ঢাকা মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৫

ধারাবাহিক

চীন দেশে কয়েকবার

চীন দেশে কয়েকবার

প্রতীকী ছবি

পর্ব : ২

প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:০৯

মোহাম্মদুল্লাহও জ্যাকেট খুলে টাইয়ের নট ঢিলে করে শার্টের হাতা গুটিয়ে নিলেন। দেখে আমরা প্রমাদ গুনলাম। চীনদেশে যাওয়ার আগেই কি ঝামেলায় পড়া গেল। আমরা দুজন কী করব ভাবছি, এ সময় টিকিট চেক করতে এলো চাইনিজ অ্যাটেন্ডেন্ট। আমরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। একটা অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়ানো গেল।
মোহাম্মদুল্লাহ উত্তেজিত স্বরে ছেলে তিনজনকে দেখিয়ে বললেন, দে আর ড্রাঙ্ক। আমার চশমা কেড়ে নিয়েছে।
চাইনিজ টিকিট কালেক্টরকে বেশি বোঝাতে হলো না। সে তিন রত্নের দিকে তাকিয়েই বুঝল ব্যাপারটা কী এবং কেন হয়েছে। সে ভাঙা ইংরেজিতে যা বলল তার সারমর্ম হলো– আমাদের দুই গ্রুপের জন্য ভিন্ন কামরার ব্যবস্থা করা হবে। ততক্ষণ আমরা বিবাদ এড়াতে দু’পক্ষই রেস্টুরেন্ট কারে গিয়ে চা কফি পান করতে পারি।

মোহাম্মদুল্লাহ শঙ্কিত চোখে তাঁর স্যুটকেসের দিকে তাকিয়ে বললেন, আওয়ার লাগেজ।
টিকিট কালেক্টর বলল, উইল বি টেকেন কেয়ার অফ। নো ওরি।
আমরা বার্থ ছেড়ে রেস্টুরেন্ট কারের দিকে গেলাম। ততক্ষণে ট্রেন চলতে শুরু করেছে। যেতে যেতে দেখলাম সব বার্থে বেশির ভাগই আমেরিকান। তারাও জোরে জোরে কথা বলছে। শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে যারা চুপচাপ বসে আছে, তারা নির্ঘাত ব্রিটিশ। চাইনিজ যাদের দেখা গেল তাদের কেউ ট্যুরিস্ট না, পোশাক দেখেই বোঝা যায়। তারাও চুপচাপ বসে আছে। তাদের ব্যাগ দেখে মনে হলো হংকংয়ে নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র কিনতে এসেছিল; যা চীনদেশে পাওয়া যায় না। কিন্তু ব্যাগের আকার এমন স্ফীত না বা তাদের সংখ্যাও এত বেশি না যে  মনে করা যেতে পারে বিক্রির জন্য কেনাকাটা করেছে। এটাই যদি হয় সাধারণ অবস্থা তা হলে বলা যায় চীনদেশে এখনও রাশিয়ার মতো কালোবাজার প্রসার লাভ করেনি। দেখলাম চীনাদের কেউ গাড়ির দুটো টায়ার, কেউ টিনে খাবার, আবার কেউ ওষুধ নিয়ে যাচ্ছে। সবই পরিমিত পরিমাণে আর সংখ্যায়। দেখেই বোঝা যায় পারিবারিক প্রয়োজনে কেনা, ব্যবসার জন্য না।
ট্রেন চলার অনেকক্ষণ পর্যন্ত হংকংয়ের শহরতলি দেখা গেল। আমরা রেস্টুরেন্ট কারে বসে দু’পাশের বাড়িঘর, রাস্তায় যানবাহন আর মানুষের ভিড় দেখছি। যানবাহনের মধ্যে মাইক্রোবাস আর বাসই বেশি। গাড়িও আছে তবে হংকংয়ের মতো নতুন আর দামি না। এত অল্প জায়গায় এত মানুষ আর বাড়িঘর কোথাও দেখিনি। বহুতল বাড়ির প্রতিটির ব্যালকনি থেকে ঝুলছে শুকোতে দেওয়া কাপড়। আবালবৃদ্ধবনিতা কেউ চুপ করে বসে নেই। ভীষণ ব্যস্ত সবাই। বোঝা যায় হংকংয়ের শহরতলি মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত এলাকা।

