কম আট-দশটা। এসব দেখে দেখে বড় আপার ঈর্ষা হয়। ছোট আপার সাথে এক বাসায় থাকতে মন চায় না। বড় আপার বদৌলতেই ছোট আপা ছবি করতে আসছিল। সে জন্য আরও পোড়ে তার। এগুলো দুই বোনের মনের মধ্যে নাই। তবুও মানুষে মনে করিয়ে দেয়। খোঁচায়! বড় আপা এই ছবিটা পাওয়ার আগে, অর্থাৎ লাশ পড়বে কবরস্থানেতে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার আগে রাতে খালি কবরের স্বপ্ন দেখতেন। কার জানি কবর! ভেতর থেকে লাশ ওঠে। দেখে মনে হয় ভোলার একটা কবর। তাদের পারিবারিক কবর। ভোলার লালমোহনের। ছোটবেলার অতিপরিচিত কবর। দাদা, দাদার বাবা এই কবরে আছে। সাথে দাদি। দাদাকে মারা যেতে দেখেছিল ছোটবেলায়। এখানে কবর দেওয়া হয়েছে, এটাও চোখের দেখা। এই কবরটাই বড় আপা স্বপ্নে দেখছেন। কবরে ঘাস আছে, কিন্তু বড় আপা স্বপ্নে কোনো ঘাস দেখেননি। দেখলেন, বিরাট এক চর, ঘাস-গাছ ছাড়া। বিরাট! চরের এক কোনায় একটা কবর। তাঁর স্বপ্নটাই কোনো একটা ছবির শুরুর দৃশ্য হতে পারত। কিন্তু এই দেশে তেমন করে ছবি কমই হয়। প্রথম দৃশ্যে কবর! মানে ছবির কবর রচনা করা! কেউ দেখবে না। প্রথম দৃশ্য দেখানোর বেশ কিছু কায়দা রপ্ত করেছে পরিচালকরা। মানে, যা হয় আর কি। ওই আর কি! হা হা। বলতে হবে না। বড় আপা স্বপ্নে দেখলেন, তার চার বছরের একটা বাচ্চাও আছে, ছেলে। এক লোক ছেলেটার হাত ধরে নাম জানতে চাইলেন। ছেলেটা তার হাত কামড়ে দিল। লোকটা এমন ভান করল যেন কিছুই হয় নাই। তারপর লোকটা ছেলেটাকে বলল, বাবু তোমার নাম কী? ছেলেটা পাত্তা না দেওয়ার ভঙ্গিতে জানাল নাম দিয়া কাম কী? লোকটা পরের প্রশ্ন ধরল, তোমার বাবার নাম কী? ছেলেটা বলল, বাবার নাম নাই! লোকটা বলল, তোমার দাদার নাম কী? ছেলেটা পাল্টা প্রশ্ন করল, তোমার দাদার নাম কী? লোকটা শেষ প্রশ্ন করল, তোমার দাদার বাবার নাম কী? ছেলেটা এবার ভেংচি কেটে বলল, তোমার দাদার বাবার নাম কী? বড় আপা পাশেই বসে ছিলেন। হাসতেছিলেন। লোকটাকে বললেন, এ ছোট, এ এত কিছু জানে না। এই যে এ পারবে! বড় আপার মেয়ে! বয়স সাত। লোকটা মেয়েটাকে শুরুতেই প্রশ্ন করল, বাবু তোমার দাদার বাবার নাম কী? মেয়েটা ছড়া কাটার মতো বলল, পারি না, পারি না, পারি না। লোকটা এবং বড় আপা একসাথে শরম পেল। বড় আপার ঘুম ভেঙে গেল। বড় আপার ঘুম ভাঙতেই এক পরিচালকের নয়া ছবির প্রস্তাব পেলেন। ছবির নামটাতেই একটা আতঙ্ক আতঙ্ক ভাব। হাতে এমনিতেই ছবি নাই। তাই বড় আপা রাজি হয়ে গেলেন। শুধু প্রাথমিক মান রাখার মতো করে বললেন, গল্পটা ভালো বলেই রাজি হলাম। পরিচালকও জানেন, আর গল্প, ছবিই পায় না! ইচ্ছা না থাকলেও বড় আপা ছোট আপাকে খবরটা দিলেন। ছোট আপা মেনিকিউরে ব্যস্ত। ওখান থেকেই উত্তর দিল। এবার তুই হিট! বড় আপাও বুঝে, এইটা বিরাট অঙ্কের সান্ত্বনা। যখন কেউ শূন্যের কোটায় পৌঁছে যায় তখন তাকে বাহবা দিলেও সান্ত্বনা, সান্ত্বনা লাগে।
বড় আপার ছবিটার শুটিং শুরু হবে আগামী মাসের পয়লা মঙ্গলবার! আপা তারিখ ধরে আগাচ্ছে এবার। ফিটফাট হতে হবে। যতটা পারা যায় ওজন কমাবেন। সুযোগটা এমনভাবে কাজে লাগাতে চান, যেন শুরু থেকেই শুরু করবেন। বড় আপা ছোট আপার হেল্প নিতে চাইলেন। একই বাসায় থাকেন, তবুও এটা-সেটা হেল্প নিচ্ছেন। উদ্দেশ্য দ্রুত ওজন কমানো। ছোট আপার হাতেও সময় থাকে না। তবুও ছোট আপার ঘুম ভাঙলেই বড় আপা পরামর্শ নিতে ছুটে যান। বিপদে থাকলে এমনই, অভিজ্ঞ ব্যক্তিও ছুটে যায় পরামর্শের জন্য, ছোট-বড় জ্ঞান থাকে না।
২.
