ঢাকা বুধবার, ২২ জানুয়ারি ২০২৫

পুরান ঢাকার সমরেশ বসু

পুরান ঢাকার সমরেশ বসু

সমরেশ বসু [জন্ম: ১১ ডিসেম্বর ১৯২৪–মৃত্যু: ১২ মার্চ ১৯৮৮]

ইমদাদুল হক মিলন

প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:১১

সমরেশ বসুকে বলা হতো ‘বাংলা সাহিত্যের রাজপুত্র’। এই রাজপুত্রের জন্ম বিক্রমপুরের ‘রাজানগর’ গ্রামে। ১১ ডিসেম্বর ১৯২৪। অতি ঘরোয়া একটি ডাকনাম ছিল ‘হরবরি’। বড় ভাই মন্মথনাথ সারাজীবন ওই নামেই ছোট ভাইটিকে ডেকেছেন। মা-বাবার পাঁচ সন্তানের সবার ছোট ছেলেটি আট বছর বয়সে মারা যায়। শেষ পর্যন্ত চার সন্তানের মধ্যে সমরেশ ছিলেন সবার ছোট। একমাত্র দিদিটির নাম ‘অমিয়া’। ডাকনাম ‘টোকানি’। ঢাকা-বিক্রমপুরের শব্দ। অর্থ হচ্ছে ‘কুড়ানি’। মা-বাবা সমরেশের নাম রেখেছিলেন ‘সুরথনাথ বসু’। লেখালেখি শুরুর পর বন্ধু দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায় তাঁর নাম দিলেন ‘সমরেশ বসু’। দেবশঙ্করের দুই বোনকে বিয়ে করেছিলেন সমরেশ। তাঁর বড়দি ছিলেন সমরেশের চার বছরের বড়। বিবাহিতা। কিন্তু স্বামীর সংসার করতেন না। নাম গৌরী মুখোপাধ্যায়। গৌরীর সঙ্গে প্রেম হলো সমরেশের। তখন তাঁর বয়স সতেরো। গৌরীর একুশ। গৌরীকে নিয়ে পালিয়ে গেলেন সমরেশ। আতপুরের বস্তিতে গিয়ে উঠলেন। দুটো টাকা হাতে নেই। প্রবল অর্থকষ্ট। গৌরীর সামান্য গহনা ছিল। সেইসব বিক্রি করে সংসার চালাতেন। আঠারো বছর তিন মাস বয়সে প্রথম সন্তানের জনক। জীবনধারণের জন্য তখন হাঁস-মুরগির খামারে কাজ নিয়েছিলেন। সাহেব-মেমদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ডিম আর সবজি পৌঁছে দিতেন। তারপর পাটকলের শ্রমিক-জীবন। একসময় কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বার হলেন। আবার সেই পার্টি ছেড়েও দিলেন। চমৎকার গান গাইতেন, খুব সুন্দর বাঁশি বাজাতেন, ছবি আঁকতেন। স্কুল পাঠ্যবই পড়তেনই না। কিশোর বয়সেই রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছ’ পড়ে ফেলেছেন। লেখালেখির ঝোঁক আছে। সেই বস্তি জীবনেই বন্ধুদের সঙ্গে মিলে হাতে লেখা পত্রিকা বের করতেন। এই পত্রিকার জন্য একটা গল্প লিখলেন। স্ত্রী গৌরী দেবী ও বন্ধুরা সেই গল্প পড়ে বললেন, “লেখা খুব ভালো হয়েছে। এই গল্প ‘পরিচয়’ পত্রিকায় পাঠিয়ে দাও।” তা-ই করা হলো। ‘পরিচয়’ পত্রিকার সঙ্গে তখন যুক্ত আছেন গোপাল হালদার ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। পরের সংখ্যায়ই গল্পটি ছাপা হয়ে গেল। সেই গল্পের নাম ‘আদাব’। সমরেশ বসুর প্রথম গল্প। চারদিকে সাড়া পড়ে গেল।