ট্রেন চলার অনেকক্ষণ পর্যন্ত শহরতলি দেখা গেল। মনে হচ্ছে হংকং থেকে চীনের সীমান্ত পর্যন্ত শহরতলি দেখা যাবে। এক জায়গায় দেখলাম বুলডোজার দিয়ে পাহাড়ি জায়গা সমান করা হচ্ছে, রাস্তা তৈরি হচ্ছে পাশ দিয়ে। স্কাইস্ক্রেপার উঠছে অনেকগুলো। অনেকক্ষণ পর সমুদ্র দেখা গেল অদূরে। জেলেদের ‘জানক’ নৌকার ওপরে ত্রিকোনা পাল বাতাসে টানটান হয়ে আছে। দূর থেকেই দেখা গেল মাথায় নীল মাও টুপি, পরনে নীল আর ধূসর রঙের প্যান্ট-জামা পরে জেলেরা নৌকা থেকে মাছের ঝুড়ি নিয়ে তীরে জমিয়ে রাখছে। সমুদ্রের রং কালচে নীল, আকাশ ধূসর দেখাচ্ছে।
মাঝে মাঝে ছোট স্টেশনে ট্রেন থামছে। যারা নামছে সবই চাইনিজ। মান্ধাতার আমলে যেমন করত তারা, সেইভাবে কাঁধে ভারে করে হংকং থেকে কেনা জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে। এই দৃশ্যে গণপরিবহনের অভাব আর দারিদ্র্যের ছবি ফুটে উঠেছে। আমরা এখনও ব্রিটিশ-শাসিত হংকংয়ের এলাকা দিয়েই যাচ্ছি, যা সরকারিভাবে নিউ টেরিটরিজ নামে পরিচিত। কমিউনিস্ট চীনে এই ছবির পরিবর্তন হয়েছে কিনা, এখনও বলার সময় আসেনি। রাস্তার পাশে ছোট ছোট স্টল দেখা যাচ্ছে, সেখানে পুরুষ আর মেয়ে বিক্রেতা দাঁড়িয়ে রয়েছে। ক্রেতারা আসছে, যাচ্ছে। বিক্রির আইটেম শাকসবজিই বেশি, সকালে ক্রেতারা এসবই কিনতে আসে মনে হয়। অনেক ক্রেতার মাথায় মাও টুপি দেখা গেল। এই এলাকা এখনও কমিউনিস্টদের না হলেও অনেকের মধ্যে মাও প্রীতি এবং গণচীনের প্রতি আকর্ষণ বেশ স্পষ্ট। ব্যাপারটা আর কিছুই না, কবি যেমন বলেছেন ‘নদীর এপার বলে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস’, সেই রকম আর কি। ওপারে যে কী আছে, তা না জেনে অথবা গোলাপি চশমা চোখে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলাটাই স্বাভাবিক। একই কবি  অবশ্য অন্যত্র লিখেছেন, ‘যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না।’ বিচিত্র মানুষের স্বভাব।
হংকং মেইনল্যান্ড গণচীনের অন্তর্ভুক্ত যদি হয় তা হলে এখানকার মানুষের মানসিক প্রতিক্রিয়া কী হবে, সেটা বেশ বড় প্রশ্ন আর জল্পনা-কল্পনার বিষয়। তবে ধনী যারা তাদের অন্য দেশে, সিঙ্গাপুরে চলে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সিটিজেনশিপ পেলে ব্রিটেনেও চলে যাবে কেউ কেউ। গণচীনে শতাব্দীর বিদেশি নিয়ন্ত্রণ এবং সার্বিক  পশ্চাৎপদতার বিপরীতে কমিউনিস্টদের শাসনে  চীনা জাতির যে গর্বিত পদযাত্রা শুরু হয়েছে, তার জন্য গর্ব অনুভব করছে নিশ্চয় সকল শ্রেণির চাইনিজ। কিন্তু সেখানে যে কঠোর শৃঙ্খলা, পরিশ্রম আর কৃচ্ছসাধন তা মনঃপূত হবে না মধ্যবিত্ত আর ধনী শ্রেণির হংকং চাইনিজদের, এ কথা এখনই বলা যায়।
[ক্রমশ]

আরও পড়ুন

×