ভাঙনের শব্দ শুনি
কচুরিপানার জীবন
প্রতীকী ছবি
ইমদাদুল হক মিলন
প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:০৩
মাটির রাস্তাটা শেষ হয়েছে নদীর মুখে গিয়ে। সকালবেলায় পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে সেদিকটায় গিয়েছিল সাত্তার হালদারের নাতি বিজু। রাস্তার দু’পাশে নদীভাঙা শ দেড়েক পরিবারের বাস। খাসজমিতে কেউ কেউ একচালা-দোচালা টিনের ঘর করেছে। কারও কারও বাঁশের বেড়ার ছাপরা ঘর। একেবারে হতদরিদ্ররা আছে ঝুপড়ি বানিয়ে।
সাত্তার হালদার থাকে ঝুপড়িতে। একমাত্র ছেলে নজু কামলা-মজুরের কাজ করে। হারিদিয়া, গাওদিয়া এইসব গ্রামের সচ্ছল গৃহস্থের খেতখোলায় তার কাজ। সেই কাজ সারাবছর থাকে না। বর্ষায় পদ্মায় মাছধরা জেলেদের সঙ্গে মজুর খাটতে যায় জেলেনৌকায়। শীতকালে রাজমিস্ত্রির সঙ্গে জোগালির কাজে যায় দূর দূর গ্রামে। একনাগাড়ে কয়েক দিন কাজ করে ফিরে আসে। এক-দু’দিন থেকে আবার যায়। বাঁধাধরা কোনো কাজ থাকলে সুবিধা হতো। তার পরও বুড়ো বাপ আর বউ-ছেলে নিয়ে খেয়েপরে মোটামুটি দিন গুজরান করছে। বউ-ছেলে নিয়ে থাকার জন্য দোচালা টিনের ঘর তুলেছে। বাপকে টিনের একচালা বানিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা অনেক দিনের। কুলিয়ে উঠতে পারেনি। ইচ্ছাটা আছে।
আজ তিন দিন হলো নজু গেছে জোগালির কাজে। গেছে ‘পয়সা’ গ্রামে। এখান থেকে গ্রামটা বেশ দূরে। নামের মতোই গ্রামটিতে শুধু পয়সার ঝনঝনানি। ঘরে ঘরে কোটিপতি। টিনের ঘর-দুয়ার বলতে গেলে নেই। দালানের পর দালান উঠছে। পাঁচতলা-ছয়তলা। ওদিককার রাস্তাঘাটেরও ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। প্রতিটি বাড়িতেই গাড়ি। রাজকীয় মসজিদ, স্কুল, মাদ্রাসা। এলাহি কাণ্ড। বেশ কিছুদিন ধরেই ওই গ্রামে কাজ করছে নজু। পয়সাঅলা লোকের বর্ষাবাদলা নেই। ইচ্ছা হলো তো শুরু করে দিল দালান তোলার কাজ। শীত-গ্রীষ্মের জন্য কে অপেক্ষা করে? পয়সা থেকে ফিরে এসে নজু সেই গ্রামের বাড়িঘরের বর্ণনা দেয় বাপের কাছে। সাত্তার হালদারের স্বভাবটাই পেয়েছে একমাত্র ছেলে নজু হালদার। গল্পবাজিতে পিতা-পুত্র সমানে সমান। নজুর ছেলে বিজুও সেই স্বভাব পায় কিনা, কে জানে! আট বছর বয়স হয়েছে। এখনও তার স্বভাব পুরোপুরি বোঝা যায় না।
সরকারি একটা প্রাইমারি স্কুল আছে দেড় কিলোমিটার দূরে। বিজু সেখানে ক্লাস টুতে পড়ে। তবে পড়াশোনায় তার মন নেই। স্কুল ফাঁকি দেওয়ার ওস্তাদ। এই বয়সেই মিথ্যাটা সত্যের মতো করে বলতে পারে। আজ সকালে একটু জ্বর-জ্বর লাগছে, কাল একটু পেট ব্যথা। তার পরদিন হয়তো স্কুলে গেল। তার পরদিন বলল আজ মাথাব্যথা করছে, স্কুলে যেতে পারব না। মটকা মেরে পড়ে রইল বিছানায়।