পয়লা মঙ্গলবার আজ! বড় আপা সারারাত টেনশনে। এপাশ-ওপাশ। গল্পটার বেশ কয়েকটা দৃশ্য নিজেই চোখ বন্ধ করে সারারাত টেনে-টুনে দেখলেন। নিজেই হাসলেন, কাঁদলেন, উত্তেজিত হলেন, শিহরিত হলেন। মাঝের গ্যাপটাই তাঁর কৌতূহলের কারণ। অথচ ক্যারিয়ারের একটা সময় চলে গেছে দিনরাত আলাদা করতে পারেননি, এত ব্যস্ততা। আর এখন দিন এবং রাত দুটিই কাটতে চায় না। সকাল সকাল শুটিংয়ে বের হলেন আজ। আগিলা সেই যুগ নাই। আগের সময়ে হলে দুপুরে বের হতেন। অথচ শুটিং শুরু সকাল থেকেই। বড় আপার তাতে কিছু যায় আসে না। লোকেশনে যাবেন আস্তে ধীরে, এক কাপ কফি খাবেন, এরপর শুটিংয়ের গন্ধ পেতে চাইতেন। এখন সময় খারাপ। বড় আপা মাকে ফোন দিলেন, সাথে বাবাকেও। মা, বাবা ভোলায়, লালমোহনে থাকেন। কর্তারহাট গ্রাম। নাইকা হওয়ার পর বড় আপা, ছোট আপা কর্তারহাট আর যাননি। সময় মেলাতে পারেননি আসলে। ঢাকায় এসেছিলেন পড়াশোনা করতে। গ্রাম থেকে যারা শহরে আসেন অধিকাংশ যুবক-যুবতীর নানা লাইনে উত্থান শহরে পড়তে আসার কারণে। কারও কারও তো পড়াশোনাই ছেড়ে দিতে হয় সাকসেসের কারণে। বড় আপা, ছোট আপাও তাই। ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েই পালাক্রমে নাইকা হয়ে গেছিলেন! শুধু হলটাই বদলালেন তারা। ভার্সিটির হল থেকে সোজা সিনেমা হলে! আলাদা ফ্ল্যাট নিলেন। চারদিকে বড় আপা, ছোট আপা। বড় আপার গাড়ি আর আগাচ্ছে না। আজ ছোট হুজুরের ডাকে সমাবেশ। শহর ভরে গেছে হুজুরে-হুজুরে। সরকারকে চাপে রাখতেই এই সমাবেশ। ভেতরে ভেতরে বিরোধী দলের হাত থাকতে পারে। আমরা ক্যামনে নিশ্চিত করে বলব। এগুলা শোনা যাচ্ছে। বিরোধী দল মাঠে নামতে পারছে না নানা কারণে। ওই যা হয় আর কি। হা হা। এ কারণে নামতে সাহস পাচ্ছে না। লোকেরা বিশ্বাস করে, এই এই কারণে নামতে পারছে না। কী আর করা যাবে। ক্ষমতা যার, সব তার। এই সময়ে বড় অস্ত্র ছোট হুজুর। হুজুর সমাবেশ ঢেকে ওয়াজ করলেও সরকারের জন্য বিরাট প্রেশার। সবাই ধরেই নেবে সরকার একটু তো ভয় পেল! এটাই সান্ত্বনা। আগিলা যুগে এইগুলা ছিল না। মানুষ বুঝত কম। এখন মানুষ বুঝে কম, কিন্তু ভাবে বেশি। নিজে নিজে ঘরে বসে এটা-সেটা বানায়। আপা কিন্তু আগাতে পারছে না। হুজুররা সকাল সকাল ছুটছে চত্বরের দিকে। রাস্তায় গাড়ি চলার জায়গা নাই। জোহরের ওক্তের পরে সমাবেশ। এখনই গিয়ে চত্বর ভরে ফেলতে হবে। তাদের চেইন অব কমান্ড খুব বেহিসাবি। অর্থাৎ এসব সমাবেশে পয়সাপাতি লাগে না। বলে দিলেই হয়। মাদ্রাসা কে মাদ্রাসা সব খালি হয়ে যায়। কিছুদিন আগেও এরা ছিল সরকারের বশে। বড় হুজরের সাথে সরকারের একটা বোঝাপড়া হইছিল। বড় হজুর মারা গেলে ছোট হুজুর গদিতে বসলেন। এখন সরকার ছোট হুজুরকে পাত্তা দিচ্ছিল না। তাই পাত্তা