‘আদাব’ গল্পের পটভূমি পুরান ঢাকা। ১৯৪৬ সালের দাঙ্গা হচ্ছে গল্পের বিষয়। শাঁখারী বাজারের ওই দিককার গলির ভেতর ডাস্টবিনের আড়ালে রাতের অন্ধকারে আশ্রয় নিয়েছে একজন মুসলমান নৌকার মাঝি ও একজন হিন্দু সুতাকলের শ্রমিক। চারদিকে দাঙ্গার হইহল্লা। মিলিটারিদের গাড়ি যাচ্ছে সাইরেন বাজিয়ে। কোথাও কোথাও দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন। পুরান ঢাকার ওই এলাকার ভিক্টোরিয়া পার্ক, পাটুয়াটুলী, ইসলামপুর, বাদামতলীর ঘাট এই জায়গাগুলোর উল্লেখ আছে গল্পটিতে। ঈদের আগের রাতের ঘটনা। মুসলমান মাঝিটি তার স্ত্রী ও সন্তানের জন্য নতুন কাপড় কিনেছে। যেমন করেই হোক বুড়িগঙ্গার ওপারে গ্রামের বাড়িতে তাকে পৌঁছাতে হবে। শেষ পর্যন্ত দু’জন দু’দিককার পথ ধরে। মুসলমান মাঝিটি দাঙ্গায় নিহত হয়। স্ত্রী-সন্তানের কাছে তার আর ফেরা হয় না। তারপর আরেকটি গল্প লিখে ‘পরিচয়’ পত্রিকায় পাঠান সমরেশ। এই গল্পটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছাপলেন না। চিঠি লিখে জানালেন, ‘এই গল্পটি আপনার আগের গল্পের সুনাম রক্ষা করতে পারবে না। অন্য আরেকটি গল্প পাঠান।’ তেভাগা আন্দোলন নিয়ে ‘প্রতিরোধ’ গল্পটি লিখলেন সমরেশ। এই গল্পে সাড়া পড়ল আরও বেশি। ‘পরিচয়’-এর জন্য জীবনের প্রথম উপন্যাসটি লিখতে শুরু করলেন। উপন্যাসের নাম ‘নয়নপুরের মাটি’। কয়েকটি কিস্তি ছাপা হওয়ার পর হঠাৎই লেখা বন্ধ করে দিলেন। পরে অবশ্য এই উপন্যাসটি তিনি শেষ করেন। গ্রন্থাকারেও প্রকাশিত হয়। তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাসের নাম ‘উত্তরঙ্গ’। বই হিসেবে ‘উত্তরঙ্গ’ই প্রথম। এভাবে শুরু হয়েছিল সমরেশ বসুর সাহিত্যযাত্রা। গৌরী দেবী অসামান্য কণ্ঠশিল্পী ছিলেন। সমরেশ ততদিনে সর্বক্ষণের লেখক। গৌরী দেবী গানের স্কুল করেছেন। আতপুর থেকে বাড়ি কিনে চলে এসেছেন নৈহাটিতে। শুধু লেখালেখির জন্য কলকাতায় দামি ফ্ল্যাট কিনলেন সমরেশ। রাজকীয় জীবন। সারাদিন লেখালেখি করে সন্ধ্যাবেলা সুন্দর পোশাক পরে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে যেতেন। চেহারা নায়কোচিত। পানাহারের আড্ডা মাতিয়ে রাখতেন গান গেয়ে।

তত দিনে একের পর এক প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর অসামান্য সব গল্প-উপন্যাস। ‘বি টি রোডের ধারে’, ‘শ্রীমতি ক্যাফে’, ‘জগদ্দল’, ‘গঙ্গা’ আর ‘বাঘিনী’র মতো উপন্যাস। অন্যদিকে ‘কালকূট’ ছদ্মনামে লিখতে শুরু করলেন একেবারে অন্যধারার উপন্যাস। ‘কালকূট’-এর যাত্রা শুরু হলো ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’ দিয়ে। তারপর ‘কালকূট’ নামে কত উপন্যাস। ‘কোথায় পাবো তারে’ পড়ে পাঠক মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি একাডেমি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন ‘কালকূট’ ছদ্মনামে লেখা ‘শাম্ব’ উপন্যাসের জন্য ১৯৮০ সালে। সমরেশ বসু সেই বিরল লেখকদের একজন, যিনি উপন্যাসের বিষয় অনুযায়ী ভাষা তৈরি করতেন। আর তাঁর মতো এত বিচিত্র বিষয় নিয়ে বাংলা সাহিত্যের কোনো লেখক লেখেননি। অবিরাম নিজেকে বদলেছেন, ভেঙেছেন। জীবনের বিভিন্ন পর্বে তাঁর লেখার গতিপথ বদলেছে। একদিকে ‘সমরেশ বসু’ নামে লিখে গেছেন নগর কলকাতার আধুনিক জীবন নিয়ে।