নজুর বউ বুলবুলি ছেলের মায়ায় অন্ধ। ছেলে যা বলে তা-ই মহাসত্য। বিজুর শরীর খারাপের কথা শুনলেই আহা-উহু করে পাগল হয়ে যায়। পারলে সংসার-কর্ম ফেলে, রান্নাবান্না ফেলে অত বড় ছেলে কোলে নিয়ে বসে থাকে। তার আদেখলাপনাতে ঝুপড়ির সামনে বসে থাকা সাত্তার হালদার খুবই বিরক্ত হয়। বলতে পারে না কিছুই। বললেই বউটা ছ্যাত করে উঠবে। এক বেলা হয়তো খেতেই দিল না। নজু ফিরলে যে বিচার দেবে, সে-ই উপায়ও নেই। বুলবুলি যেমন ছেলের মায়ায় পাগল, নজু তেমন পাগল বউয়ের মায়ায়। এই সংসারে শুধু মায়া-দয়ার বাইরে পড়ে আছে বুড়ো অথর্ব সাত্তার হালদার। তবে নাতিটার সঙ্গে হালদারের গোপন একটা বন্ধুত্ব আছে। বিজু তার দাদাকে ভালোই মহব্বত করে। সময় সময় দাদার পাশে বসে তাঁর মুখে গল্প শোনে। অতীত দিনের গল্প নাতিকে খুবই রসিয়ে রসিয়ে বলে সাত্তার হালদার। নাতি মুগ্ধ হয়ে শোনে।
আজ সকালে ঘুম ভাঙার পর অনেক ক্ষণ মটকা মেরে বিছানায় পড়ে রইল বিজু। সকালের নাশতা হিসেবে আতপ চাউলের জাউ রান্না করতে বসেছে বুলবুলি। রান্না ফেলে ছেলের কাছে ছুটে এলো। ‘‘কী রে বাজান, ইশকুলে যাবি না? শইল খারাপ লাগতাছে?’’
বিজু কাতর কণ্ঠে বলল, ‘‘আমি যে রাইতে ঘুমাইতে পারি নাই, তুমি তো সেইটা বোঝই নাই। এর লেইগা আমার মাথা বেদনা করতাছে।’’
“হায় হায়, কছ কী? তয় রাইতে আমারে ডাক দেছ নাই ক্যা? মাথাটা একটু টিপা দিতাম। ঠিক আছে অহন দিতাছি।’’
গভীর মায়া ও যত্নে ছেলের মাথা টিপতে লেগেছিল বুলবুলি। এই মাথা টেপাটেপিটা বিজু আবার পছন্দ করে না। দু-তিন মিনিটের মধ্যেই সে বিরক্ত হয়ে গেল। বলল, ‘‘তোমার টিপাতে মাথার বেদনা আরও বাড়ছে। তুমি যাও মা, আমি একটু শুইয়া থাকি।”
কীসের মাথাব্যথা, কীসের কী! খানিক পর স্বাভাবিকভাবেই উঠেছে বিজু। হাত-মুখ ধুয়ে জাউ খেয়েছে। তারপর তার মতো ইস্কুল ফাঁকি দেওয়া কয়েকটির সঙ্গে খেলতে চলে গেছে নদীর পাড়ে। এখন দৌড়ে এসে মাকে কোথাও খুঁজে পেল না বিজু। দিশেহারা ভঙ্গিতে ছুটে গেল সাত্তার হালদারের কাছে। বর্ষাকাল শেষ হওয়ার মুখে নদীতে প্রবল স্রোত। জলে টান লেগেছে। সমুদ্রের দিকে নেমে যাচ্ছে পদ্মার ঘোলা জল। শরৎকাল পড়ে গেছে। আকাশে ভাসছে কাশফুলের মতো নির্মল মেঘ। হেমন্তে শুরু হবে ধান কাটা। তারপর দেশ-গ্রাম কাঁপিয়ে আসবে শীত। কয়েক বছর ধরে শীতকাল আসার আগে নিজেকে নিয়ে চিন্তিত হয় সাত্তার হালদার। শীতকাল হচ্ছে বুড়ো মানুষের মৃত্যুর ঋতু। শীত আসার আগে হালদারের তা-ই মনে হয় ‘এই শীতটা টিকুম তো?’