আদায় করতেই হুজুরের এই কৌশল। এসবও মানুষের বানানো আসলে। সত্য কিনা জানি না। ছোট হুজুরও কিছু সুবিধা পেতে চায় বড় হুজুরের মতো। এসব মানুষ বানায়। আগাগোড়া হাছা না মিছা জানি না। বড় আপা ছোট আপা নিয়েও মানুষ যেমন কত কী বানায়, তেমনি বড় হুজুর আর ছোট হুজুরকে নিয়েও মানুষের বানানোর শেষ নাই। কিন্তু ভাই, বড় আপা আর আগাইতে পারতেছে না, ইয়া বড় বড় মিছিল, কী কইতাম, যতদূর দেখা যায় খালি সাদা আর সাদা। সাদা কালার সামনের দিকে এগিয়ে চলতেছে। চুনের স্রোত। বড় আপা ফোন দেয় পরিচালকরে। পরিচালক বেজার হয়। বলে, আপনে তো জানেন এমন হবে। ভোরে রওনা দিতেন! এখন বেলা বাজে বারোটা। বড় আপা বলে, আমি দুই ঘণ্টা ধরে এক জায়গায় বসা, জ্যাম। বড় আপারে ঝাড়ি দিল কিনা বোঝা গেল না। বড় আপার দোষটা কোথায়। আপা নতুন ছবির খুশিতে দেশ-দুনিয়া ভুলে গেছে। এত বড় সমাবেশ তার বাসার পাশে, খোঁজই রাখে না। তাইলে সে হিসাবে চলত। রাস্তায় নেমে তো আর সেই হিসাব মিলানো যায় না। তাও অনেকদূর আগায়ে গেছেন। ছোট আপার খোঁজ পাওয়া গেল। সকালে উঠে কফি খেতে খেতে টিভি দেখেন। তিনি ভয়েই বের হন নাই। জানতেন বিরাট জ্যাম হবে। চালাক আপা। বড় আপার কপালের দোষ দেন। কিছুটা আগিলা যুগেরও আছে ভিতরে ভিতরে। বিরাট ক্যারিয়ারে এ জন্যই এত ধাক্কা। ফিটনেস নিয়ে সচেতন থাকেন নাই। এখনও যা ফিট আছেন একটু চালাক হলে আরও বছর কয় চালিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু ওই যে, আগিলা যুগের একটু ভাব আছে তার মধ্যে। ছোট আপার মতো সচেতন না। ছোট আপা এক্কেবারে এই যুগের মানুষ। দিন-দুনিয়ার খবর, অন্য নাইকাদের হাঁড়ির খবর সব রাখেন। নাম্বার ওয়ান নায়কের সঙ্গে কার কী উপায়ে কোথায় কী সব সংবাদ তার ফোনে। এ জন্য আপাতত ঠেকতেছেন না। এই উপায়েই কি বড় আপাকে ডাউন দিয়ে দিলেন, নাকি বড় আপারই দোষ! এটা কথার কথা বলা যাচ্ছে না। হিসাব আছে মেলা। বড় আপা নিজেকেই দোষ দেন। ছবির ব্যস্ততায় ফিগারের দিকে মনোযোগ দেননি, বডি আর আগের মতো নাই, মুখ ভারী হয়ে গেছে, গলা ফুলে গেছে, চিবুকের নিজে ফোলা। সব মিলিয়ে নাচের দৃশ্যেও বডি যে তার আগের মতো নাই নিজেই টের পান। ক্লান্ত হচ্ছেন অল্পতে। সান্ত্বনা একটাই যে মিডিয়ায় তার আগের ফিগারই বেশি ছাপা হয়। ইদানীংকালে ছবিই তো করেননি, ফলে তাঁর দেখা কেউ পায় নাই। যাই হোক, বড় আপাও হাল ছাড়বেন না এত সহজেই, ফিগার ও মুখের আদল আগের জায়গায় নিয়েই আবার শুরু করবেন। আপা নিজেই শুরুর দিককার ছবি দেখেন, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বর্তমানের সঙ্গে মেলান। কখন যে বদলে গেলেন। আপা কি পারবেন আবার আগের অবস্থায় ফেরত যেতে? সে যাই হোক, আপাতত লোকেশনে যেতে পারলেই