অন্যদিকে আতপুর জগদ্দল এলাকার শ্রমিক-জীবন দারুণভাবে উঠে এসেছে তাঁর লেখায়। আরেকদিকে গ্রাম-জীবন ও দেশ বিভাগ তাঁর লেখা সমৃদ্ধ করেছে। কী অসামান্য সব গল্প লিখেছেন। ‘আদাব’, ‘প্রতিরোধ’, ‘অকাল বসন্ত’, ‘পাড়ি’, ‘শানা বাউরীর কথকতা’, ‘পাপ-পুণ্য’, ‘মানুষ রতন’– এ রকম কত স্মরণীয় গল্প। এক সমরেশ নিজেকে দু’ভাগে ভাগ করে নিয়েছিলেন। একদিকে ‘সমরেশ বসু’, আরেকদিকে ‘কালকূট’।
সমরেশ বসুর লেখালেখি চারটি পর্বে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্বে ‘উত্তরঙ্গ’, ‘বি টি রোডের ধারে’, ‘শ্রীমতি ক্যাফে’, ‘জগদ্দল’, ‘বাঘিনী’, ‘গঙ্গা’, ‘যুগ যুগ জিয়ে’। দ্বিতীয় পর্বে ‘বিবর’, ‘প্রজাপতি’, ‘পাতক’। তৃতীয় পর্বের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস ‘টানা-পোড়েন’। বিষ্ণুপুরের তাঁতশিল্পীদের নিয়ে লেখা এই উপন্যাসটি পড়ে মনীষী আবু সয়ীদ আইয়ুব এক চিঠিতে সমরেশকে লিখেছিলেন, “মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’র পর এত নিখুঁত বাংলা উপন্যাস আর লেখা হয়নি।” সমরেশের এই পর্বের আরেকটি মহৎ উপন্যাস, নকশালবাড়ি আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা ‘মহাকালের রথের ঘোড়া’। নকশালবাড়ি আন্দোলন নিয়ে অনেকেই উপন্যাস লিখেছেন কিন্তু সমরেশের ‘মহাকালের রথের ঘোড়া’র কোনো তুলনা হয় না। এই পর্বে তাঁর আরও তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস ‘শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে’, ‘বাথান’ ও ‘খণ্ডিতা’। রাজনৈতিক উপন্যাসের ক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যে সমরেশের কোনো জুড়ি নেই। ‘শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে’ আর ‘তিন পুরুষ’ তার প্রমাণ। চতুর্থ পর্বে এসে সমরেশ লিখেছিলেন তাঁর সেই অসমাপ্ত কীর্তি ‘দেখি নাই ফিরে’। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘নয়নপুরের মাটি’ শিল্পী-জীবন নিয়ে লেখা। এ ছাড়া দ্বিতীয় পর্বের ‘টানা-পোড়েন’ শিল্পী-জীবন নিয়ে লেখা। জীবনের সর্বশেষ লেখাটিও লিখলেন শিল্পী রামাকিঙ্কর বেইজকে নিয়ে। নিজে এক মহান জীবনশিল্পী ছিলেন বলেই শিল্পী-জীবন বারবার তাঁকে আকর্ষণ করেছে।
সমরেশ বসুর ছেলেবেলা কেটেছে পুরান ঢাকায়। সূত্রাপুর এলাকার একরামপুরে ছিল তাদের বাড়ি। বাবা রূপলাল এস্টেটে কাজ করতেন। বড় ভাই চলে গিয়েছিলেন নৈহাটিতে। লক্ষ্মীবাজারের একটা টোলে পড়েছেন সমরেশ। তারপর পুরান ঢাকার গ্র্যাজুয়েট হাই স্কুলে পড়াশোনা। সেই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ছিলেন তাঁর ভগ্নিপতি। স্কুলে বলতে গেলে সমরেশ যেতেনই না। পালিয়ে পালিয়ে চলে যেতেন সদরঘাটে। বুড়িগঙ্গার তীরে গিয়ে বসে থাকতেন। কখনও চলে যেতেন শ্যামপুরের শ্মশানঘাটে। বাবা-মা বাধ্য হয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন নৈহাটিতে, বড় ভাই মন্মথের কাছে। সেখানেও স্কুলে ভর্তি করানো হলো তাঁকে কিন্তু স্কুল সমরেশ পছন্দই করেন না। টিচাররা অভিযোগ করেন। বড় ভাই আবার তাঁকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিলেন। আবার সেই গ্র্যাজুয়েট হাইস্কুল। সব মিলিয়ে ক্লাস এইট পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। তারপর আর হয়নি। v

 

আরও পড়ুন

×