এবারও এ রকম একটা চিন্তাতেই আছে হালদার।
আজ সকালে আকাশ ভরা রোদ। নদীভাঙা মানুষগুলোর এলোমেলো ঘর-দুয়ারের ফাঁকে ফাঁকে যেটুকু খোলা জায়গা, সেখানে টুকরো-টাকরা হয়ে পড়েছে শরতের রোদ। সাত্তার হালদার বসে আছে তার ঝুপড়ির সামনে। সেখানে একটা তেঁতুল গাছ। তার ডালে বসে একটা কাক ডাকছে।
বিজু বলল, ‘ও দাদা, হুনছো নি? গাঙ্গে তো আবার ভাঙন লাগছে।’
এত মানুষজনের মধ্যে থেকেও সাত্তার হালদার আসলে একা মানুষ। কার এত সময় আছে তাকে সঙ্গ দেওয়ার, তার সঙ্গে দুটো কথা বলার, গল্প করার। দিন-রাত মানুষটা শুধু তা-ই পেছনে ফেলে আসা জীবনের কথা ভাবে। অতীতের সোনালি দিনগুলোর কথা ভাবে। কত সুখের দিন ছিল। কত ধানপাটের জমি। কত বড় বাড়ি। চৌচালা টিনের ঘর। সংসার আলো করে আছে নজুর মা। বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে কারও নিজ গ্রামে, কারও পাশের গ্রামে। সচ্ছল গৃহস্থ ঘরে সুখে আছে তারা। ছোট দুই ভাই যে যার নিজের জমিতে ফসল ফলায়। এখন নজু যেমন কামলা-মজুরের কাজ করে, তেমন চার-পাঁচজন বাঁধা কামলা-মজুর বাড়িতে। গোয়ালে পাঁচ-সাতটা গরু। বিশাল পুকুরটির মাছ সারাবছর খেয়েও শেষ করা যায় না। তিনটা বিশাল বিশাল গোলাঘর বাড়িতে। বছরভর খেয়ে শেষ করা যায় না গোলার ধান। পকেট ভরা বাড়তি ধান বিক্রির পয়সা। কত সুখের দিন। নদীর ভাঙনে তছনছ হয়ে গেল সব। তা-ও একবার না, তিন-তিনবার ভাঙনের শিকার। নদীভাঙা মানুষের থাকে না কিছুই। সব যায়। জমিজিরাত, ঘর-দুয়ার সব ভাঙে। সংসার ভাঙে। সম্পর্ক ভাঙে। মানুষগুলো যেন পড়ে যায় নদীর তীব্র স্রোতের মধ্যে। স্রোতের টানে কে যে কোথায় ভেসে যায় খবর থাকে না।
সাত্তার হালদারের ভাইবোনরাও ভেসে গেছে। কে বেঁচে আছে, কে মরে গেছে, হালদার জানে না। স্রোতে পড়া মানুষ নিজেকে বাঁচাতেই ব্যস্ত। অন্যের খবর কে রাখে!