হয়। বিরাট জ্যাম এই অঞ্চলে, পেছনে ফেরারও সুযোগ নাই। ছোট হুজুরের কারণে বড় আপা বিপদে। হুজুররা যায় আর উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখে। আপারে আবছা দেখা যায় বাইরে থেকে। আপা ভয়েই আছেন, কখন আবার আগুন ধরিয়ে দেয় গাড়িতে, অথবা নামতে বলে নানা কথা বলে হেনস্তা করে। বুঝেনই তো! কী কথা থাকতে পারে তাদের। ওই যে, ওইসব কথা! যা বলে আর কি! হা হা। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেরকম কিছুই ঘটে নাই। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দামি গাড়িতে কে বসা এটা দেখা দোষের কিছু না। এটা একটা সাধারণ কৌতূহল। এই দেখা পথিমধ্যে কোনো এক যাত্রীকে দেখা, নারীকে দেখছে বললে হবে না! বড় আপা কি আজ শুটিংয়ে পৌঁছতে পারবেন? মনে হয় না দুপুরের আগে বের হতে পারবেন এই জটিলতা থেকে। পরিচালক ফোন দিয়েই যাচ্ছে। বড় আপা ধরছে না। একই তো উত্তর। ধরে লাভ কী?
৩.
শেষমেশ সেদিন শুটিংয়ে পৌঁছতে বড় আপার বিকাল হয়ে যায়। কিন্তু আপার মন ভালো ছিল না। যা বুঝলেন, এটা বড়জোর একটা বি গ্রেডের ছবি হবে। আয়োজন দেখেও অনেক কিছু বোঝা যায়। গল্পটা ভালোই। কিন্তু ভালো গল্পও খারাপ হয়ে যেতে পারে ঠিকঠাক এন্তেজামের অভাবে। বড় আপার চেষ্টার ত্রুটি থাকবে না। কিন্তু একার চেষ্টায় কী হয়? এরপর আরও ঘটনা আছে। সেন্সর বোর্ড, হল পাওয়া, ছবি মুক্তি পাওয়া কত ঘটনা। পরিচালক সব জেনেই নাইকা নিয়েছেন। তবুও কথাটা বলতে ছাড়লেন না, আপা কী ছিলেন আপনে, কী হলেন। একটু নজর দেন, অন্তত চেহারার দিকে নজর দেন! আগের অর্ধেকে অন্তত ফেরত আসেন। বড় আপা কষ্ট পেলেন না। শুনতে শুনতে অভ্যস্ত এইগুলা। মানুষের বয়স বাড়ে, বয়সের সাথে চেহারায় চেঞ্জ আসে। কারও বেশি করে ধরা পড়ে, কারও পড়ে না। ছোট আপা যেমন একই রকম আছে। কিশোরী বয়সে যা ছিল, এখনও তা। কোনো চেঞ্জ নাই। কার চেহারায় বয়সের ছাপ পড়বে না এটা বলা কঠিন। মেকআপে আর কত লুকানো যায়। বডিতেও তো আর মেকআপের উপায় নেই। ওজন বেড়ে গেলে লুকানো কঠিন। ফিগার নষ্ট হয়ে যায়। তবুও বড় আপা পরিচালকের কথায় হাসলেন। হাসা যদিও কঠিন। দেখা যাক, এই অবস্থা নিয়ে ছবিটা কতটা আগায়। আগিলা যুগে বাংলা ছবিতে একটু মোটা নাইকাই বেশি মানাতো। দর্শকের সেরকমই চাহিদা ছিল। এখন মানুষের রুচি চেঞ্জ হচ্ছে। স্লিম ফিগার ব্যাপারটা স্লোগান হয়ে গেছে। ছবি যাই হোক, নায়িকার স্লিম ব্যাপারটা লাগে। পরিচালক বলল, আপা, আমার পরিচিত খুব ভালো একজন ডায়েটেশিয়ান আছে। দুই মাস সময় নেবে!’ শুনে বড় আপা খুশি হয়। বলে, নিয়ে যাইয়েন সময় করে। পরিচালক বলে, ‘ফোন দিব নে আপনারে একদিন সন্ধ্যায়। রাত দশটা পর্যন্ত চেম্বারে বসে। মঙ্গল আর শনি বসে না।’
৪.
এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটে গেল। ছোট আপা ব্যস্ততার কারণে আসতে পারলেন না। বড় আপার হাতে কাজ নাই। তাই শুনেই চলে আসলেন। সোজা কর্তার হাট। বড় আপা যেই কবরটা স্বপ্নে দেখেছিলেন, যেই কবরটায় তাঁর পূর্বপুরুষের অনেকেই আছেন, সেই কবরটা কিছুদিনের মধ্যেই নদীতে ভাঙা পড়বে। ফলে কবর বদলাতে হবে। এই কবরটার বয়সও বেশি না। এখানে নদীর কবল থেকে কবর পাল্টানো নতুন কিছু না। প্রায়ই ঘটে এটা। বড় আপার দাদার বাবার কবর এখানে আনার আগে আরেক জায়গায় ছিল। সেটাও নদীতে তলিয়ে যাওয়ার হুমকিতে ছিল। তাঁকে এই কবরে আনার বছর খানেকের মাথায় কবরটা নদী হয়ে গেছে। এখন আবার নদী কাছে চলে এসেছে। বড় আপার দাদা একশ চল্লিশ বছর আয়ু পেয়েছিলেন। শোনা যায়, আগিলা যুগের আয়ু বেশি ছিল। শত বছর হায়াত পেত অনেকেই। পূর্বপুরুষের স্মৃতি রক্ষা করা বংশধরদের কর্তব্য। আর এটা তো কবর। যাদের বংশধর থাকে না, তাদের কথা ভিন্ন, তাদের কবর নদী নিয়ে যায়, লাশসহ। এত বছরে কি আর লাশ থাকে, থাকে হাড়, কংকাল, সেটাকেই নতুন জায়গায় এনে কবর দেওয়া হয়। গ্রামে আবারও একই কথা! পূর্বের ন্যায় এবারও শোনা গেল। মাওলানা আবদুর রহিম সাহেবের লাশ অক্ষত! যেভাবে করব দেওয়া হয়েছে সেইভাবেই আছে। আগেরবারও বছর পঁচিশ আগে কবর বদলানোর সময় যারা দেখেছিলেন তারাই বলতেছে, হুজুরের লাশ আগেরবার যে রকম ছিল, আজও ঠিক সে রকম। পচে নাই, কাফনের কাপড়টাও আগের মতোই রয়ে গেছে। মুখটাও আগের মতোই অক্ষত, জীবত থাকতে যেমন ছিল। মনে হয়, এই বুঝি চোখে সুরমা দিলেন! এখনও সুরমার দাগ মোছে নাই। কেউ শুনে সোবহানাল্লাহ না পড়লে সংবাদদাতা ঝাড়ি দিয়ে বলছে, ‘সোবহানাল্লাহ বলো না ক্যান মিয়া। এমন ঘটনা আগে দেখছো!’ প্রথমবার কবর দেওয়ার সময় যারা হুজুরকে দেখেছেন তারাই বলতেছে হুজুরকে এখনও চেহারা মোবারক দেখে চেনা যায়। আল্লাহর খাঁটি বান্দা না হলে হয়! বড় আপা লাশ উত্তোলনের সময় ছিলেন না। মাওলানা আবদুর রহিম তার দাদার বাবা। বড় আপাও সংবাদটা শুনলেন। তার দাদার বাবা অবিকল আগের মতোই আছেন। এত বছর পরেও কোনো পরিবর্তন নাই। মরার পরপরই লাশ পচে যায়, গন্ধ বের হয়, চেহারায় কংকাল ভেসে ওঠে। বড় আপা কী যেন ভাবতে থাকেন! কী ভাবেন তিনি? ভাবনায় তলিয়ে যান। নদী কবর তাড়া করে, নদী তার ক্যারিয়ার তাড়া করে! নদী অনেক কিছু উন্মোচিত করে। তিনি কি পারবেন আবার? অবশ্যই পারবেন। তার পূর্বপুরুষ পেরেছে, তিনিও পারবেন। তার পূর্বপুরুষ মৃত্যুর পরও যেটা করে দেখিয়েছে, আর তিনি জীবিত থাকতে পারবেন না! অবশ্যই পারবেন! v
- বিষয় :
- গল্প