প্রথমবার ভাঙনের পর তিন ভাই-ই একটা একটা করে ঘর বাঁচাতে পেরেছিল। তিন ভাইয়ের জমানো টাকা একত্র করে পাশের গ্রামে গিয়ে একটু জমি কিনে ঘরগুলো তুলেছিল। কিন্তু খাবে কী করে? ছেলেমেয়ে মানুষ করবে কী করে? ভাইদের ঘরে তিনটা-চারটা করে ছেলেমেয়ে। সাত্তারের ঘরে শুধু নজু। তা-ও বিয়ের বারো বছর পরে ছেলের জন্ম। অনেকে ধরেই নিয়েছিল সাত্তারের বউ বাঁজা। সন্তানাদি হবে না। শেষ পর্যন্ত নজু এসেছিল সংসারে।
তিন ভাই একত্রিত হয়ে তারপর সংসার চালাবার পথ বের করেছিল। বড় একটা ঘর বিক্রি করে সেই টাকায় আড়তদারির ব্যবসা শুরু করেছিল বাজারে। সঙ্গে রাখিমালের কারবার। অর্থাৎ মাল মজুদ করে রেখে চড়া দামে বিক্রি। তার পরই শিকার হলো দ্বিতীয় ভাঙনের। এবারও ঘরগুলো বাঁচাতে পারল। কিন্তু সেই ঘর তুলে থাকবে কোথায়? জমি তো নেই! একজনের জমি ভাড়া নিয়েছিল। কী কপাল, সে-ই জায়গাও শিকার হলো ভাঙনের। এবারের ভাঙনটা এত দ্রুত ঘটল, ঘর-দুয়ার সরাবার সময়ই পেল না। পদ্মা রাঘববোয়ালের মতো হাঁ করে গিলল। হালদার পরিবার পথের ফকির। বউ-বাচ্চা নিয়ে একেক জন একেক দিকের পথ ধরল। তত দিন নজুর মা পরপারে, নজু তাগড়া জোয়ান। সাত্তার হালদার একেবারেই ভেঙেচুরে গেছে। নজুর বিয়ে ঠিক হয়েছিল এক পরিবারে। তারাও ভাঙনের শিকার। তার পরও বিয়েটা হলো। বুলবুলি এলো সংসারে। বছর দেড়েকের মাথায় বিজুর জন্ম। রাস্তার ধারের ঝুপড়ি ঘরের জীবন। কামলা-মজুর খেটে কোনো রকমে টিনের ঘরটা তুলতে পেরেছে নজু। বাপের থাকার ব্যবস্থা করেছে ঝুপড়িতে। সাত্তার হালদার তত দিনে প্রায় অথর্ব। লাঠি ভর দিয়ে হাঁটতেও কষ্ট।
এই অবস্থায় নাতি এসে খবর দিল, নদীতে আবার ভাঙন লেগেছে। শুনে হইচই হুড়োহুড়ি পড়ে গেল রাস্তার দু’পাশে থাকা পরিবারগুলোর মধ্যে। নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো সবাই ছুটে গেল নদীতীরে। নদীভাঙা মানুষগুলো আবার হাহাকার করতে লাগল। আবার অনিশ্চিত জীবন তাদের। আবার পড়ে গেছে নদীর তীব্র স্রোতে। এবারের টানে কোথায়, কোন দিকে যাবে তারা? কোথায় গিয়ে পাবে পায়ের তলার মাটি? মাথা গোঁজার ঠাঁই?
পাড়ার মহিলাদের সঙ্গে বুলবুলি ছুটে গেছে নদীতারে। তার সঙ্গে ছিল বিজু। ঘণ্টাখানেক পরে শুকনো মুখে ফিরে এলো দু’জনেই। বিজু অত কিছু বোঝে না। তার মুখে দুশ্চিন্তার তেমন ছায়া নেই। কিন্তু বুলবুলির মুখে প্রবল উৎকণ্ঠা। পাড়ার মহিলা-পুরুষ সবাই ছোট ছোট দল করে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছে। কথা একটাই, এখন কী হবে তাদের? এবার কোথায় যাবে?
বিজু এসে হালদারের পাশে বসেছে। বলুবুলিও এলো একসময়। শ্বশুরকে সে ‘আব্বা’ ডাকে। অসহায় কণ্ঠে বলল, ‘‘অহন উপায় হইব কী আব্বা? ঘর-দুয়ার লইয়া কই যামু?’’
হালদার ভাঙাচোরা গলায় কোনো রকমে বলল, “কিছুই বুঝতাছি না গো মা। আমি অচল মানুষ। মাথাও আগের লাহান কাম করে না। নজুরে খবর দেও। সে আইসা বুদ্ধি বাইর করুক।”
বুলবুলি বিরক্ত হয়ে বলল, “কেমতে খবর দিমু? কতবার কইলাম অল্প দামের দুইটা মোবাইল কিনো। একটা আমার কাছে থাকুক, আরেকটা তোমার কাছে। খালি কয়, এই মাসে কিনুম, ওই মাসে কিনুম। হেই মাস আর আইলই না।”
“নজুর লগে এইবার কাদির যায় নাই কামে?”
কাদিরের কথা শুনে বুলবুলি একটু আশ্বস্ত হলো। “ভালো কথা কইছেন। কাদির ভাই তার লগে গেছে। ভাবির মোবাইল আছে। কাদির ভাইয়েরও আছে।”
‘‘তয় এতক্ষণে কাদির খবর পাইয়া গেছে। কাদির খবর পাইলে নজুও পাইব। এত চিন্তা কইরো না বউ, এত ভাইঙ্গা পইড়ো না। আল্লায় যা করে, তা-ই হইব। নজু আহুক।’’
তবু বুলবুলির চেহারা থেকে উৎকণ্ঠা গেল না। দুপুরের রান্না না বসিয়ে সে চলে গেল অন্য বউ-ঝিদের সঙ্গে কথা বলতে।
বিজু বসে আছে হালদারের পাশে। দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘আমগ এই জায়গাটাও ভাইঙ্গা যাইব নদীতে?’’
হালদার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘‘হ গো দাদা। পদ্মা হইল রাক্ষস। যখন গিলতে শুরু করে, তখন সহজে আর থামে না। এই পাড়া আর রাস্তাঘাট গিল্লা খাইতে তার কোনো সময়ই লাগব না। চাইর-পাঁচ দিনের মইধ্যে এই জায়গা নদীতে যাইব।’’
‘‘তয় আমরা যামু কই? থাকুম কই?’’
‘‘আল্লায়ই জানে। দাদা রে, তুই কচুরিপানা চিনছ?’’
বিজু অবাক। ‘‘কচুরিপানা চিনুম না ক্যান? কচুরি ফুল কত সুন্দর হয়! খালে-বিলে থাকে, পুকঐর দিঘিতে থাকে, নদীতেও থাকে।’’
‘‘হ, ঠিকই কইছস। ওই সব জায়গাতেই কচুরিপানা থাকে। নদীর কচুরিপানা ভাইসা যায় কাটালের টানে। খাল-বিল পুকঐরেরটা ভাইসা যায় বর্ষার পানিতে। আমরা যারা নদীভাঙ্গা মানুষ, আমগ জীবনটা হইল ওই কচুরিপানার মতন। নদীর কাটালে ভাইসা এক জায়গা থিকা চইলা যাই আরেক জায়গায়। সেই খানে গিয়া থির হই। কিছুদিন কাটে সেই জায়গায়। তখন আসে বর্ষা, বিষ্টি। খাল-বিল আর পুকঐরে থির হইয়া থাকা কচুরিপানা আবার ভাসতে শুরু করে। আবার নতুন জায়গায় গিয়া থির হয়। এই হইল আমগ জীবন। তর বাজানে আসুক। আইসা বেবাকতে মিল্লা বুদ্ধি করুক। কোন জায়গায় গিয়া থির হইব ঠিক করুক। মন খারাপ করিছ না দাদা। নদীভাঙ্গা মানুষের জীবন এই রকমই।’’
বুলবুলি কখন এসে বসেছে টিনের ঘরটার সামনে। এখন সে একেবারেই ভাঙাচোরা মানুষ। চোখের জলে গাল ভাসছে। মায়ের কান্না দেখে বিজুরও কান্না পেল। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘‘মা-য় কানতাছে দাদা।’’
‘‘হ কানবই তো! সংসার গুছাইয়া বইছিল এক জায়গায়, সেই জায়গা ছাড়তে হইব। এইটা বড় দুঃখের কথা। বউমানুষ, তার চোখে পানি আসবই। আমার হাতটা ধর, দাদা। লাঠিটা দে। আমি একটু খাড়াই।’’
নাতির হাত ধরে, লাঠি ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল সাত্তার হালদার। ধীর পায়ে হেঁটে বুলবুলির সামনে এসে দাঁড়াল। তার মাথায় হাত দিয়ে বলল, ‘‘কাইন্দ না গো মা, কাইন্দ না। নদীভাঙ্গা মানুষের জীবন এমুনই। এক জায়গায় বেশি দিন থির হওয়া যায় না।’’
শ্বশুরের হাতটা দু’হাতে জড়িয়ে ধরল বুলবুলি। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘‘আমগ জীবনডা এই রকম হইল ক্যান আব্বা? আল্লার কাছে কোন পাপ করছি আমরা? কোন পাপের শাস্তি আল্লায় আমগ এইভাবে দেয়?’’
বুলবুলির প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারে না সাত্তার হালদার। তার চোখেও পানি আসে।
- বিষয় :
- গল্প